২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমিয়ে কৃষি-শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ জনকল্যাণমূলক খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবিতে কেন্দ্র ঘোষিত দেশব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)-এর উদ্যোগে ৩ জুন সকাল সাড়ে ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সড়কে সমাবেশ ও পরবর্তীতে মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন দলের কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটির সদস্য আলমগীরহোসেন দুলাল, মানস নন্দী, জহিরুল ইসলাম, ফখরুদ্দিন কবির আতিক। মিছিল শেষে একটি প্রতিনিধি দল অর্থমন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি পেশ করেন। অর্থমন্ত্রীর পক্ষ থেকে স্মারকলিপি গ্রহণ করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা খলিলুর রহমান।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, “আগামীতে যে (প্রায়) ৪ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণীত হবে, তাতে বর্তমান অর্থবছরের চেয়ে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা আরো ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি ধরা হয়েছে। বিগত কয়েকবছরের বাজেট বিবেচনায় দেখা যাবে, প্রতিবারই ট্যাক্সের আওতা ও পরিধি বেড়েছে আর সাধারণ জনগণের ওপর ব্যয়ের বোঝা চেপেছে। এমনিতেই দ্রব্যমূল্য, জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণের প্রকৃত আয়কমেছে। কেবলমাত্র চালের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ৫ লক্ষ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে গেছে। ওএমএস-এর যে চাল অল্পসংখ্যক মানুষ ১০ টাকায় কিনতে পারত, তা এখন ৩০ টাকা। অথচ উৎপাদক কৃষক এবারও দাম পায়নি।ফসল ফলানোর সময় উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, বিক্রির কালে উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে বিক্রি করে কৃষক হারাচ্ছে তার সম্বল। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যরা রেশন সুবিধা ভোগ করেন, অথচ বছরের অর্ধেকের বেশি সময় কর্মহীনকৃষকের জন্য রেশনের ব্যবস্থা নেই। শ্রমিকের নেই বাঁচার মত মজুরি। গার্মেন্টস থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ৮১ ভাগ অর্জিত হলেও শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি মাত্র ৫৩০০ টাকা। অথচ গার্মেন্টস মালিকরা কর ছাড়, নগদ সহায়তাসহনানা সুবিধা পেয়েছে। এ অর্থবছরেও বিজিএমইএ-র পক্ষ থেকে কর তুলে দেয়ার দাবি করা হয়েছে।”
নেতৃবৃন্দ বলেন, “আমাদের দেশে GDP-র ৬ ভাগ বরাদ্দের দাবি শিক্ষানুরাগী মহলের পক্ষ থেকে তোলা হলেও সরকারের বরাদ্দ ২-এর কোঠায় সীমাবদ্ধ। এটি বাস্তবে প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে সর্বনি¤œ এবং ১৬১টি দেশেরমধ্যে ১৫৫তম। সরকারি দায়িত্ব অস্বীকার করতে করতে সর্বস্তরে এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই শিক্ষার প্রধান ধারা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অবকাঠামোগত আয়োজনের যেমন ঘাটতি, পাশাপাশি শিক্ষকের সংখ্যাও অপ্রতুল।নন-এমপিও শিক্ষকরা ১০-১৫ বছর যাবৎ বেতন ছাড়াই শিক্ষকতা করছেন। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল এমন দাঁড়িয়েছে, ব্যয় মেটাতে গিয়ে বছরে দরিদ্র হচ্ছেন ৬৪ লাখ মানুষ। বহু সংখ্যক সরকারি হাসপাতাল নির্মাণকরে চিকিৎসা সেবা রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে আনার উদ্যোগ নেই বললেই চলে।”
তারা বলেন, “ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সুপরিকল্পিত উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সরকারি পরিসংখ্যানে কম দেখানো হলেও বেকারের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৮০ লাখ (বেসরকারি হিসেবে)। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় সাড়ে ৩লক্ষ শূণ্য পদে কোনো নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরির উদ্যোগ দেখা নেই। যোগাযোগ-পরিবহন খাতে রেল পথের বিকাশ ও রেলের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হলে, গণপরিবহন বৃদ্ধি ও বেসরকারিপরিবহন সীমিত করে আনলে মানুষের সময়, অর্থ ও শ্রম বাঁচতে পারে। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে নদী ও খাল দখলকারীদের উচ্ছেদ করে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।”
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, “জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি তুললেই টাকার অভাবের কথা বলা হয়। অথচ, বারবার রিশিডিউল করেও সোয়া লক্ষ কোটি টাকা এখন খেলাপী ঋণ। ১০ বছরে ৬ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশেপাচার হয়েছে। ৭ বছরে ব্যাংকগুলো থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। ব্যাংক বাঁচাতে রাষ্ট্রীয় বাজেট থেকে প্রতিবারই নগদ সহায়তা দেয়া হয়। এ অর্থবছরে দেয়া হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। আবার অবকাঠামো খাতেবরাদ্দের টাকা কীভাবে বেহাত হয় তা ফ্লাইওভার, পদ্মাসেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাজেটের উত্তরোত্তর কয়েকগুণ বৃদ্ধি থেকেই বোঝা যায়। ইউরোপের চেয়েও ২/৩ গুণ বেশি খরচে রাস্তা নির্মিত হচ্ছে। অর্থমন্ত্রীনিজেও বলেছেন, ‘মেগা প্রকল্প মানে মেগা লুটপাট’। শূন্য গ্যাসক্ষেত্র খুঁড়ে ২৩০ কোটি টাকা লোপাটের খবর কয়েকদিন আগে প্রকাশ পেয়েছে। এ অর্থ বছরের প্রথম ৯ মাসে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা বা এডিপির মাত্র ৪৫ ভাগব্যয়িত হয়েছে। বাকী ৩ মাসে ৫৫ ভাগ ব্যয় কীভাবে করা সম্ভব? মে-জুনের মধ্যে বাজেটের টাকা শেষ করার জন্য তাড়াহুড়োয় নিম্ন মানের কাজ হচ্ছে। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছেন — এবারও বাজেটে কালো টাকা সাদা করারসুযোগ থাকছে। দুর্নীতির টাকা উদ্ধার না করে টাকার অভাবের কথা বলা, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির মূল্যবৃদ্ধিসহ নিত্যনতুন ট্যাক্স আরোপ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”
অর্থমন্ত্রী বরাবরে প্রদত্ত স্মারকলিপিতে দাবি জানানো হয় – কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি ও খোদ কৃষকের হাতে তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন ও পর্যাপ্ত হিমাগার স্থাপন করতে হবে। ভূমিহীন ও প্রান্তিককৃষকদের জন্য শস্যবীমা, কৃষিবীমা, প্রাকৃতিক দুর্যোগবীমা চালু করতে হবে। বাণিজ্য ও পণ্য বাজারজাতকরণে মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সংস্থা টিসিবি-কে সক্রিয় করতে হবে। কর্মসংস্থানসহ ন্যায্য মজুরিরসুনির্দিষ্ট নিশ্চয়তা দিতে হবে। শক্তিশালী সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত গড়ে তোলার লক্ষ্যে হাসপাতাল নির্মাণ, চিকিৎসক নিয়োগে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে জিডিপি-র অন্তত ৬ ভাগ শিক্ষা খাতেবরাদ্দ করতে হবে।