দলের পরিবর্তিত নাম বাসদ (মার্কসবাদী)
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত
সাম্যবাদ প্রতিবেদন
একদিন বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের বুকের দীর্ঘশ্বাসকে কেন্দ্র করে ধর্ম এসেছিল সমাজের পরিবর্তন ঘটাতে। পরিবর্তন কিছু ঘটলেও শোষণ-বঞ্চনার চির অবসান হয়নি। কালের অমোঘ নিয়মে শোষণ-বঞ্চনা নতুন রূপ নিয়েছে। মানুষের দীর্ঘশ্বাসে পৃথিবীর বাতাস আরো ভারি হয়েছে। এরপর এল সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা-নারীমুক্তির বাণী। আবারো সমাজ টালমাটাল হয়ে উঠল। অনেক উথাল-পাথাল শেষে পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুনিয়ার বুকে কায়েম হয়ে বসল। কিন্তু যতই দিন গড়াতে লাগল, মানুষ দেখতে পেল, বৈষম্য পাহাড় সমান হয়েছে, বঞ্চিত মানুষের দল দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। লুণ্ঠন-নিপীড়ন সীমাহীন হয়েছে। নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাসে পৃথিবীর বাতাস ভারাক্রান্ত।
এই নিপীড়িত শোষিত মানুষের মুখে ভাষা দেবে কে? তাদের মুক্তির পথ কোথায়? ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেই পথনির্দেশ দিয়ে গেছেন মহান কার্ল মার্কস এবং তাঁর সহযোদ্ধা বন্ধু এঙ্গেলস। তাঁরা দেখিয়েছেন, ব্যক্তি-সম্পত্তি ভিত্তিক এই ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করেই সম্ভব শোষণ-বৈষম্য-বঞ্চনাহীন পৃথিবী গড়ে তোলা। তার জন্য চাই শোষিত-নিপীড়িত মানুষের সংঘশক্তি — সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী দল। মার্কস-এঙ্গেলসের শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন মহান লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সেতুঙ এবং শিবদাস ঘোষ। তাঁরা দেখিয়েছেন, বিপ্লবী দল গড়ে তোলার কঠোর কঠিন সংগ্রামের মধ্যেই শোষিত মানুষের মুক্তির পথে প্রথম অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ। মার্কসবাদী বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে বাংলাদেশের বুকে সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েই গত ২০ থেকে ২৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হল বিশেষ কেন্দ্রীয় কনভেনশন।
বাম আন্দোলনে সুবিধাবাদ-ব্যক্তিবাদ ও গণবিচ্ছিন্নতা মোকাবেলা করে নীতিনিষ্ঠ ও লড়াকু বিপ্লবী পার্টির শক্তি বৃদ্ধি করা, সংশোধনবাদ-সংস্কারবাদকে পরাস্ত করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার সংগ্রাম শক্তিশালী করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে অনুষ্ঠিত হল বাসদ-এর চার দিন ব্যাপী বিশেষ কেন্দ্রীয় কনভেনশন। ২০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় মহানগর নাট্যমঞ্চ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। কনভেনশনে যোগ দিতে ভোর হতেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দলের নেতাকর্মীরা মহানগর নাট্যমঞ্চে মিছিল নিয়ে সমবেত হতে থাকেন। বেলা সাড়ে ১১টায় অতিথিদের নিয়ে নেতৃবৃন্দ মঞ্চে আরোহন করেন। এরপর দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী।
পতাকা উত্তোলন শেষে সংক্ষিপ্ত ভাষণের মাধ্যমে কনভেনশনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেন, শোষণ-বৈষম্যের এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সমস্ত দিক থেকে মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে, সমাজ-সভ্যতাকে ধ্বংস করছে। শত অন্যায়-অবিচার করার পরও এই ব্যবস্থা টিকে আছে। কারণ এই ব্যবস্থা আপনা-আপনি বিলুপ্ত হবে না, উচ্ছেদ হবে না। একে বিপ্লবের আঘাতে উচ্ছেদ করতে হবে। সমাজ পরিবর্তনের এই বিরাট বিপুল সংগ্রামে শোষিত নিপীড়িত মানুষকে নেতৃত্ব দিতে হলে চাই সঠিক বিপ্লবী দল। আর এ কারণেই বিপ্লবী দল গড়ে তোলার সংগ্রাম ব্যতিত গরিব মানুষের মুক্তির পথ নেই।
তিনি বলেন, মার্কস-লেনিনের সুযোগ্য ছাত্র, এ যুগের মহান মার্কসবাদী চিন্তাবিদ কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে পাথেয় করে ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর আমাদের দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে ভিত্তি করে যে দল গড়ে তোলার সংগ্রাম আমরা পরিচালনা করছি, তাতে অনেক চড়াই-উৎরাই আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছে। দলের অভ্যন্তরে শোধনবাদী-সংস্কারবাদী-সুবিধাবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করার মধ্য দিয়েই আমরা আজকের জায়গায় এসেছি। আমাদের সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই এ বিশেষ কনভেনশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তিনি কনভেনশন সফল করতে দেশবাসীর সহযোগিতার কথা স্মরণ করে তাদের অভিনন্দন জানান।
উদ্বোধনীর পর মঞ্চের পাশে নির্মিত শহীদ বেদীতে দেশে দেশে বিপ্লবী সংগ্রামের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী এবং ভারতের সোস্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের পক্ষে এসইউসিআই(সি)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড সি. কে. লুকোস। এ সময় শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। এরপরই মার্কসবাদী অথরিটিদের ছবি, বিভিন্ন দাবি সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ড এবং লাল পতাকা দিয়ে সুসজ্জিত প্রায় ৫ হাজার মানুষের মিছিল মহানগর নাট্যমঞ্চ থেকে বেরিয়ে গুলিস্তান-পল্টন-প্রেসক্লাব-হাইকোর্ট-দৈনিক বাংলা-মতিঝিল হয়ে পুনরায় নাট্যমঞ্চে গিয়ে শেষ হয়।
বিকাল সাড়ে ৩টায় শুরু হয় প্রকাশ্য সমাবেশ। এতে সভাপতিত্ব করেন বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সংগ্রামী আহ্বায়ক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সোস্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। আলোচনা করেন বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক কমরেড আব্দুস সাত্তার। সমাবেশ পরিচালনা করেন কমরেড মানস নন্দী। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল পরিবেশনার মধ্য দিয়ে আলোচনা সভার সমাপ্তি হয়। আলোচনা সভার শুরুতে ময়মনসিংহ ও গাইবান্ধা জেলার চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সদস্যরা এবং আলোচনা সভার শেষে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় টিম সঙ্গীত পরিবেশন করে।
আলোচনায় বাম মোর্চার সমন্বয়ক ও ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার বলেন, উত্তরবঙ্গের আলুচাষীরা আলুর দাম নিয়ে যখন হাহাকার করছিল তখন গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা এবং বিশেষভাবে বাসদ যে আন্দোলন করেছিল তা সারা দেশে প্রবল ঢেউ তুলেছিল। আমরা যখন তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে আন্দোলন করছিলাম, তখন আমরা দেখেছি ভারতের মাটিতে বসে এস ইউ সি আই (সি) আমাদের ন্যায্য দাবির পক্ষে দাঁড়িয়ে কণ্ঠ তুলেছিল। তিনি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যাসহ বাংলাদেশের জনগণের সকল ন্যায়সঙ্গত দাবির পক্ষে ভারতের শোষিত মেহনতি মানুষের ঐকান্তিক সমর্থন সহযোগিতা কামনা করেন।
কমরেড সাত্তার বলেন, শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার কীভাবে ক্ষমতায় এসেছে? তারা হয়ত সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় আছে। কিন্তু তারা জনগণের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসেনি। এই যে জনগণের সমর্থন ছাড়া এরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে সে প্রয়োজন থেকে এরা দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো, কয়লাক্ষেত্রগুলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দিচ্ছে। আর ভারতের হাতে আমাদের সুন্দরবন ধ্বংস করার হাতিয়ার রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করার অনুমোদন তুলে দিয়েছে। তিনি বলেন, কি ভয়াবহ লুটপাট দেশে চলছে সেটা আপনারা সাম্প্রতিক প্রকাশিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতির খবর থেকেই সবাই জানে। বিমানে দেখুন কি ধরনের লুটপাট চলছে। এই শাসকগোষ্ঠী লুটপাট, দুর্নীতির মাধ্যমে আমাদের দেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার বলেন, আমাদের আন্দোলনের বর্শাফলক তাক করতে হবে বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। এদেরকে ক্ষমতা থেকে নামাতে হবে। অপরাপর বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সাথে মিলে বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একই সাথে জামাত-সহ মৌলবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধেও আমাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
বিশেষ কেন্দ্রীয় কনভেনশনের ২য় দিনে প্রতিনিধি অধিবেশন ২১ নভেম্বর সকাল ১১টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সেমিনার হলে শুরু হয়। অধিবেশন চলে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত। প্রতিনিধি অধিবেশনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দলিল উত্থাপন ও গ্রহণ, দল গড়ে তোলার নীতিগত আদর্শগত সংগ্রামের অভিজ্ঞতা ও মূল্যায়ন, রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদন উত্থাপন ও গ্রহণ করা হয়। কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিনিধি অধিবেশন পরিচালনার জন্যে কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, আলমগীর হোসেন দুলাল, মানস নন্দী ও মনজুরা নীলার সমন্বয়ে প্রেসিডিয়াম গঠন করা হয়। প্রতিনিধি অধিবেশনের শুরুতে কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য ও দলের বগুড়া জেলার সমন্বয়ক কমরেড কৃষ্ণ কমলের দুর্ঘটনাজনিত অকাল মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশসহ দুনিয়ার দেশে দেশে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মানবমুক্তির লড়াইয়ে আত্মদানকারী শহীদদের স্মরণে এবং বাংলাদেশের পুঁজিপতি-মালিকগোষ্ঠীর নির্মম শোষণে রানা প্লাজা-তাজরিন ফ্যাশন্স-সহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় গণহত্যার শিকার শ্রমজীবী মানুষদের স্মরণে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। উদ্বোধনী পর্বে বক্তব্য রাখেন এস ইউ সি আই (সি) এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। এ সময় উভয় দলের পক্ষ থেকে পতাকা ও বিভিন্ন স্মারক বিনিময় করা হয়।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর গৃহিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সারা দুনিয়ায় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের দুর্বল চেহারা এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আস্ফালন, যুদ্ধ ও আগ্রাসন মানুষকে হতাশ করছে। আর এ পরিস্থিতি কমরেড শিবদাস ঘোষের অমূল্য শিক্ষার দিকে আমাদের আরো গভীর মনোযোগ দাবি করছে। কি অজেয় শক্তি হিসাবে বিশ্ব সাম্যবাদী শিবিরের আবির্ভাব ঘটেছিল, মানব জাতির সামনে মুক্তির প্রত্যাশা জাগিয়েছিল। কিন্তু আধুনিক সংশোধনবাদের আক্রমণে সবই বিপর্যস্ত হয়ে গেল। অথচ এ বিপদ সম্পর্কে কমরেড শিবদাস ঘোষ ১৯৪৮ সাল থেকেই হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন। ক্রুশ্চেভ-চক্রের শোধনবাদী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াই করেছেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনে যান্ত্রিক চিন্তাপদ্ধতি ও অন্ধ আনুগত্য সম্পর্কে এবং ব্যক্তিবাদ-শোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষের অমূল্য শিক্ষার দিকে আমাদের বার বার ফিরে তাকাতে হবে। উত্থাপিত প্রতিবেদনের উপর প্রতিনিধিরা মতামত প্রদান করেন।
২২ নভেম্বর দ্বিতীয় দিনের প্রতিনিধি অধিবেশনে জাতীয় পরিস্থিতির প্রতিবেদন উত্থাপন করা হয়। এরপর উত্থাপিত দলিলের ওপর প্রতিনিধিরা মতামত প্রদান করেন। জাতীয় পরিস্থিতির প্রতিবেদনে বলা হয়, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বিভিন্ন সংগ্রামে এদেশের মানুষ জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করেছে, আত্মদান করেছে। কিন্তু সঠিক নেতৃত্বের অভাবে বুর্জোয়াশ্রেণী মানুষের আন্দোলনকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে, ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই সঠিক নেতৃত্ব হল সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বুর্জোয়াশ্রেণী ও মালিকগোষ্ঠীর শোষণ-লুটপাটকে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করার জন্যই আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করা হয়েছে। যে-দেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধ করে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, গণঅভ্যুত্থান করে সামরিক স্বৈরশাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়েছে — সে দেশ আজ ফ্যাসিবাদী শাসনের দিকে এগিয়ে চলছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একদল বামপন্থী সরাসরি শাসকদের পক্ষ নিয়েছে, একদল শাসকদের হয়ে জনগণকে প্রতারিত করতে ভূমিকা রেখেছে। আর যারা আন্তরিক বামপন্থী তারা রাজনৈতিক বিভ্রান্তির কারণে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। একই সাথে বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও নীতি-আদর্শহীনতার চর্চা গণআন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড হতাশা সৃষ্টি করেছে। আর এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন মহাজোট রাষ্ট্র শাসনে ফ্যাসিবাদী আয়োজনের ভিত্তি রচনা করছে। প্রতিবেদনে এ অচলাবস্থা কাটাতে জনজীবনের সমস্যা-সংকট নিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় ভিত্তিক ধারাবাহিক গণআন্দোলনের গড়ে তোলার জন্য বামপন্থী শক্তির প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
কনভেনশনের প্রতিনিধি অধিবেশনের শেষ দিনে সাংগঠনিক প্রতিবেদন, আয়-ব্যয়ের প্রতিবেদন পেশ করা হয়। এরপর দলের ইতিহাস ও মতবাদিক সংগ্রামের উপর প্রতিবেদন উত্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, জাসদের অভ্যন্তরে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে সংগ্রাম চালিয়ে আমাদের দলের জন্ম হয়েছে। দলের অভ্যন্তরেও শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নানা শোধনবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। দলের প্রতিষ্ঠিত নেতৃবৃন্দ যখন শোধনবাদী-সুবিধাবাদী চিন্তার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে তখন পুনর্বার মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার মহান পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে দলের অভ্যন্তরে মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়েছে। এতে বলা হয়, দল গড়ে তোলার এই কঠিন-কঠোর সংগ্রাম আমরা যত নিবিড়ভাবে পরিচালনা করতে পারব, তার উপরই বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি নির্ভর করছে।
অধিবেশনে দল পরিচালনার খসড়া নিয়মাবলী ওপর আলোচনা হয়। বাসদ-এর বিশেষ কনভেনশনে পার্টির নাম কিছুটা পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)’ ঘোষণা করা হয় এবং কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী-কে সাধারণ সম্পাদক করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট ‘কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটি’ গঠন করা হয়। পার্টি বিকাশের বর্তমান বিশেষ স্তরকে বিবেচনায় রেখে এই কার্য-পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। সবশেষে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গাওয়ার মধ্য দিয়ে বিশেষ কনভেনশনের প্রতিনিধি অধিবেশনের কর্মসূচি সমাপ্ত হয়।
বাসদ (মার্কসবাদী)র কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটি সাধারণ সম্পাদক : কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। সদস্য : কমরেডস্ শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, আলমগীর হোসেন দুলাল, মানস নন্দী, মন্জুরা নীলা, উজ্জ্বল রায়, ওবায়দুল্লাহ্ মুসা, ফখরুদ্দিন কবির আতিক ও সাইফুজ্জামান সাকন।