পুরান পল্টনস্থ মৈত্রী মিলনায়তনে ১৮ জুলাই ২০১৮ এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে আট দলের সমন্বয়ে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ এর ঘোষণা দেন বামপন্থী নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনের প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তর করেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শুভ্রাংশু চক্রবর্তী। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক।
সংবাদ সম্মেলনে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয় রাষ্ট্র ও সরকারের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের উন্নয়নের রাজনীতিতে ধনী গরিবদের মধ্যে আয় ও সম্পদের সীমাহীন বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত, মার্কিন ও পাকিস্তানসহ বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের অপতৎপরতা চলছে। নির্বাচন সামনে রেখে বড় দুই দলের বিদেশি প্রভুদের কাছে ধর্ণা বাংলাদেশে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের সুযোগ বাড়িয়ে তুলেছে, বিপদগ্রস্ত করছে দেশের সার্বভৌমত্বকে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের’ মডেল নির্বাচন ও জনগণের ভোটাধিকারকে প্রহসনে পরিণত করেছে।
সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বে জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, সকল দল ও সমাজের অপরাপর অংশের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন এবং গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়।
প্রশ্নোত্তর পর্বে নেতৃবৃন্দ দেশ বাঁচানো, গণতন্ত্র বাঁচানো লড়াই গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আটটি রাজনৈতিক দল – বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সমন্বয়ে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
জোটের প্রথম সমন্বয়ক হিসেবে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের নাম ঘোষণা করা হয়। জোটের কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির সদস্যবৃন্দ হচ্ছেনÑ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মো. শাহ আলম, খালেকুজ্জামান, বজলুর রশীদ ফিরোজ, সাইফুল হক, আকবর খান, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, ফখরুদ্দিন কবির আতিক, জোনায়েদ সাকি, ফিরোজ আহমেদ, মোশাররফ হোসেন নান্নু, অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, মোশরেফা মিশু, মমিন উর রহমান বিশাল, হামিদুল হক, রণজিত কুমার।
কর্মসূচি
ক) দুঃশাসন, জুলুম, দুর্নীতি-লুটপাটতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র প্রতিরোধ এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে আগামী ২৪ জুলাই ঢাকাসহ দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় বিকাল ৪টায় প্রেসক্লাবের সম্মুখে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
খ) ৪ আগস্ট, ২০১৮ ভোটাধিকার নিশ্চিত করা এবং বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবিতে ঢাকায় মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে।
গ) আগামী ১০ ও ১১ আগস্ট দেশের ৬টি বিভাগীয় শহর, যথাক্রমে চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুরে সভা, সমাবেশ, জনসভা, মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। জোটের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এসব কর্মসূচিতে অংশ নেবেন।
সংবাদ সম্মেলনে পঠিত বক্তব্য
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আমাদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করুণ। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, আমাদের বক্তব্য, নতুন জোটের ঘোষণা ও আন্দোলনের কর্মসূচিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে অবহিত করতেই আমরা এই সংবাদ সম্মেলনে আপনাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি।
আপনারা অবগত আছেন যে, সরকার সংবিধান স্বীকৃত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ রুদ্ধ করে দমন-নিপীড়নের পথে জবরদস্তিমূলক ক্ষমতা অব্যাহত রেখেছে। জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অত্যাচার, নির্যাতন, হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, রিম্যান্ডে শরীরিক-মানসিক নির্যাতন, অপহরণ, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ডকে সাধারণ নিয়মে পরিনত করেছে; গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিনত করা হয়েছে। আইনের শাসনকে বিদায় দেয়া হচ্ছে। বিরোধী দল ও মতকে গায়ের জোরে দমন করা হচ্ছে। গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ ও ভীতি প্রদর্শনের অশুভ তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ সভা, সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধনেও বাধা প্রদান ও আক্রমন করা হচ্ছে। পুলিশের পাশাপাশি সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন-ছাত্রলীগকেও সন্ত্রাসী হামলায় ব্যবহার করা হচ্ছে। মহাজোট সরকারের নজিরবিহীন দুর্নীতি আর দুঃশাসনে দেশের মানুষ আজ দিশেহারা। আগেকার সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় দলীয়করণ, জবরদখল, ব্যাংক ডাকাতি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সীমাহীন চুরি, লুটপাট, অর্থপাচার এক ভয়ানক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। চরম স্বেচ্ছাচারীতায় ব্যাংক ও আর্থিক খাতে নৈরাজ্য কায়েম হয়েছে। তদারকি ও নিয়ন্ত্রণকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা মারাত্মভাবে খর্ব করা হয়েছে। বিচার ব্যবস্থার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও কর্র্তৃত্ব পূর্বের সকল সময়ের চেয়ে আরো জোরদার করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে তার ভারসাম্যমূলক ভূমিকার অবসান ঘটানো হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে অকার্যকরি করে তোলা হয়েছে। এই সমুদয় অপতৎপরতার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বিপদজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জনগণের ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক যে কোন আন্দোলন, প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে দমন করতে সরকার মরীয়া। শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত যে কোন আন্দোলনের বিরুদ্ধেও তারা নজিরবিহীনভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছে। খডগহস্ত ছাত্র আন্দোলন ও শিক্ষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে। সরকারী চাকুরীর কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের পরিবর্তে ছাত্রদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ দমন করতে সরকার নজিরবিহীন নৃশংসতা ও বর্বরোচিত হামলা-আক্রমণের আশ্রয় নিয়েছে। এই হামলা আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি শিক্ষক, ছাত্রী ও অভিভাবকেরাও। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সায়ত্বশাসন মারাত্মক হুমকীর মুখে। ছাত্রলীগকে সশস্ত্র পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে।
মানুষের জানমালের নিরাপত্তা আজ গুরুতর হুমকির মুখে। নারীর উপর সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষ রয়েছে আতঙ্কের মধ্যে। হেফাজতে ইসলাম ও ’৭১ এর ঘাতকসহ সা¤প্রদায়িক ধর্মান্ধ শক্তিকে খোলাখুলি মদত দেয়া হচ্ছে।
চালসহ দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, বাড়িভাড়া, গাড়ীভাড়া, চিকিৎসাসহ জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি, স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, বিশাল বেকারত্ব, অব্যাহত সড়ক দুর্ঘটনা ও পাহাড় ধসে মানুষের করুণ মৃত্যু জীবন-জীবিকাকে চরম অসহায় ও দুর্বিসহ করে তুলেছে। মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হলেও এখনও পর্যন্ত গার্মেস্টস শ্রমিকসহ শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়নি। গার্মেস্টস শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে মালিক ও সরকার পক্ষ তামাশা শুরু করেছে। সদ্য পাশ হওয়া জাতীয় বাজেটে জনপ্রশাসন, আইন শৃংঙ্খলা রক্ষা ও প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি করা হলেও কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ উৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। ক্ষেত্র বিশেষে বরং তা আরো কমেছে। সরকারের কথিত উন্নয়নের রাজনীতি লুটেরা ধনীদেরকে আরো ধনী করছে, বাড়িয়ে তুলছে ধনী গরীবের মধ্যে আয় ও সম্পদের সীমাহীন বৈষম্য।
বস্তুত: বর্তমান সরকার, শাসক-শোষকশ্রেণীর মহাজোট-জোট কোন অংশের কাছেই মানুষ যেমন নিরাপদ নয়, তেমনি তাদের কাছে নিরাপদ নয় দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় সম্পদ। দেশের মানুষের মতামত উপেক্ষা করে দেশী-বিদেশী লুটেরা ও ভারতকে তুষ্ট রাখতে রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অব্যাহত রাখা হয়েছে; প্রবল নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে ১ লক্ষ ১৪ হাজার কোটি টাকার রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। স্বপ্লমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ বাদ দিয়ে অধিক মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং জ্বালানি খাতে সীমাহীন চুরি দুর্নীতির মামলা এড়াতে দায়মুক্তির বিধানকে আর প্রলম্বিত করা হয়েছে। সরকারের নতজানু নীতির কারণে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা পাওয়া পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত, মার্কিন, পাকিস্তানসহ বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের বহুমুখী অপতৎপরতাও অব্যাহত রয়েছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আবারও ভারতসহ বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দেবার এক লজ্জাজনক তৎপরতা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ শাসকশ্রেণীর দলসমূহের আত্মসমর্পণের এই নতজানু নীতি বাংলাদেশে বিদেশীদের হস্তক্ষেপের সুযোগ বাড়িয়ে তুলছে, বিপদগ্রস্ত করছে দেশ ও দেশের সার্বভৌমত্বকে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
এরকম একটি আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থায় এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর একতরফা নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে যে রাজনৈতিক সংকটের শুরু ইতিমধ্যে তা আরো ঘনীভূত হয়েছে। এই সংকট সমাধানের কার্যকরী রাজনৈতিক উদ্যোগ না নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারী দল উল্টো যাবতীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার করে নির্বাচনের আগাম প্রচার অব্যাহত রেখেছে। অথচ বিরোধী দলসমূহের শান্তিপূর্ণ সভা, সমাবেশ, মিছিলসহ সাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেও রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করে নানাভাবে দমন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সংসদ নির্বাচনের রোড়ম্যাপ ঘোষণা করা হলেও দেশে এখনও পর্যন্ত অবাধ ও মুক্ত পরিবেশে ভোট প্রদান ও নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বলে কিছু নেই। সমগ্র নির্বাচনী ব্যবস্থা কার্যত ভেঙ্গে পড়েছে। খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার, সরকারী দল ও নানা সংস্থার ব্যবস্থাপনা ও কর্তৃত্বে ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের’ এক নজিরবিহীন মডেল চালু করা হয়েছে। দেশবাসীর পাশাপাশি আমাদের আশংকা রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালের ৩০ জুলাই এর সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মডেল অনুসৃত হবে। এইভাবে আরো একটি একতরফা সংসদ নির্বাচনের আয়োজন সম্পন্ন করা হচ্ছে। গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কার্যত ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে এবং নির্বাচন পুরোপুরি টাকার খেলায় পর্যবসিত হয়েছে। ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ এই সমগ্র নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া গণতান্ত্রিক পরিবেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোন অবকাশ নেই। গত ক’বছরের অভিজ্ঞতাও সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করেছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোন সুযোগ নেই। সরকার অনুগত নির্বাচন কমিশন দিয়েও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। পাশাপাশি জনগণের ম্যান্ডেটহীন জাতীয় সংসদ বহাল রেখেও সকল দল ও জনগণের জন্য নির্বাচনের সমান সুযোগ তৈরী হবে না। এ কারণে আমরা মনে করি জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বে জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, সকল দল ও সমাজের অপরাপর অংশের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন এবং গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
বন্ধুগণ,
গত বছর ৭ আগষ্ট সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যে আমরা উল্লেখ করেছিলাম “১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের অঙ্গীকার ছিল সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, সেক্যুলার মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে শাসকশ্রেণী সেই রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে; রাষ্ট্র ও সংবিধানসহ গোটা ব্যবস্থাকে চরম বৈষম্যমূলক, অগণতান্ত্রিক, নিপীড়নমূলক ও সা¤প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। স্বাধীনতা উত্তর শাসক-শোষকশ্রেণী ও তাদের দলসমূহের প্রতারণা, নির্মম শোষণ, লুষ্ঠণ, দমন-পীড়ন আর হত্যা-খুনের রাজনীতির কারণে জনগণের স্বপ্ন-আকাঙ্খা বিপর্যস্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো দলগুলোর দুঃশাসন আর বিভিন্ন সময়ে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ আজ দেশি-বিদেশী লুটেরা, সন্ত্রাসী, দাগি অপরাধী ও মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে; মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ‘৭১-এর গণহত্যাকারী ঘাতক শক্তিসহ নানা সা¤প্রদায়িক জঙ্গিবাদী অপশক্তি।”
এই পরিস্থিতি শোষক লুটেরা পুঁজিপতিদের শাসন তথা বিদ্যমান আর্থ সামাজিক ব্যবস্থারই প্রতিফলন। দেশবাসী এই দুঃসহ অবস্থার পরিবর্তন চায়, মুক্তি চায় এই দুঃশাসন থেকে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে নতজানু লুটেরা পুঁজিপতি ধনীকশ্রেণীর দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বারা বা তাদের মধ্যে ক্ষমতার গতানুগতিক পালাবদলের মধ্য দিয়ে এই সব সংকট ও দুর্দশা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না। এই অবস্থায় লুটেরা পুঁজিপতি শ্রেণীর নিষ্ঠুর শোষণমূলক ব্যবস্থা, বর্তমান স্বৈরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান এবং অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ জনগণের গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেন্দ্রীক লুটেরা ধনীকশ্রেণীর দ্বি-দলীয় অপরাজনীতির বাইরে জনগণের নিজস্ব বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশ জোরদার করা জরুরী। বাম প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক শক্তিই জনগণের প্রকৃত ভরসার যায়গা হয়ে উঠতে পারে।
সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আপনারা অবগত আছেন যে, এই রাজনৈতিক অবস্থান ও লক্ষ্য নিয়েই গত এক বছর ধরে আমরা সিপিবি-বাসদ-গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার অন্তর্ভূক্ত আট’টি রাজনৈতিক দল আন্দোলনের আশু পাঁচ দফা দাবিসমূহের ভিত্তিতে গণ-আন্দোলন গণসংগ্রাম বিকশিত ও জোরদার করতে কাজ করে আসছি। আমাদের এই উদ্যোগকে আরো শক্তিশালী ও বেগবান করতে আমরা আমাদের ঐক্য ও সংহতিকে নতুন স্তরে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। এই লক্ষ্যে আমরা আন্দোলনের নতুন জোট “বাম গণতান্ত্রিক জোট” গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি। আটটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে এই জোট গঠিত হচ্ছে। জোটে শরীক রাজনৈতিক দলসমূহ হচ্ছে-বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন।
জোটের একজন সমন্বয়ক থাকবেন। প্রতিটি দল থেকে দুইজন করে প্রতিনিধি নিয়ে জোটের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদ গঠিত হবে। শরীক দলগুলোর মধ্য থেকে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে প্রতি তিন মাসের জন্য একজন সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন। প্রথম সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। জোটের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সদস্যবৃন্দ হচ্ছেন- মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মোঃ শাহ আলম, খালেকুজ্জামান, বজলুর রশীদ ফিরোজ, সাইফুল হক, আকবর খান, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, ফখরুদ্দিন কবির আতিক, জোনায়েদ সাকি, ফিরোজ আহমেদ, মোশাররফ হোসেন নান্নু, অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, মোশরেফা মিশু, মমিন উর রহমান বিশাল, হামিদুল হক, রণজিত কুমার। জোটের অস্থায়ী কার্যালয় হবে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়, মুক্তিভবন, ২, কমরেড মণি সিংহ সড়ক, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
নতুন এই জোটের পক্ষ থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার করতে বাম গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে সকল গণতান্ত্রিক, অসা¤প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তিবর্গসহ দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।
আশা করি অচিরে আমরা এই জোটের আশু ও পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে পারব।
আন্দোলনের কর্মসূচি
ক) দুঃশাসন, জুলুম, দুর্নীতি-লুটপাটতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র প্রতিরোধ এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে আগামী ২৪ জুলাই ঢাকাসহ দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় বিকাল ৪টায় প্রেসক্লাবের সম্মুখে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
খ) ৪ আগস্ট, ২০১৮ ভোটাধিকার নিশ্চিত করা এবং বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবিতে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে।
গ) আন্দোলন জোরদার করতে আগামী ১০ ও ১১ আগস্ট দেশের ৬টি বিভাগীয় শহর, যথাক্রমে চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুরে সভা, সমাবেশ, জনসভা, মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। জোটের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ তিনটি টিমে ভাগ হয়ে বিভাগীয় পর্যায়ের এসব কর্মসূচীতে অংশ নেবেন।
আশা করি আমাদের সমগ্র উদ্যোগ ও কর্মকান্ডে আমরা আপনাদের সার্বিক সহযোগিতা পাব। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিতির জন্য আবারও আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষে
(সাইফুল হক)
সমন্বয়ক