সুন্দরবনের বাঘের খ্যাতি দুনিয়া জুড়ে। এই বাঘের কারণেই ‘বাংলার বাঘ’ কথাটি এসেছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, বন উজাড় হয়ে যাওয়া, চোরা শিকারীদের আক্রমণ ইত্যাদি নানা কারণে এই বাঘেদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। বিশ্বের মাত্র ১৪টি দেশে বাঘ নামক প্রাণিটি টিকে আছে। কিছুদিন আগে বিশ্ব বাঘ দিবস পালনের সময় পত্র-পত্রিকায় খবর এসেছে যে বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা কমছে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে (৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার) ৪০০ বাঘ থাকার কথা থাকলেও এখন সব মিলিয়ে বাঘ রয়েছে ১০৬টি। আসলে শুধু বাঘ নয়, গোটা সুন্দরবনের অস্তিত্ব নিয়েই দেশের সচেতন মানুষ উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন সারা দুনিয়ার পরিবেশ সচেতন মানুষেরাও। যে কারণে এবার বিশ্ব বাঘ দিবসের স্লোগানও ছিল ‘সেভ সুন্দরবনস টাইগার ল্যান্ডস্কেপ’, অর্থাৎ বাঘ রক্ষা কর, সুন্দরবন রক্ষা কর।
বাঘ কমে যাওয়ার তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান মহাজোট সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, বাঘের সংখ্যা কমেনি, বাঘ পশ্চিমবঙ্গে বেড়াতে গেছে। তার ওই বক্তব্য নিয়ে সে সময় সংবাদমাধ্যমে এবং সর্বসাধারণের মধ্যে বেশ হাস্যকৌতুকেরও সৃষ্টি হয়েছিল। মন্ত্রী মহোদয়রা যাই বলুন না কেন, তিনি যে সরকারি অনুষ্ঠানে এমন বালখিল্য মন্তব্য করেছেন ওই অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ বলেছিলেন, ২০১১ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বাঘ সম্মেলনে বাংলাদেশ যে অঙ্গীকার করেছিল, তা যদি বাস্তবায়ন হতো, তাহলে আজকের বাঘের সংখ্যা এতটা কমে আসত না। বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল করার কথা ছিল না। বাঘ রক্ষা করতে হলে সুন্দরবনের ভেতরে এসব তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। অনুষ্ঠানের শুরুতে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক তপন কুমার দে বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথ চালু হওয়ার পর বনের বাঘ শিকার বেড়েছে।
সুন্দরবনের অনেক বিপদ
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল বেড়ে যাওয়ায় শুধু যে বাঘেদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে তাই নয়। গত ডিসেম্বরে শেলা বা শ্যালা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটার তেলভর্তি জাহাজ ডুবির এবং এবছরের জুলাইতে মরা ভোলা নদীতে ৭০০ টন পটাশ সারবাহী জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এদুটি জাহাজ ডুবির ফলে ওই অঞ্চলের নদীগুলোর জলজপ্রাণীসহ আশেপাশের পরিবেশে কী বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে তাও আমাদের জানা। বিলুপ্ত-প্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন ও শুশুক ওই অঞ্চলের নদীগুলোতে বাস করে। এদের অস্তিত্বের ওপর আঘাত এসেছে। আসলে গোটা অঞ্চলের পরিবেশের ওপরই আঘাত এসেছে।
৯ ডিসেম্বর শ্যালা নদীতে জাহাজ দুর্ঘটনায় ট্যাংকার থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ে ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তেল ছড়িয়ে পড়ার পর সুন্দরবনের নদী-খালগুলোতে প্রাণী ও উদ্ভিদের সংখ্যা অস্বাভাবিক পরিমাণে কমেছে। এই তেল ছড়িয়ে পড়ার ফলে সুন্দরবনের জলজ প্রাণীর উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। অনেকক্ষেত্রে বনের প্রাণীদের জিনগত বা জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের উপরও প্রভাব পড়ে। ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় যে তেল ছড়িয়ে পড়েছিল, তার প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী ১০-১২ বছর পর দেখা গেছে অনেক প্রাণী এলাকা থেকে হারিয়ে গেছে।
বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দলসহ সবাই এই ঝুঁকির কথা বলেছে। কিন্তু বরাবরের মতোই সরকার তেমন কোনো ক্ষতি হবে না বলে আশ্বাস বাণী প্রচার করেছে এবং সাময়িকভাবে নৌ-চলাচল বন্ধ রাখলেও আবার তা চালু করেছে। অথচ সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌ-চলাচল প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত করে, আচরণের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে – এটা সমস্ত দিক থেকে প্রমাণিত।
কিন্তু যে দেশে মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের বিষয়টিই শাসকরা আমলে নিতে চায় না, সেখানে বাঘ, ডলফিন বা বনাঞ্চল তো অনেক দূরের ব্যাপার। তারপরও আমাদের এ নিয়ে ভাবতে হয়, কারণ আমরা জানি, পরিবেশকে ধ্বংস করে মানুষ বাঁচতে পারবে না, টিকতে পারবে না। আর তাই সুন্দরবন নিয়েও আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে হয়।
রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপ্রকল্প : সুন্দরবনের মহাবিপদ
দেশের সচেতন মানুষ মাত্রেই জানেন যে জাহাজ ডুবি বা জাহাজ চলাচলের চেয়েও বড় বিপদ সুন্দরবনের ঘাড়ে চেপে বসেছে। সেই বিপদের নাম রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপ্রকল্প।
ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরু করেছে আওয়ামী মহাজোট সরকার। ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে তাঁর রাষ্ট্রীয় সফরের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারতীয় সহযোগিতা ও বিনিয়োগের আহ্বান জানান। সে অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি ২০১০ ভারতীয় জ্বালানি সচিবের বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও ভারতের রাষ্ট্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) যৌথভাবে ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রকল্পের স্থান চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকেই রামপালে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ এবং মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। সেসময় উর্বর কৃষিজমি এবং লাভজনক মৎস্য উৎপাদন এলাকা ছাড়তে অনিচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দাদের জোর করে জমি থেকে উচ্ছেদের অভিযোগ ওঠে এবং জমি দখলের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনকে পুলিশ ও সরকার দলীয় ক্যাডারবাহিনী দিয়ে দমন করা হয়। শুধু তাই নয়, ওই এলাকায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে কোনো ধরনের প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে দেয়া হচ্ছে না।
কোনো ধরনের ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়াই সুন্দরবনের মতো পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকার নিকটে বিপজ্জনক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর বিরুদ্ধে স্থানীয় কৃষকদের দায়ের করা রীট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাইকোর্ট এই প্রকল্পের কাজ স্থগিতের নির্দেশ দেয়। ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি পিডিবি ও এনটিপিসি চুক্তির মাধ্যমে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ‘বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি’ গঠন করে। একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের রীটের প্রেক্ষিতে ২০১২ সালের আগস্ট মাসে হাইকোর্ট প্রকল্প এলাকায় জলাভূমি ভরাটের কাজ কেন অবৈধ ঘোষিত হবে না তা জানতে চায়। এসকল রীট নিষ্পত্তি এখনো হয়নি, কিন্তু সরকার প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখে। ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার, পিডিবি ও এনটিপিসি প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে। দাম চূড়ান্ত না করেই পিডিবি ২৫ বছর ধরে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ক্রয়ের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। সরকারের সাথে সম্পর্কিত সংস্থা ‘সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস’ (সিইজিআইএস)-কে রামপাল প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার দায়িত্ব দেয় পিডিবি। ওই সংস্থা ২০ জানুয়ারি ২০১৩ ইআইএ রিপোর্ট জমা দেয়। বিভিন্ন মহলের মতামত প্রদানের পর ১০ জুলাই চূড়ান্ত রিপোর্ট পিডিবি পরিবেশ অধিদপ্তরে জমা দেয়। অথচ, এই রিপোর্টের ওপর ঢাকায় অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে উপস্থিত বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো রিপোর্টটিকে ত্রুটিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করে।
সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে গত ৫ আগস্ট ’১৪ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিবেশগত ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। অবশ্য পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়ার বহু পূর্বেই মহাজোট সরকার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চূড়ান্ত করে এনেছে। ৫ অক্টোবর ’১৩ এক ভিডিও কনফারেন্সে শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রামপালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সরকার জানতো তারা পরিবেশ ছাড়পত্র পাবেই, একারণে গত ৩ বছর ধরে প্রকল্পের কাজ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ যেন বিচারের রায় পকেটে রেখে বিচার আয়োজনের মতো ব্যাপার। আর ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদীর সফরের সময় ৬ জুন ’১৫ রামপালে প্রকল্পের একটি মডেল নরেন্দ্র মোদির কাছে হস্তান্তর করেন শেখ হাসিনা।
কয়লা-বিদ্যুতের শাঁখের করাত
আমরা শাঁখের করাতের কথা জানি, আসতেও কাটে, যেতেও কাটে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা হল সেই শাঁখের করাত, বিশেষত সুন্দরবনের মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর বনাঞ্চলের জন্য। জানা গেছে, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সবচেয়ে নিম্নমানের কয়লা আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। সুতরাং, এ কয়লা আসতেও কাটবে, পোড়াতেও কাটবে, পোড়ানোর শেষেও কাটবে। আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপদের প্রধান দিকগুলো এক এক করে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
১) সাড়ে চার বছর ধরে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কালে নির্মাণের মালামাল ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নদী পথে পরিবহন করার সময় নৌযান চলাচল, তেল নিঃসরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নিঃসরণ, ড্রেজিং ইত্যাদির মাধ্যমে সুন্দরবনের ইকো সিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
২) বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানী করা কয়লা সুন্দরবনের মধ্য দিয়েই পরিবহন করা হবে। এ জন্য বছরে ৫৯ দিন কয়লা বড় জাহাজ এবং ২৩৬ দিন লাইটারেজ জাহাজ সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লার মতো দূষণকারি কার্গো নিয়ে চলাচল করবে। ফলে কয়লা পরিবহন, উঠানো-নামানো, জাহাজের ঢেউ, নাব্যতা রক্ষার জন্য ড্রেজিং, জাহাজ থেকে নির্গত তরল-কঠিন বিষাক্ত বর্জ্য, জাহাজ নিঃসৃত তেল, দিন-রাত জাহাজ চলাচলের শব্দ, জাহাজের সার্চ লাইট ইত্যাদি সুন্দরবনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও জৈববৈচিত্র্য বিনাশ করবে। সর্বোপরি নদীর পানিতে কয়লার গুঁড়া মেশার ফলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জুয়োপ্লাংটন ধ্বংস হবে এবং জুয়োপ্লাংটনের ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য মাছ ও প্রাণীও বিলুপ্ত হবে।
৩) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের টারবাইন, জেনারেটর, কম্প্রেসার, পাম্প, কুলিং টাওয়ার, কয়লা উঠানো নামানো, পরিবহন ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও যানবাহন থেকে ভয়াবহ শব্দ দূষণ হয় যা ওই অঞ্চলের পরিবেশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
৪) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড (SO2) ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড (NO2) নির্গত হবে যা পরিবেশ আইনে বেধে দেয়া পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকার সীমার (প্রতি ঘনমিটারে ৩০ মাইক্রোগ্রাম) তুলনায় এইসব বিষাক্ত গ্যাসের মাত্রা অনেক বেশি (প্রতি ঘনমিটারে ৫৩ মাইক্রোগ্রামের বেশি)। এর ফলে এসিড বৃষ্টি, শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতিসহ গাছপালা জীবজন্তুর জীবন বিপন্ন হবে।
৫) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বছরে ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লক্ষ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এই ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, তরল ঘনীভূতি ছাই বা স্লারি ইত্যাদি ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করে কারণ এতে বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে। এই দূষণকারী ছাই দিয়ে ১৪১৪ একর জমি ৬ মিটর উঁচু করা হবে। ফলে এই ছাই উড়ে, ছাই ধোয়া পানি চুইয়ে আশপাশের নদী খাল এবং আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল দূষিত করবে।
৬) প্ল্যান্ট পরিচালনার জন্য পশুর নদী থেকে ঘণ্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার পানি সংগ্রহ করা হবে এবং পরিশোধন করার পর পানি পশুর নদীতে ঘণ্টায় ৫১৫০ ঘনমিটার হারে নির্গমণ করা হবে। পরিশোধন করার কথা বলা হলেও বাস্তবে পরিশোধনের পরও পানিতে নানান রাসায়নিক ও অন্যন্যা দূষিত উপাদান থেকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকেই। তাছাড়া নদী থেকে এই হারে পানি প্রত্যাহার, তারপর বিপুল বেগে পানি আবার নদীতে ছাড়া, পানির উচ্চ তাপমাত্রা ইত্যাদি নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ, পানির প্লবতা, পলি বহন ক্ষমতা, মৎস ও অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনচক্র ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবেই যা নদী-নালা খাল-বিলের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গোটা সুন্দরবনের জলজ বাস্তুসংস্থানের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।
৭) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চিমনী থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসের তাপমাত্রা হবে ১২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা চারপাশের পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
বিপদ শুধু সুন্দরবনের নয়, গোটা দেশের
সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে, মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে। দুনিয়ার সব সভ্য ও সচেতন দেশেই বনভূমির নিকটস্থ জায়গায় অর্থাৎ পঁচিশ কিলোমিটারের মধ্যে এই রকম পরিবেশ দূষণকারী স্থাপনা নিষিদ্ধ। ভারতীয় জনগণের প্রতিবাদের মুখে ভারত নিজের দেশে সুন্দরবন ও রাজীব গান্ধী ন্যাশনাল পার্কের পাশে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে পারেনি। অথচ আমাদের দেশের শাসকশ্রেণী, পুঁজিপতি-ব্যবসায়ীদের মুনাফার বাসনা এমন উগ্র যে এ দেশের পরিবেশ, প্রাণ, প্রকৃতি টিকে থাকবে কি থাকবে না সে চিন্তাও তাদের নেই।
এ প্রকল্পের উৎপাদিত বিদ্যুতের দামও পড়বে বেশি। চুক্তিতে বিদ্যুতের দামের জন্য যে ফর্মুলা দেয়া হয়েছে তাতে হিসাব করে দেখা গেছে, এখানকার প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ৮.৮৫ টাকা। অর্থাৎ শুধু পরিবেশগত দিক থেকেই নয়, অর্থনৈতিক স্বার্থগত দিক থেকেও এ বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের জন্য লাভজনক নয়।
বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক জীবন অচল। যদিও দেশের ৫৫ ভাগ মানুষ, যাদের সবাই গ্রামের গবির মানুষ, প্রত্যক্ষভাবে বিদ্যুতের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সেই বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের কথা বলেই সুন্দরবনের পাশে স্থাপন করা হবে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। সুন্দরবনকে বলা হয় বাংলাদেশের ফুসফুস। একই সাথে সুন্দরবন এ দেশের জন্য এক প্রাকৃতিক দেয়াল, যে দেয়াল আইলা-সিডরের মতো ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে গোটা দেশকে রক্ষা করে। অভাবের তাড়নায় আর মুনাফা-লোভীদের পাল্লায় পড়ে অনেক সময় গরিব মানুষ নিজের কিডনি বিক্রি করে, এসব খবর আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখি। আর সুন্দরবনের পাশে পরিবেশ দূষণের জন্য সারাবিশ্ব জুড়ে লাল তালিকাভুক্ত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা কি তেমনই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি? বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্যে আমাদের ফুসফুস বিক্রি করতে বসেছি? এ প্রশ্ন দেশপ্রেমিক প্রতিটি মানুষের গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। একই সাথে এরকম একটি জনস্বার্থবিরোধী এবং দেশের প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিটি দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষের প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রধানত ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রকল্প। এর সাথে দু’দেশের জনগণের স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি বাস্তবায়িত হলে দু’দেশেরই প্রকৃতি, পরিবেশ ও জনগণের সীমাহীন ক্ষতি হবে। অর্থাৎ এর ক্ষতিকর প্রভাব শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, ভারতের উপরও পড়বে। তাই ভারতের বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে আমরা আবেদন করছি, আপনারাও সুন্দরবন ধ্বংসকারী এ ভয়াবহ চক্রান্ত রুখে দাঁড়ান।