১৯৪১ সালের ৩ জুলাই মহান স্ট্যালিনের ঐতিহাসিক ভাষণ
[১৯৪১ সালের ২২ জুন হিটলারের ফ্যাসিস্ট জার্মান সেনাবাহিনীর ১৭০টি ডিভিশন (প্রায় ৩০ লক্ষ সেনা) সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। ১৯৩৯ সালে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত অনাক্রমণ চুক্তি জার্মানি হেলায় দু’পা মাড়িয়ে যায়। অতর্কিত ভয়াবহ আক্রমণে জার্মান বাহিনী দ্রুত ঢুকে আসতে থাকে। ইতোমধ্যে ফ্রান্স, পোল্যান্ড, চোকোস্লোভাকিয়া জার্মান ফ্যাসিস্টদের সম্পূর্ণ পদানত, ব্রিটেন পর্যুদস্ত। দেশের এই গভীর বিপদকে কীভাবে সোভিয়েত লালফৌজ প্রতিরোধ করবে, সোভিয়েত জনগণের ভূমিকা কী হবে, শেষপর্যন্ত দুর্ধর্ষ জার্মান বাহিনীকে প্রতিরোধ করা কি সম্ভব হবে? Ñ এইসব প্রশ্ন যখন সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বিশ্বের জনগণকে আলোড়িত করছে, সে’সময় আক্রান্ত হওয়ার ১০ দিনের মাথায় ১৯৪১ সালের ৩ জুলাই মহান নেতা কমরেড জে ভি স্ট্যালিন সোভিয়েত রাষ্ট্র ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হিসাবে এক বেতার ভাষণে দেশবাসীকে প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। তাঁর এই ভাষণ ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ, যার মর্মবস্তু, ভাষা ও উপস্থাপনা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। কীভাবে এই ভাষণ গোটা সোভিয়েত জনগণকে আত্মত্যাগের প্রেরণায় উদ্বুব্ধ করেছিল, তা নিয়ে বহু কাহিনী ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছে। মানবসভ্যতাকে রক্ষার এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে সোভিয়েত জনগণের আত্মত্যাগ এক বিশ্বজনীন আবেদন নিয়ে সাহিত্যেরও বিষয় হয়েছে। ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলো একটির পর একটি যখন হিটলার বাহিনীর কাছে পদানত হয়েছে, তখন মহান স্ট্যালিন তাঁর প্রথম ভাষণেই বলেছিলেন, সোভিয়েত জনগণের দ্বারা জার্মান বাহিনী পরাজিত হবে। বহু অমূল্য প্রাণের বিনিময়ে সোভিয়েত জনগণ নেতার এই আস্থা ও বিশ্বাসকে সত্য প্রমাণ করেছিল। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের বিজয়ের ৭০ বছর উপলক্ষে স্ট্যালিনের এই ভাষণটি প্রকাশ করা হল। এটি নেয়া হয়েছে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক গণদাবী-র ১৫ মে ’১৫ সংখ্যা থেকে।]
আমার দেশবাসী ভাইবোনেরা, নাগরিক ও কমরেডগণ, আমাদের সেনা ও নৌবাহিনীর যোদ্ধারা, আজ আমি আপনাদের উদ্দেশ্যেই বলছি।
বিশ্বাসঘাতক হিটলারপন্থী জার্মানি আমাদের পিতৃভূমির উপর গত ২২ জুন যে সামরিক আক্রমণ শুরু করেছে তা এখনও চলছে। লালফৌজের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের মুখে পড়ে যদিও শত্রুসেনার শ্রেষ্ঠ ডিভিশনগুলি, সেরা বিমানবহর ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়েছে, যুদ্ধের ময়দানে তারা ব্যর্থতার মুখে পড়েছে, তবুও নতুন নতুন বাহিনীকে আক্রমণে এনে শত্রুরা আমাদের দেশের ভিতর ঢুকে আসছে।
হিটলার বাহিনী লিথুয়ানিয় দখল করতে সফল হয়েছে, লাতভিয়ার একটা বড় অংশ, পশ্চিম বেলারুশ ও ইউক্রেনের পশ্চিম অংশ দখল করেছে। ফ্যাসিস্ট বিমানবহর আক্রমণের ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত করেছে। মুর্মানস্ক, ওরশা, মগিলেভ, স্মোলেনস্ক, কিয়েভ, ওডেসা ও সেবাস্তোপোলের ওপর তারা বোমাবর্ষণ করে চলেছে। দেশের সামনে আজ গভীর বিপদ। আমাদের মহান লালফৌজ থাকা সত্ত্বেও এতগুলি শহর এবং জেলা কীভাবে ফ্যাসিস্ট সেনার হাতে চলে গেল, কী করে এটা ঘটতে পারল? উদ্ধত ফ্যাসিস্ট বাহিনী সর্বদা সোচ্চারে যেটা প্রচার করে থাকে, তবে কি সেটাই সত্য? জার্মান বাহিনী কি সত্যই অপরাজেয়? না, তা অবশ্যই নয়।
ইতিহাস আমাদের দেখায় — কোনও সেনাবাহিনীই অপরাজেয় নয়। অতীতেও ছিল না, এবং আজও নেই। নেপোলিয়ানের বাহিনীকে অপরাজেয় মনে করা হয়েছিল, কিন্তু রাশিয়া, ইংল্যান্ড ও জার্মান সেনাবাহিনীর হাতে তাকে বার বার পরাজয় মানতে হয়েছিল। প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সময় কাইজার উইলহেলমের সেনাবাহিনীকে অপরাজেয় বলে মনে করা হয়েছিল, কিন্তু তাকেও বার বার রুশ ও ইঙ্গ-ফরাসি বাহিনীর হাতে পরাজিত হতে হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত ইঙ্গ-ফরাসি বাহিনী তাকে ধ্বংস করে দেয়।
বর্তমানে হিটলারের ফ্যাসিস্ট বাহিনীরও একই পরিণতি ঘটবে। এখন ইউরোপের মাটিতে তারা কোনও দৃঢ় প্রতিরোধের সামনে পড়েনি। একমাত্র আমাদের দেশের মাটিতেই তাদের যথার্থ প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে। এবং লালফৌজের এই প্রতিরোধের আঘাতে জার্মান ফ্যাসিস্ট বাহিনীর সবচেয়ে সেরা ডিভিশনগুলিকে পরাজয় মানতে হয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে, এই সেনাবাহিনীকেও ধ্বংস করা সম্ভব এবং বাস্তবেও এদের দশা হবে নেপোলিয়ন এবং উইলহেলমের বাহিনীর মতোই। এসত্ত্বেও ইতিমধ্যেই আমাদের দেশের খানিকটা জার্মানরা যে দখল করতে পেরেছে, তার কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আক্রমণের সময়টা ছিল ফ্যাসিস্ট জার্মানির পক্ষে অনুকূল এবং সোভিয়েত শক্তির পক্ষে প্রতিকূল। বাস্তব ঘটনা হল, ইতিমধ্যেই যুদ্ধে লিপ্ত দেশ হিসাবে জার্মানি পূর্ণ সৈন্য সমাবেশ করেই রেখেছিল। আক্রমণ চালাবার জন্য যে ১৭০টি জার্মান ডিভিশনকে সোভিয়েত সীমান্তে নিয়ে আসা হয়, তারা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে তৈরিই ছিল, আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য শুধু একটা সঙ্কেতের অপেক্ষা করছিল। অথচ সোভিয়েত সেনাবাহিনীর তখনও শক্তিসমাবেশ ঘটাতে ও সীমান্তে পৌঁছাতে বাকি ছিল। এ ক্ষেত্রে অপর একটি ঘটনাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১৯৩৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে জার্মানি যে অনাক্রমণ চুক্তি করেছিল, অত্যন্ত আকস্মিকভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করে সেই চুক্তি তারা লঙ্ঘন করেছে। এজন্য বিশ্বের চোখে জার্মানি হানাদার রূপে চিহ্নিত হবে একথা জেনেও চুক্তি লঙ্ঘন করতে তাদের আটকায়নি।
আমাদের দেশ শান্তি চায়, চুক্তি লঙ্ঘনে আমরা অগ্রণী হতে চাইনি, বিশ্বাসঘাতকতার পথে যাইনি। প্রশ্ন উঠতে পারে, হিটলার এবং রিবেনট্রপের মতো বিশ্বাসঘাতক শয়তানের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তিতে কেন সোভিয়েত সরকার মত দিয়েছিল? এটা কি সোভিয়েত সরকারের ভুল ছিল না? না, কখনই তা ভুল নয়। অনাক্রমণ চুক্তি হল দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি চুক্তি। ১৯৩৯ সালে এই চুক্তির প্রস্তাব জার্মানিই আমাদের দিয়েছিল।
সেই প্রস্তাব কি সোভিয়েত সরকার প্রত্যাখ্যান করতে পারত? আমি মনে করি, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব কোনও শান্তিকামী দেশই প্রত্যাখ্যান করতে পারে না, এমনকী প্রতিবেশী দেশের সরকারি ক্ষমতার শীর্ষে হিটলার ও রিবেনট্রপের মতো নরখাদক শয়তান থাকলেও নয়। এক্ষেত্রে অপরিহার্য শর্ত একটাই, তা হল, চুক্তি কোনও মতেই প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে শান্তিকামী দেশের ভৌগোলিক সংহতি, স্বাধীনতা ও সম্মানের হানি ঘটাবে না। সকলেই জানেন, সোভিয়েত-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি এ ধরনেরই একটা চুক্তি।
জার্মানির সঙ্গে এই অনাক্রমণ চুক্তি করায় আমাদের লাভ কী হয়েছে? এর ফলে দেড় বছর আমরা শান্তি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি। চুক্তি থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে আক্রমণ চালাবার ঝুঁকি যদি ফ্যাসিস্ট জার্মানি নেয়, সেকথা ভেবে রেখে তা প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ আমরা পেয়েছি। এভাবেই চুক্তির মধ্য দিয়ে কিছু নিশ্চিত সুবিধা আমরা পেয়েছি, যেটা বিপরীতে ফ্যাসিস্ট জার্মানির পক্ষে নিশ্চিত অসুবিধার কারণ হয়েছে।
বিশ্বাসঘাতকের মতো চুক্তি ছিঁড়ে ফেলে সোভিয়েত ইউনিয়নে হানাদারি চালিয়ে ফ্যাসিস্ট জার্মানি কী লাভ করেছে এবং ক্ষতিই বা তার কী হয়েছে?
এর দ্বারা অল্পসময়ের জন্য সুবিধাজনক জায়গায় নিজের সৈন্য সমাবেশের সুযোগ জার্মানি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু গোটা দুনিয়ার চোখে নিজের রক্তপিপাসু হানাদার চরিত্র উদ্ঘাটিত করে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে জার্মানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, সামরিক দিক থেকে জার্মানির লাভটুকু নেহাতই একটা ক্ষণস্থায়ী ঘটনা। অন্য দিকে যে বিরাট রাজনৈতিক লাভ সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘস্থায়ী, যেটা ফ্যাসিস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে আগামী দিনে লালফৌজের সামরিক বিজয়ের জমি তৈরি করে দেবে।
এই কারণেই, আমাদের বীর লালফৌজ, আমাদের বীর নৌবাহিনী, আমাদের সদাতৎপর বিমানবাহিনীর সকলে, দেশের সমগ্র জনগণ, ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার সুসন্তানেরা এবং জার্মানিরও শ্রেষ্ঠ নরনারীগণ সকলে জার্মান ফ্যাসিস্টদের বিশ্বাসঘাতকতার নিন্দা করছে। তারা সোভিয়েত সরকারের পাশে থাকছে, সোভিয়েত সরকারের আচরণকে সমর্থন করছে। তারা দেখছে, আমরা ন্যায়ের জন্য লড়ছি। তারা বুঝেছে — শত্রুর পরাজয় অনিবার্য, জয় আমাদের হবেই।
আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া এই যুদ্ধের পরিণামে চরম সোভিয়েতবিদ্বেষী এবং চূড়ান্ত প্রতারক জার্মান ফ্যাসিবাদের মৃত্যুশীতল বজ্রমুষ্ঠির কবলে আমাদের দেশ পড়েছে। ট্যাঙ্ক এবং জঙ্গি বিমানে সুসজ্জিত ভয়ঙ্কর শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের সৈন্যবাহিনী অমিত শৌর্যের সঙ্গে লড়াই করছে। অসংখ্য প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে বহু আত্মদানের মধ্য দিয়ে লালফৌজ ও লাল নৌবাহিনী প্রতি ইঞ্চি সোভিয়েত ভূমির জন্য মরণপণ লড়াই চালাচ্ছে। হাজার হাজার ট্যাঙ্ক ও যুদ্ধবিমানে সজ্জিত লালফৌজের মূল শক্তি এখন যুদ্ধে নামছে। লালফৌজের সৈনিকরা বীরত্বের অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করছে। শত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ সবদিক থেকে আরও জোরদার হচ্ছে।
লালফৌজের সাথে সাথে সমগ্র সোভিয়েত জনগণ স্বদেশ রক্ষার আহ্বানে উঠে দাঁড়িয়েছে। দেশের এই গভীর বিপদকে প্রতিহত করার জন্য, শত্রুকে পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্য আমাদের কী কী করা দরকার?
সর্বাগ্রে আমাদের দেশের জনগণ, সোভিয়েত জনগণকে খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে দেশের সামনে বিপদ কত গভীর। সমস্ত আত্মসন্তুষ্টি, সবরকম অসতর্কতা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। শান্তিপূর্ণ গঠনমূলক কাজের যে মানসিকতা, যা যুদ্ধের আগে স্বাভাবিক ছিল, তা পরিত্যাগ করতে হবে, কারণ যুদ্ধ সবকিছুর আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে, এখন পূর্বেকার ঐ মানসিকতা পরাজয় ডেকে আনতে পারে।
শত্রু নির্মম এবং দুর্দম। তার লক্ষ্য — আমাদের দেশ দখল করা, আমাদের ঘামে ভেজা মাটি, আমাদের শস্য, আমাদের শ্রমে সৃষ্ট তৈলসম্পদ দখল করা। শত্রুর উদ্দেশ্য, সামন্তপ্রভুদের শাসন ফিরিয়ে আনা, আবার জারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা। রুশ, উক্রাইনীয়, বেলারুশ, লিথুয়ানীয়, লাতভীয়, এস্তোনীয়, উজবেক, তাতার, মোলডাভীয়, জর্জিয়, আর্মেনীয়, আজারবাইজানীয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য মুক্ত জনগোষ্ঠীর স্বাধীন জাতীয় অস্তিত্বকে তারা ধ্বংস করতে চায়। তাদের জার্মানির অধীনস্ত করতে চায়, জার্মান ব্যারন ও প্রিন্সদের দাসে পরিণত করতে চায়।
কাজেই সোভিয়েত রাষ্ট্রের কাছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের কাছে এটা জীবনমরণ প্রশ্ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ স্বাধীন থাকবে, নাকি দাসত্বের জোয়ালে বাঁধা পড়বে — এই প্রশ্নেরও মীমাংসা হবে এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
বর্তমান পরিস্থিতির তাৎপর্য সোভিয়েত জনগণকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে এবং সবরকম অসতর্কতা পরিহার করতে হবে, জনগণকে সমস্ত শক্তি সংহত করতে হবে, যুদ্ধকালীন প্রয়োজন অনুযায়ী সমস্ত কাজকে পুনর্গঠিত করতে হবে, শত্রুর প্রতি বিন্দুমাত্র মমত্বের স্থান এখন নেই।
কাপুরুষ, ভীতু, আতঙ্ক সৃষ্টিকারী এবং বেইমানদের কোনও স্থান আমাদের মধ্যে নেই। পিতৃভূমি রক্ষার এই যুদ্ধে ভয় কাকে বলে আমাদের জনগণকে তা ভুলতে হবে। যে ফ্যাসিস্টরা মানুষকে দাস বানাতে চায় তাদের হাত থেকে মুক্তির যুদ্ধে নিজেদের সর্বস্ব দেওয়ার মন নিয়ে জনগণকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মহান লেনিন বলতেন — সাহস, শৌর্য, সংগ্রামে নির্ভীকতা, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সদা তৈরি মন — এগুলিই হল বলশেভিকদের শ্রেষ্ঠ গুণ।
বলশেভিকদের এই অসামান্য গুণাবলীকে এখন লক্ষ লক্ষ লালফৌজ, লাল নৌসেনা এবং সোভিয়েত জনগণের সকলের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে। আমাদের সকল কর্মকা-কে এখন যুদ্ধকালীন প্রয়োজন অনুযায়ী ঢেলে সাজাতে হবে। যুদ্ধ ক্ষেত্রের জন্য যা প্রয়োজন এবং শত্রুকে ধ্বংস করার জন্য যা প্রয়োজন — সেটাই এখন মুখ্য, বাকি সব প্রয়োজনকে গৌণ করে ফেলতে হবে। আমাদের মতো দেশ, যে দেশ সকল মেহনতি মানুষের স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত করেছে, সেই দেশের প্রতি জার্মান ফ্যাসিস্টদের বর্বর ক্রোধ ও ঘৃণা যে কোনও মতেই প্রশমিত হওয়ার নয় — সোভিয়েত জনগণ এখন তা পরিষ্কারভাবে বুঝেছে।
এই শত্রুর বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণকে দৃঢ়প্রত্যয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। নিজেদের অধিকার ও নিজেদের দেশকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে হবে। লালফৌজ, লাল নৌবাহিনী, সোভিয়েতের প্রতিটি মানুষ সোভিয়েত ভূমির প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষার জন্য লড়বে, আমাদের গ্রাম ও শহরগুলি রক্ষায় শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত ঢেলে দেবে। আমাদের জনগণের শিরায় শিরায় বইছে যে দুঃসাহসী উদ্যোগ ও বুদ্ধিমত্তা, তার প্রকাশ ঘটাবে।
লালফৌজের পাশে আমাদের সমস্ত সহায়সম্বল নিয়ে দাঁড়াতে হবে, লালফৌজের যারা প্রাণ দিচ্ছে তাদের জায়গা দ্রুত নতুন নতুন মানুষ দিয়ে ভরে দিতে হবে, ফৌজের যা প্রয়োজন তার সরবরাহ অক্ষুন্ন রাখতে হবে। সেনা, রসদ ও যুদ্ধসরঞ্জাম এবং আহতদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দ্রুত পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে।
লালফৌজের পৃষ্ঠভূমি রক্ষার ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে এবং এই কাজের কাছে বাকি সব গৌণ করে ফেলতে হবে। আমাদের সমস্ত শিল্প-কারখানায় আরও কঠোর শ্রম দিয়ে আরও বেশি রাইফেল, মেশিনগান, কামান, বুলেট, গোলা, বিমান তৈরি করতে হবে; কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ যোগাযোগের নিরাপত্তা নিñিদ্র করতে হবে, সমস্ত এলাকায় বিমান আক্রমাণ থেকে রক্ষার কার্যকরী ব্যবস্থা করতে হবে।
যুদ্ধক্ষেত্রের পশ্চাদভূমিতে যারা অন্তর্ঘাত চালাচ্ছে, যারা পলাতক, গুজব ছড়িয়ে যারা আতঙ্ক সৃষ্টি করে, তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমাহীন সংগ্রাম চালাতে হবে। গুপ্তচর, বিভেদপন্থী ও শত্রুর ছত্রীসেনাদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে। সরাসরি শত্রুসংহারে লিপ্ত সেনা ব্যাটেলিয়নগুলিকে সবরকম সাহায্য পৌঁছে দিতে হবে। সর্বদা মনে রাখতে হবে, শত্রু অত্যন্ত ধূর্ত, নীতিহীন এবং প্রতারণা ও মিথ্যা প্রচারে অভিজ্ঞ। এটা সবসময় খেয়ালে রাখতে হবে এবং প্ররোচনার ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না।
আতঙ্ক ছড়িয়ে বা কাপুরুষতার জন্য যারাই প্রতিরক্ষার কাজ ব্যাহত করবে — তারা যে-ই হোক — তৎক্ষণাৎ তাদের সামরিক ট্রাইবুনালের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। কোথাও লালফৌজ পশ্চাদপসরণে বাধ্য হলে, সেখান থেকে সমস্ত ধরনের যানবাহন সরিয়ে নিতে হবে, যাতে একটিও রেলইঞ্জিন, একটিও রেলগাড়ি শত্রুর হাতে না পড়ে, এক পাউন্ড শস্য, এ গ্যালন পেট্রলও যেন তারা না পায়।
যৌথ খামারের চাষীরা অবিলম্বে সমস্ত গবাদি পশু সরিয়ে দিন এবং সমস্ত ফসল ফ্রন্টের পিছনে দূরে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিন। ধাতু, শস্য এবং জ্বালানি তেলসহ সমস্ত সম্পদ যা সরানো যাবে না, তা ধ্বংস করে ফেলতে হবে। এর অন্যথা যেন কোনও মতেই না হয়।
শত্রু কবলিত এলাকায় ঘোড়সওয়ার ও পদাতিক গেরিলা বাহিনী অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। শত্রুর উপর আঘাত হানার জন্য, শত্রুকে ভুল পথে চালনা করার জন্য ছোট ছোট গোষ্ঠী তৈরি করতে হবে। সর্বত্র গেরিলা হামলা চালিয়ে যেতে হবে। সেতু, রাস্তা, টেলিফোন-টেলিগ্রাফ লাইন উড়িয়ে দিতে হবে। অরণ্য, গুদাম, যানবাহন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। শত্রুকবলিত এলাকায় এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে শত্রু ও তার সহযোগীরা সেখানে তিষ্ঠাতে না পারে। পদে পদে তাদের ঘেরাও করে মেরে শেষ করে দিতে হবে। শত্রুর সমস্ত কার্যক্রম ব্যর্থ করে দিতে হবে। ফ্যাসিস্ট জার্মানির সঙ্গে এই যুদ্ধ একটা সামান্য যুদ্ধ নয়। এটা কেবলমাত্র দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ নয়, এ হল জার্মান ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে সমগ্র সোভিয়েত জনগণের যুদ্ধ।
ফ্যাসিস্ট উৎপীড়কদের বিরুদ্ধে সমগ্র জাতিকে জড়িত করে আমাদের এই যুদ্ধের লক্ষ্য কেবল আমাদের দেশের সামনে দেখা দেওয়া গভীর বিপদ দূর করাই নয়, জার্মান ফ্যাসিবাদী জাঁতাকলে পিষ্ট সমস্ত ইউরোপীয় জনগণকে সহায়তা করাও আমাদের লক্ষ্য।
এই মুক্তিসংগামে আমরা একা নই। ইউরোপ, আমেরিকার জনগণ, এমনকি হিটলারি স্বৈরাচারীদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ জার্মান জনগণের মধ্য থেকেও আমরা বিশ্বস্ত মিত্র পাব। আমাদের দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমাদের এই যুদ্ধ এবং ইউরোপ ও আমেরিকার জনগণের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই অঙ্গাঙ্গীভাবে এক হয়ে আছে। এটা হবে জনগণের এক যুক্তফ্রন্ট, যা দাসত্বের বিরুদ্ধে এবং হিটলারি ফ্যাসিস্ট সেনার হাতে দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ার বিপদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য লড়বে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই সোভিয়েত ইউনিয়নকে সাহায্য করার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের এবং আমেরিকার ঘোষণার প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা যায়। এই সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা সোভিয়েত জনগণের মধ্যে কৃতজ্ঞতা জাগিয়েছে।
কমরেডস, আমাদের শক্তি অপরিমেয়। এ সত্যটা অচিরেই গর্বোদ্ধত শত্রুপক্ষ বহু মূল্য দিয়ে বুঝতে পারবে। আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে লালফৌজের পাশে দাঁড়াতে বহু হাজার শ্রমিক, যৌথ খামারের কৃষক ও বুদ্ধিজীবীরা এগিয়ে আসছে। সোভিয়েতের আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ মহাশক্তি রূপে জেগে উঠবে।
মস্কো এবং লেনিনগ্রাদে মেহনতি মানুষ ইতিমধ্যেই লালফৌজের সাহায্যের জন্য জনগণের দানে এক বিশাল ভা-ার গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে। শত্রুর হানাদারির সম্মুখীন এমন সমস্ত শহরেই জনগণের দানে এমন ভা-ার গড়ে তুলতে হবে। ফ্যাসিস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে আমাদের দেশ, আমাদের মর্যাদা এবং স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, সমস্ত মেহনতি মানুষকে এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।