গভীর রাত। হঠাৎ আগুনের লেলিহান শিখা। দাউ দাউ করে জ্বলছে চারপাশ। চোখে ঘুম নিয়েই এক দল ছেলে-মেয়ে ছুটে চলছে আগুন নেভাতে। না, নিজের ঘরটা নয়। বাঁচাতে গেছে তাদের বহু যতেœ গড়া পাঠাগারটিকে। শহীদ রুমি স্মৃতি পাঠাগার তার নাম। একে রক্ষা করতে না পারলে তাদের স্বপ্নগুলোও যে মরে যাবে। এ পাঠাগারে বসেই তো তারা জীবনের কথা বলে, বড় মানুষ হবার স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখায় অনেককে। শুধু কিছু ছেলে-মেয়ে নয়, পাঠাগারের সাথে যুক্ত তাদের পরিবারগুলোও। অভিভাবকরাও যেন নিশ্চিন্ত থাকেন। এখানে যুক্ত হলে অন্তত নষ্ট হবার ভয় থাকে না। এত ভালোবাসার পাঠাগার কি আগুন পোড়াতে পারে? সবার সম্মিলিত চেষ্টায় সেদিন পাঠাগারটিকে রক্ষা করা গিয়েছিল। এই পাঠাগারটি ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর মাঝখানে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচাইতে বড় বস্তি কড়াইলে অবস্থিত। পাঠাগারটি রক্ষা করা গেলেও কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে, কেন কিছুদিন পর পর এই বস্তিতে আগুন লাগে? কারা লাগায়?
কড়াইল বস্তিতে প্রায় ৩ লাখ মানুষ বসবাস করে। সবাই শ্রমজীবী মানুষ। এদের মধ্যে কেউ গার্মেন্টসে কাজ করে, কেউ রিকশা চালায়, কেউবা দিনমজুর। শ্রমজীবী এই মানুষদের পেটে লাথি মারার মতো একটি ঘোষণা গত কিছু দিন আগে পুলিশ প্রধান দিলেন। বললেন, ‘এই বস্তি উচ্ছেদ করা হবে।’ কেননা এখানে মাদক ব্যবসায়ী, চোরাকারবারী, অপরাধীরা থাকে। তাদের কারণে সমাজে অপরাধ বাড়ছে। এদের ধরতে হলে এই বস্তি উচ্ছেদ করতে হবে।
বস্তিতে থাকে কারা? দরিদ্র মানুষ, যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, মূলত তারাই এখানে বাস করে। গ্রামে কাজ নেই। সবকিছু খুইয়ে শহরে এসেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদী ভাঙ্গন, বন্যা, ক্ষুদ্র ঋণের কারবারীদের চাপ ইত্যাদি বহু কারণে একদল মানুষ কোনো মতে বেঁচে থাকবার জন্যই তো এখানে আশ্রয় নেয়। ঢাকা শহরসহ অন্যান্য বড় শহরগুলোতে এমন মানুষদের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। বাড়ছে, কেননা এই মানুষগুলোর জন্য এলাকাভিত্তিক কোনো কাজের ব্যবস্থা সরকার করতে পারেনি।
বেঁচে থাকার ব্যবস্থা সরকার করতে না পারলে কী হবে? অত্যাচার তো করতে পারবে। তাই বস্তি উচ্ছেদের ফরমান এসেছে। বলা হয়েছে, বস্তিগুলো অপরাধীদের আবাসস্থল। যেন অপরাধ কেবল বস্তিতে হয়! বস্তিতে যেমন অপরাধ হয় তেমনি অভিজাত পাড়াগুলোতেও চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন, ধর্ষণ, মাদক চোরাচালান সবই হয়। সারা দেশেই তো একই চিত্র। যে অপরাধ করবে, দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। তাহলে বস্তি উচ্ছেদের প্রশ্ন আসে কেন? আর অপরাধীদের ধরবে যারা, সেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনদেরও তো এসবের সাথে যুক্ত থাকার খবর প্রায়ই শিরোনাম হয়। সর্ষের ভেতর ভূত থাকলে, ভূত সারাবে কে? এ কথাও সবার জানা যে, যারা মাদক ব্যবসা ও নানা ধরনের অপরাধের সাথে যুক্ত তাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে টিকে থাকে। সরকার কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। তাহলে বস্তি উচ্ছেদের উদ্দেশ্য কী?
বস্তিতে বসবাস করা শহিদুল নামের এক কলেজ ছাত্র জানালো এর কারণ। বললো, ‘গুলশান সোসাইটির উদ্যোগে গুলশান লেক সম্প্রসারণ করার কথা। কিন্তু এই বস্তি থাকার কারণে সেই কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে যেকোনো মূল্যে তারা বস্তি উচ্ছেদ করতে চায়।’ আরেকটি বিষয়ও এখানে উল্লেখ করার মতো। সম্প্রতি কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় কিছু রিপোর্ট এসেছে। বলা হচ্ছে, বস্তিটি উঠিয়ে দিয়ে সেখানে গড়ে তোলা হবে ‘তথ্যপ্রযুক্তি গ্রাম’। কাগজপত্রে এর নাম হবে ‘মহাখালী আইটি ভিলেজ’। (সূত্র : বাংলাদেশ টুডে, ২৬ নভেম্বর ’১৭) সরকার বলছে তারা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেবে, পুনর্বাসন করবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে ইত্যাদি। এর আগেও যখন আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর কিংবা মিরপুরে বস্তি উচ্ছেদ করা হয়, তখন তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য এ ধরনের কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ এলাকাতেই পুনর্বাসন কার্যক্রম খুব সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে। কড়াইলের ক্ষেত্রেও একই পরিণতি হবে, এটা সহজেই বলা যায়।
আজ ঢাকাকে আধুনিক নগরীতে পরিণত করতে চায় সরকার। কিন্তু এই আধুনিকতা কার স্বার্থে? কাদের স্বার্থে গরীব মানুষদের একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই সরকার উচ্ছেদ করতে চাইছে? পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায় সরকারের এই পরিকল্পনা দেশের মুষ্টিমেয় বড়লোকদের জন্য। আইটি ভিলেজ তো বড়লোকদের জন্য দরকার। তারা কাড়ি কাড়ি টাকা বিনিয়োগ করবে, প্রযুক্তির ব্যবসা করবে। এজন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে বসবে কি না, তা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র ভাবনার সময় নেই। একইভাবে কড়াইল বস্তি উচ্ছেদ করে গুলশান লেকের নয়নাভিরাম দৃশ্য তৈরি করতে পারলে তা তো বড়লোকদের জন্যই উপভোগের ব্যাপার হবে। আমরা বুঝতে পারি এদেরই স্বার্থে রাতের অন্ধকারে বারে বারে আগুনের লেলিহান শিখা বস্তির বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, সেখানকার মানুষদের সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে।
আজ এ কথা বোঝার সময় এসেছে, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামাত এরা কেউই গরীব মানুষদের দল নয়। এদের প্রত্যেকের চরিত্র এক। এরা যখন যারা ক্ষমতায় ছিল, প্রত্যেকে গরীব-অসহায় মানুষদের বঞ্চিত করে বড়লোকদের সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলায় সহযোগিতা করেছে। আজ কড়াইলের বস্তি উচ্ছেদের ঘটনার সাথেও একই উদ্দেশ্য জড়িত। তাই সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধ হবার। একসাথে লড়াইয়ে নামার।
কড়াইল বস্তির ছেলে-মেয়েরা শহীদ রুমি স্মৃতি পাঠাগারকে যেভাবে রক্ষা করেছে, তা একটি প্রতীকী ব্যাপারও। তাদের এই চেষ্টা বলে গেল, একইভাবে শাসকদের লোভের আগুন থেকে বাঁচতে হলে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করতে হবে। এখান থেকে পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। কেননা এ লড়াই বাঁচার লড়াই, স্বপ্নগুলোকে জীবন্ত রাখার লড়াই।