Sunday, December 22, 2024
Homeবিশেষ নিবন্ধবিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যু -- টেরি ঈগলটন

বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যু — টেরি ঈগলটন

finial coverবিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে কি মানবিকবিদ্যা উধাও হতে যাচ্ছে? প্রশ্নটি রীতিমত অবান্তর। পানশালা থেকে কি মদ উঠে যাচ্ছে অথবা হলিউড থেকে অহম? – প্রশ্নটি অনেকটা সেরকমই ঠেকবে। সুরা ছাড়া যেমন সুঁড়িখানা হয়না, তেমনি মানবিকবিদ্যা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় হয় না। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি থেকে ইতিহাস ও দর্শন প্রভৃতি মুছে ফেলা হয়, তবে এটি কেবল কারিগরি প্রশিক্ষণ অথবা কর্পোরেট প্রশিক্ষণ অথবা কর্পোরেট গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হবে। তখন সেটা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্রুপদী সংজ্ঞার সঙ্গে মিলবে না। তারপরও এ নামে ডাকা হলে তা হবে বিভ্রান্তিকর।

অন্যদিকে, মানবিক বিষয়গুলোকে অন্যান্য বিভাগগুলো থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত করে রেখেও প্রকৃত অর্থে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে না। মানবিকবিদ্যার বিষয়গুলোকে খাটো করে দেখানোর সহজতম উপায় হলো : এগুলোকে একেবারে হটিয়ে না দিয়ে একরকম বাড়তি পাওনা হিসেবে দেখানো। ফলে অবস্থাটা দাঁড়াচ্ছে যে; পাঠ্যবিষয় হিসেবে আইন ও প্রকৌশল হলো পৌরুষদীপ্ত, অন্যদিকে চিন্তা ও মূল্যবোধের বিষয়গুলো বড্ড মেয়েলী। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই হলো সকল বিদ্যাচর্চার মূলে থাকতে হবে মানবিকবিদ্যা। সাহিত্য ও কলা বিভাগে তো বটেই, আইন আর প্রকৌশল অনুষদের শিক্ষার্থীদেরও ইতিহাস ও দর্শনবিদ্যা এবং সঙ্গে কিছুটা শিল্প-সাহিত্যও পাঠ করতে হবে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানবিক অনুষদগুলো এখনও মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন নয়, কেননা উচ্চশিক্ষার অন্যসব বিষয়ের সাথে এটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

তথাকথিত মানবিক বিষয়গুলোর বর্তমান চেহারাটি ১৮শ শতকের গোড়ার দিকে প্রথম ফুটে উঠে। তখন তাদের একটা তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা ছিল। সেই সময়ে এসব বিভাগের দায়িত্ব ছিল সমাজের মূল্যবোধ আগলে রাখা ও মানুষের মাঝে এসবের অনুশীলন ছড়িয়ে দেয়া। কিন্তু এ কাজে বৃহত্তর সমাজের হাতে খুব কমই সময় বরাদ্দ থাকত। আধুনিক মানবিকবিদ্যা ও শিল্পায়িত পুঁজিবাদ আসলে ছিল প্রায় যমজ সহোদর। একটা মূল্যবোধের কাঠামোকে সংরক্ষণ ও ভাবগত উৎপাদনকে রক্ষা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের দরকার ছিল দৈনন্দিন সামাজিক জীবন প্রবাহ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার। এমন দূরত্বের ফলে এই আন্তরিক জ্ঞানার্জনকেও ভাবা হয়েছিল বুঝি শোচনীয়ভাবে অকার্যকর। যদিও মানবিকবিদ্যা প্রচলিত জ্ঞানগরিমার সমালোচনা করার সুযোগ পেয়েছিল।

সত্যিকার অর্থে কেমন জীবন যাপন আমরা করছি এবং কেমন জীবন আমাদের হতে পারত- এই বিতর্ক সময়ে সময়ে আমাদেরকে রাজপথে নিয়ে গেছে, যেমনটা বৃটেনে গত কয়েক সপ্তাহে ঘটেছে কিংবা ঘটেছে ’৬০-এর দশকের শেষ দিকেও।

আমরা এমন একটা সময় পার করছি যখন সমালোচনার কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যু ঘটেছে; আমরা তার জীবন্ত সাক্ষী। মার্গারেট থ্যাচারের সময় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সেবক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সরে এসেছে ন্যায়-নীতি, ঐতিহ্য, ভাবনা-চিন্তা, মানব-কল্যাণ ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা অথবা বিকল্প ভবিষ্যতের চিন্তা এবং এসবকে ভিত্তি করে প্রচলিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা থেকে। মানবিক বিভাগগুলোকে প্রায় কপর্দক শূন্য করে রাখার চেষ্টার বিপরীতে শুধু রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করলেই এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না। শুধুমাত্র শিল্পী বেমব্রাঁ কিংবা র‌্যাঁবোকে পড়ানো নয়, পরিস্থিতি পাল্টাবে তখনই, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে মানবীয় নীতি ও মূল্যবোধ স্থাপন করা যাবে।

শেষ পর্যন্ত মানবিক বিষয়গুলো কতটা অপরিহার্য-সেটিকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেই একে রক্ষা করা সম্ভব এবং এর মানে হলো ছাত্রদের পুরো শিক্ষাজীবনে এই বিদ্যার গুরুত্ব সম্পর্কে জোরারোপ করা। ব্যাপারটা এমন নয় যে, গরীব আত্মীয়কে আশ্রয় দিতে যেমন সেরকম খরচ হয় না, তেমনিভাবে মানবিকবিদ্যাকে বিবেচনা করা হবে।

চর্চার ভেতর দিয়ে এ লক্ষ্য আমরা অর্জন করব কীভাবে? আর্থিকভাবে দেখলে, এটি অবাস্তব। সরকার-ই বরং মানবিকবিদ্যাকে সংকোচিত করতে চায়, বাড়ানোর পরিবর্তে।

শেলীর কবিতা পড়ানোর পেছনে পয়সা খরচ করলে কি প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ব না? কিন্তু একটা বিশ্ববিদ্যালয় হতেই পারেনা অধিকতর মানবীয়সত্তার অনুসন্ধান ছাড়া। তার মানে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় আর বর্ধনশীল পুঁজিবাদ পরস্পর বিরোধাত্মক।এই বিষয়টির রাজনৈতিক তাৎপর্য টিউশন ফি’র প্রসঙ্গ থেকেও অনেক গভীরে প্রোথিত।

টেরি ঈগলটন যুক্তরাজ্যের ল্যাঙ্কাশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক, তাত্ত্বিক ও সমালোচক। গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১০ দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকায় তাঁর এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাপেক্ষে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে লেখাটি তুলে ধরা হলো। অনুবাদের ত্রুটির দায় আমাদের।

অনুশীলন : অক্টোবর ২০১৪ || সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments