Saturday, December 21, 2024
Homeসাম্যবাদবিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে সংগঠিত না হলে আমরা মুক্তির পথ পাব না —...

বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে সংগঠিত না হলে আমরা মুক্তির পথ পাব না — কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

MHC_Convention--sizeকমরেডস, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং বর্তমান বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের ভয়ঙ্কর সংকটগ্রস্ত অবস্থা, অর্থনৈতিক থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক-নৈতিক যে ভয়াবহ সংকট, সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী যে নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে সমগ্র বিশ্ববাসী আছে, তার সম্পর্কে এতক্ষণ আমরা শুনলাম। আমি আন্তর্জাতিক এ পরিস্থিতির আলোকে এখন আমাদের দেশকে কেন্দ্র করে যে সমস্যা, সেগুলি নিয়ে কিছু কথা বলি।

প্রথম কথা হল, আমরা অবিভাজ্য কোনো জাতি নই। আমরা একটি সম্পূর্ণ শ্রেণী-বিভক্ত জাতি। আমাদের দেশ পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পরে যাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন রকমের সহায়ক শক্তির দ্বারা সাপোর্টেড হয়ে আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, সেই শ্রেণীই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল, এমন এক যুগে আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে যখন বুর্জোয়াশ্রেণীর ঐতিহাসিকভাবেই আর কোনো প্রগতিশীল ভূমিকা নেই। কমরেড প্রভাস ঘোষ ইতিহাসের সেই সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে এই পুঁজিবাদী সামাজিক ব্যবস্থারও যে একটা বিরাট ভূমিকা ছিল তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু যখন বিশ্ব পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ এবং সর্বহারা বিপ্লবের যুগে তাদের আর কোনো প্রগতিশীল ভূমিকা নেই সেই রকম সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব করেছে বাংলাদেশের বুর্জোয়াশ্রেণী। বাংলাদেশের বুর্জোয়াশ্রেণী এই কথাটা যখন আমরা বলি তখন এদেশের বুর্জোয়াশ্রেণী কতখানি শক্তিশালী, কতখানি তার ইনডাস্ট্রিয়াল পাওয়ার আছে – সেটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
রাজনীতি এবং অর্থনীতি পারস্পরিক সম্পর্কিত — এটাই ঠিক। কিন্তু রাজনীতি প্রায়শই, কমরেড লেনিনের ভাষায়, অর্থনীতিকে সুপারসিড (অতিক্রম) করে। সে কারণে, বুর্জোয়াশ্রেণীর নেতৃত্ব-সংগঠন যা ছিল তার চেয়ে বড় কথা সেই উদ্দেশ্যেই এখানে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বুর্জোয়াশ্রেণী অধিষ্ঠিত। এবং যখন থেকে এই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের পত্তন হয়েছে — বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন এখানে হয়েছে যার সবটাই কিন্তু পুঁজিবাদকে সংহত করার লক্ষ্যে হয়েছে। যারা শাসক হিসাবে এসেছে তাদের মধ্যে কেউ খুব ভালোভাবে চেষ্টা করেছে, কেউ হয়ত ততখানি ভালোভাবে পারেনি — সেটা তাদের বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা-যোগ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু শ্রেণী হিসাবে বুর্জোয়াশ্রেণী যেহেতু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সেজন্য পুঁজিবাদকে সংহত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। ফলে বাংলাদেশের যে কোনো মানুষ, যারা সাধারণভাবে অর্থনীতি বোঝেন তারা বুঝতে পারবেন যে গ্রাম-শহরের কোথাও এখন সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যের বাইরে আর কোনও উৎপাদন সম্পর্ক এদেশে নেই। এবং শ্রম এবং পুঁজির দ্বন্দ্বই এখানকার প্রধান দ্বন্দ্ব।

গোটা দুনিয়া জুড়ে পুঁজিবাদের যে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থা, সে অবস্থার মধ্যে আমাদের দেশে পুঁজিবাদের জন্ম। এবং সেই কারণে কোথাও তার এতটুকু প্রগতিশীল ভূমিকা, এতটুকু দেশপ্রেমিক ভূমিকা, এতটুকু জনগণের পক্ষের ভূমিকা আমরা দেখিনি। কিন্তু যে প্রবল শক্তিতে আমরা স্বাধীনতা আন্দোলন করেছিলাম, আমাদের দেশে যে ভয়াবহ নৃশংসতম হত্যাকা- হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছিল — তার মধ্যে যে প্রবল আবেগ, আশা-আকাক্সক্ষা জড়িয়েছিল — কিন্তু উচ্চ রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন বোধ আমাদের জনগণের মধ্যে না থাকায় সুযোগ নিয়ে দেশীয় পুঁজিবাদ এইখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবং জন্মের পর থেকেই আমরা প্রতিটি সরকারের আমলেই দেশবাসীকে লুণ্ঠন করা, তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করে তাদেরকে সর্বহারা করা, প্রতিদিন গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ শহরের দিকে আসছে — জীবন-জীবিকা তাদের অনিশ্চিত হয়ে গেছে — এই সমস্ত বহু তথ্য আছে যেগুলি দিয়ে আমরা প্রমাণ করতে পারব যে আমাদের এ দেশটা একটা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মধ্যে চলছে।

শহীদ বেদীতে মাল্যদান
শহীদ বেদীতে মাল্যদান

আমি এর বিশেষ ঘটনাসমূহের মধ্যে যাচ্ছি না, আমি শুধু বলতে চাইছি যে বাংলাদেশে দুইটি পক্ষ — পুঁজিপতিশ্রেণী আর সর্বহারা। ঘটনাক্রমে ঐতিহ্যের দিক থেকে বাংলাদেশের বুর্জোয়ারা বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয়ে আছে। এর একটা অংশ হল, যারা একসময় পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল, যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বর্তমানে আমরা সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে যাদের বিচার কামনা করছি, চেয়েছি, সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আংশিকভাবে হলেও হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে সমস্ত জনগণকে যুক্ত করে তাদের যে বিচার হওয়া উচিত ছিল সেগুলি হয়নি। এখন কিছু বিচার হচ্ছে, প্রধান প্রধান কুখ্যাত কিছু লোকের শাস্তি হচ্ছে — যদিও এখনও অনেক কিছু অনিশ্চিত থাকছে, অনেক আপস, গোপন বহু জিনিসের সম্ভাবনা আমাদের দেশের মানুষ আঁচ করে। আরেকটা অংশ হল যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। কিন্তু পুঁজিবাদী শাসনের নিয়ম অনুযায়ী এরা সবাই জনবিরোধী শাসনই পরিচালনা করেছে বা করছে। এবং এর মধ্য দিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই বাংলাদেশের কোনো সরকারের যে আর জনপ্রিয়তা থাকে না — জনবিরোধী কার্যকলাপ, লুটপাট, সীমাহীন দুর্নীতি — এক আমল আরেকটা আমলকে পরাস্ত করার জন্যে, কনটেস্ট করার জন্যে তারা দুর্নীতির চরমে তুলে দিয়েছে আমাদের দেশকে — এখন আর নীতি-আদর্শ নিয়ে কোনো রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করা কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব না।

এইরকম একটা পরিস্থিতিতে দেশ যেহেতু শ্রেণী বিভক্ত — পক্ষ যদি বলতে হয় তাহলে বলতে হবে লুটেরা মালিকগোষ্ঠী আর জনগণ, পুঁজিপতিশ্রেণী আর সর্বহারা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ইত্যাদি কথা বলে পুঁজিপতিদের মধ্যে ঐতিহ্যগত যে পার্থক্য আছে — সেই পার্থক্যের সুবিধা নেয়ার উদ্দেশ্য থেকে তারা পক্ষ বিপক্ষ করছে। আসলে তারা ওভারঅল একটা শ্রেণী অর্থে এক পক্ষ। এই যে মৌলবাদী শক্তিগুলো এখনো দেশে বিরাট শক্তি হিসাবে আছে — বিভিন্ন ভাবে আছে তারা — হেফাজতে ইসলামের নামে আছে, জামাতে ইসলামের নামে আছে, বিভিন্ন ইসলামী শক্তির নামে আছে। এখন যদি কালকে — আমরা কোনও ভাবেই এটা কামনা করছি না — তারা যদি দেশের মানুষের সমর্থন নিয়ে — যারা আধুনিক শাসনের কথা বলে তাদের দুর্নীতি, অনৈতিকতা এগুলি দেখিয়ে মধ্যযুগীয় যে চিন্তাভাবনা তারা ধারণ করে — আমাদের ব্যাপক জনগণের মধ্যে তার প্রভাবও আছে — তার সুযোগ নিয়ে যদি এরা কখনো ক্ষমতায় আসে তাহলে ওরা কি করবে? ওরা এসে কি আবার পুরনো সামন্তীয় রাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অথবা খিলাফৎ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? খিলাফৎ প্রতিষ্ঠা করার একটা কথা মধ্যপ্রাচ্যেও শোনা যাচ্ছে। খিলাফৎ আসলে কিছু না। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ একেকটা মিনেস (উপায় বা যন্ত্র) তৈরি করে, সেগুলিকে দিয়ে একটা সাময়িক কাজ করিয়ে নেয়। তারপর এরা যেহেতু একটা শক্তি হিসাবে কাজ করে, যেহেতু এদের অস্ত্র দেয়, অর্থ দেয়, অস্ত্র দিয়ে বিরোধী শক্তিগুলোকে দমন করে — তখন সেই অস্ত্রধারী শক্তিগুলো আবার নিজেরা একটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবে পরিণত হয়। এরা উল্টো যারা তৈরি করেছিল তাদেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ ধরনের কনট্রাডিকশন পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় থাকবেই। এই মৌলবাদীদের ওরাই তৈরি করেছিল কমিউনিজম মোকাবেলা করার জন্যে। কমিউনিজমের অনেক রকম সংকট তখন হয়েছিল; সমাজতান্ত্রিক দেশের অনেক রকম ভুল-ভ্রান্তি হতে হতে তার পতন হয়েছে — আমরা সেই আলোচনায় যাচ্ছি না — বলছি, কমিউনিজম দমনের জন্যে যে তালেবানেরা তৈরি হয়েছিল, সেই তালেবানেরাই পরবর্তীকালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চলে গেল। এখন মার্কিনীরা তাদেরকে দমন করতে বাধ্য হচ্ছে। এদের ভাবখানা এমন যে একটা গোঁড়া মধ্যযুগীয় নৃশংস সন্ত্রাসী শক্তিকে দমন করছে। তারা তৈরি করেছিল যে কাজের জন্যে সেই কাজই করেছে — কিন্তু যেহেতু অস্ত্র হাতে পেয়েছিল সেহেতু অস্ত্র হাতে খানিকটা স্বতন্ত্র সত্ত্বা হিসাবে থাকতে থাকতে, খানিকটা জনগণের মধ্যে যে অপমান অবমাননা, সেগুলিকেও খানিকটা কাজে লাগিয়ে, প্রভাব বিস্তার করে তারা একটা শক্তি-ভিত্তি তৈরি করেছে। এইভাবে আপনারা জানেন, আরব দেশে আল কায়েদা, এখন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এইসব অর্গানাইজেশন (সংগঠন) যে তৈরি হয়েছে এগুলি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো সবাই সহায়তা দিয়ে এদের তৈরি করেছিল। তাদেরকে দিয়ে যে কাজ করাবে সেটা যখন করা শেষ হল, তখন তেলক্ষেত্রগুলো নিয়ে একটা বিরোধ তৈরি হল। তাদেরকে নিরস্ত্র করতে আর পারছে না, তারাও শক্তি হিসাবে মোকাবেলা করার মতো একটা জায়গায় চলে এসেছে — মোকাবেলা করতে পারুক না পারুক, সাময়িকভাবে একটা চেষ্টা করছে — এবং তাদের নিজস্ব কতগুলো উদ্দেশ্যও তৈরি হয়ে গেছে।

Convention_stageযে সাম্রাজ্যবাদীরা এসব করছে তার ফলে কি হয়? সেইখানে মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনা, ধর্মীয় কুসংস্কারগ্রস্ত চিন্তাভাবনা, সেইগুলিকে নিয়ে জনগণের মধ্যেই বিবাদ-বিসম্বাদ লাগিয়ে দিল। এখন দেখুন, শিয়া-সুন্নী বিরোধ। সুন্নীরা কিন্তু শিয়াদেরকে মুসলমান নয় এমন মনে করে না। তাদের সঙ্গে মতপার্থক্য আছে — কিছু বক্তব্য, কিছু চিন্তা, কিছু ইনটারপ্রিটেশনে পার্থক্য আছে — কিন্তু এখন তো তারা খুনাখুনি করছে। শিয়া-সুন্নীদের মধ্যে সেখানে চরম শত্রুতা — একজন আরেক জনকে ধ্বংস করার জন্য যা করা দরকার তাই করছে। কিন্তু এ সমস্ত কিছুই আসলে অতীতের পিছিয়ে পড়া চিন্তা, কুসংস্কার, অতীতের সংস্কৃতির প্রভাব যে মানুষের মধ্যে ছিল সেগুলিকে সাম্রাজ্যবাদীরা-পুঁজিবাদীরা কাজে লাগিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে এবং বিভক্ত মানুষকে আজকে ভয়াবহ অবস্থায় নিক্ষেপ করছে। এই মৌলবাদী শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের তেলক্ষেত্রগুলো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য কিছুটা সাময়িক অসুবিধার সৃষ্টি করেছিল। আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেট এরা এখনো করছে। ফলে তেলক্ষেত্রগুলোর উপর সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার সহযোগিরা মৌলবাদী শক্তিগুলো দমনের নামে বাস্তবে সাধারণ মানুষের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। এই যে সহযোগিরা, এরা আসলে কিছুই নয়। তারা যে কত দুর্বল হয়েছে, দুনিয়ার পরিস্থিতি ভালো করে আলোচনা করার সুযোগ পেলে বলতে পারতাম। ওই ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ভুক্ত দেশগুলো সবাই এখন ধুঁকছে। অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। আর শক্তি হিসাবেও কুঁকড়ে গেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা অস্ত্রের জোরে এবং গত বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন জায়গায় কর্তৃত্ব করার যে সুযোগ পেয়েছে সেগুলোর জোরে টিকে আছে। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে এরাও বিপর্যস্ত — দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ঋণগ্রস্ত জাতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ঋণগ্রস্ত কথাটা ব্যক্তিগতভাবেও বুঝতে পারেন যে ব্যক্তিগতভাবে ঋণগ্রস্ত গৃহস্থের কি হয়। পুরো জাতি পুরো রাষ্ট্র ঋণগ্রস্ত হিসাবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে।

এই ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে যে সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদ এই ব্যাপারে কমরেড প্রভাস ঘোষ নানা দিক থেকে বহু আলোচনা করেছেন। আমি শুধু দেখাচ্ছি, এই যে আল কায়েদা ইত্যাদি এদেরকে দিয়ে ওখানে মানুষে মানুষে বিভেদ লাগিয়ে — বিভেদের উপাদান হয়ত ওখানে মানুষের সংস্কৃতি, মানুষের চিন্তাভাবনার মধ্যে জড়িয়েছিল, সেটাকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে সমস্ত দেশগুলিকে। এই রকম সময়ে আমাদের দেশে পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছে। এই পুঁজিবাদ জন্ম থেকেই আমাদেরকে নিপীড়ন-শোষণ করছে। এই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে আমরা কিছুতেই রেহাই পাব না।

Convention_Narimuktiএখন আমরা একটা ছোট দল। সামান্য কিছু তরুণ যুবককে আমাদের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছি। ১৯৭২ সালে যখন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল হল, সে দলের মধ্যেই আমরা কিছু যোগাযোগের মধ্য দিয়ে, তাদের প্রধান নেতাদের মধ্যে যোগাযোগের মধ্য দিয়ে এ সংগ্রামটা আমরা শুরু করি। এক সময় তারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, শ্রেণী সংগ্রাম — এসব কথাগুলি বলছিল। তখন আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করি। এই যোগাযোগের মধ্যে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে একটা বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলা ছাড়া যে শুধু বিশাল যুবসমাজ এক জায়গায় জড়ো হলেই, লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়ো হয়ে গেলেই বিপ্লব সম্ভব না, সেটা বোঝাবার চেষ্টা, একটা বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার চেষ্টা আমরা করেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যে ভয়ঙ্কর শক্তি ক্ষমতায় বসল, দেশের সমস্ত সম্পদ লুটপাট করে তাদের পুঁজি সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করল এর ফলে সেই সময় যারা দেশপ্রেমিক এবং স্বাধীন হওয়ার পরে তাদের যে ব্যর্থতা, নিরাশা, হতাশা — এরা সব জড়ো হচ্ছিল যাদের প্রায় সবাই তরুণ। এই যুবশক্তির মধ্যে সর্বহারাশ্রেণীর মতাদর্শ — মার্কসবাদ-লেনিনবাদের যে প্রভাব পড়ে তার মধ্যেই আমার একটা সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার যে প্রশ্ন, আজকের যুগে যেভাবে সে পার্টি গড়ে উঠবে সেই চিন্তাটা নিয়ে আসি। এখানে তো মার্কসবাদ-লেনিনবাদের কথা আমাদের জন্মের আগেও ছিল। এ চিন্তা নিয়ে তো এখানে কাজ হয়েছে। কিন্তু কোনো সময়েই এ দেশে, যে পরিস্থিতি আমাদের দেশ অতিক্রম করছে তার যথার্থ বিশ্লেষণ করতে পারল না, শত্রু-মিত্র নির্ধারণ করতে পারল না, শত্রুর বিরুদ্ধে মিত্রদের ঐক্যবদ্ধ করে একটা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে দেশের জনগণকে নিয়ে একটা বড় আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ধারে-কাছেও যেতে পারল না। কেন পারল না? এসব প্রশ্নগুলিকে কেন্দ্র করে মার্কসবাদী চিন্তাভাবনার একটা নতুন দিক কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে নিয়ে আসি।

বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলন যখন বাইরের দিক থেকে দেখলে বিরাট শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়ানো, কোনো রকমের চিড় ধরেনি, এতটুকু মাত্র দুর্বলতা দেখা যায় নি, সেই রকম সময়ে কমরেড ঘোষ আদর্শগত ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্দোলনের যে সংকট — যেগুলো কমরেড প্রভাস ঘোষ আলোচনা করলেন — সেগুলি তিনি দেখিয়েছেন। এই শিক্ষাগুলো নিয়েই এদেশে এসেছিলাম। একটা সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী দল, একটা লেনিনবাদী পার্টি গড়ে তুলতে হলে কমরেড লেনিনের চিন্তাকে আরো সমৃদ্ধ ও যুগোপযোগী করা অত্যন্ত জরুরি। লেনিনের চিন্তা হল ব্যক্তিবাদের যখন এতটুকু সংকটগ্রস্ত চেহারা দেখা দেয়নি, সে সময়ের চিন্তা। আজ ব্যক্তিবাদ যখন চরম সংকটগ্রস্ত, যখন ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণাই একটা প্রিভিলেজে (সুবিধায়) পরিণত হয়েছে, আর কোনও রকমের দেশপ্রেমের সঙ্গে যুক্ত নয়, আর কোনও রকম ভাবেই মানুষের জন্যে ত্যাগের সঙ্গে যুক্ত নয় — এই রকম একটা চরম সংকটের কালে, যখন ব্যক্তিস্বার্থপরতাই হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে সম্পর্কিত — এই রকমের একটা সময়ে একটা সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী দল গড়ে তোলার জন্যে যে নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধ লাগে, এবং এই সংকটকে মোকাবেলা করার জন্যে যে আদর্শের মূর্ত রূপ লাগে, সেই শিক্ষা, পথনির্দেশ কমরেড শিবদাস ঘোষ বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের সামনে রেখে গেছেন। আমরা চেষ্টা করেছি কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার মাধ্যমে এদেশের যুবকদের, এইসব চিন্তাভাবনা যারা করছিল তাদের নিয়ে কাজ করতে। এই সংগ্রামে যৌক্তিকভাবে অনেক মানুষ আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন। কিন্তু এটাকে অনুশীলন করার যখন প্রশ্ন আসল, নিজের জীবনে ধারণ করার প্রশ্ন আসল, জীবনের সকল ক্ষেত্রকে ব্যাপ্ত করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত কিছুর মধ্যে এই মহান বিপ্লবী সংগ্রামকে ধারণ করার প্রশ্ন আসল — তাতে অনেকেই দাঁড়াতে পারলেন না। আমি কিন্তু তাদের কোনো ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করছি না, তাদের কোনো অমর্যাদা করছি না। আমি বলছি যে একজন সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী হিসাবে গড়ে ওঠবার জন্যে যে নিবিড় সংগ্রাম ব্যক্তিগত জীবনে পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে যৌথতা নির্মাণের জন্যে করতে হয়, সেই কাজটা তারা করতে পারলেন না। এই সমাজে ব্যক্তিস্বার্থপরতার ভিত্তিতেই তো আমরা বড় হই। সেইভাবেই আমরা গড়ে উঠি। আর এই রকমের একটা মানসিক ধাঁচা নিয়ে যখন আমরা গড়ে উঠি, তারই মধ্যে আবার পরবর্তীকালে সমাজের যে ঐতিহাসিক প্রয়োজন, যৌথতার ভিত্তিতে সমাজ পরিচালিত হওয়া উচিত — সেই ঐতিহাসিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে মানুষগুলো যখন সেভাবে গড়ে ওঠে দরকার — সেই রকমের একটা বিপ্লবী পার্টি, তার সংহতি দরকার। এইসব প্রশ্নগুলো নিয়ে যখন এসেছিলাম, তখন তার একটা বিরাট আকর্ষণ যুবকদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল।

জাসদের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট একটা গ্রুপ গড়ে তোলবার চেষ্টা চলছিল। তাদের লাল ইশতেহার নামক একটা পত্রিকায় কমরেড শিবদাস ঘোষের ‘কেন ভারতবর্ষের মাটিতে এস ইউ সি আই একমাত্র সাম্যবাদী দল’ যার মধ্যে তিনি দেখিয়েছিলেন কোন প্রক্রিয়া-পদ্ধতি আজকের যুগে অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে ইউনিফরমিটি অব থিংকিং (uniformity of thinking), ওয়ান প্রসেস অব থিংকিং (one process of thinking) — একই পদ্ধতিতে চিন্তা করা যা সর্বহারাশ্রেণীর দল গড়ে তোলার জন্যে অত্যাবশ্যক সেটা গড়ে উঠতে পারে। একই পদ্ধতিতে চিন্তা কে করতে পারে? বিজ্ঞানের লোকেরা বুঝতে পারে, একই পদ্ধতির চিন্তা ছাড়া কখনোই কোনও একটি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাবে না। ফলে একই পদ্ধতিতে চিন্তা — ওয়ান প্রসেস অব থিংকিং, ইউনিফরমিটি অব থিংকিং, ওয়াননেস ইন এপ্রোচ (oneness in approch), সিঙ্গেলনেস অব পারপাস (singleness of purpose) — এই বেইজ আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এর ভিত্তিতে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলা ছাড়া আজকের যুগে কোনো দেশেই সমাজের বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন সাধন সম্ভব নয়। এখন, এইসব প্রশ্ন নিয়ে অনেক জটিল পথ অতিক্রম করতে করতে শেষ পর্যন্ত আমাদের পার্টি গত দুই বছর আগে একটা বিভক্তির শিকার হল। জীবনের সর্বক্ষেত্রে মার্কসবাদ — এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে যে মূর্ত চিন্তা, বক্তব্য কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন — শুধু বাংলাদেশের বা ভারতের নয় — সমগ্র বিশ্বের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সামনে — ব্যক্তিবাদকে সম্পূর্ণ মোকাবেলা করার জন্যে যে যৌথতা গড়ে তোলার সংগ্রাম পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার কথা উনি এনেছেন, সেগুলি থেকে দলের কিছু নেতার সরে যাওয়ার প্রয়োজন এল। নিজেদের ব্যক্তিত্ব, তার প্রয়োজন, সেগুলিকে কেন্দ্র করে কমরেড শিবদাস ঘোষের যে অথরিটি সেটাকে অস্বীকার করলেন।

অথরিটি কথাটা মার্কসবাদী রাজনীতি বা বিজ্ঞানে সব সময় আছে। যখনই বিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়েছে, ইমপিরিসিজম (অভিজ্ঞতার স্তর) থেকে যখন কো-অর্ডিনেটেড সমন্বিত বিজ্ঞানের জন্ম হল, তখন থেকেই অথরিটি ধারণা তৈরি হয়েছে। অথরিটি একটি পর্যায় থেকে আরেকটা পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে। ন্যাচারাল সায়েন্সে (প্রকৃতি বিজ্ঞানে) যেমন অথরিটি থাকে, মার্কসবাদ যেহেতু সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক আদর্শ, এখানেও অথরিটি কনটিনিউয়াসলি অ্যাপিয়ার করবে এবং একটা পর্যায়ে এসে সেই অথরিটিদের অনেক কথা ইনএডুকোয়েট হবে। আবার তাকে এডুকোয়েট করার জন্যে, সেই ধারাকে আরো উন্নত করার জন্যে নতুন অথরিটিদের অ্যাপিয়ারেন্স হবে।
রাজনৈতিক কর্মীরা, সংগঠকেরা আমার কথা বুঝতে পারছেন। আমি জনগণের কাছে মাফ চাইছি যে আমাদের দলকে কেন্দ্র করে যেসব কথা সেগুলি আপনারা হয়ত আমার কথা থেকে বুঝতে পারবেন না। কিন্তু আমরা সবাই বাংলাদেশের বুকে এই যে নির্মম-নিষ্ঠুর পুঁজিবাদের শোষণ-শাসনের হাত থেকে বাঁচতে চাই। আর এর জন্যে চাই একটা সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি। পার্টির যে প্রয়োজন, সে প্রয়োজনটা বোঝাও আজকে বিপ্লবের আকুতি যাদের মধ্যে আছে তাদের বোঝাটা খুবই প্রয়োজনীয়। সব রকমের বিশ্লেষণ বলছে, আজ বিপ্লবী পার্টি কত প্রয়োজন।

আপনারা দেখলেন, দুনিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন হয়েছে — সেটা ঠিক। কিন্তু পুঁজিবাদী দেশগুলো কোথাও স্থিরভাবে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কোনো ধরনের স্ট্যাবিলিটি নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারছে না। আপনারা খেয়াল করেছেন, জেনোয়া থেকে সিয়াটল, কাঁপিয়ে দিয়েছিল দুনিয়াটাকে। এরপর আবার দেখুন শুরু হল, পর্তুগাল থেকে গ্রিস পর্যন্ত এই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো কি ভয়াবহ সংকটে। পুঁজিবাদের সংকট এবং তার বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের বিক্ষোভ। এই তো সেদিন ‘আরব বসন্ত’ কত ঘটনা দেখিয়ে দিল। কত সম্ভাবনা, কত আকাক্সক্ষা তৈরি করল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এগুলি একটা যুক্তিসম্মত পরিণতিতে যেতে পারেনি। তার মানে, এর পুরোটাই ব্যর্থ হয়েছে আমি তা বলছি না। নিশ্চয়ই এতবড় আন্দোলন মানুষের ভাবনার জগতেও অনেক পরিবর্তন ঘটাবে — কিন্তু সত্যিকার অর্থে একটা চোখে পড়ার মতো শক্তিশালী ভিত্তি ঐ দেশগুলিতে দেখতে পাচ্ছি না। মিসরে দেখুন, কি অবস্থা! মিলিটারির হাত থেকে মৌলবাদ, মৌলবাদের হাত থেকে আবার মিলিটারি। কত বড় কা- হল, কি বিশাল আত্মত্যাগ, কি প্রচণ্ড সংগ্রাম — কিন্তু দিশেহারা মানুষ। এতবড় যে আন্দোলন দেশে দেশে হল, সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি ছাড়া সেসব কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারল না।

ইউরোপের সমস্ত দেশে সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টির সংকট। কোন পার্টিই শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। আমি ইউরোপের নানা জায়গায় গেছি নানাভাবে। আমি দেখেছি, এই পার্টিগুলো এই একবার কিছু লোক জড়ো করে কিন্তু ধরে রাখতে পারছে না। কেন পারছে না? শুধু পুরনো কথা দিয়ে, পুরনো যুক্তি দিয়ে মানুষকে আর বোঝানো যাবে না। মানুষকে বোঝানোর জন্যে মার্কসবাদের যে যুগোপযোগী ব্যাখ্যা, বর্তমান কালের যে নৈতিক সংকট, সাংস্কৃতিক সংকট, এবং এখনকার সময়ে অর্থনীতি মানুষকে কী ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলছে সেসব উপলব্ধি তুলে ধরতে হবে। পুঁজিবাদ যে আর দাঁড়াতে পারছে না এটা তো স্পষ্ট। কিন্তু যত সংকটই তার থাক, যত কাণ্ডই সে করুক যতক্ষণ পর্যন্ত সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে মানুষ সংগঠিত না হচ্ছে, ততক্ষণ কোথাও কোনো মুক্তির পথ, দিশা আমরা পাব না।
কমরেডস, আমাদের দেশে অনেক ঘটনা ঘটছে। আমাদের দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে করে বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা এইভাবে রাজনীতিকে পোজ করেন। অনেক প্রাণের বিনিময়ে এই দেশ যে মুক্ত হয়েছে তার সবটাই বুর্জোয়াশ্রেণী কুক্ষিগত করেছে। যার কারণে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ছিলাম আমাদের অনেক আকাঙ্ক্ষা মার খেয়েছে। যেহেতু রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নানা দিক থেকে শ্রেণী-দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশের অবস্থাকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা এবং সঠিক বিপ্লবী পার্টির দিশা তাদের কাছে নেই, সেজন্য অনেক দুর্নীতিবাজ লোকদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে শুনতে মানুষ বিভ্রান্ত। কি যে করবে বুঝতে পারছে না। ভয়ানক সংকটের মধ্যে মানুষ। আবার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল সেই সব শক্তির সঙ্গে মিলে বুর্জোয়াদের আরো যে শক্তি আছে সেগুলিও ক্ষমতায় এসেছে। এই রকম একটা অবস্থা চলতে চলতে এখন দেশের কি অবস্থা? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যে, সে কীভাবে ক্ষমতায় টিকে আছে, সে থাকতে পারছে কীভাবে?

মিলিটারি কিন্তু আমাদের এখানে বেশ কয়েকবার এখানে আসা যাওয়া করেছে। আনপপুলার হয়েছে, চলে গেছে বা বুর্জোয়াদের প্রয়োজন হয় নি — জনগণের সামনে তার চরিত্র সম্পূর্ণ উদ্ঘাটিত হয়ে যাচ্ছে দেখে এক সময় গুটিয়ে গেছে। কিন্তু এইবার তো মিলিটারি আসল না, এই বার তো ভয়ংকর একটা সংকটজনক পরিস্থিতি গেল। তার মানে বাংলাদেশের সমস্ত বুর্জোয়াশ্রেণী তাদের চায়নি, অন্য কিছু চেয়েছে। বাংলাদেশের বুর্জোয়াশ্রেণী একটা শক্তিশালী ভিত্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছে, একটা শক্তিশালী বুর্জোয়াশ্রেণীর অভ্যুত্থান এখানে ঘটেছে। অনেক সময় হয়ে গেছে, রাত হয়ে গেছে, না হলে তথ্য-টথ্য দিয়ে আলোচনা করা যেত। বাংলাদেশের মানুষ দরিদ্র হলে কি হবে, এখানকার বুর্জোয়ারা বেশ ধনী। ওই ভারতের কথা শুনলেন তো। ভারত কিন্তু এখন পৃথিবীর বিরাট একটা অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। কোন অর্থে? বুর্জোয়া অর্থে, পুঁজিবাদী অর্থে, সাম্রাজ্যবাদী অর্থে। কিন্তু সমস্ত দেশের মানুষের জীবনধারণের মানোন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত করলে ভারত কিন্তু পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের একটা। এমনিভাবে আমাদের দেশেও কোটি কোটি মানুষ বেকার, অভাব অনটন দুঃখের মধ্যে জীবনযাপন করে। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা। বেসরকারিকরণ করছে সর্বত্র, শিক্ষার কী ভয়ংকর অবস্থা। এই যে হাসপাতাল — কোথাও মানুষের সেবামূলক কোনও কিছু নেই। সমস্ত কিছুতেই ব্যবসার ক্ষেত্র প্রসারিত করছে — এইরকম ভয়ংকর একটা সমাজ।

এর আরেকদিকে ধর্মের নাম করে আমাদের বিভ্রান্ত করে। সবাই করে। ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করেছে একসময়, ব্যবসা-ট্যাবসা এইসব ভাষা আমি বলতে চাই না। এরা ধর্মের নাম নিয়েই মানুষের উপর ভয়ংকর অত্যাচার, নৃশংসতা করেছে। এরাও ধর্মের কথা বলে। আবার যারা পুঁজিবাদী কায়দায় আমাদের উপর হাজার রকম অত্যাচার-অন্যায় করছে, শোষণ-নির্যাতন করছে, আমাদেরকে প্রতিদিন জমি-হারা করছে, বাড়ি হারা করছে, চাকুরি হারা করছে — তারাও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, ধর্মের কথা বলে বিভ্রান্ত করছে। আমাদের গ্রামের জনগণের কি ভয়ংকর অবস্থা — কোনো কর্মসংস্থান নাই। গ্রামের যুবকদের কি দরকার? সারা বছর এরা বেকার থাকে। বেকার মানুষের কর্ম পাওয়া হল এদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা। পুঁজিবাদ যতদিন আছে, আপনাদের আমাদের এসব সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারবে না। ফলে যারা পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যে আরো নানা রকমের কথা এনে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ এইসব কথা এনে পুঁজিবাদকে আড়াল করার জন্যে বিভিন্ন কায়দা তৈরি করছে সেগুলো আমাদের দেশের গরিব মানুষকে বুঝতে হবে। বিভিন্ন কায়দা আছে, ধর্মীয় কায়দা আছে, আধুনিক কায়দা আছে — এইসব কায়দাই তারা প্রয়োগ করছে। এর সাথে আছে সমস্ত মিডিয়া শক্তি। খেয়াল করুন, বিশাল বিশাল মিডিয়া পাওয়ার, যারা জনগণের মাথায় সর্বক্ষণ কী করতে হবে, কী চিন্তা করতে হবে, কী খেতে হবে, কী পড়তে হবে, কোন বেশভূষা নিতে হবে — সবকিছু তৈরি করে দিচ্ছে। গ্রামের একদম গরিব মানুষ, আমাদের চাষী-ভুষিরা, আজকে আধুনিক জীবন কীরকম করে যাপন করতে হয় সেটা জানে? এই সব কিছু বুর্জোয়ারা শেখাচ্ছে। তাদের প্রয়োজন মতো শেখাচ্ছে, তাদের মতো করে শেখাচ্ছে। লোভ-লালসা, সুবিধা এবং প্রতিযোগিতা — এই ধরনের মনোবৃত্তিগুলিকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে শেখাচ্ছে। এই ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে দেশটা আছে।

এই বিষয়গুলো বুঝলেই বুঝবেন পুঁজিবাদের ভয়ংকর সংকটের মধ্যে আমরা আছি। এবং আমাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্যে পক্ষ-বিপক্ষ করছে। দেশে অবশ্যই দুইটা পক্ষ আছে — একদিকে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ, তারা একটা পক্ষ। সব রকমের মেহনতি মানুষ — হোয়াইট কালারড এমপ্লয়ি যারা, যারা কাজ করে জীবন ধারণ করে তারা যাই মাইনা পাক না কেন, তারা সবাই সংকটগ্রস্ত। ১ লক্ষ টাকা মায়না পেলেও তারা সংকটগ্রস্ত। অভাবের মধ্যে আছে। ওই লোক দেখানোর জন্যে প্রত্যেকে নিজের স্ট্যাটাস মেনটেইন করতে গিয়ে জেরবার হয়ে যাচ্ছে। একমাত্র লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকার মালিক যারা তাদের এই ধরনের আর্থিক সংকট নেই। কিন্তু তাদেরও সংকট আছে। দুনিয়ার মানুষকে দুঃখের মধ্যে রেখে কেউ নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারবে না, কেউ পারবে না। একমাত্র কমিউনিজমের পথ, সমাজতন্ত্রের পথ সমস্ত মানুষকে মুক্ত করতে পারে। তো কমিউনিজম তো অনেক দূরের কথা, তার আগের যে পর্যায়, সেই পর্যায় হল এখন পুঁজিবাদকে মোকাবেলা করার জন্যে আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার।

বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের যে শ্রদ্ধেয় বন্ধুরা আছেন, তাদের যে আত্মত্যাগ, তাদের যে সংগ্রাম, তাদের যে সারাজীবন ধরে মানুষের পক্ষে থাকার জন্যে অনেক রকম কষ্টকর জীবন তাদের আছে। এ সবকিছুকে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে শুধু এ কথাটা বলব যে, কোনও আত্মত্যাগ কোনও সততাই আমাদেরকে সঠিক পথের দিকে নিয়ে যেতে পারবে না। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী যথার্থ চিন্তার ভিত্তিতেই আমাদেরকে বুঝতে হবে যে সঠিক একটা রাজনৈতিক লাইন ঠিক করতে না পারলে শত্রু-মিত্রও আমরা যথার্থভাবে চিহ্নিত করতে পারব না। বন্ধুদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারব না।

আমাদের দেশে বহুদিন ধরে সত্যিকারের গণআন্দোলন নেই। আগে যে গণআন্দোলনগুলি হয়েছে, বড় বড় আন্দোলনগুলি হয়েছে, সেগুলো কিন্তু খানিকটা বুর্জোয়াদের বিভিন্ন প্রয়োজন থেকেই হয়েছে। জনগণেরও প্রয়োজন ছিল। মিলিটারি শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়োজন জনগণেরও প্রয়োজন। কিন্তু সিভিল রুল নিয়ে আসা বুর্জোয়াদেরও দরকার ছিল, গণতন্ত্র-টন্ত্র এইসব বলে। কোনও গণতন্ত্র আমাদের দেশে বুর্জোয়ারা দেয় নি। গণতন্ত্রের কিছুই ওরা জানে না। ওরা জানেও না, ওরা ফ্যামিলিতে প্র্যাকটিস করে না, ওরা দেশে প্র্যাকটিস করে না; ওদের ওয়ে অব লাইফ, মোড অব লাইফের মধ্যে গণতন্ত্রের কোনও চিহ্ন মাত্র নেই। বুর্জোয়া অর্থে যে গণতন্ত্র সেটারও নাই, আর সর্বহারা যে গণতন্ত্র সেটা তো বহু উচ্চমানের বিষয়। এই রকমের এক কঠিন দিনের ভেতর দিয়ে আমরা পার হচ্ছি।

বামপন্থী আন্দোলনে দুর্বলতার কথা সবাই বলেন। দুর্বলতা কথাটার মানে কি? প্রথম তো দুর্বল থেকেই শুরু করতে হয়। তারপরে লড়াই করতে করতে, মার খেতে খেতে সবল হতে থাকে। জেলে যাওয়া, লাঠি খাওয়া, গুলি খাওয়া এসব তো অনেক দিন বন্ধ হয়ে গেছে এ দেশে। সেই রকম করে বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তোলার যে একটা সংগ্রাম সেটাও তো হচ্ছে না। আমি অসুস্থ অবস্থায় আর বেশি কথা বলতে পারব না। কমরেডদেরকে, আমাদের বামপন্থী নেতৃত্বের কাছেও আবেদন করছি যে সঠিকভাবে দেশের পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করতে না পারলে একটা যুক্তফ্রন্টীয় যে আন্দোলন, যা ছাড়া আপনারা আমরা কেউ বিকশিত হতে পারব না, সেটা গড়ে তোলার জন্য। যে কোনো বিপ্লব — জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব বলুন, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলুন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলুন — প্রত্যেকটার মধ্যেই যুক্তফ্রন্টীয় একটা আন্দোলন আছে। কিন্তু যুক্তফ্রন্টীয় আন্দোলনের মধ্যে ন্যূনতম যে বিষয় সেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোচ্চ বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সর্বনিম্ন যে কর্মসূচি তাকে ভিত্তি করে যুক্তফ্রন্ট আন্দোলন। নিজের নিজের রাজনৈতিক লাইন নিয়ে আমাদের মধ্যে বিরোধ আছে, সেগুলো নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে অনেক সময় লাগে, হয়ত বিপ্লবের চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে ওভারঅল ইউনিটি ডেভেলপ করে। কিন্তু আগে তো জনগণকে সংঘবদ্ধ করে তাদেরকে নিয়ে আন্দোলন করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কমরেড আমাদের এখানে যে সরকার বসে আছে তার চরিত্রটা একটু ব্যাখ্যা করে দেখাই। ওরা একদম বেআইনিভাবে বসে আছে। বেআইনি কথাটার মানে কি? ওরা জনগণকে শাসন করার জন্যে, শোষণ করার জন্যে যে আইন তৈরি করেছিল, এমনকি সেটার যে একটা বাহ্যিক লোক-দেখানো ভঙ্গি আছে, একটু মানুষের কথা বলার অধিকার, মিছিল-মিটিং করার অধিকার — এগুলি থাকে, সেগুলি সবকিছুকে বাদ দিয়ে, ওই আইন-টাইন কোনো কিছুকে না মেনে শাসন চালাচ্ছে। নিজেদের তৈরি আইন নিজেরাই কনটিনিউয়াসলি ভাঙছে। ওরা আইনের শাসন বলে কোনো কিছু বিশ্বাসও করে না। সেই যে এক সময় আইনের শাসনের কথা বলা হত, বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতার কথা বলা হত, প্রশাসন সম্পূর্ণ সরকারের প্রভাব মুক্ত থাকবে — এসব কথা বলা হত, সেসবের কিছুই অবশিষ্ট নেই। স্বাধীন বিচারবিভাগ এবং পার্লামেন্টের যে একটা সার্বভৌম শক্তি — কোনো কিছু এখানে নেই। পুঁজিবাদীদের যে মূল স্বার্থ, তাকে রক্ষাকারী হিসাবে যারা ক্ষমতায় থাকে, সরকারে থাকে Ñ তাদের চোখের ইশারায় সব হয়। পুঁজিবাদের সেবাদাস হিসাবে যারা ক্ষমতায় আছে তারাই এখন সমস্ত কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন বাংলাদেশে এইরকম একটা বেআইনি সরকার বসে আছে কীভাবে? বিচারবিভাগ সমর্থন করছে। প্রশাসনের কোনো রকমের বিরোধ নেই, তাদের অভ্যন্তরে বিরোধ থাকলেও তার প্রকাশ নেই, জনগণের পক্ষে কোনো বিরোধ বাহ্যিকভাবে নেই। মিলিটারি কত বার আসল-গেলো, কিন্তু তারাও এবার চুপচাপ, সরকারের পক্ষে আছে। তার মানে হল, বাংলাদেশে নির্মম পুঁজিবাদের আরো প্রসার ঘটাবার জন্যে এরা আছে।

উন্নত দেশগুলো যখন তাদের কল-কারখানা বন্ধ করছে, সেখানে আর পুঁজি খাটাতে পারছে না, তখন অনুন্নত দেশগুলিতে পুঁজি খাটাবার ক্ষেত্র প্রসারিত হচ্ছে। আমাদের এখানে আরো একটু প্রসারিত করার চেষ্টা তারা করছে, ইপিজেড ইত্যাদি আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। এই প্রয়োজনের জন্যে বাংলাদেশের সমস্ত ধনকুবের যারা তারা এদের পক্ষে আছে। এদেশের ধনপতিগোষ্ঠী হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। ১৫-২০ হাজার কোটি টাকার কনসেনট্রেশন এখানকার বিগ হাউজগুলির হয়েছে, তারা খানিকটা একচেটিয়া রূপ নিয়েছে। এই যে কনসেনট্রেশন অব ক্যাপিটেল হয়েছে তার জন্যে একটা ফ্যাসিস্ট শাসনের যে প্রক্রিয়া এখানে জারি হয়ে গেছে। তার থেকে আমাদের এখানে এই সরকারকে তারা সমর্থন করছে। বিচারবিভাগ সম্পূর্ণ তাদের পক্ষে আছে। প্রশাসন আছে। মিলিটারি তাদের পক্ষে আছে। অনেক কিছু দেখলেন তো! সর্বোপরি আছে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ। দৃঢ়তার সঙ্গে আছে। তার একক কর্তৃত্বে বাংলাদেশ পরিচালিত হবে। বাংলাদেশে আর কোনো বাইরের শক্তি বেশি মাথা ঢুকাতে পারবে না। বাংলাদেশের বুর্জোয়াদের নিজেদের স্বার্থকে কেন্দ্র করে যতটুকু বিরোধ আছে যা ভারত মোকাবেলা করতে পারবে না — ততটুকুকে নিয়ে কনট্রাডিকশনে থাকতেই হবে। হয়ত দেখা যাবে একটু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ কিছু লেন-দেন করছে, বা আরেক জনের সঙ্গে কিছু করছে, কিন্তু ভারত খুব দৃঢ়তার সাথে তার সঙ্গে আছে। আর এখন জনসাধারণ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে শাসনক্ষমতায় থাকার জন্যে এই শক্তিগুলোকে এভাবে মবিলাইজ করেছে। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ দৃঢ়তার সঙ্গে এদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এর ফলেই এরা এত শক্তি নিয়ে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে। বিরোধী শক্তি যারা তারা লক্ষ লোক জড়ো করতে পারে। কিন্তু কোনো আন্দোলন তারা তৈরি করতে পারে নি। আমার ধারণা, পারবেও না। যখন বুর্জোয়ারা চাইবে যে এরা সরে যাক, এরা মানুষের চোখে আর গ্রহণযোগ্য নেই, তখনই কিছু হবে। আর মানুষ বরদাস্তও করবে না, ফলে বিশাল কা- ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার ছোট ছোট পার্টি হয়ত দেখা যাবে ওই রকম একটা সংগ্রামের মধ্যে বিরাট শক্তি হয়ে গেছে — তার ভয়ে বুর্জোয়ারা হয়ত ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু এখন দৃঢ়তার সঙ্গে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত বেশ কিছু দিন চলবে।

এইরকম একটা অবস্থার মধ্যে বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এবং জটিল না করে জনগণের সাফারিংসগুলিকে (সংকটগুলিকে) তুলে ধরে তার ভিত্তিতে আন্দোলনে নামতে হবে। এই গণআন্দোলনের যাতে স্থায়ী শক্তি ডেভেলপ করানো যায় সে চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। রাজনীতি যখন করি তখন আন্দোলনের মধ্যে প্রত্যেকেই আমরা প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করব, কিন্তু জনগণের আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোনো বিরোধ-সমস্যা নেই। আমাদের দলের বাইরেও জনগণের আন্দোলনের শক্তি, প্রতিরোধের শক্তিগুলি গড়ে ওঠা দরকার। এবং এই প্রতিরোধের শক্তিই একদিন ধীরে ধীরে সারাদেশে জালের মতো নেটওয়ার্ক তৈরি করে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে একদিন বিশাল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে যেতে পারব। এই সমস্ত সম্ভাবনাগুলিকে বাস্তবায়িত করতে হলে একটা বিপ্লবী পার্টির বিরাট প্রয়োজন। সে প্রয়োজনকে কেন্দ্র করেই আমাদের পার্টি বিশেষ কনভেনশন করছে।

আমরা অতীতে যে পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম, সে পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতেই গড়ে উঠছিল। ওই জাসদের ভেতরেও তার প্রমাণ আছে। আমাদের পার্টি এতদিন ধরে যে চলেছে তার মধ্যে প্রমাণ আছে। খেয়াল করুন, এমন একটা সময়ে হাজার হাজার লোকজন জড়ো করতে পারি যখন সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়। যখন সমাজতন্ত্র সমস্ত বিশ্বে পর্যুদস্ত হয়ে গেছে, সাময়িকভাবে হলেও হেরে যাচ্ছে, তখনকার সময়ে সমাজতন্ত্রের পক্ষে থাকাটা ভীষণ কষ্টকর কাজ, সেই সময়ে বাংলাদেশে আমাদের পার্টি ধীরে ধীরে যুবশক্তিকে এমনভাবে জড়ো করতে পেরেছিলাম যে হাজার হাজার মানুষ আমাদের পক্ষে ছিল। এবং সেদিন সমস্ত বামপন্থীরা — আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি, কাউকে অসম্মান করার জন্যে না — সমস্ত বামপন্থীরা হতচকিত হয়ে দেখেছে যে কীসের জোরে এইভাবে যুবশক্তিকে এরা রাস্তায় নামাতে পারে! নিঃস্বার্থভাবে ক্রিয়া করতে পারে!

মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অমোঘ শক্তির সঙ্গে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা, তার আদর্শ। মার্কসবাদের সবচেয়ে উন্নত প্রকাশ এ যুগে যার মাধ্যমে হয়েছে তার চিন্তাধারার ভিত্তিতে একটা পার্টি গড়ে তোলার সংগ্রাম আমরা করছিলাম। কিন্তু অনেক জটিল পথ অতিক্রম করার যে সংগ্রাম, সে পথে আমরা মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছি। ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখবেন, আমরাই শুধু না, দুনিয়ার অনেক দেশেই বিপ্লবী পার্টি ভাঙা-গড়া, ভাঙা-গড়া এগুলির ভেতর দিয়ে গেছে। এগুলি হয় তার কারণ হল, অনেক বন্ধুর পথ বেয়ে, শ্রেণীসংগ্রামের তীব্রতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী আদর্শকে সংহত করার প্রক্রিয়া চলে। ফলে, হতাশ হওয়ার কোনো কিছু নেই। আমরা হতাশ হলেই মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না। আমাদের কিন্তু কোনও উপায়ই নেই, বিপ্লব ছাড়া কোনও পথ নেই। এই বিশ্বাস ধারণ করি, জীবনের সর্বশেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ আদর্শ নিয়ে এ পথে এগোতে চেষ্টা করব। এ পার্টি গড়ে উঠবেই। এ প্রতিজ্ঞা করেই আজকে আমরা প্রথম প্রকাশ্য অধিবেশনের কাজ শেষ করব। এরপর তিন দিন আমাদের ডেলিগেট সেশন চলবে। আমাদের কমরেডরা সারাদেশ থেকে এসেছে। তাদের অনভিজ্ঞতা অনেক, আবার তাদের প্রচ- আশা-আকাক্সক্ষা। এবং তারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করা, দেশের মানুষকে সংগঠিত করার কাজে প্রাণপাত করতে প্রস্তুত। চিন্তার ঐক্য গড়ে তোলার যে সংগ্রাম সে সংগ্রামের প্রক্রিয়াতে আমাদের তিন দিনের প্রতিনিধি অধিবেশন চলবে। এর মধ্য দিয়েই আমাদের কনভেনশনের কাজ শেষ হবে।

নেকক্ষণ ধরে আপনারা বসে আছেন, সারাদিন কষ্ট করেছেন, অনেক দূর দূর থেকে আপনারা এসেছেন, আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর একটা কথা, যারা আমাদের দলের সঙ্গে যুক্ত নন, সর্বসাধারণকে বলছি। এই কনভেনশনের কিছু প্রচার-প্রোপাগান্ডা চোখে পড়ার মতো হয়ত হয়েছে। মনে হবে যেন আমরা প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করেছি। কিছু টাকা-পয়সা খরচ করেছি সেগুলিও মানুষের কাছ থেকে তুলেছি। চোখের সামনে মানুষ দেখতে পেয়েছে টাকা কীভাবে সংগ্রহ হয়। আমাদের কমরেডরা পরিশ্রম করে করে এসব করেছে। সারাদিন কালেকশন করেছে, সারা রাত জেগে জেগে দেয়াল লিখন করেছে, পোস্টার লাগিয়েছে, পার্টির প্রচার-প্রোপাগান্ডা করেছে। পার্টির প্রচার-প্রোপাগান্ডা যতখানি চোখে পড়ার মতো হয়েছে সেটা আমাদের কমরেডদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। আমি কমরেডদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা জিন্দাবাদ!
দুনিয়ার মজদুর, এক হও!

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments