গত ২৩ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে গেল এক বর্বরোচিত হামলাযজ্ঞ। ছাত্রী নিপীড়ন ও সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের ভিসি কার্যালয় ঘেরাওকালে ছাত্রলীগ এ হামলা চালায়। এর প্রতিবাদে গত ২৯ জানুয়ারি সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ঘটনাটিকে আড়াল করার জন্য বিভিন্ন মিডিয়ায় কতিপয় ব্যক্তিবর্গ বিভ্রান্তিকর নানা কথা বলছেন। সে ব্যাপারগুলোতে আলোকপাত করার আগে আসলে কী ঘটেছিল তা আগে আমরা একবার দেখে নেই।
ঘটনার পূর্বাপর
৭ কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে গত ১১ জানুয়ারি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র কর্মসূচি পালন করে। ১৫ জানুয়ারি সাধারণ ছাত্ররা যখন তাদের দাবি জানাতে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয় তখন প্রক্টর ও প্রশাসনের নির্দেশে শিক্ষার্থীদের হুমকি প্রদান ও মারধর করা হয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নেতা মশিউর সাদিককে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা উপাচার্য কার্যালয়ের ভেতর নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে এবং দুইদিন তাকে অজ্ঞাতস্থানে আটকে রাখে। পরবর্তীতে জানা যায়, প্রশাসনের পক্ষ থেকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে পুলিশ প্রশাসনের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়। ওইদিন ছাত্রীরা লাঞ্ছনার শিকার হয়। আন্দোলনরত একজন ছাত্রীর ভাষ্যমতে, ‘সেইদিন ওরা (ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী) আমাদের সাথে যা করেছে তা আমাদের জন্য ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। পা দিয়ে পেছনে লাথি দেওয়া, সিগারেট খেয়ে ধোঁয়া ছুড়ে দেয়া, নোংরা কথা বলা আরও কত কী!’
এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ১৭ জানুয়ারি ‘নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’র ব্যানারে শিক্ষার্থীদের উপর নিপীড়ন ও ছাত্রীদের উপর লাঞ্ছনার প্রতিবাদে অপরাজেয় বাংলায় মানববন্ধন ও পরে প্রক্টর অফিসের সামনে অবস্থান নেয়া হয়। দেখা গেল, সেদিন কলাভবনের সামনের গেট বন্ধ করে রাখা হয়েছে (যা কখনই বন্ধ রাখা হয় না)। প্রশাসনের এ আচরণে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা গেট ভেঙে ফেলে। এসময় প্রক্টর চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলেন। কিন্তু তিনি নিপীড়কদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অপারগতার কথা জানান। ওইদিন বিকেলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের কাছে তিন দফা দাবি জানায়। দাবিগুলো ছিল — নিপীড়নকারীদের সাময়িক বহিষ্কার, ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৩ জন ছাত্র প্রতিনিধিসহ তদন্ত কমিটি গঠন ও ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করে নিপীড়কদের আজীবন বহিষ্কার এবং ব্যর্থ প্রক্টরের পদত্যাগ। কিন্তু, দাবি পূরণ দূরে থাক, প্রক্টর ও প্রশাসন নিপীড়কদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিচার প্রার্থী অজ্ঞাতনামা ৫০/৬০ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করে। ৪৮ ঘণ্টা অতিবাহিত হবার পরও প্রশাসন যখন নিপীড়কদের রক্ষা করতেই তৎপর, তখন বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ২৩ জানুয়ারি উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেয়। ভিসি কার্যালয়ে সেদিন মূল চত্ত্বরের বাইরের গেট বন্ধ করে রাখা হয়। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা উপাচার্যের সাথে দেখা করে তাদের দাবিপূরণের বিষয়ে জানতে চায়। কিন্তু, উপাচার্য ছাত্রদের দাবি উপেক্ষা করে উপরন্তু ছাত্রলীগকে ডেকে এনে হামলার প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। সেদিন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতে বিভিন্ন হলের সহস্রাধিক নেতা-কর্মী লাঠি লোহার রড দিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। রেজিস্টার বিল্ডিংয়ের ভেতরে ও বাইরের গেটের সামনের অংশে প্রায় দু’ঘণ্টাব্যাপী চলে হামলা ও নির্যাতন। এতে মারাত্মকভাবে আহত হন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাবি শাখার সাবেক সভাপতি ইভা মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক প্রগতি বর্মণ তমা, সহ-সভাপতি সাদিকুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি উম্মে হাবীবা বেনজীর, শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহাদী, আরশাদসহ প্রায় অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী ও শিক্ষাথী। ছাত্রলীগের নৃশংস হামলা থেকে সাংবাদিকরাও রেহাই পায়নি।
সুবিধাবাদের সাথে যুক্ত শিক্ষকরা চরিত্র হারিয়ে ফেলছেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কথা বললে শামসুজ্জোহার কথা মনে আসবে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছিলেন। ঊনসত্তরের উত্তাল সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বাঁচাতে পুলিশকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে বাধা দেয়ায় গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। জীবন দিয়ে জীবনের মর্যাদা রক্ষার এরকম আরো কত উদাহরণ আছে। স্বাধীন দেশে আজ প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বরত শিক্ষকদের ভিতর শিক্ষার্থীদের প্রতি অভিভাবকসুলভ দায়িত্ববোধ কোথায়? এ দায়িত্ববোধ থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ম. আখতারুজ্জামানের পক্ষে কি সম্ভব ছিল ছাত্রদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করে ছাত্রী লাঞ্ছনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগকে ডেকে আনা? ভিসি কি কোনো চেয়ার নাকি ছাত্রদের ভালো মন্দ দেখার সর্বোচ্চ দায়িত্ব? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিরা দেখেও দেখান না, জেনেও জানেন না, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি হল একেকটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। এদেরই নির্লিপ্ত ও সহযোগী ভূমিকার কারণে শীতের রাতে গেস্টরুমে হাজিরা দিতে গিয়ে নিউমোনিয়ায় মারা যায় ছাত্র। দশ বছর আগে এফ রহমান হলে সিট দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের গোলাগুলিতে মারা যায় মেধাবী ছাত্র আবু বকর। গত কয়েকদিন আগে প্রকাশিত রায়ে দেখা গেল আবু বকর হত্যার জন্য কেউই দোষী সাব্যস্ত হয়নি। রায় যে হয়েছে, তাও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানে না। কোন বাবা-মা তার সন্তানের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি মেনে নেবেন?
বিভিন্ন টক শো, লেখালেখিতে প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ও শিক্ষক রাজনীতির সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং কতিপয় সাংবাদিক যেসব প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তাতে রীতিমত হবাক হতে হয়। নিতান্ত দলকালা না হলে এরা আন্দোলনের বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে গেটের তালা ভাঙ্গাকেই মূখ্য করে তুলতেন না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, যেন জীবনে এই প্রথমবার তালা ভাঙতে দেখেছেন। এদেশের ছাত্রসমাজ তার ন্যায্য দাবিতে কত কতবার ধর্মঘট, অবরোধ করেছে। শুধু তালা ভাঙা কেন, প্রশাসনকে বাধ্য করতে সহিংস হতে হয়েছে — তার ইয়ত্তা নেই। পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ আমলসহ বিভিন্ন সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রদের আপোষহীন ভূমিকা না থাকলে স্বাধীন দেশ কিংবা স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্তি — কোনোটাই মিলত না। অবাক করা বিষয় হলো — এদের মুখে ছাত্রী লাঞ্ছনা কিংবা বর্বরোচিত হামলার জন্য ছাত্রলীগের প্রতি কোনো নিন্দা নেই। সারাদেশে সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব, নারী নির্যাতন, মাদক ব্যবসাসহ শিক্ষার পরিবেশ বিপন্ন করার বিরুদ্ধে কোনো উচ্চারণ নেই! ভিসিকে রক্ষার যে হাস্যকর ভাষ্য ছাত্রলীগ তুলে ধরেছে, তাতে এদের কারো মাথায় প্রশ্নের উদয় হয়নি — পুলিশের দায়িত্ব কি ছাত্রলীগকে দেয়া হয়েছে? রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছিলেন, “… … বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ”। বাস্তবিকই বাংলাদেশে আজ বুদ্ধিজীবী শিক্ষকদের বড় অংশই ক্ষমতা ও পদপদবির সুবিধার জন্য নীতি-নৈতিকতা-মনুষ্যত্ববোধ সবকিছুকেই বিকিয়ে দিচ্ছেন।
চিত্রিত করার সেই পুরোনো কায়দা
বহু প্রত্যাশিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যখন চলছিল, সেসময় সরকারের যেকোনো গণবিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করলে একটি কথাই বলা হতো — ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বানচাল করার জন্যই এসব করা হচ্ছে’। সবক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন পদাধিকারীদের একই কৌশল! ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কখনো বলা হচ্ছে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এরা আন্দোলনে ছিল। আবার কতিপয় শিক্ষকরা উচ্চারণ করছেন সেই চিরায়ত বাণী — ‘একটি স্বার্থান্বেষী মহল বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে চায়’, ‘সরকারকে নাজুক অবস্থায় ফেলতে চায়’ ইত্যাদি। গন্ধশোঁকার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণীদের রিফ্লেক্সের বাইরে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য থাকবার উপায় নেই। কিন্তু এদের উদ্দেশ্য কপট। প্রকারন্তরে এরা ছাত্রলীগের আধিপত্যবাদী মানসিকতাকেই লালন করেন, তাকেই বজায় রাখতে সহায়তা করেন। এদের যেমন ছাত্রলীগের দরকার তেমনি ছাত্রলীগেরও অভিভাবকত্ব প্রয়োজন। এরকম শিক্ষকদের অ্যাকাডেমিক পাঠদানের ভিতর দিয়ে কীভাবে একজন ছাত্র প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে — এ এক বড় প্রশ্ন। সচেতন মানুষকে আজ এটি ভাবতে হবে।
আশা কোথায় তাহলে?
অন্ধকার যখন বড় হয়ে থাকে ভেতরের ছোট্ট আলোটি অনেক সময় দৃশ্যমান হয় না। ক্ষমতার মদমত্ততা, সুবিধাবাদের ধারা বর্তমানে প্রবল- এটা যেমন সত্য, পাশাপাশি এ কথাও সত্য একদল শিক্ষক আছেন যারা ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন। গণমানুষের যেকোনো অধিকারের প্রশ্নে এরা রাজপথে শামিল হোন। আশাবাদ এখানেই। প্রতিবাদের ছোট্ট কণ্ঠস্বরটিকে বড় করে তোলা ছাড়া আর কোনো পথ আছে কি? বেশিরভাগ শিক্ষার্থী যারা এ হামলাকে সমর্থন দেয়নি, আবার সক্রিয় অংশগ্রহণও করেনি, তাদেরও ভাবতে হবে ভীতসন্ত্রস্ত্র থেকে নিজের আত্মশক্তিকেই কি আমরা বিনাশ করছি না? দখলদার শক্তির কাছে আমাদের শিক্ষার পরিবেশ, জীবন, আত্মসম্মানবোধ সবকিছুকে বিকিয়ে দিচ্ছি না? আমাদের সংঘবদ্ধতা কতিপয়ের হাতে আমাদের বর্তমান জিম্মিদশাকে মুহূর্তেই পাল্টে দিতে পারে। আত্ম উপলব্ধির মধ্য দিয়ে সংগ্রামের ধারাটিকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে যেমন রক্ষা পাবে বিদ্যায়তন, একইভাবে রক্ষা পাবে মনুষ্যত্ব, ছাত্র-শিক্ষকদের চরিত্র।