Wednesday, November 20, 2024
Homeবিশেষ নিবন্ধবাণিজ্যিকীকরণের অক্টোপাসে আক্রান্ত স্কুল শিক্ষা

বাণিজ্যিকীকরণের অক্টোপাসে আক্রান্ত স্কুল শিক্ষা

Education is a rightসরকারি বাগাড়ম্বর বনাম মাধ্যমিক শিক্ষার বেহাল দশা

বাংলাদেশের স্কুল শিক্ষায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে বলে হৈ চৈ তুলেছে একদল সরকারি বুদ্ধিজীবী। কিছু পাবলিক পরীক্ষার প্রবর্তন, পরীক্ষার নাম পরিবর্তন, কাগুজে আইন করেই শিক্ষাক্ষেত্রে সফল মন্ত্রীর তালিকায় এসেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম। বছরের শুরুতে অবশ্য বই দিতে পারার সফলতা সরকারের প্রাপ্য। যেখানে  চার দলীয় জোট আমলে টাকা দিয়ে বই পাওয়া নিয়ে সীমাহীন ভোগান্তি সহ্য করত শিক্ষার্থীরা। তখন থেকেই দেশের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবি ছিল স্কুল পর্যায়ে বিনামূল্যে বই দিতে হবে। সে সময় এ দাবিকে অনেকেই  অকল্পনীয় মনে করলেও আজ প্রমাণিত হয়েছে সেটা সম্ভব। দয়া হলে বা নির্বাচনী জনপ্রিয়তার জন্য জনগণের কিছু অধিকার তারা পূরণও করে। কিন্তু দয়া দাক্ষিণ্যের মনোভাব থেকে বেরিয়ে আত্মমর্যাদাবান জাতি গড়ে তোলার দৃষ্টিতে দেখলে প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। তাই শুধু বই কেন, শিক্ষার যাবতীয় খরচ তো রাষ্টকেই বহন করা উচিত।
কিন্তু আজ দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার অবস্থা কী? তীব্র শিক্ষক সংকট, বেসরকারি স্কুলগুলোর লাগামহীন ফি বৃদ্ধি, শিক্ষকদের চরম দারিদ্র্য, প্রশিক্ষণহীনতা, নতুন পদ্ধতির সাথে ছাত্র-অভিভাবকদের অস্পষ্টতা, লাইব্রেরি-ল্যাবরেটরিসহ অন্যান্য আয়োজন না থাকা, আরও শত সমস্যায় জর্জরিত। আর এসব সমস্যার উপজাত হিসেবে আসছে গাইড বই আর কোচিং বাণিজ্য, বাণিজ্যিক স্কুল। বাড়ছে অভিভাবকদের খরচের বোঝা, আর শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে পড়ছে নিুবিত্ত গরীব ঘরের ছাত্ররা। কিন্তু পাশের হার প্রতি বছর বাড়ছে, বাড়ছে জিপিএ পাওয়া ছাত্রের সংখ্যাও। কিন্তু এটা কতটুকু সরকারের কৃতিত্ব, আর কতটুকু ছাত্র অভিভাবকদের প্রাণান্ত লড়াই- সেটা ছাত্র-অভিভাবকরা প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝেন। তবে সফল মন্ত্রীত্বে বাহবা কুড়ানোর জন্য উদার হস্তে উত্তরপত্রের মূল্যায়নের কৃতিত্ব অবশ্য সরকার নিতে পারে। কিন্তু এতে শিক্ষার মানের কী দশা? গত চার বছরে স্কুলসমূহে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকে স্কুল শিক্ষার সাফল্যের সরকারি খতিয়ান আর বাস্তব চিত্র আমরা নিচে কিছুটা পেতে পারি।

সৃজনশীল প্রশ্ন চালু ; ৫ বছরের অভিজ্ঞতা
মুখস্থ বিদ্যাই ছিল একসময়ে পরীক্ষা পাসের সহায়ক। বুঝে হোক আর না বুঝে হোক মুখস্থ বিদ্যার জন্য ছাত্রদের দ্বারস্থ হতে হত গাইড বইয়ের উপর কিংবা গৃহ শিক্ষক বা কোচিং সেন্টারের নোটের উপর। তাই মুখস্থ বিদ্যা, গাইড বই এবং কোচিং এর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করা হল।
আশা করা হল, এখন থেকে মুখস্থ বিদ্যা, গাইড, কোচিং আর থাকবে না। কল্পনা আর  মেধাকে কাজে লাগানোর অপূর্ব সুযোগ যেন এসে গেল। সৃজনশীল পদ্ধতি চালুু হওয়ার পর থেকে বাড়তে থাকল বছর বছর জিপিএ ৫ এর সংখ্যা আর পাসের হার। রেকর্ড সংখ্যক পাশের সাফল্যের মূল কারণ হিসেবে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির কথা প্রচার করতে থাকল সরকার ও তার অনুগতরা। সরকার যতই উন্নতির ঢাক বাজাক আসলে বাস্তব অবস্থা কি?
২০১০ সালে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নের নাম পাল্টিয়ে স্কুল পর্যায়ে এসএসসি পরীক্ষায় বাংলা প্রথম পত্র এবং ধর্মশিক্ষা বিষয়ে প্রথমবারের মত সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করা হয়। প্রবর্তনের ৪ বছর পর  সম্প্রতি সরকারের পক্ষে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউমি) সারা দেশে সৃজনশীল পদ্ধতির উপর গবেষণার প্রতিবেদন প্রদান করে। ‘একাডেমিক সুপারভিশন’ নামের এই অনুসন্ধানে দেখা গেছে ৫৫ ভাগ স্কুলের শিক্ষক এ পদ্ধতির প্রশ্ন করতে সক্ষম। এই পদ্ধতিতে একেবারেই প্রশ্ন করতে পারে না ১৭ ভাগ শিক্ষক। বাকি ২৭ ভাগ মাঝামাঝি পর্যায়ের। অর্থাৎ এই সব প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর প্রশ্ন করতে পারে আর কিছু প্রশ্ন অন্য বিদ্যালয় থেকে সংগ্রহ বা  কিনে এনে পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। প্রকৃত পক্ষে অবস্থা আরো হতাশাজনক। চলতি বছর সরকার গণিত বিষয়টিকেও সৃজনশীল পদ্ধতির অধীনে আনে। শুরুতেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এর বিরোধিতা করে। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে শিক্ষকদেরও কোন ধারণা দেয়া হয়নি। পরে দেখা গেল অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৮০ ভাগ ছাত্রছাত্রী ফেল করেছে। সারাদেশে সবচেয়ে উচ্চশিক্ষিত দক্ষ, যোগ্য ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছেন রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। সেখানে যদি এই দশা হয় তাহলে সারা দেশের চিত্র কি তা সহজেই অনুমেয়। পরবর্তীতে উদারভাবে খাতা মূল্যায়ন করার ছাত্র নির্দেশনা দেয়া হলেও এবছর বার্ষিক পরীক্ষায় ব্যাপক সংখ্যাক গণিতে ফেল করেছে।

কোচিং, গৃহশিক্ষক, গাইড বইই যেন ভরসা
সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পর শিক্ষার্থীরা টেক্সট বইয়ের পরিবর্তে উল্টো গাইড বই নির্ভর হয়ে পড়ছে ক্লাস শুরুর দুই এক মাসের মধ্যেই। সৃজনশীল চালু হওয়ার পর স্কুল ছাত্ররা কোচিং, গৃহশিক্ষক, গাইডের উপর কিভাবে নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয় তা বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া হলÑ ৬ষ্ঠ শ্রেণীর বিজ্ঞানের একটি সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা। অধ্যায়ের নাম উদ্ভিদ ও প্রাণী কোষীয় সংগঠন।
সৃজনশীল প্রশ্ন ১: দীপ্তি বাবার সাথে ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে যায়। গার্ডেনে সে বিভিন্ন বর্ণের গাছপালা দেখতে পায়। পরবর্তীতে সে পার্শ্ববর্তী চিড়িয়াখানায় যায়। সেখানেও সে বিভিন্ন প্রাণী দেখতে পায়।
এ অংশের নাম দেয়া হয়েছে উদ্দীপক। তারপর প্রশ্ন করা হয়েছে
(ক) নিউক্লিয়াস কি?
(খ) কোষের শক্তি উৎপাদনের কেন্দ্র কোনটি?  ব্যাখ্যা কর।
(গ) দীপ্তির পর্যবেক্ষণকৃত উদ্ভিদগুলো বিভিন্ন বর্ণ ধারণ করার কারণ কি? ব্যাখ্যা কর।
(ঘ) দীপ্তির দেখা জীবগুলোর কোষীয় বৈশিষ্ট্যের তুলনা কর।

এই হলো একটি সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা। ছকে বাঁধা এবং উল্লেখিত উদ্দীপক ছাড়া আগেকার বর্ণনার সাথে এ প্রশ্নের মিল কোথায় তা বোঝা মুশকিল।
এ প্রশ্নগুলোর প্রথমটির (ক) নাম দেয়া হয়েছে জ্ঞানমূলক। দ্বিতীয়টির (খ) নাম দেয়া হয়েছে অনুধাবন মূলক। তৃতীয়টির (গ) নাম দেয়া হয়েছে প্রয়োগমূলক। চতুর্থটির (ঘ) নাম দেয়া হয়েছে উচ্চতর দক্ষতা স্তর। এখানে অনুধাবন মূলক (খ) প্রশ্নটির উত্তর শুধু উদ্দীপক নয়, বই থেকে জানা সম্ভব নয়। কোষের শক্তি উৎপাদনের কেন্দ্রের নাম বা এ সংক্রান্ত কোন তথ্য এ অধ্যায় তো বটেই বইয়ের কোথাও নেই। তাহলে শিক্ষার্থীরা এর জবাব কিভাবে দেবে? ফলে শিক্ষার্থীদের এর জবাব খুঁজতে গাইডের সহযোগিতা নিতে হবে। অন্যদিকে স্কুলে এ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত ধারণা না পাওয়ায় আরও বিশদ বোঝার জন্য কোচিং এর শরণাপন্ন  হতে হয়। অধিকাংশ ছাত্র আগে যেখানে বিজ্ঞান, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে কোচিং করত এখন বাংলা বা সমাজবিজ্ঞান এর মতো বিষয়গুলোর জন্য তাকে কোচিং এ যেতে হচ্ছে। কারণ স্কুলগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই বা তারা সব বিষয়ে ধারণা দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত ক্লাস নিতে পারেন না। ফলে স্কুল এবং স্কুলের বাইরে কোচিং ব্যবসা বেশ রমরমা। এ ক্ষেত্রে সরকারের কোচিং নীতিমালা স্কুলে কোচিং ব্যবসাকে একেবারে বৈধ করে দিয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে সব স্কুলগুলোতে দুর্বল শিক্ষার্থীদের পরিবর্তে সকলকে কোচিং করানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে শারীরিক শিক্ষার মতো বিষয়গুলোরও কোচিং করতে হয়। অভিভাবকদের গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।
আর আগে যেখানে একটি কোম্পানির গাইড কিনলে চলত, এখন বেশি বেশি উদ্দীপক পেতে একাধিক গাইড কিনতে হয়। গাইড কেবল শিক্ষার্থীরা কিনছে তা নয় শিক্ষকরা পর্যন্ত ক্লাসে গাইড পড়ে পাঠ দান করছেন। এ প্রসঙ্গে শিক্ষক প্রশিক্ষক শাহবাজ রিয়াজ বলেছেন, ‘পাঠ্য পুস্তকে সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা দেয়া থাকে দু একটি করে। অন্যদিকে গাইড বইগুলোতে নমুনা প্রশ্ন ও উত্তর দেয়া থাকে অসংখ্য। ভালো ফলাফলের আশায় শিক্ষার্থী, অভিভাবক এমনকি কাজের চাপে ক্লান্ত শিক্ষক সবাই গাইডমুখী হয়ে পড়েছে। প্রায় সব শিক্ষকই বাজারে প্রচলিত গাইড বইগুলোতে যে নমুনা দেয়া থাকে এবং পাবলিক পরীক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ে যে প্রশ্নগুলো দেয়া হয় তা অনুসরণ করে শুধু নাম পাল্টিয়ে প্রশ্ন করেন। যার কারণে সৃজনশীল প্রশ্নই এখন গতানুগতিক হয়ে গিয়েছে।’ (সমকাল ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪)

এ বছরে এসএসসি ফল প্রকাশের সাফল্য প্রচার করতে গিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ফাহিমা খাতুন বলেছেন, ‘নোট বই না কিনে বিনামূল্যে দেওয়া সরকারের বই পড়লে ভাল নাম্বার পাওয়া যায় এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।’ ফাহিমা খাতুন সৃজনশীল পদ্ধতির সফলতার ইঙ্গিত দিয়ে একথা বলেন। কিন্তু এ ধারণা ঠিক কাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? অভিভাবক, শিক্ষক নাকি তার মত প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাছে তা স্পষ্ট হয়নি। বাস্তবে সরকার ৮০০-৯০০ টাকার বই বিনামূল্যে দিলেও এখন একজন ছাত্রকে ১৫০০-১৭০০ টাকা শুধু গাইড বই কিনতে খরচ করতে হয়।

সৃজনশীল পদ্ধতি কী?
বর্তমান সৃজনশীল চালুর আগে নামটা কাঠামোবদ্ধ হওয়ার কথা ছিল। সেটাই সৃজনশীল নামে হল। মূলত একজন শিক্ষার্খীর মেধা যাচাই মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে করা যায় না। যথার্থভাবে তার মেধার পরিমাপ করা যায় এমন পদ্ধতি কাম্য। বিশ্বব্যাপী প্রকৃত মেধা যাচাইয়ের পদ্ধতি অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। শিক্ষা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে গ্লুমস টেক্সনোমি। ৫০ এর দশকের প্রথমার্ধে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেঞ্জামিন এস গ্লুমের নেতৃত্বে একদল গবেষক এ পদ্ধতি চালু করেন। যেখানে শিক্ষার্থীর মেধার প্রধান তিনটি বিষয় দেখা হয় যা হল জ্ঞানমূলক, অনুভূতিমূলক এবং মনস্তাত্বিক। জ্ঞানমূলকের আবার ৬টি বিষয় আছে। জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষন, মূল্যায়ন। এসব বিষয়ের সংযোগ ঘটিয়ে কোন প্রশ্ন তৈরি করলে সেটাই হবে আদর্শ প্রশ্ন। আমাদের দেশে যে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু আছে উপরোক্ত বিষয়গুলোর তিনটি দেখা হয়। জ্ঞান স্তর, অনুধাবন স্তর এবং প্রয়োগ স্তর। তাই বলা যায় আমাদের পদ্ধতি পুরোপুরি সৃজনশীল হয়নি তবুও যতটুকু হয়েছে সেটাকেও কার্যকর করার জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তার পরিপূরক হিসেবে ঢেলে সাজানো হয়নি। পুরোনো অবকাঠামো আর দুর্বল ভিত্তির উপর ৮ তলা বিল্ডিং করে বাইরে রং লাগিয়ে কাজ চালালে যেমন রানা প্লাজার মতো মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড হয়, এক্ষেত্রেও শুধু আধুনিক পদ্ধতির কথা বলে এর ভেতরটা সমাধানে হাত না দিলে স্কুলের প্রাণসত্ত্বাকে হত্যা করা হবে।

প্রশিক্ষণ নেই , শিক্ষক স্বল্পতা, অপ্রতুল আয়োজন
স্কুলগুলোতে চলছে ভয়াবহ শিক্ষক স্বল্পতা। পত্রিকায় এসেছে ৩২৩টি সরকারি স্কুলে ২১৩টিতেই প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। আবার ১৫৩২টি সহকারি শিক্ষকের পদ ফাঁকা পড়ে আছে। ফলে শিক্ষা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া জয়হরি স্প্রাই সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, জীব বিজ্ঞান, ভূগোল ও হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে একটি করে পদ থাকলেও কোন শিক্ষক নেই। ভৌত বিজ্ঞানে দু’জন শিক্ষকের জায়গায় আছেন একজন। সমাজ বিজ্ঞানেও একই অবস্থা। সেই একমাত্র শিক্ষকও প্রশিক্ষণে আছেন। আর বাংলার তিনজন শিক্ষকের জায়গায় আছেন মাত্র একজন। (প্রথম আলো-১৪ ফেব্রুয়ারি’১৪) সরকারি স্কুলগুলোর যখন এ অবস্থা, তাহলে বুঝতে বাকি থাকে না গ্রাম বা মফস্বলের স্কুলগুলোর পরিস্থিতি কী? ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষকের সংকট প্রায় প্রতিটি স্কুলে। সরকার শিক্ষানীতিতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ৩০:১ এর কথা বলছে। কিন্তু স্কুলগুলোতে এক সেকশনের জন্য বিষয়ভিত্তিক একজনের বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার নীতি নেই। ফলে দেখা যাচ্ছে একজন শিক্ষককেই একাধিক বিষয়ের উপর ছয়টি শ্রেণীতে ক্ষেত্র বিশেষে ৮ ঘন্টা করে ক্লাস নিতে হয়। এ অবস্থায় ৪৫ মিনিট সময়ে একজন শিক্ষকের পক্ষে ক্লাস ভর্তি শিক্ষার্থীদের  মধ্যে চিন্তা, বুদ্ধি আর কল্পনা শক্তির প্রয়োগকে উৎসাহিত করা কী আদৌ সম্ভব? আর একজন শিক্ষককে সৃজনশীলতা দিয়ে পড়ানোর যে প্রস্তুতি তাও তিনি পাবেন কি করে। ফলে প্রাইভেট বা কোচিংই যেন শেষ ভরসা।
সৃজনশীল পদ্ধতি কার্যকরের আর একটা বড় দিক হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আনুষঙ্গিক আয়োজন। আয়োজনের অপ্রতুলতার কারণে বিজ্ঞান শিক্ষার ছাত্র কমছে দিন-দিন। বিজ্ঞানাগার এবং বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের চরম সংকট স্কুলগুলোতে। ২০১২ সালে ‘সেভ দ্য চিলড্রেনের’ অর্থায়নে পরিচালিত ‘চাইল্ড পার্লামেন্ট’ দেশের ৬৪ জেলায় এক জরিপ পরিচালনা করে। এতে ২৪২ জন শিক্ষার্থী এবং ২০৩ জন অভিভাবক অংশ নেন। জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৬১.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছে তাদের ব্যবহারিক ক্লাশ হয় না। ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছে বিজ্ঞানাগারের জন্য তাদের অতিরিক্ত ফি দিতে হয়। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজ্ঞানাগার না থাকা এবং ব্যবহারিক ক্লাস না হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অবস্থায় সৃজনশীলতার সফলতা কীভাবে আশা করা যাবে? এছাড়া স্কুলের লাইব্রেরিগুলোও প্রায় প্রত্যেক স্কুলে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। নেই কোন সাংস্কৃতিক আয়োজন ও ললিত কলা শিক্ষা। এসব আয়োজন না করে শুধু প্রশ্ন পদ্ধতি পাল্টিয়ে আর পাশের হার বাড়িয়ে যারা হাততালি পেতে চায় তাদের প্রতারক ছাড়া আর কি বলা যায়?
খরচ বাড়ছে অভিভাবকের, বাণিজ্যের কবলে স্কুল শিক্ষা
মাধ্যমিক শিক্ষা ক্রমাগত ব্যয় বহুল হয়ে উঠেছে। বছর বছর বেতন-ফি বৃদ্ধি, যাতায়াত ভাড়া, কোচিং ফি, শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃৃদ্ধি ইত্যাদি স্কুল শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে রেখেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান চট্টগ্রাম শহরের ১৪টি ভাল মানের স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন- একজন অভিভাবক তার সন্তানের স্কুল শিক্ষার জন্য গড়ে মাসিক ৬,০৮৪ টাকা খরচ করেন। এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত আছে টিফিন ও যাতায়াতের মতো দৈনিক খরচ, কোচিং, খাতা-কলম, বেতনের মতো মাসিক খরচ, অন্যান্য ফি এবং ড্রেস, ব্যাগ, জুতা-স্যান্ডেলের মতো এক কালীন বার্ষিক খরচ। সবচেয়ে বড় খরচ কোচিং। যা মোট খরচের ৩৯%। নিুবিত্ত পরিবারের ১০ ভাগ শিক্ষার্থী খরচ সাশ্রয় করে এসব স্কুলে টিকে থাকে।
অন্যদিকে প্রতিবছর ভর্তির মৌসুমে ফি নিয়ে চলছে নৈরাজ্য। সরকার ভর্তি ফি সংক্রান্ত নীতিমালা ঘোষণা করেছে। মফস্বল এলাকায় যেমন চার্জসহ ভর্তি ফি সর্ব-সাকুল্যে ৫০০ টাকা, পৌর (উপজেলা) এলাকায় ১ হাজার টাকা, পৌর (জেলা) এলাকায় ২ হাজার টাকা, ঢাকা ছাড়া অন্যান্য মহানগরে ৩ হাজার টাকা এবং ঢাকা মহানগরে ৫ হাজার টাকার বেশি হবে না। এ পরিমাণ  টাকাও সাধারণ মানুষের জন্য বেশি। কিন্তু তারপরও ভর্তির ক্ষেত্রে এ নীতিমালা কেউ মানছে না। সরেজমিনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখা যায়, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গড়ে উঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ফি ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর বার্ষিক পরীক্ষায় পাস করার পরও পুন:ভর্তি নামে টাকা নেওয়ার সংস্কৃতি অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়মে পরিণত হয়েছে। এর বাইরে নামে বেনামে রশিদবিহীন ফি তো আছেই। আবার স্কুলে কোচিং নামে বাধ্যতামূলক ফি আদায় করা হচ্ছে। এর সাথে এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের সময় অতিরিক্ত ফি আদায়তো আছেই। এসব কারণে গরীব নিুবিত্ত পরিবারের সন্তানদের শিক্ষাজীবন হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। অন্যদিকে সন্তানের পড়ালেখার মান নিশ্চিত করতে গিয়ে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস চরম হয়ে উঠেছে।
সৃজনশীল পদ্ধতির দুর্বলতা এবং স্কুল শিক্ষার সংকট দূর করতে হলে চাই শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ। এর সাথে যুক্ত সরকারের শিক্ষা সর্ম্পকিত নীতিমালা। শিক্ষা বাজেট না বাড়িয়ে যত নতুন সিস্টেমই চাল করুক, তাতে ভাল ফল হবে না। শিক্ষকদের  জীবনযাত্রার মান এতই মানবেতর যে, বেতন না বাড়িয়ে তাদের কাজ থেকে সৃজনশীলতা আশা করাটা অন্যায়। কিন্তু সরকার সে পথে যাবে না। অন্যদিকে এই ঊর্দ্ধগতির বাজারে টিকে থাকার জন্য শিক্ষকেরা নিত্যনতুনভাবে ছাত্রবেতন বাড়ানোকে সমর্থন না দিয়ে পারছেন না। ফলে সেই গর্বের ছাত্র-শিক্ষক মূল্যবোধের সম্পর্কও আজ ক্রেতা বিক্রেতার দরকষাকষির জায়গায় নামিয়ে আনা হয়েছে। সরকার যতই স্কুল শিক্ষার সাফল্য প্রচার করুক আজ এটাইতো নিমর্ম বাস্তবতা। তাই সরকারের উচিত বাগাড়ম্বতা পরিহার করে মুনাফাবৃত্তির হাত থেকে স্কুলের বেহাল দশা ঘুচানো। আর ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সমাজের স্কুল শিক্ষাকে বাঁচানোর দাবিতে সংগঠিত হওয়া ছাড়া এই মূহুর্তে ভিন্ন কোন পথ নেই।

 অনুশীলন : সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট মুখপত্র

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments