Wednesday, November 20, 2024
Homeফিচারবর্তমান পরিস্থিতি, পরিবর্তনের সংগ্রাম ও বিকল্প শক্তি কোন্ পথে

বর্তমান পরিস্থিতি, পরিবর্তনের সংগ্রাম ও বিকল্প শক্তি কোন্ পথে

db6a2323bab35bd9ef9d24a9a0807a3e

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্টি ও ভবিষ্যত নিয়ে হতাশা অধিকাংশ মানুষের মনেই আছে। জনগণ এই অবস্থার পরিবর্তন চায়, কিন্তু পরিবর্তনের ক্ষমতা নিজের হাতে আছে বলে মনে করে না। কারণ, পরিবর্তন বলতে মানুষ বোঝে ভোটে সরকার পাল্টানো। কিন্তু, জনগণের ভোট ছাড়াই দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা ধরে রেখেছে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার। ভবিষ্যতেও ক্ষমতা দখলে রাখতে তারা নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে বলে জনমনে ধারণা। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের পরিবর্তে ক্ষমতায় আসার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তি আছে বিএনপি। তারাও তো অতীতে প্রায় একই ধরনের দুঃশাসন চালিয়েছে। ফলে, পরিবর্তন কোন্ পথে সম্ভব – এ প্রশ্নের জবাব না পেয়ে মানুষ উপায়হীন-অসহায় মনোভাব ব্যক্ত করে। কিন্তু, আন্দোলনের পথ ও উপায় খুঁজে পেলে মানুষ নিশ্চয় এগিয়ে আসবে। সঠিক পথে ও নেতৃত্বে সংগঠিত জনগণের সচেতন সক্রিয় ভূমিকাই এই অচলায়তন ভাঙ্গতে পারে।

বর্তমান অবস্থা গত ৪৬ বছরের পুঁজিবাদী দুঃশাসনের ফলাফল
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে ক্ষমতায় ছিল গত ৪৬ বছরে। ফলাফল – গণতন্ত্র মৃত্যুশয্যায়, অভাব-বেকারত্ব-মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবন বিপর্যস্ত, লুটপাট-দুর্নীতি সর্বগ্রাসী, সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব-দলীয়করণের বিস্তৃতি, সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের উত্থান, সামাজিক মানবিক নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। বর্তমান মহাজোট সরকার নিজেদের যাবতীয় অপকর্ম ঢাকতে বিরামহীনভাবে ‘উন্নয়ন’-এর ঢাক পিটিয়ে চলেছে। প্রশ্ন হলো, এত উন্নয়নের পরেও কেন হাজার হাজার বাংলাদেশী বিপজ্জনক সাগরপথে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে যাচ্ছে ইউরোপে বা মালয়েশিয়ায়? বাংলাদেশে তো কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি নেই। ঈদের সময় সামান্য দামের জাকাতের শাড়ি নিতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হয়ে মারা যায় দরিদ্র নারীরা। হাওর, পাহাড়, সমতলে বন্যা-বৃষ্টিতে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে কেন? কেন এখনো সরকারি হিসাবেই ৪-৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে? গ্রামে গ্রামে লক্ষ-কোটি মানুষ ক্ষুদ্রঋণের ফাঁসে জড়ায় কেন? বস্তিবাসী-গৃহহীন ভিক্ষুকের সংখ্যা কত? শিক্ষা-চিকিৎসার অধিকার কি সবার আছে? শ্রমিকরা কি ৮ ঘন্টা কাজের মজুরিতে মোটামুটি সংসার চালাতে পারে? কৃষক কি ফসলের ন্যায্য দাম পায়? এমন আরো অনেক প্রশ্ন সরকারের কথিত উন্নয়নকে প্রতিনিয়ত ব্যঙ্গ করে।

আসলে রাস্তাঘাট-ফ্লাইওভার-দালানকোঠা অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যা শোষণ-বৈষম্য-অভাব-বেকারত্ব রয়ে গেছে। আরেকদিকে সমাজের একাংশের প্রচুর উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হচ্ছে বিদেশে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমানো টাকার পরিমাণ বাড়ছে। মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম বা কানাডার ‘বেগমপাড়া’য় বাংলাদেশীদের সংখ্যা বাড়ছে। কোথা থেকে আসে এত টাকা? বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। আদায় অযোগ্য হয়ে যাওয়ায় অবলোপন করা হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। সবমিলে খেলাপি ঋণের মোট স্থিতি ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৭ শতাংশ। কালো টাকা সীমাহীন, অর্থমন্ত্রী একবার বলেছিলেন জিডিপি’র ৮০%-ই কালো টাকা। সরকারী ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করে আত্মসাৎ করা হচ্ছে। সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে ৪ হাজার কোটি টাকা লুট, বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান নিজের প্রভাব খাটিয়ে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ভুয়া ঋণ প্রদান, বিসমিল্লাহ গ্রুপ-এর নামে ৫ ব্যাংক থেকে ১২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ এর উদাহরণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে’ ৮০০ কোটি টাকারও বেশি চুরির ঘটনা ঘটেছে। ২০১০ সালে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতে সরকারি তদন্ত কমিটির হিসেবেই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের নামে লোক ঠকিয়ে টাকা কামাচ্ছে একদল, শুধু ডেসটিনি-ই আত্মসাৎ করেছে ৪,১১৯ কোটি টাকা। ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসা করে ফুলেফেঁপে উঠছে এনজিওগুলো। গার্মেন্টস শ্রমিকদের নামমাত্র মজুরি দিয়ে সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় (বছরে প্রায় ৩০০০ কোটি ডলার বা ২ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা) করে টাকার পাহাড় বানাচ্ছে মালিকরা। বাংলাদেশে নিম্নতম মজুরি ৫৩০০ টাকা মাত্র যা এশিয়ার মধ্যেই সর্বনিম্ন। শ্রমিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, দমন-পীড়ন চালিয়ে মালিকদের ইচ্ছামত শর্তে ও কর্মপরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। সরকারের কাছে বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা নিচ্ছে রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের মালিকরা, বছরে অন্তত ৬-৭ হাজার কোটি টাকা এই বাবদ লোকসান হচ্ছে বিদ্যুত খাতে। দেশের বড় গ্যাসক্ষেত্রগুলো শুষে নিয়ে বিপুল মুনাফা করছে বিদেশি কোম্পানি, তার ভাগ পাচ্ছে এদেশের কিছু লোক। অযৌক্তিকভাবে ওষুধের দাম, গাড়িভাড়া বাড়িয়ে, কখনো চিনি-ভোজ্য তেল, কখনো ডাল-পিঁয়াজ ইত্যাদির কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মানুষের পকেট কাটছে ব্যবসায়ীরা। শিক্ষা ও চিকিৎসা এখন লাভজনক ব্যবসাক্ষেত্র। কৃষকের কাছ থেকে মৌসুমে কম দামে ধান কিনে নিয়ে মজুদ করে হাওরে বন্যা ও নেকব্লাস্ট রোগে ফসলহানির সুযোগে এখন চড়া দামে চাল বিক্রি করে মুনাফা করছে চাল ব্যবসায়ী-আড়তদার-মিল মালিক সিন্ডিকেট।

অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের ওপর কর-ভ্যাটের বোঝা ক্রমাগত বাড়িয়ে সরকার বড় বাজেট করছে, বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প নিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, মহাসড়ক-রেললাইন-ফ্লাইওভার-সেতুসহ যেকোনো নির্মাণ কাজে উন্নত দেশগুলো থেকে অনেক বেশি খরচ হচ্ছে বাংলাদেশে। যেমন, উন্নত দেশগুলোতে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে গড় ব্যয় হচ্ছে ৩১ কোটি টাকা। অথচ, বাংলাদেশে সর্বশেষ ঢাকা-পায়রা বন্দর রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে দ্বিগুণ বা তারও বেশি ব্যয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কয়েক বছর ধরে সর্বনিম্ন দামে তেল কিনে দেশে দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি করে সরকার রাজস্ব বাড়াচ্ছে। গ্যাস খাতে কোনো লোকসান না থাকলেও দাম বাড়িয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার ভরা হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে সরকারঘনিষ্ঠ বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের মুনাফা যোগান দেয়া হচ্ছে। এইভাবে শোষণ-লুণ্ঠন-দুর্নীতি সবকিছুর মিলিত ফলাফলে শিল্পপতি-ব্যবসায়ী-সামরিক/বেসামরিক আমলা-এনজিও মালিক-মধ্যসত্ত্বভোগী এরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। এই শোষক-লুটেরাদের তত্ত্বাবধায়ক ও সুবিধাভোগী হলো ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিরোধী দলের লোকেরাও এসব ধনকুবেরদের সাথে যোগাযোগ রাখেন, তারাও এদের হাতে রাখেন।

ফলে দেশের চিত্র হলো – উন্নয়ন হচ্ছে মুষ্টিমেয় ধনীদের, তাদের সম্পদ হু-হু করে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে শুধু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন হিসাবের সংখ্যা ৪৯ হাজার ৫৫৪। ২০০৯ সালে কোটিপতি ছিল ২৩ হাজার ১৩০ জন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ওয়েলফেয়ার মনিটরিং সার্ভে অনুযায়ী, মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশের হাতেই দেশের সম্পদের সবচেয়ে বড় অংশ, ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ। এর কিছুটা ভাগ পাচ্ছে মধ্যবিত্তদের ওপরের অংশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক-চাষী-নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ কোনোমতে টিকে আছে। বাস্তবে, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে এমনই হবার কথা। সব পুঁজিবাদী দেশেই, এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও প্রাচুর্য আর দারিদ্র্যের সহাবস্থান অবশ্যম্ভাবী। এর কারণ হলো, সমাজে সবাই শ্রম দিয়ে যে সম্পদ তৈরি করে তার সিংহভাগ জমি-কারখানা-ব্যবসা ইত্যাদি উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানার জোরে পুঁজিপতি শ্রেণীর পকেটে চলে যায়। সামান্য অংশ শ্রমিক ও পেশাজীবীরা পায়। এজন্যই পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বৈষম্য অবশ্যম্ভাবী।

ফ্যাসিবাদের পথে হাঁটছে দেশ
পুঁজিবাদী অর্থনীতি সৃষ্ট এই ‘স্বাভাবিক’ শোষণ-বৈষম্যের সাথে যুক্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের বেপরোয়া লুটপাট-দুর্নীতি-দখলবাজি। এই লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্য টিকিয়ে রাখতে চলছে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, দমন-নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িকতার সাথে আপোষ, ভারত তোষণসহ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোকে খুশি রাখার নীতি, প্রশাসন ও বিচারবিভাগের চূড়ান্ত দলীয়করণ ইত্যাদি। এদিকে, লুটপাট ও দখলের ভাগ নিয়ে হানাহানি চলছে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যেই। এদের দাপটে স্থানীয় পর্যায়ে জনগণ সন্ত্রস্ত। সম্প্রতি বগুড়ায় শ্রমিক লীগ নেতা কর্তৃক ধর্ষণ ও মা-মেয়েকে নির্যাতনের ঘটনা এর সর্বশেষ উদাহরণ। দুয়েকদিন পর হয়তো এটিও সর্বশেষ থাকবে না। বিরোধী রাজনীতি দমনে পুলিশ-র‍্যাব ও প্রশাসনের অপব্যবহারের ফলে আইনের শাসন ও শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। নারায়ণগঞ্জে র‍্যাব কর্তৃক সাত খুন, ক্রসফায়ার-গুমের অসংখ্য ঘটনা, শেখ মুজিবের ছবি বিকৃতির কথিত অভিযোগে ইউএনওকে জামিন না দেয়া – এমন বহু ঘটনা উল্লেখ করা যাবে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেও পার্লামেন্ট-বিচার বিভাগ-প্রশাসন এদের আপেক্ষিক স্বাধীনতা কিছুটা থাকে। বর্তমান সরকার সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্ষমতার চূড়ান্ত কেন্দ্রীভবন করে এক ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করার পথে হাঁটছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও উন্নয়নের শ্লোগান দিয়ে সব অপকর্মকে জায়েজ করার চেষ্টা হচ্ছে।

জনদাবিতে লড়াই-সংগ্রাম ছাড়া কেবল নির্বাচনমুখী হয়ে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সম্ভব নয়
জনগণ এই স্বৈরতান্ত্রিক ও গণবিরোধী শাসনের পরিবর্তন চায়। কিন্তু ভোটে পরিবর্তনের আশা দেখা যাচ্ছে না, কারণ এই সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করেছে। অন্যদিকে, শাসক শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ বিরোধে বা পুঁজিপতি শ্রেণীর গড় শ্রেণীস্বার্থ রক্ষা করতে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের পথে সরকার পরিবর্তন হলে তাতেও জনস্বার্থ রক্ষা হবে না। ২০০৭ সালের ১/১১ এর অভিজ্ঞতা সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। বিকল্প হলো – গণঅভ্যুথানের পথে সরকার পরিবর্তন অথবা গণআন্দোলনের চাপে আপাত নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করা। কিন্তু নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? আওয়ামী লীগও তো নির্বাচিত সরকার ছিল। এর আগে নির্বাচনে জেতা বিএনপি সরকার ২০০৬ সালে নীলনকশার নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল। বাস্তবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামায়াত এসব দলগুলি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। এসব বুর্জোয়া দলগুলি আজ আর বুর্জোয়া গণতন্ত্রের চেতনাও ধারণ করে না। ফলে শুধু নির্বাচনে সরকার বদল নয়, আন্দোলনের লক্ষ্য হতে হবে ব্যবস্থার বদল। কিন্তু বাস্তবতা হল – এই মুহূর্তে সমগ্র আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা বদলানোর উপযুক্ত রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠেনি। ফলে, আশু লক্ষ্য হতে পারে – জনগণের দাবি আদায়ে আন্দোলনের সংস্থা গড়ে তোলা। এই সংস্থার নেতৃত্বে জনজীবনের সংকট নিরসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের পথে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গণভিত্তি অর্জন করতে পারে ও ভবিষ্যতে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিতে পারে।

যেন-তেন প্রকারে দ্রুত কিছু করার মনোভাব সুবিধাবাদের জন্ম দেয়
বামপন্থীরাই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি যারা বিদ্যমান ব্যবস্থা বদলের কথা বলে ও যাদের পক্ষে সম্ভব বিকল্প কর্মসূচি দেয়া। সাংগঠনিক শক্তিতে ক্ষুদ্র হলেও যেকোনো সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ড ও জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তারাই সাধ্যমতো প্রতিবাদ ও আন্দোলনে নেমেছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ-নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, কৃষিতে ভর্তুকি ও ফসলের ন্যায্য দামের দাবিতে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিবাদে, হাওরের দুর্গত মানুষকে রক্ষার দাবিতে, সাম্প্রদায়িক জাতিগত-লিঙ্গগত নিপীড়নের প্রতিবাদে, গুম-খুন-ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষাসহ নানা দাবিতে বামপন্থী দলগুলো সবসময়ই কম-বেশি রাস্তায় আছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাসমূহ নিয়ে বামপন্থী শক্তিসমূহ ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কার্যকর গণভিত্তি সম্পন্ন কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। কতক বামপন্থী দল ‘বিকল্প’ -এর কথা বললেও প্রধান দুই বুর্জোয়া দলের মধ্যকার বিরোধে দূতিয়ালি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় অথবা ‘মুক্তিযুদ্ধের’ পক্ষের শক্তি/চেতনার ধুয়া তুলে আওয়ামী ব্ল্যাকমেইলিং-এর শিকারে পরিণত হয়। সাধারণ মানুষের কাছে এই সব বামপন্থী দলসমূহ আওয়ামী ঘরানার রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেই বিবেচিত হয়। এ সব কারণে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলতে একটা কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বামপন্থী দলসমূহ জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। জনসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে যেতে না পারা, আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারায় গণসম্পৃক্তি খুব বেশি অর্জন করা যায়নি। বুর্জোয়ারা টাকা-প্রশাসন-প্রচারমাধ্যম-পেশীশক্তি-ধর্ম-আঞ্চলিকতা ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে রাজনীতিকে নীতিহীন সুবিধাবাদী কর্মকান্ডে পরিণত করেছে। এর মধ্যে নীতি-আদর্শের রাজনীতি দাঁড় করানো সহজ নয়। এই প্রতিকূল অবস্থায় বামপন্থী রাজনীতিতেও হতাশাজাত অস্থিরতা তৈরি হয়, যেকোনোভাবে দ্রুত কিছু করে ফেলার মনোভাব জন্ম নেয়। এই পথে বিভ্রান্তি বা সুবিধাবাদ আসে।

যেমন, বামপন্থীদের অনেকে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দ্বিদলীয় মেরুকরণের বাইরে বিকল্প শক্তি বা তৃতীয় ধারা গড়ার কথা বলে আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকীদের সাথেও নির্বাচনী জোট বা সমঝোতা করতে চান। সম্প্রতি উত্তরায় আ স ম রবের বাসায় একটি সভায় পুলিশী হস্তক্ষেপ নিন্দিত হলেও, এর মধ্য দিয়ে এধরনের রাজনৈতিক মেরুকরণের উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়েছে। যদিও প্রক্রিয়াটি কয়েক বছর ধরেই চলে আসছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরির বাসায় জাতীয় পার্টির জি এম কাদেরসহ অনুরুপ আরেকটি সভার খবর পত্রিকায় এসেছে গত ২ আগস্ট। শাসক দলগুলো থেকে দলছুট বা তাদের একসময়ের সহযোগী কিছু নেতার ব্যক্তিপ্রচারের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এসব তথাকথিত ‘উদার গণতন্ত্রী’ দলগুলোর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি নেই, জনগণের দাবিতে লড়াই-সংগ্রামের কোনো উদ্যোগ-ঐতিহ্যও নেই। এদের অনেকের ভাবমূর্তি বিতর্কিত, কেউ সামরিকতন্ত্রের সহযোগী ছিলেন, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সাথে যুক্ত বলে কারো কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি জোটের বাইরে বিকল্প রাজনীতির যে আকাঙ্খা মানুষের মধ্যে আছে বা শাসকশ্রেণীরও বিশেষ সময়ে প্রয়োজন হতে পারে, তাকে ব্যবহার করে এরা সামনে আসতে চায়। প্রয়োজনে আবার প্রধান দুই জোটের সাথে যোগাযোগ ও দরকষাকষি করে সুবিধা নিতে চায়। বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যমও তাদের কিছুটা প্রচার দিয়ে মানুষের সামনে বিকল্প হিসেবে খাড়া করে রাখে। এইসব তথাকথিত ‘উদার গণতন্ত্রী’দের লক্ষ্য আসন্ন নির্বাচনে নিজের বা দলের জন্য দুয়েকটি সংসদীয় আসন নিশ্চিত করা। কিন্তু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ভোটে জেতার মতো সাংগঠনিক শক্তি ও জনভিত্তি এদের প্রায় কারোই নেই। এজন্য শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশের সাথে তাদের আঁতাত ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নেই। যেসব বাম রাজনৈতিক দল এদের সাথে নিয়ে বিকল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন, তাদের ভাবনা কী এ বিষয়ে? এই তৎপরতার মাধ্যমে তারা কার্যত বামপন্থার অবশিষ্ট গ্রহণযোগ্যতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছেন। এদের মধ্যে ড. কামাল হোসেনের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি জনমনে কিছুটা থাকলেও তিনি যে আন্দোলনের লোক নন তা পরিষ্কার। ফলে এদের সাথে নির্বাচনী ঐক্যে গণআন্দোলনের সম্ভাবনার দিক থেকে ফলপ্রসূ কিছু হবে না, বরং বামপন্থীদের জন্য তা আত্মঘাতী হবে।

বামপন্থীরা ছাড়া এ মুহূর্তে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই
জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভোটাধিকার রক্ষায় আপাত নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি বামপন্থীরা অবশ্যই জোরের সঙ্গে তুলবে। কিন্তু, নির্বাচনটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য হতে পারে না। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে তাতে বামপন্থীদের অংশগ্রহণের লক্ষ্য হওয়া দরকার আন্দোলনের শক্তি ও বক্তব্যকে মানুষের কাছে আরো ছড়িয়ে দেয়া। বুর্জোয়াদের সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক-কায়েমী স্বার্থগোষ্ঠীর সমর্থন-টাকার জোর-মিডিয়া-পেশীশক্তিকে মোকাবেলা করার মতো মজবুত সংগঠন এবং লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে প্রভাব তৈরি করা ছাড়া নির্বাচনে এই মুহূর্তে ‘কিছু করে ফেলা’র চিন্তা বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। বাম ও ‘উদারপন্থী’রা মিলিতভাবে নির্বাচন করলেও প্রচার যতই পাক্, সংগঠন ছাড়া ভোটের মাঠে তা বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারবে না। অবশ্য, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি জোটের সাথে দর কষাকষি করে কেউ কোনো ছাড় পেলে তা ভিন্ন কথা। গণআন্দোলনের ধারায় অন্য কোনো গণতান্ত্রিক শক্তি যদি অংশগ্রহণ করে এবং জনগণের মধ্যে যদি ঐক্যের তাগিদ সৃষ্টি হয়, তখন বামপন্থীদের সাথে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোরও যুগপৎ বা অভিন্ন লক্ষ্যে আন্দোলন হতে পারে। এখন পর্যন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, বামপন্থীরা ছাড়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আমরা এসব দিক গভীরভাবে ভেবে দেখার জন্য সকল বাম নেতা-কর্মী-সমর্থক ও সচেতন দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানাই।

এই অবস্থায় গত ৩০ জুলাই যৌথ সমাবেশ ও ১ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা ও সিপিবি-বাসদ যুগপৎ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। গণতন্ত্র রক্ষা, জনজীবনের সংকট নিরসন ও বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার ডাক দিয়ে আশু ২১ দফা দাবিতে যুক্ত আন্দোলনের ঘোষণা বামপন্থী নেতা-কর্মী-সমর্থক ও সচেতন মানুষের মধ্যে আশাবাদ সঞ্চার করেছে। ঐক্যবদ্ধভাবে ধারাবাহিক সংগ্রামের মাধ্যমে বামপন্থীরা জনগণের আস্থা অর্জন করবে এবং এই পথে অন্যান্য বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তি-ব্যক্তিবর্গকে সমবেত করে সত্যিকার অর্থে জনগণের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দেবে – আমরা এই প্রত্যাশাই করি।

সাম্যবাদ আগষ্ট ২০১৭

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments