মাস পেরিয়ে গেলেও বর্ষবরণে টিএসসিতে নারী লাঞ্ছনাকারীদের কাউকে পুলিশ এখনো গ্রেফতার করতে পারে নি। প্রথম দিকে এ ঘটনাকে অস্বীকার করার বহু চেষ্টা সরকার ও প্রশাসনের তরফ থেকে করা হয়েছে। কিন্তু ছাত্রসমাজ, নারীসমাজসহ দেশবাসীর সোচ্চার প্রতিবাদ সামাল দিতে লক্ষ টাকার পুরস্কারের আড়ম্বরপূর্ণ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ভিডিও ফুটেজে অপরাধী শনাক্ত করা গেলেও তাদের ধরা যাচ্ছে না অথচ মিথ্যা অভিযোগে যখন তখন যে কাউকে ধরপাকড়ে পুলিশ বিন্দুমাত্র কসুর করে না। এর মধ্যেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী লাঞ্ছনার শিকার হন ছাত্রী ও শিক্ষিকা। ঢাকার একটি নামকরা স্কুলে শিশু বয়সী ছাত্রীদের উপর যৌননির্যাতনের খবর আমাদের হতভম্ব করেছে। খবর এসেছে, এক গার্মেন্ট কর্মীকে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে দেয়ার।
প্রশ্রয় পেলে নির্যাতকরা কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে এসব ঘটনায় তার সাক্ষ্য মেলে। চারিদিকে যখন নারী নির্যাতনের এরকম বীভৎস উৎসব চলছে তখন প্রশাসন এমন নির্বিকার কেন? নিস্পৃহ কেন? ‘এ আর এমন কিছু নয়’, ‘হাজার লোকের সমাবেশে একটু-আধটু হয়’, ‘ছেলেদের সামান্য দুষ্টুমি’, ‘পাশের বাড়ির ছেলেদের কাজ’ — এসব বলে ঘটনাকে গুরুত্বহীন করে তোলার চেষ্টা করে চলেছেন। নারীকে ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখার মধ্যে রয়েছে এর শেকড়। মানুষকে সংবেদনহীন করে তোলা, অভ্যস্ত করে তোলাই এর উদ্দেশ্য।
নারী নির্যাতন এখন প্রতিদিনের ঘটনা। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, লাঞ্ছনা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। নিভৃত গ্রামে, শহরের বস্তিতে, নির্জন গলিতে যেমন তেমনি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নারী নির্যাতন, নারী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটছে। বখাটে মাস্তান আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সবাই নির্যাতকের চরিত্রে। সমাজের সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ে ঘুঁচে গেছে শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ব্যবধান।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার নামে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে নারীকে ঘরের ভেতর থেকে বাইরে টেনে এনেছে সস্তা শ্রমের যোগান দেবার জন্য। মুনাফার উদগ্র লালসায় নারীকে নগ্ন করেছে, নারীর দেহ-সৌন্দর্য্য সমস্ত কিছুকে পণ্য করেছে। ভোগবাদের বিস্তারে নারী হয়েছে পুঁজির অন্যতম কাঁচামাল। আর পুঁজিবাদী মিডিয়া অত্যন্ত সুকৌশলে নারীকে পণ্য করার কাজটি করে চলেছে। নর-নারী নির্বিশেষে পুরো সমাজমননে নিকৃষ্ট ভোগবাদের পঁচাগলা আবর্জনাগুলো প্রবেশ করাচ্ছে। পুরুষদের শেখাচ্ছে — নারী মাত্রই ভোগের সামগ্রী, আর নারীদের শেখাচ্ছে — নিজেকে ভোগের উপযুক্ত করে তোল, বাজার দর বাড়াও। এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে দুর্বৃত্তায়িত ও নিকৃষ্ট দলবাজীর রাজনীতি। নারী নির্যাতন ও লাঞ্ছনার ঘটনার সাথে জড়িতরা দলীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে পার পেয়ে যায়, থেকে যায় বিচারের আড়ালে। এভাবে বিচারহীনতা অপরাধের মাত্রাকেই দিন দিন বাড়িয়ে চলে।
তবে আশার কথা, বর্ষবরণের যৌন নিপীড়নের ঘটনা যেমন ঘটেছে তেমনি এর বিপরীতে কিছু সাহসী তরুণ ছাত্র-যুবক এই ঘটনাকে প্রতিহত করার সৎ সাহস দেখিয়েছে। নারী লাঞ্ছনা প্রতিরোধ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সভাপতি লিটন নন্দীসহ কয়েকজন নেতা-কর্মী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ন্যাক্কারজনক এসব ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আন্দোলন চলমান আছে।
প্রগতিশীল ছাত্র জোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য এই দুই জোট মিলিতভাবে ৫টি দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কর্মসূচি পরিচালনা করছে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে নারী নির্যাতনের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার, নিস্ক্রিয় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের অপসারণ, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও কার্যকর, জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়ী যৌন নিপীড়কদের আজীবন বহিষ্কার এবং সকলক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও পণ্য হিসেবে উপস্থাপন বন্ধ করার দাবিতে ধারাবাহিক মিছিল-সমাবেশ, সংহতি সমাবেশ, উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাও করা হয়। একপর্যায়ে ছাত্র ইউনিয়নের ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশ হামলা করলে তার প্রতিবাদে ১২ মে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। পরবর্তীতে ১৭ মে রবিবার বিকাল ৪টায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে সংহতি সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০ মে পূর্ব ঘোষিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি সফলভাবে পালিত হয়। এ সময় সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান তারেক, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি জনার্দন দত্ত নান্টু, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী রিন্টু, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম সোহেল, ছাত্র গণমঞ্চের আহ্বায়ক শান্তনু সুমন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি এস এম পারভেজ লেলিন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি ফয়সাল ফারুক অভি, ছাত্র ঐক্য ফোরামের আহ্বায়ক সরকার আল ইমরান, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি সালমান রহমান, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক জাকি সুমন, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা থুইক্য চিং মারমা।
নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদে জবি-তে আন্দোলনের বিজয়
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পক্ষ থেকে ছাত্রী লাঞ্ছনাকারী হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. মো. সাখাওয়াৎ হোসেন-এর অপসারণ এবং শিক্ষিকা লাঞ্ছনাকারী ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র আরজ মিয়ার ছাত্রত্ব বাতিল করে স্থায়ী বহিষ্কারের দাবিতে ৩ মে বেলা ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয় ভাস্কর্য চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ ও কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জবি শাখার সভাপতি মাসুদ রানা, পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক মেহরাব আজাদ। আরো বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রী চক্রবর্তী রিন্টু। উল্লেখ্য যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রণ্টের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে প্রশাসন শিক্ষিক লাঞ্ছনাকারী ছাত্রলীগ নেতাকে আজীবন বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়।
নড়াইলে গৃহবধু নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ
নড়াইলে গৃহবধু নির্যাতককারী আজিজুরসহ সকল আসামীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে ১৩ মে বিকাল ৪টায় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সীমা দত্ত । বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মর্জিনা খাতুন, ঢাকা নগর শাখার সভাপতি এড. সুলতানা আক্তার রুবি ও সাধারণ সম্পাদক তাছলিমা নাজনিন সুরভী।
বক্তারা বলেন, গত ৩০ এপ্রিল নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের শালবরাত গ্রামের গৃহবধু ববিতা খানমকে লম্পট স্বামী শফিকুল ইসলাম গাছের সাথে বেঁধে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করেছে। ববিতা এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর এই নির্যাতনে নেতৃত্ব দিয়েছে কাশিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহবায়ক ও স্থানীয় মাতব্বর আজিজুর রহমান। মূল আসামী শফিকুল গ্রেফতার হলেও ঐ নির্যাতনে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহবায়ক আজিজুর রহমানকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। নেতৃবৃন্দ, অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানান।
মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে শিশু নিপীড়নকারীদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ
মোহম্মদপুর প্রিপারেটরি উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে শিশু নিপীড়নকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, ভাইস প্রিন্সিপালের অব্যাহতির আদেশ দ্রুত কার্যকর করা এবং শিক্ষাঙ্গনে নিরাপদ পরিবেশের দাবিতে ১৭ মে বিকেল ৪টায় নারীমুক্তি কেন্দ্রের উদ্যোগে স্কুলের সামনে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। নারীমুক্তি কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় সভাপতি সীমা দত্তের সভাপতিত্বে ও মনিদীপা ভট্টাচার্যের পরিচালনায় মানববন্ধন ও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন নাঈমা খালেদ মনিকা, জান্নাতুল মাওয়া, অভিভাবক লাভলী বেগম, আয়াতুন নেসা, সোহেল, সম্পা প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, ৫ মে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে প্রথম শ্রেণীর ছাত্রীকে মুখ চেপে ধরে ঐ স্কুলের ক্যান্টিন বয় বা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা ধর্ষণের চেষ্টা করে এবং এর দুইদিন পর ৫ম শ্রেণীর শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। কর্তৃপক্ষ দোষিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে শুধু সময় ক্ষেপণ করছে যা খুবই ন্যাক্কারজনক। অপরাধীদের শাস্তির আওতায় না আনায় এরকম জঘন্য অপরাধের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে । এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও চলন্ত বাসেও নারীরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, তাই এর বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একই দাবিতে ২২ মে বিকেলে প্রিপারেটরি স্কুলের সামনে নারীমুক্তি কেন্দ্রের উদ্যোগে মানববন্ধন ও মোহাম্মদপুর টাউন হলের সামনে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।