Saturday, November 23, 2024
Homeফিচারবামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পথ দেখাতে পারে - মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পথ দেখাতে পারে – মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

নভেম্বর বিপ্লব বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অসারতা উন্মোচিত করেছে

গত ৭ নভেম্বর ছিল মহান রুশ বিপ্লবের ৯৬তম বার্ষিকী এবং আমাদের দল বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯১৭ সালের এই দিনে রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে মহান নভেম্বর বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। পৃথিবীর বুকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল।

আজকে আমরা যখন দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং নভেম্বর বিপ্লববার্ষিকী উদযাপন করছি তখন আমাদের দেশের বুর্জোয়া ব্যবস্থা গভীর সংকটে নিপতিত। বুর্জোয়াদের সংঘাতে সাধারণ মানুষ জিম্মি। প্রশ্ন হল, আজ এত বছর পরেও আমরা এই রুশ বিপ্লবের কথা স্মরণ করি কেন? রাশিয়ায় আজ সমাজতন্ত্র নেই। মাও-এর লালচীনে নেই। বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতন হয়েছে। আর এই পতনের সময় আমাদের দলের জন্ম। কোন শক্তিবলে আমরা সেদিন সেই ধ্বংসের সময়েও দাঁড়াতে পেরেছিলাম? কোন শক্তিতে ভর করে আজও কমিউনিজমের ঝান্ডা নিয়ে আমরা লড়াই করে যাচ্ছি? সমাজতান্ত্রিক শিবির আজ নেই। কিন্তু গোটা বিশ্বের আজ কি পরিস্থিতি? নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্য বুঝতে হলে আজ সবকিছুকেই পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।

আন্তর্জাতিকভাবে পুঁজিবাদ আজ একটি ব্যর্থ সমাজব্যবস্থা

সারা বিশ্বে পুঁজিবাদ আজ ভয়াবহ সংকটে নিমজ্জিত। সংকট যেন আর কাটতেই চাইছেনা। একটা সংকট মোকাবেলা করে তো পুঁজিবাদ আর একটা সংকটের মধ্যে গিয়ে পড়ে। বড় বড় কোম্পানিগুলো সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তীব্র বাজার সংকট। বাজার দখলের জন্য দুটি বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। ফলে বেকারত্ব, ছাঁটাই, অনাহার লেগেই আছে। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের দেশের সমস্ত উৎপাদনক্ষেত্র বন্ধ করে দিয়ে আমাদের মতো অনুন্নত দেশে তাদের কারখানা স্থাপন করছে। লক্ষ্য হল এদেশের সস্তা শ্রমশক্তি লুট করা। তারা আজ এই সস্তা শ্রমের উপর নির্ভর করে এই মন্দার মধ্যেও সর্বোচ্চ মুনাফা তুলে নিচ্ছে।

সারা বিশ্বের উপর ছড়ি ঘোরানো আমেরিকা আজ দেউলিয়া, বিপর্যস্ত। সেখানে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের সামনে বিক্ষোভ হচ্ছে। সংংগঠিত হয়েছে ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন। মানুষ বলছে, তোমাদের অর্থনীতি ৯৯ ভাগ মানুষকে ঠকিয়ে ১ ভাগের বড়লোক হওয়ার অর্থনীতি। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আমাদের পথে বসিয়েছে। এ আমরা চাই না।

এ কথা কারা বলছে? বলছে খোদ আমেরিকার মানুষ। একই অবস্থা ইউরোপ, আফ্রিকা-সহ গোটা বিশ্বে। গোটা বিশ্বে বিক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। কিছুদিন আগে আরব বিশ্ব ফুঁসে উঠল। দেশে দেশে মানুষের তীব্র বিক্ষোভে রাষ্ট্রযন্ত্র বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। মিশরে সরকারের পতন ঘটল। কিন্তু আজ তার পরিণতি কি? পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে। বেকার মানুষ, অভুক্ত অনাহারী মানুষ, গৃহহীন মানুষ রাস্তায় নামছে। লড়াই করছে। কিন্তু মৌলিক পরিবর্তন হচ্ছে না। মিসরে স্বৈরাচারী মোবারক সরকারের পতন ঘটল, আর এক সরকার আসল। কিন্তু মানুষকে আবারও রাস্তায় নামতে হল। অবস্থার পরিবর্তন হল না। শোষণমুক্ত কাক্সিক্ষত সমাজব্যবস্থা আসল না। আসলে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহাল রেখে কয়েক শত বার সরকার পরিবর্তন করলেও জনগণের কাক্সিক্ষত মুক্তি আসবে না। তাই দরকার সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। আবার দুনিয়া জোড়া অসংগঠিত মানুষ চাইলেই এ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে পারবে না। সেজন্য চাই সঠিক বিপ্লবী পার্টি, যে পার্টি সঠিক বিপ্লবী তত্ত্বের ভিত্তিতে এ বিক্ষোভকে সংগঠিত করে বিপ্লবে রূপদান করবে। নেতৃত্বহীন জনতা বিপ্লব ঘটাতে পারে না, যেটা সোভিয়েত রাশিয়ায় ১৯০৫ সালে প্রমাণিত হয়েছে। সেদিনের বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু রক্ত ঝরেছে অনেক। পরবর্তীতে ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি সেদেশে সফল বিপ্লব সংগঠিত করে। এটা নভেম্বর বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রকৃত চেহারা আজকে আমাদের দেশে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে

গোটা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও সীমাহীন সংকট। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। দফায় দফায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। মধ্যবিত্তরা পরিবার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। নিম্নবিত্তরা তো খেয়ে না খেয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ঠিক করা হয়েছে ৫৩০০ টাকা যা দিয়ে একটা পরিবার দুবেলা শুধু নুন দিয়েও ভাত খেতে পারবে না। শ্রমিকরা দুর্বিসহ জীবনে অসহ্য হয়ে মাঝে মাঝেই রাস্তায় নামছে। পুলিশের মার খাচ্ছে।

আবার গ্রামের কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম নেই। বীজ, সারের দাম বেশি। ফসল বিক্রি করে চাষের খরচই ওঠে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি হলে তো আর কথাই নেই। তাই দলে দলে ক্ষুদ্র কৃষকরা জমি বিক্রি করে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে কাজের আশায়। কিন্তু কাজ দেবে কে? কোনো স্থায়ী শিল্প দেশে গড়ে উঠছে না। গার্মেন্ট তো কোনো স্থায়ী শিল্প নয়। আবার সেখানেও যারা কাজ করে তাদের অবস্থা তো আপনারা খুব ভালো করেই জানেন।

তাই আজ রাস্তা ভর্তি মানুষ। এদের একদিন বাড়িঘর ছিল, জমি-জিরেত ছিল। পুঁজিবাদ আজ তাদের পথের ভিখেরি করেছে। রাস্তায় তারা রাত কাটায়। সোডিয়ামের নিয়ন আলোয় রাতের ঢাকা শহরে স্পষ্ট বোঝা যায় জীবন কত নিষ্ঠুর হতে পারে। তাদের সন্তানরা আজ ২০০/৫০০ টাকায় বিক্রি হয়ে মিছিলে যায়, হরতালে গাড়ি পোড়ায়, ককটেল ছোড়ে। বুর্জোয়ারা তাদের নিঃস্ব করে পথে বসিয়েছে, আবার তাদের পথ থেকে কিনে নিয়ে নিজেদের গোষ্ঠী সংঘাতে কাজে লাগাচ্ছে। এমন নির্মমতা আদিম বর্বর সমাজেও দেখা যায়নি।
এই হল দেশের অবস্থা। অথচ দেখুন, রাষ্ট্র চালায় যে বড় দুই দল ও তাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট-মহাজোট, তারা নিজেদের গদি দখলের রাজনীতিতে চরম সংঘাতময় পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছে। জনগণকে নিঃস্ব করে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধির সুযোগ কে পাবে এ নিয়ে লড়াই শুরু হয়ে গেছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। আর এক্ষেত্রেও বলির পাঁঠা হচ্ছে জনগণ। ঘর থেকে বাইরে বেরুলে প্রাণ নিয়ে ঘরে ফেরা যাবে কিনা তাই দায়।

এই হল তথাকথিত গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা। সারা বিশ্বে যেমন, বাংলাদেশেও তেমন। হয়তো ভিন্ন ভিন্ন রূপে, কিন্তু সব দেশেই তা মানুষের সকল মৌলিক আকাক্সক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ, চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বৈরাচারী। অথচ পুঁজিবাদের শুরুর সময়ে যখন একচেটিয়া পুঁজি আসেনি, তখন বহু ক্ষুদ্র পুঁজিপতির মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্বকে ভিত্তি করে মাল্টি পার্টি ডেমোক্রেসি গড়ে ওঠে। ফলে ওই সময় বুর্জোয়া পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি আজকের তুলনায় অনেক ব্যাপক, উদার ও গণতান্ত্রিক ছিল। যদিও তখনও এই গণতন্ত্র পুঁজিবাদী শোষণমূলক ব্যবস্থার স্বার্থেই কাজ করেছে। কিন্তু আজ সে লাভের জন্য ন্যূনতম মূল্যবোধকেও গলা টিপে ধরছে।

একদিন বুর্জোয়ারাই ধর্মনিরপেক্ষতার শ্লোগান তুলেছিল, আজ তারা ভোটের জন্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তৈরী করছে

সামন্ত সমাজের ধর্মীয় ভেদাভেদ, জাতপাতের বিরুদ্ধে বুর্জোয়ারা একসময়ে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছিল। সেদিন ছিল তার উত্থানের সময়। রাজা-বাদশাদের সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে তখন আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের উৎপত্তি হচ্ছে। সামন্ত ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের পরিবর্তে বৃহৎ আকার শিল্প সৃষ্টি হচ্ছে। কলকারখানায় মানুষ দরকার। জাতপাত-ধর্মের নিগড়ে মানুষ আটকে থাকলে তাকে কারখানায় আনা যাবে না। রাষ্ট্র গঠনে কাজে লাগান যাবে না। তাই সেদিন বুর্জোয়ারাই শ্লোগান তুলেছিল, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। আজ তাদের কি পরিণতি!

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন মানুষ আতঙ্কিত হচ্ছে। কারণ আক্রমণের লক্ষ্য তারাই। একদল তাদের উপর হামলা করে, বাড়িঘর পুড়িয়ে, ভয় দেখিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চাইবে। অপর পক্ষ এই আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরী করে, ধর্ম রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে সংখ্যাগুরুদের ভোট পেতে চাইবে, সংখ্যালঘুদের ভোট নিরঙ্কুশ করতে চাইবে। তাই সাঁথিয়া ও মহেন্দ্রনগরে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিলেও সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। প্রশাসনের কোনো বিকার নেই। কারণ আতঙ্ক তৈরী হলেই তাদের লাভ। এই হচ্ছে তাদের ভোটের রাজনীতি। আর মানুষও এই রাজনীতি বুঝতে না পেরে যারা এর হোতা তাদের উপরই নির্ভর করছে। আমরা তাদের বলছি, এ দু’দলের উপর ভরসা করে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করা যাবে না। হামলাকারীদের চিনতে পারছেন, আর উস্কানীদাতাদের চিনতে পারছেন না? এত অত্যাচারের পরও পারছেন না? তাই সময় থাকতে এদের চরিত্র উন্মোচিত করুন। ভারতেও একই কাণ্ড হচ্ছে। সম্প্রতি উত্তর প্রদেশে দাঙ্গা ঘটে গেল। সেখানেও একই ভাবে বিজেপি ও কংগ্রেস ফায়দা লুটতে চাইছে। দেশে দেশে বুর্জোয়া রাজনীতির নগ্ন রূপ আজ স্পষ্ট।

এদেশের বাম গণতান্ত্রিক শক্তি কোনো কার্যকর গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি

এই অবস্থায় জনগণের পক্ষে দাঁড়াবে কে? লড়াই সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবে কে? আওয়ামী লীগ-বিএনপি কে দিয়ে তো এ আশা করা যায় না। কারণ তাদের দ্বারাই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তারা ও তাদের জোটের শরিকরা দেশের পুঁজিপতিদের পলিটিক্যাল ম্যানেজার। পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করতে তাদের সমস্ত রকম সহযোগিতা নিয়ে এ দলগুলো ক্ষমতায় বসে। ফলে তারা জনগণের স্বার্থ দেখবে না। জনগণের স্বার্থ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই সংগ্রাম করেছে, প্রাণ দিয়েছে যে বামপন্থী শক্তিগুলো, তারাও আজ সঠিক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারছে না। এদেশের বামপন্থী শক্তিসমূহ সবসময়েই দুর্বল। আবার মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে বামপন্থীরা কার্যকর গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। মাওলানা ভাসানীকে কেন্দ্র করে এদেশে সে সম্ভাবনা এসেছিল। কিন্তু তাকে বামপন্থীরা কাজে লাগাতে পারেনি। বাস্তবে এদেশের বামপন্থীরা শ্রেণী সংগ্রাম পরিচালনা, শ্রেণীর বিকাশ ইত্যাদি কখনও বুঝতেই পারেনি। তাই স্বাধীনতার পর আজ অবধি এখানে নাগরিক জীবনের সমস্যা সংকট নিয়ে, কৃষকের দাবি নিয়ে, শ্রমিকের দাবি নিয়ে কোনো দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলন গড়ে তোলা যায় নি। এটা বামপন্থীদের ব্যর্থতা। বামপন্থীদের ব্যর্থতার ক্ষেত্রে আমরা আমাদের দায়মুক্ত মনে করছিনা।

দুনিয়ার কোনো দেশে ধারাবাহিক লাগাতার আন্দোলন সংগ্রাম লড়াই ছাড়া কোনো বামপন্থী শক্তি বিকশিত হতে পারেনি। মানুষের আস্থা-ভরসা অর্জন করতে পারেনি। তা করাও যায় না। অথচ আমাদের দেশের বামপন্থীদের এক অংশ মহাজোটের শরিক হয়ে ক্ষমতার লড়াইয়ের দুর্বল সৈনিক। আর এক অংশ ভোটের রাজনীতির চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। দু’দলের উপর মানুষের বিতৃষ্ণা দেখে বিভিন্ন সময়ের দলছুট বুর্জোয়াসহ অন্যান্য বামপন্থীদের নিয়ে বিকল্প হতে চাইছেন। অর্থাৎ নিরূপায় জনগণ মন্দের ভাল হিসাবে তাদের ভোট দিয়েও দিতে পারে – এই তাদের আশা। সেক্ষেত্রে জনগণের বিবেচনা কি সেটা ভোটের সময় বোঝা যাবে। কিন্তু এই বামপন্থীদের চিন্তাধারা আমাদের মনে কষ্টের উদ্রেক করছে। গণআন্দোলনের কষ্টকর ও ধারাবাহিক পথ এড়িয়ে গিয়ে কোনো দেশেই বামপন্থীরা শক্তি অর্জন করতে পারেনি, এমনকি ভোটের রাজনীতিতেও বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যেতে পারেনি। এ হল ইতিহাসের শিক্ষা।

গণআন্দোলন দূরে যাক, যতটুকু বিক্ষোভ দেশের মানুষের মনে জমা হয়ে আছে তা বেরুবার রাস্তা পর্যন্ত বামপন্থীরা তৈরি করতে পারছে না। এরকম কোনো কর্মসূচি নেই। ঘরে ঘরে ক্যাম্পেইন নেই। এত সংকট চারপাশে – মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িক নির্যাতন – এগুলো নিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করে বামপন্থী শক্তিকে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বলা উচিত ছিল Ñ “আসুন, রাস্তায় নামুন। এ অত্যাচার সহ্য করবেন না। করলে মনুষ্যত্ব থাকবে না।” অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য এই প্রাথমিক কাজ পর্যন্ত বামপন্থীদের দ্বারা হয়নি। বিভিন্ন দলের বিভিন্ন মত থাকবেই, কিন্তু কোনো একটা ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে বামপন্থীরা গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ যারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছেন তাদেরকে যুক্ত করে দীর্ঘদিন প্রচার-প্রচারণা-বিক্ষোভ সংগঠিত করতে পারেনি। তার চেষ্টাও করেনি। কারণ চরম সংকীর্ণতার রাজনীতির কারণে তারা নিজেরাই ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না।

আবার আমাদের বামপন্থী বন্ধুদের মধ্যে সিপিবি-বাসদ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আওয়ামীলীগ-বিএনপির সাথে সংলাপ করছে। সংকট কাদের? সংকট এই বুর্জোয়া ব্যবস্থার। তাদেরই দুই দলের নেতৃত্বে দুই জোট নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে এ সংকট তৈরি করেছে ও জিইয়ে রাখছে। তাদের সৃষ্ট সংকট থেকে উত্তরণের দায়িত¦ কি বামপন্থীরা নিতে পারে? অথচ তারা তাই করছেন। তারা নিজেদের কমিউনিস্ট বলেন, সর্বহারা-শোষিত মানুষের মুক্তির কথা বলেন; অথচ সর্বহারাদের যারা জুলুম করে, নিঃস্ব করে – গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের চরিত্র উন্মোচনের কষ্টকর সংগ্রাম তারা এড়িয়ে যেতে চান। তাই আজ তারা বুর্জোয়াদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মীমাংসার জন্য তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। মীমাংসা কারা করে? যারা দুদলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয় তারাই। বুর্জোয়াদের দ্বন্দ্বের মীমাংসা করার তৃতীয় পক্ষ হিসেবে দুদলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হচ্ছেন যারা আবার তারাই ঐ বুর্জোয়াদের বাইরে বিকল্প শক্তি নির্মাণের, সর্বোপরি তাদেরকে উচ্ছেদের শ্লোগান তুলছেন Ñ এরকম কখনও হয় কি? কথা ও কাজে অমিলের এই রাজনীতি তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তারা ভেবে দেখেছেন কি?

নভেম্বর বিপ্লবের কিছু উল্লেখযোগ্য শিক্ষা

নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শুধু বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এর মধ্য দিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূণর্ শিক্ষাও লেনিন দিয়ে গেছেন। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর রাশিয়ায় বিপ্লবের স্তর নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু তত্ত্বগত বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তখন লেনিন লিখলেন তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘এপ্রিল থিসিস’। সেখানে তিনি দেখান যে, রাশিয়ার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় সামন্ত সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার মতোই আছে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়ারা রাষ্ট্র ক্ষমতা করায়ত্ব করেছে। ফলে সামন্তশ্রেণীর হাত থেকে রাষ্ট্রতক্ষমতা বুর্জোয়াদের হাতে এসেছে। তখনকার সময়ে অন্যান্য কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্কার না থাকায় রাজনৈতিক এ পট পরিবর্তনকে তারা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি। অথচ লেনিন মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি অনুযায়ী বিশ্লেষণ করে বিপ্লবের স্তর সম্পর্কিত এবং শ্রেণীমৈত্রী, শ্রেণীসম্পর্কের ব্যাপারেও নতুন কথা তুললেন। রাষ্ট্র ও বিপ্লব সম্পর্কে মার্কসবাদী জ্ঞানভাণ্ডারে এ এক নতুন ধরনের কনট্রিবিউশন।

মার্কসবাদী আন্দোলনে অথরিটি প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ

মার্কসবাদী রাজনীতিতে অথরিটি ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানে যেমন অথরিটি থাকে তেমনি মার্কসবাদ যেহেতু একটি বিজ্ঞান তাই সেখানেও অথরিটির ধারণা বিদ্যমান। মার্কসবাদী রাজনীতিতে বিপ্লবী দল গঠনের ক্ষেত্রে সাধারণত তিন ধরনের অথরিটির ধারণা আমরা পাই।

প্রথমত; দল পরিচালনা, দলের দৈনন্দিন কার্যক্রম সম্পাদন, দলীয় শৃঙ্খলা কার্যকর রাখা ইত্যাদির জন্য সকল দলেই একজন অথরিটি থাকে। তাকে বলে দলের সাংগঠনিক অথরিটি।

দ্বিতীয়ত; একটা দেশের বুকে বিপ্লবী রাজনীতি তৈরি করার ক্ষেত্রে যে তত্ত্বজ্ঞান অর্থাৎ দেশের ইতিহাস, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, জনগণের চিন্তা-চেতনা, সংস্কৃতি, সাহিত্য সবকিছুকে মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে বিচার-বিশ্লেষণ করে সেই দেশের বিপ্লবী রাজনীতি তৈরি করার ক্ষেত্রে দলের অভ্যন্তরে যৌথজ্ঞানের পরিমণ্ডল তৈরির মধ্য দিয়ে সেই যৌথজ্ঞানের ব্যক্তিকৃত প্রকাশ হিসেবে একজন সেই দেশে, একটি বিশেষ পার্টিতে অথরিটি হিসেবে আবির্ভূত হন।

তৃতীয়ত; আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভিন্ন যুগসন্ধিক্ষণে কারও কারও আবির্ভাব ঘটে যিনি ঐ সময়ে গোটা মার্কসবাদী আন্দোলকে সকল প্রকার বিচ্যুতির হাত থেকে রক্ষা করেন। মার্কসবাদী জ্ঞানভাণ্ডারে নতুন কিছু যুক্ত করেন। গোটা কমিউনিস্ট আন্দোলনকে পথ দেখান। এসব মানুষের আবির্ভাব ঘটে এক একটি যুগসন্ধিক্ষণে। মার্কস-এঙ্গেলসের পর যখন পুঁজিবাদী সমাজ একচেটিয়া পুঁজির স্তরে প্রবেশ করেছে, তখন সেই যুগকে ব্যাখ্যা করা ও সেই সময় সংগ্রামের পথ নির্দেশ করেন লেনিন। তিনি পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর যে সাম্রাজ্যবাদ তা দেখান এবং মার্কসবাদী অর্থনীতিতে মৌলিক সংযোজন ঘটান। আবার লেনিনের শিক্ষাকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা এবং বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে তাঁকে যথার্থভাবে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে স্ট্যালিন বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনে অথরিটি হিসেবে আবির্ভূত হন। মাও সে তুং চীনের মতো একটি আধাসামন্তবাদী, প্রায় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে বিপ্লব ঘটান। পিছিয়ে পড়া একটি দেশে বিপ্লব ঘটানোর মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বের সামনে অনুন্নত দেশে বিপ্লব ঘটানোর এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি শোধনবাদবিরোধী সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশ্ব কমিউনিস্ট অন্দোলনে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মহান সাংস্কৃতিক অন্দোলন তাঁর নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়। এর মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের অথরিটি হিসেবে গণ্য। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে ব্যক্তিবাদের প্রভাব ও সংশোধনবাদের উত্থান সম্পর্কিত বিষয়ে বিশ্লেষণ তুলে ধরে শিবদাস ঘোষ অসামান্য অবদান রাখেন। ব্যক্তিবাদের উত্থান বুর্জোয়া সমাজের ঊষালগ্নেই ঘটেছিল। কিন্তু সেদিনের ব্যক্তিবাদ ছিল সামাজিকভাবে প্রগতিশীল। আর আজ ব্যক্তিবাদ ব্যক্তির সমস্ত রকম সামাজিক দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করছে। সামাজিক কোনো দায়িত্বই আজ সে পালন করতে চাইছেনা। ব্যক্তিবাদের চরম অবক্ষয়ের এ যুগে দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন কীভাবে বিকশিত হবে, দলের ভেতরে ব্যক্তিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই কিরূপ হবে, যৌথতা-যৌথজীবন ইত্যাদি বিষয়ে দিক-নির্দেশনা কমরেড শিবদাষ ঘোষই হাজির করেন এবং এ প্রক্রিয়ায় তিনি লেনিনীয় পার্টি গঠনের নীতিকে উন্নত করেন। এইভাবে কমরেড শিবদাস ঘোষও বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে অথরিটি হিসেবে আবির্ভূত হন।

সমাজতন্ত্র মানুষের ভিতরের বিপুল ঐশ্বর্যকে জাগিয়ে তুলেছিল

আজ এই বন্ধ্যা সমাজের দিকে তাকান। পুঁজিবাদ এ সমাজের কি অবস্থা করেছে। ইতিহাসের দিকে মুখ ফেরালেই দেখা যাবে ১৯১৭ সালের বিপ্লবের আগে রাশিয়ায়ও একই অবস্থায় ছিল। জারের শাসনে নিষ্পেষিত রাশিয়ায় তখন জমিতে চাষ হতো মধ্যযুগীয় প্রথায়। লাঙ্গলগুলো ছিল ঘরের তৈরি, কাঠের। লোহার ফাল পর্যন্ত থাকত না ওগুলোয়। মানুষের মননজগৎ, জীবনযাপনও ছিল ঐ রকম পিছিয়ে পড়া। শুভদিন দেখে বীজ বোনা হত। জমির ঊর্বরতা বজায় রাখার জন্য শোভাযাত্রা করে পবিত্র জল ছিটানো হত। পুরোহিতরা ট্রাক্টরকে বলত শয়তানের কল। চাষীরা ট্রাক্টর দেখলে ঢিল ছুঁড়ত। একেক পরিবারে জমি ছিল ১০-১২ একর। তাও অনেক খণ্ডে বিভক্ত। ১৯৩০-৩৩ সালের মধ্যে এইরকম এককোটি চল্লিশ লক্ষ ক্ষুদ্রাকার অনুন্নত খামার একত্রিত হয়ে দু লক্ষ বড় খামারে পরিণত হল। সেগুলোতে যৌথ মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হল। ট্রাক্টর ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হল। কৃষি উৎপাদনে সারা দেশে একের পর এক রেকর্ড ভাঙা শুরু হল।

একই কাণ্ড হল শিল্পক্ষেত্রে। হাজার হাজার কিলোমিটার রেললাইন পাতা হল। তৈরি হল লৌহ ও ইস্পাত শিল্প, কৃষিযন্ত্র, কেমিক্যালসহ অন্যন্য ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প। বিপ্লবের আগে যার কিছুই রাশিয়ায় ছিল না। শিল্পশ্রমিকের সংখ্যা বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের থেকে দ্বিগুণ বাড়ল। শিল্প উৎপাদনও বহুগুণ বাড়ল।

সেসময় এক অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। দেশের সকল মানুষ তখন সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াকে গড়ে তুলতে মণপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিল। ডনবাসের কয়লাখনি জার্মানির বিখ্যাত ‘রুর’-এর দ্বিগুণ উৎপাদন করল। গোর্কি অটো মোবাইল কারখানা মার্কিন ‘ফোর্ড’-এর উৎপাদন সীমা ছাড়িয়ে গেল। লেনিনগ্রাদের কয়েকজন মুচি চোকোস্লোভাকিয়ার ‘বাটা’র দেড়গুণ বেশি উৎপাদন করল। শুধু তাই নয়, মরুভূমিতে রেললাইন পড়ল। প্রবলস্রোতা নিপার নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হল। কুয়াশাচ্ছন্ন উরাল পর্বতমালাকে শ্রমশিল্পের কেন্দ্র পরিণত করা হল। এরকম আরও শত সহস্র উদাহরণ দেয়া যাবে।

শুধু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সোভিয়েতবাসী এ মহাযজ্ঞ করেনি, তারা ছিল সর্বহারার মহান আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী

এক নতুন মানুষ তৈরির সংগ্রামে নেমেছিল সোভিয়েতবাসী। একেক জন নিজের সর্বোচ্চ কর্মশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্তাখানভ নামের কয়লাখনির এক শ্রমিক উৎপাদনের উন্নততর পথ বের করে ও রেকর্ড সংখ্যক উৎপাদন করে তাক লাগিয়ে দিল। তার নামে একটা আন্দোলন তৈরি হয়ে গেল। মারি দেমচেঙ্কো নামে এক মেয়ে যৌথখামারে চিনি-বিট জন্মাতো। সে ঘোষণা দিয়ে অনাবৃষ্টির মধ্যেও একর প্রতি সর্বোচ্চ বিট ফলিয়ে সাড়া ফেলে দিল। কে কাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে তার প্রতিযোগিতা লেগে গেল। শুধু কাজই নয়, কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা উত্তর মেরু অভিযান করে, সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে পড়ে হৈ চৈ ফেলে দিল। দুনিয়ার তিল পরিমাণ ভূমিও অজেয় থাকবে না – এই ছিল তাদের মনোবল। দুঃসাধ্য সকল কাজ সাধনের জন্য প্রাণ বাজী রাখতে পারত তারা।

যৌবনের শক্তি সেদিন সোভিয়েত রাশিয়া দেখিয়েছে। মানুষের ক্ষমতা সেদিন দুনিয়া প্রত্যক্ষ করেছে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে তাদের মধ্যে মহান সমাজতন্ত্রের চেতনা ও বিশ্বের কোটি কোটি নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পথের সৈনিক – এই দায়িত্ববোধের কারণে। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ দেশপ্রেম দিয়ে আজ আর এই মানুষ তৈরি করতে পারবে না। সেদিন সোভিয়েতের প্রত্যেকটা মানুষ ভাবত, তাদের দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয়ের উপরে সারা পৃথিবীর শোষিত নিপীড়িত মানুষেরা তাকিয়ে আছে। এদের মুক্তি লড়াইয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাই তারা এরকম হতে পেরেছিল। ১০ বছর বয়সীদের একটা স্কুলের বিদায়ী অনুষ্ঠানে তাই সেদিন কিশোর স্নাইনিক বিদায় বক্তৃতায় বলেছিল, “বেঁচে থাকা সুখের – এই রকম একটা দেশে, এই রকম একটা যুগে।”

শ্রমের মর্যাদা এই পুঁজিবাদী সমাজে নেই

কি বিশাল বিপুল কা- হলো রাশিয়ায় – মানুষের শ্রমে। অথচ আমাদের এ পুঁজিবাদী সমাজে জীবনধারণের জন্য বিক্রি করা ছাড়া শ্রমের আর কোনো মূল্য নেই। বেঁচে থাকার জন্য শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য – এই মানসিকতার পরিবর্তে সমাজের অগ্রগতির স্বার্থে স্বেচ্ছায় আনন্দের সাথে পরিশ্রম করার মনোভাবের সমাজতান্ত্রিক সমাজে জন্ম হবে। এখন শ্রমিকরা শ্রম দেয়, তার বেশিরভাগ অংশ মালিকরা আত্মসাৎ করে, তাই শ্রমের আনন্দ এখানে নেই। যখন মহৎ উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য করে শ্রম – শ্রম তখন আনন্দের। এটাই রাশিয়ায় সম্ভব হয়েছিল।
সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পতন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যর্থতাকে প্রমাণ করে না

আধুনিক সংশোধনবাদের কারণে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল। অনেকে এটা দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ব্যর্থ – এই যুক্তি উপস্থাপন করেন। এটা কোনো যুক্তিই নয়। রাশিয়ায় বিপ্লবের পরই লেনিন বলেছিলেন, “মুষ্টিমেয় বৃহৎ বুর্জোয়া মালিকানা উচ্ছেদ করা অপেক্ষাকৃত সহজ, কিন্তু কোটি কোটি সাধারণ মানুষের মধ্যে পুরনো সমাজের ধ্যানধারণা, সংস্কৃতি, অভ্যাস, আচরণ দূর করা খুবই কঠিন।” এজন্য দীর্ঘদিন ধরে আদর্শগত ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম চালাতে হয়। আর এগুলি টিকে থাকলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরেও ব্যক্তিগত লোভলালসা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, মালিকানাবোধ দীর্ঘদিন থাকে। অন্যদিকে এগুলোকে ব্যবহার করে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ ও ক্ষমতাচ্যুত দেশীয় পুঁজিবাদ প্রতিবিপ্লব ঘটাতে পারে। ফলে ক্রমাগত চেতনার বিকাশ ঘটানোর কাজ রাশিয়াতে হয়নি বলে তার এই দশা হয়েছে।

বিষয়টা এমন নয় যে এটা তখন কেউ ধরতে পারেনি। কিংবা বোঝার আগেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ব্যাপারটা মোটেই এরকম নয়। ধীরে ধীরে রাশিয়ায় সংশোধনবাদ বিকশিত হয়েছে, পুঁজিবাদ অনুপ্রবেশ করেছে। অঙ্কুরেই এই উপসর্গ ধরতে পেরে তৎকালীন ভারতের এসইউসিআই-এর সাধারণ সম্পাদক, প্রখ্যাত মার্কসবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে চীনের পার্টিও রাশিয়ার সাথে এ বিষয়ে বিতর্ক করেছে। কিন্তু ব্যক্তিবাদ ও তার উত্থান, সমাজতান্ত্রিক ব্যক্তিবাদ ইত্যাদি কীভাবে দলের অভ্যন্তরে সংশোধনবাদী প্রবণতা উস্কে দেয় এবং ফলশ্রুতিতে গোটা দল ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন ঘটে – এ সম্পর্কিত তাত্ত্বিক মূল্যায়ন সেই সময়ে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনে কমরেড শিবদাস ঘোষই হাজির করেন। বিশ্ব সমাজতন্ত্রের জয়জয়কারের ঐ সময়ে বড় বড় মার্কসবাদী দলের ভীড়ে সঠিক আদর্শ ও চর্চা নিয়ে শুরু করা তাঁর দল খুব বড় ছিল না, এবং তিনিও খুব পরিচিত নেতা ছিলেন না বলে এসব বিষয় সেদিন খুব একটা আলোচনায় আসেনি। সে সময় এই শিক্ষা থেকে সোভিয়েত রাশিয়া নিজেদের শুধরে নিলে আজ হয়তো এই পৃথিবীর চেহারা অন্য রকম হতো।

বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই মানুষকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধারের পথ দেখাতে পারে

সকল রকম দলীয় সংকীর্ণতা পরিত্যাগ করে, জনগনের সমস্যা সংকট নিয়ে সর্বোচ্চ বোঝাপড়া ও ন্যূনতম কর্মসূচি-ভিত্তিক ঐক্যের ভিত্তিতে বামপন্থীদের গণআন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। বিভিন্ন দলের বিভিন্ন মত থাকবেই। সেটা নিয়ে মতবিনিময় হবে, সংগ্রাম হবে। এমনকি আন্দোলনের সময়ও নির্বাচন নিয়ে, কলাকৌশল নিয়ে, সংগ্রামগুলোকে শেষ পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে চাই এবং এর জন্য সংগ্রামগুলোকে কীভাবে গড়ে তুলবো তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকবে এবং থাকাটা স্বাভাবিক। ‘ঐক্য-সংগ্রাম-ঐক্য’র ভিত্তিতেই তার সমাধান হবে। সার্বিক ঐক্য কোন সংগ্রাম নেই, আবার সার্বিক সংগ্রাম কোন ঐক্য নেই, ঐক্য সম্পর্কিত এই ধারণা ভ্রান্ত। ফলে এই প্রক্রিয়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে বামপন্থীদের এগোতে হবে।

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে দল গড়ে তোলার সংগ্রাম বেগবান করতে হবে

মার্কসবাদ-লেনিনবাদের শিক্ষার ভিত্তিতে কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখান যে, বিপ্লব করতে হলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথম শর্ত – সঠিক আদর্শ, তত্ত্ব ও বিপ্লবী রাজনৈতিক লাইনের ভিত্তিতে একটি সঠিক বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব দেয়ার মতো উপযুক্ত শক্তি নিয়ে উপস্থিত হওয়া। দ্বিতীয় শর্ত – যুক্তফ্রন্ট। প্রথমে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্তরে বামপন্থী এবং গণতন্ত্রের শক্তিগুলোর যুক্তফ্রন্ট। এই স্তর উত্তীর্ণ করার পর পুঁজিবাদ বিরোধী বিপ্লবের অবশ্য প্রয়োজনীয় যুক্তফ্রন্ট। অর্থাৎ প্রলেতারিয়ান ইউনাইটেড ফ্রন্টের জন্ম দেয়া। তৃতীয় শর্ত – সংযুক্ত এবং সম্মিলিত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জনতার নিজস্ব সংগ্রামের হাতিয়ার গড়ে তোলা – যেগুলো সকল পার্টির প্রতিনিধিদের নিয়ে যুক্তফ্রন্টের এলাকা বা জেলাগত কমিটিগুলোর মতো হবে না। এ হবে, খানিকটা রাশিয়ার শ্রমিক চাষীর সোভিয়েতের মতো সংগঠন। যা শ্রমিক চাষীর সম্মিলিত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে। এবং যাদের কর্মধারা গ্রহণ করবার, বর্জন করবার এবং কর্মধারাকে বাস্তবে প্রয়োগ করবার মতো স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থাকে। এই তিনটি শর্ত পূরণ করতে না পারলে বিপ্লব হবে না। তাই শর্তসমূহকে পূরণ করার লক্ষ্যে আমাদের দলকে সর্বশক্তি নিয়ে মানুষের মধ্যে যেতে হবে এবং যুক্তফ্রন্ট আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে কমরেডদের বুঝতে হবে। এভাবে ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার মধ্য দিয়ে জনগণের নিজস্ব সংগ্রামের হাতিয়ার আমরা গড়ে তুলব। সে লক্ষ্যে সবাই এগিয়ে যাবেন।

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা জিন্দাবাদ।

[মহান রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ৯৬তম বার্ষিকী এবং আমাদের দলের ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ৮ নভেম্বর ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের আলোচনা সভায় এবং ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম শহীদ মিনারের জনসভায় কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর প্রদত্ত বক্তব্য সংকলিত করে প্রকাশ করা হল।]

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments