Wednesday, November 20, 2024
Homeফিচারফ্যাসিবাদের বিপদ ও গণতান্ত্রিক শক্তির করণীয়

ফ্যাসিবাদের বিপদ ও গণতান্ত্রিক শক্তির করণীয়

228847_192465477484494_7010605_nএকটি গণতান্ত্রিক দেশ ও সমাজের আকাঙ্ক্ষা এদেশের মানুষের বহুদিনের। ওই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এদেশের মানুষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছে, পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছে। এই আকাঙ্ক্ষা বুকে ধারণ করেই মানুষ দেশ স্বাধীন করেছে। এমনকি স্বাধীন দেশের মাটিতেও গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য প্রাণ দিয়েছে। সে দেশে আজ কি শাসন চলছে? একটি একতরফা ভোটার ও প্রার্থীবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার মসনদে বসে আছে। দেশের এই পরিস্থিতিতে যে কোনো গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষ বুঝতে পারছেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রের শক্তিভিত্তিসমূহ অর্থাৎ প্রশাসন, বিচারবিভাগ, পুলিশ-মিলিটারি সর্বপ্রকারে সহযোগিতা করছে। ফলে এরকম একটা শাসনব্যবস্থা যেখানে অন্যদের কোনো মতামতের ধার ধারছে না, গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি, আইন-কানুনের তোয়াক্কা করছে না — সম্পূর্ণ একদলীয় জবরদস্তির শাসন পরিচালিত হচ্ছে।

প্রতিবাদহীন দুঃসহ দিন
দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে আমরা দেখেছি, শাসকদের ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বুদ্ধিজীবীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের দেশেও অতীতে বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদী ভূমিকা নানা মাত্রায় আমরা দেখেছি। কিন্তু এবার একদলীয় এই জবরদস্তির শাসনের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্ষীণ কিছু প্রতিবাদী কথা ছাড়া কোনোরকম নাড়াচাড়া করছেন না। আবার দেশের যে মিডিয়াগুলো এই জবরদস্তি শাসনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজ করছে — বাস্তবে প্রায় সকল মিডিয়াই করছে — এই বুদ্ধিজীবীরা সেখানে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ধরে রাখছেন। এসব ছাপিয়ে কোথাও কোনো একটু প্রতিবাদী কণ্ঠ শোনা গেলেও এই জবরদস্তিমূলক রাষ্ট্রে তাকে স্তব্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা আছে। সংবাদ মাধ্যমগুলোকে নানারকম নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। নতুন নতুন আইন জারি করা হচ্ছে। আইনি হস্তক্ষেপের বাইরেও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বহু রকম চাপ তৈরি করা হচ্ছে।

এই শাসনব্যবস্থার পেছনের উদ্দেশ্য কি? আমরা বহু বার বলেছি, এর পেছনের উদ্দেশ্য হল পুঁজিপতি-শিল্পপতি-ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একচেটিয়া শোষণ-লুণ্ঠনের পথ সুগম করা, নিরাপদ করা। পুঁজির এই নির্বিঘ্ন শোষণ-জুলুমের শিকার হয় কারা? অবধারিতভাবেই দেশের বৃহত্তর জনগণ — শ্রমিক-কৃষক, নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশা বাড়তে থাকে, জীবন-জীবিকার সংকট বাড়তে থাকে। সংকট বাড়তে থাকে মধ্য ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনেও। বর্তমানেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বাড়িভাড়া-গাড়িভাড়া-বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এবং সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, বেকারত্ব ইত্যাদি সংকট বাড়ছে কিন্তু রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে সেগুলো সামনে আসছে না। এ সময় রাজনৈতিক অস্থিরতায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় কৃষকের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। অর্থনৈতিক এই লুণ্ঠন এবং বৈষম্যের পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া হিসাবে সামাজিক অস্থিরতা, সন্ত্রাস-সহিংসতার প্রকোপও বাড়ছে। এ সবই রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চাপা পড়ে যাচ্ছে। বিবেকবান গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ এবং ভুক্তভোগী মানুষের কাছে প্রতিটি দিন ক্রমাগত দুঃসহ হয়ে উঠছে।

যে পরিস্থিতিটা দেশে চলছে তাতে ভিন্ন মত, ভিন্ন বক্তব্য, ভিন্ন রাজনীতি ধারণ করার যে সামাজিক পরিবেশ তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কোথাও কোনও ক্ষীণ প্রতিবাদী কণ্ঠ থাকলে তাকে গুম, খুন, ধরে নিয়ে যাওয়া — ইত্যাদি কায়দায় দমন করা হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে সমাজের কোথাও যদি কিছু একটা আলোড়ন মনন জগতে তৈরী হয়, তা প্রতিবাদের জন্য বাইরে আসছে না। পুরো দেশটাকে অসংখ্য কাপুরুষের দেশ বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

বিভ্রান্ত ও অসংগঠিত জনগণই সবচেয়ে অসহায়
শোষণ-নিপীড়ন-বৈষম্য ও জুলুমে জর্জরিত হলেও জনগণ যখন অসংগঠিত তখন সে থাকে অসহায়। জনগণের আরো একটি অসহায়ত্ব হল বিভ্রান্তি — শত্রু কে মিত্র কে বুঝতে না পারা। আর দুটোই যখন একসঙ্গে ঘটে — অসংগঠিত ও বিভ্রান্ত — তখনই সম্ভবত জনগণ সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় নিপতিত হয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বর্তমানে ঠিক এমনই। ফ্যাসিস্ট শাসনের মুখে এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই যার পাশে গিয়ে মানুষ দাঁড়াতে পারে। এদেশের বামপন্থী সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলো — যারা সমাজতন্ত্রী বলে পরিচিত, তারা সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে সরকারের শক্তিচক্রের আশেপাশে অবস্থান করছে। একদল বামপন্থী নামধারী আছেন যারা সরকারের সমালোচনা করার ছল করতে করতেই সরকারকে সব রকম সহযোগিতা করে চলেছেন। বামপন্থী অল্প কিছু ছোট শক্তি এই পরিস্থিতিকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে ক্রমাগত বিকশিত হওয়ার চেষ্টা করছে।
জনগণের এই বিভ্রান্ত ও অসংগঠিত দশাকে কাজে লাগিয়ে, অবৈধ শাসনের বৈধতা দেয়ার জন্য ইলেকশনের রাজনীতির ঘণ্টা বাজানো হয়েছে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ নির্বাচনকেই গণতন্ত্র বলে মনে করে। তারাও খোলা চোখে দেখছে, এই নির্বাচনটি হবে ক্ষমতায় যারা বসে আছে তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। নির্বাচনের জয়-পরাজয়সহ পুরো পরিস্থিতির ওপর শাসকদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ (complete domination)  কাজ করছে। সাধারণ গণতান্ত্রিক দাবি তোলা দূরে থাক, সত্যিকারের বিরোধী শক্তি অর্থাৎ যারা বর্তমানের সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রবল শক্তিতে বিরোধীতা করতে চায়, তাদের মত এই ইলেকশনের মধ্যে দিয়ে প্রচার করার উপায় নেই। ফলে যে ইলেকশন হতে যাচ্ছে, তার উদ্দেশ্য হলো কত দলকে সরকার তার কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে আসতে পারে সেটা দেখানো।

আন্দোলনের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হোন – আন্দোলনের শক্তি গড়ে তুলুন
এ অবস্থায় বাংলাদেশে বিরোধী দল বলে যারা পরিচিতি ছিল তারা কার্যকর কোনো আন্দোলনের পথে না গিয়ে একেক সময় একেক কথা ছেড়ে দিচ্ছে। যেহেতু মিডিয়া শক্তিতে তাদেরও একটা ভূমিকা আছে, ফলে তারা যা বলছে মিডিয়া তাই প্রচার করছে, জনগণকে সেটাই জানানো হচ্ছে, জনগণও সেটাই জানছে। কিন্তু তাদের বৈধভাবে প্রতিবাদের যত পথ ছিল সেসব পথ তারা অনুসরণ করেনি। গণআন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে কিছুই তারা করছে না। ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছে। আর জনগণের ওপর পেট্রোলবোমা-ক্রসফায়ারের বিপদ নামিয়ে নিজেরা ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। এরকম একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা দেশে চলছে।

অনেক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ইতিহাস যে দেশের আছে, সে ধারায় সংগঠিতভাবে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় জনগণের সামনে নেই বলে নিজের মধ্যে তারা গুমরে মরছে। গুমোট তৈরি হচ্ছে সমস্ত দেশে। শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষ সবাই এই অবস্থার মধ্যে আছে। কিন্তু তারা এই অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। মুক্তিকামী এই মানুষদের সামনে আমরা একটা প্রশ্ন রাখতে চাই, একটা আবেদনও রাখতে চাই। জনগণের গণতান্ত্রিক দাবি নিয়ে যারা জানবাজি আন্দোলন করবে না, তারা কেমন করে জনগণের বন্ধু হয়? জনগণকে বিপদে ফেলে যারা লেজগুটিয়ে পালায় তারা কেমন করে জনগণের বন্ধু হয়? তারা কেমন করে ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের দাবি বাস্তবায়ন করবে? আমাদের এই প্রশ্নটি গভীরভাবে ভাবতে অনুরোধ করব।

সেই সাথে আমরা দেশবাসীর সামনে আবেদনও রাখছি – আন্দোলনের শক্তি খুঁজে নিন, আন্দোলনকারী শক্তিগুলোর পাশে দাঁড়ান। বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনে জনগণের সক্রিয় ভূমিকা অবশ্যই দরকার। সময়সাপেক্ষ হলেও ধীরে ধীরে সারাদেশে গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য দরকার। এই গণতান্ত্রিক শক্তি বলতে কি বুঝব সেটাও বোঝা দরকার। যারা সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু কিছু কথা ইন-বিটুইন বলতে পারেন – তাদেরকেও অনেকে গণতান্ত্রিক শক্তি বলেন। তারা কেউই গণতান্ত্রিক শক্তি না।

আমরা ছোট দল। এই মুহূর্তে আমরা মহা কিছু করতে পারবো না। কিন্তু আমাদের সাথে আরও যে বন্ধুরা আছে, তাদের নিয়ে ধীরে ধীরে আমরা ন্যূনতম কিছু কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হতে চাই। যা হচ্ছে কোনো মতেই তা মেনে নেয়া যাবে না। এটা আমরা মতের অর্থে প্রকাশ করছি, আবার মানুষের কাছে গিয়ে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে তাদের সংগঠিত করছি। আমাদের দল এই সময়ের ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় এটাই করণীয় বলে মনে করে।

আন্দোলনহীন পরিবেশ ভয়ঙ্কর বিপদ নিয়ে আসবে
সরকার ব্যবসায়ী-ধনকুবের গোষ্ঠীদের সহায়তায় জনগণের ওপর জবরদস্তি চালিয়ে টিকে থাকতে পারছে। আবার তাদেরকে আন্তর্জাতিকভাবে অনেকে সহায়তা করছে। এদের মধ্যে ভারত এ সরকারের পাশে সব রকম সহযেগিতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ অন্যায় শাসনকে সমর্থন করছে। ভারতের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণকারী জনগণ তাদের দেশের শাসকদের এ অন্যায় চলতে দেবে তা হতেই পারে না। তাদেরও অনেক সংগ্রামের ইতিহাস আছে।

কিন্তু ভারতের এই ভূমিকার ফলে অগণতান্ত্রিক, প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সঙ্গী-সাথীরা সারা দেশের মানুষের মধ্যে গুনগুন করে একটা প্রবল সাম্প্রদায়িক সুর তুলে দিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্ট করছে। একদিকে আওয়ামী লীগের গায়ের জোরের শক্তি, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর প্রতিবাদ-শূন্যতা ও আন্দোলনহীনতার সুযোগ নিয়ে সরকারের অত্যাচারের যে প্রতিক্রিয়া তাকে ধারণ করে অগণতান্ত্রিক, প্রতিক্রিয়াশীল ও মৌলবাদী শক্তি এক মহাবিপদের দিকে দেশকে নিয়ে যাচ্ছে।

আমরা সমস্ত গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষকে সতর্ক করছি, দেশের বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বপ্রথম সরকারের এই প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বলছি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র যে কাপুরুষোচিত ভূমিকা তা উন্মোচিত করে জনগণকে সাথে নিয়ে গণআন্দোলনের ধারা গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। দুই প্রধান বুর্জোয়া দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির ছত্রছায়ায় ও প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা ধর্মান্ধ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালনের বিরুদ্ধে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments