হাজার হাজার সহযোদ্ধা ও শুভানুধ্যায়ীকে চোখের জলে ভাসিয়ে বিদায় নিলেন বাংলাদেশের সামাজতান্ত্রিক দল – বাসদ কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য ও বগুড়া জেলা শাখার সমন্বয়ক কমরেড কৃষ্ণ কমল।
গত ২১ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৬টায় প্রাতঃভ্রমণকালে বগুড়ার তিনমাথায় (আদর্শ স্কুল এ্যান্ড কলেজের সামনে) পেছন থেকে ধেয়ে আসা ট্রাকের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৪০ বছর।
সদা হাস্যময় কমরেড কৃষ্ণ কমল শোষিত-মেহনতী মানুষের মুক্তি সংগ্রামের সার্বক্ষণিক একজন কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে দলের যেমন এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তেমনি তাঁর মৃত্যু শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করা অকৃত্রিম এক বন্ধুর বিয়োগ হিসেবে বামপন্থী ও প্রগতিশীল মহলে বিবেচিত হয়েছে। আর সে কারণে কমরেড কৃষ্ণ কমলের শবদেহ বিকাল ৪টায় যখন শহীদ খোকন পার্কের শহীদ মিনারে রাখা হয়, শতশত কমরেড ও গুণগ্রাহীদের ঢল নেমেছিলো
তাঁকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। সেখানে অন্যান্যদের মধ্যে এসেছিলেন বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, কমরেড ওবায়দুল্লাহ মূসা, কমরেড উজ্জ্বল রায়, কমরেড মানস নন্দী। শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্যামল ভট্টাচার্য, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ভাষাসৈনিক মাহফুজুল হক দুলু। এছাড়াও বাসদ কনভেনশ প্রস্তুতি কমিটি বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, গাজীপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ, সমাজতন্ত্রিক ক্ষেতমজুর ও কৃষক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব মনজুর আলম মিঠু, সদস্য আহসানুল হাবিব সাঈদ-সহ বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি কমরেড জহিরুল ইসলাম-সহ কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ, সমাজতন্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটি সভাপতি সাইফুজ্জামান সাকন, কল্যাণ দত্ত-সহ বিভিন্ন জেলার জেলার নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক রোকেয়া বেগম ও মাছুমা আল মাহবুবা-সহ বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ।
এছাড়াও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ বগুড়া জেলা শাখার আহবায়ক কমরেড সাইফুল ইসলাম পল্টু-সহ নেতৃবৃন্দ, বাসদ নওগাঁ, রংপুর, জয়পুরহাট জেলার নেতৃবৃন্দ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, সিপিবি বগুড়া জেলার সভাপতি কমরেড জিন্নাতুল ইসলাম জিন্নাহ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী-এর জেলা নেতৃবৃন্দ, জাসদের পক্ষ থেকে রেজাউল করিম তানসেন, আমিনুল ইসলাম মিঠু, জাসদ ছাত্রলীগ, যুবজোট, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, গনসংহতি আন্দোলন, জয়পুরহাট মহিলা ডিগ্রী কলেজ, বিপ্লবী ছত্র মৈত্রী, গণজাগরণ মঞ্চ, প্রজাবাহীনী প্রেস লেন ব্যবসায়ী সমিতিসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার শতশত মানুষ।
এরপর সর্বসাধারণের অংশগ্রহণে এক শবযাত্রা শহীদ খোকন পার্ক থেকে শুরু হয়ে সাতমাথা হয়ে বড়গোলায় শেষ হয়। এরপর কমরেড কৃষ্ণ কমলের শবদেহ তাঁর গ্রামের বাড়ি রংপুরের পীরগাছার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে শবদেহসহ কমরেডগণ যখন পীরগাছায় পৌঁছান, সেখানও সেই রাতের বেলা শতশত মানুষ অপেক্ষা করছিল তাঁকে শেষবারের মতো একবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।
কমেরড কৃষ্ণ কমল কিশোর বয়সেই স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে যখন বাসদের বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন, তখন তিনি মাত্র ৮ম শ্রেণির ছাত্র। এতটুকু বয়সে কোনো তত্ত্ব না বুঝলেও এটুকু বুঝেছিলেন যে শোষণমুক্তির সংগ্রামই হচ্ছে বড় মানুষ হওয়ার একমাত্র পথ। তারপর এসএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে তিনি সক্রিয়ভাবে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাথে যুক্ত হন। পীরগাছা ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে কমল কিছুদিন রংপুরে পার্টির কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরে অনার্সে ভর্তির সূত্রে ১৯৯৭ সালে বগুড়ায় আসেন। এখানেই তার সংগ্রামী রাজনৈতিক যাত্রার শুরু। বগুড়ায় সরকারী আযিযুল হক কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির পরপরই তিনি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। একই বছর ছাত্র ফ্রন্টের বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর পর পরই ১৯৯৮ সালে আকসু নির্বাচনে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কলেজে রাজনীতি শুরু করার পর থেকেই ছাত্রদের স্থানীয় ও জাতীয় সংকট নিরসনের আন্দোলনের মাধ্যমে সবার হৃদয়ে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করেন। তাঁর সংগ্রামের একাগ্রতা ও বলিষ্ঠতা এবং বিনয়ী স্বভাব কলেজের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর মনে যে রেখাপাত তৈরী করে, তাতে তিনি সকলের প্রিয় ‘কমল দা’-তে পরিণত হন।
সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় কমরেড কৃষ্ণ কমল ১৯৯৯ সালেই ছাত্র ফ্রন্টের পূর্ণ সদস্য, ২০০৩ সালে তিনি বগুড়া জেলার সভাপতি এবং একই বছরে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০০৪ সাল পার্টির সিদ্ধান্তক্রমে রাজনীতির পাশাপাশি জয়পুরহাট মহিলা ডিগ্রী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সেই কলেজেই কর্মরত ছিলেন।২০০৯ সালে তিনি বাসদের বগুড়া জেলা শাখার সদস্য সচিব নির্বাচিত হন। বগুড়ায় পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কমরেড কৃষ্ণ কমল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছাত্র ফ্রন্ট, কৃষক ফ্রন্ট, শ্রমিক ফ্রন্ট-সহ সকল ফ্রন্ট সমূহকে নিবিড়ভাবে পরিচর্যা করে একদিকে যেমন বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলার ভূমিকা পালন করেন অন্যদিকে মার্কসবাদী চিন্তার চর্চা ও জীবনের সর্বক্ষেত্রকে ব্যাপ্ত করে তার প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য ও সবার অনুসরণীয়।
পার্টির অভ্যন্তরে শোধনবাদ-সংস্কারবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামেও কমরেড কৃষ্ণ কমল ছিলেন একজন বলিষ্ঠ সৈনিক। তিনি পার্টির প্রাণসত্ত্বা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা ভিত্তিতে নিরলস ও কষ্টকর সংগ্রাম পরিচালনা করেন। তিনি ২০১৩ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর কমরেড কৃষ্ণ কমল বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমমিটি বগুড়া জেলা শাখার সমন্বয়কের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
সদালাপী ও মিষ্টভাষী কমরেড কৃষ্ণ কমল কেবল দলের কর্মী-সংগঠকদেরই নয়, বগুড়ার সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যাক্তি সংগঠনের স্নেহের, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র ছিলেন। তিনি তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির বগুড়া জেলা শাখার সদস্য সচিবের দায়িত্বও পালন করেছেন।
কমরেড কৃষ্ণ কমল লাল সালাম!
স্মরণ সভা
আগামী ২৯ অক্টোবর বগুড়ায় কমরেড কৃষ্ণ কমলের সংগ্রমী জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাত মাথা মোড়ে বেলা সাড়ে তিনটায় এক স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাসদ কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখবেন ভাষা সৈনিক মাহফুজুল হক দুলু, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শ্যামল ভট্টাচার্য্য, কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবত্তর্ী সহ বিভিন্ন বাম প্রগতিশীল দলের নেতৃবৃন্দ।