ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রমাত্রেই জানেন যে পুঁজিবাদী দেশগুলিতে সংবিধান ও পার্লামেন্ট, যেগুলিকে আমরা দেখি সেগুলি চিরকাল ছিল না, চিরকাল থাকবেও না। ইতিহাস ও সমাজপ্রগতির ধারায় একটি বিশেষ স্তরে বিশেষ অর্থনৈতিক বনিয়াদের রাজনৈতিক উপরিকাঠামো হিসেবে, শাসক বুর্জোয়া শ্রেণী স্বার্থ ও অর্থনৈতিক বনিয়াদটির রক্ষক হিসেবে এদের আবির্ভাব ঘটেছে।
ইতিহাসের অগ্রগতির পথে বুর্জোয়ারা একদিন শ্রেণী হিসেবে সংগঠিত হয়ে, পুরাতন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙ্গে পত্তন করল নতুন পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিল্পবিপ্লব ঘটাল। পুরাতন সামন্তী অর্থনীতির বদলে নূতন পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক নিয়ম চালু করল, যে নূতন নিয়মের প্রথম অবস্থায় অর্থনীতির ক্ষেত্রে অবাধ ও সুষম প্রতিযোগিতার নীতিটি স্বীকৃত হল। এই যে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় সকলেরই অবাধ ও সমানাধিকারের নীতিটি স্বীকৃত হল – এরই পরিপূরক হিসেবে রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা, আইন-ব্যবস্থাতেও মানুষের সমানাধিকার ও অবাধ স্বাধীনতার নীতিটিকে স্বীকৃতি দেয় এমনই এক … রাজনৈতিক উপরিকাঠামো তৈরীর সামাজিক প্রয়োজনটি দেখা দিল।
অতীত ইতিহাসের এই বিশেষ সন্ধিক্ষণে … সেদিন শ্রেণী হিসেবে বুর্জোয়ারা ছিল সমাজের সবচেয়ে অগ্রগামী অংশ। সামন্তী সমাজের অভ্যন্তরে শোষিত অত্যাচারিত মানুষের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, সমানাধিকারের পতাকা এরাই সেদিন বহন করেছে। এরাই সেদিন পুরাতন সামন্তী সমাজকে ধ্বংস করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাপক সামাজিক সমর্থনকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে ধ্বনি তুলেছিল : “সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা”। … আর, পুরাতন সামন্তী অর্থনৈতিক বনিয়াদকে ভাঙ্গার প্রয়োজনে দেখা দিল এরই সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যতকিছু গলিত, জীর্ণ সামন্তী চিন্তা-ভাবনা, আচার অভ্যাস, নীতি-নৈতিকতা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিচার, আইন, আর সবার উপরে রাজতন্ত্র আর তার দৈব অধিকারের ধারণাকে উপড়ে ফেলার সংগ্রাম।
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এই প্রভাতে, বুর্জোয়া চিন্তাবিদরা বলেছেন : “যদি সমগ্র মানবজাতির মধ্যে একজন ব্যক্তিও অন্য সকলের সঙ্গে চিন্তায় একমত না হতে পারেন, তবে সেই একজনের চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ঠিক তেমনই থাকে, যেমন সেই একজনেরও কোন অধিকার নেই তার একার চিন্তা ও মতকে চাপিয়ে দিয়ে বাকী সকলের কন্ঠ রোধ করার। বিরুদ্ধ মতের কন্ঠরোধের অর্থ হলো যারা এই কন্ঠরোধ করেন, তাদের এক অদ্ভুত অহংবোধ যে তারা কখনই ভুল করতে পারেন না।” … (লিবাটির্ — জন ষ্টুয়ার্ট মিল)।
সেদিন বুজোয়ারা সংগ্রাম করেছিল — যে কোন মত পোষণ ও তার অবাধ প্রচার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য। “স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্তি অর্জনের যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রাম পরিচালনার স্বাধীনতা তারা দাবী করেছিলেন। বিনা বিচারে অন্তরীণ রাখা ও নির্যাতন চালানো, যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ ব্যতিরেকে বাড়ীতে অনধিকার প্রবেশ ও তল্লাসী চালানো – এইসব স্বৈরাচারী অনাচারের অবসান ঘটানোর জন্য সংগ্রাম একদিন এই বুর্জোয়ারা করেছিলেন। … মত ও আদর্শ পোষণ করা ও তার প্রচারের স্বাধীনতাকে কোন শর্তেই যে সমর্পণ করা যায় না – একথাও একদিন এই বুর্জোয়ারা বলেছিলেন।”
এখানে একটি কথা পরিষ্কার করে বুঝে নিতে হবে। সেটা হল এই যে, বুর্জোয়ারা সাম্য- মৈত্রী-স্বাধীনতার উদাত্ত ধ্বনি তুলল। এই যে তারা বলল যে, সমাজের সকল মানুষের সমান অধিকার – এইসবের কি মানে থাকতে পারে, যদি না মানুষ সমাজে সত্যিকারের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে। যদি না মানুষের উপর মানুষের শোষণ চালাবার তথাকথিত অধিকার থেকে সমাজ মুক্ত হতে পারে। যদি একটা পুঁজিপতি মালিকের তথাকথিত ‘স্বাধীনতার’ দাবী মেটাতে শতসহস্র মানুষের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ এই জীবনের অবসান ঘটে। আর, ঠিক এই জিনিসটিই সমাজে নিয়ে এল বুর্জোয়া শাসক।
বুর্জোয়াদের শ্রেণীশোষণের ভিত্তিতে যে নুতন সমাজব্যবস্থাটিকে তারা গড়ে তুলল পুরাতন সামন্তী সমাজকে ভেঙ্গে, সেই নতুন ব্যবস্থায় সমাজের উৎপাদনের যন্ত্রের মালিকানাটি হস্তগত করল। … পুঁজিপতিশ্রেণীর মালিকানার এই যে তথাকথিত ‘স্বত্ব’টি প্রতিষ্ঠিত হল, তারই যুপকাষ্ঠে বলি হল সমাজের মুক্তি, মানুষের মুক্তি। আর সেই জন্যই বুর্জোয়াদের এই যে গণতান্ত্রিক বিপ্লব, যা সফল করতে সমাজের সাধারণ মানুষের এত বলিদান, এত রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, তার মধ্য দিয়ে এল না এই অর্থনৈতিক শোষণের অবসান – … বদল হল মালিকানার, এক শ্রেণীর হাত থেকে আর এক শ্রেণীর হাতে।
তাই সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমান অধিকারের যে উদাত্ত ধ্বনি, বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় আসবার আগে একদিন তুলেছিল, তা হল নিষ্ঠুর ব্যঙ্গে পর্যবসিত। কেননা, অর্থনৈতিক পরাধীনতার শৃঙ্খলে জীবনভোর আবদ্ধ মানুষের কাছে, বুর্জোয়াদের প্রতিশ্রæত সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার বাণীটি রয়ে থাকল শুধু কথার কথা – অত্যাচার আর অবিচারের পাষাণভার থেকে মুক্তির জন্য আইন ও ন্যায্য বিচারের ধারণা লেখা রইল পুঁথির পাতায় – জীবনে তা কার্যকরী হল না।
কিন্তু এই সহজ সরল সত্য কথাগুলো যখন আমরা মনে রাখব, তখন সেই সঙ্গে সঙ্গে এ ভুলও করব না যে, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর যে সমাজটা পুরাতন সামন্তী সমাজকে ভেঙ্গেই গড়ে উঠল, তা চিন্তা-চেতনা অধিকারের বিচারে পুরাতন সামন্তী সমাজ থেকে কোন ছেদই ঘটাতে পারেনি। না, তা নয় – ছেদ নিশ্চয়ই ঘটলো। বুর্জোয়ারা সামাজিক দাবী হিসাবে … গণতন্ত্রের যে ধারণা এবং মানুষের অধিকারগুলি মেনে নিতে বাধ্য হল, তা ছিল পুরাতন সামন্তী সমাজে, এক কথায় অকল্পনীয়। তাই সামন্তী সমাজে যা সম্ভব হয়নি, বুর্জোয়া সমাজে, সাধারণভাবে ভাবতে গেলে, সেই ‘আইনের শাসন’, ‘আইনের চক্ষে সবাই সমান’ অন্ততঃপক্ষে কার্যকরী নীতি হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। …
… বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থায় গোড়ার যুগে যখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতা এবং তাতে সকলের সমান অধিকারের নীতিটি কার্যকরী ছিল, এরই পরিপূরক হিসাবে রাজনৈতিক উপরিকাঠামো হিসাবে গড়ে উঠেছিল বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্র। এরও ভিত্তি ছিল, সামন্তী সমাজের রাজতন্ত্রের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারের বদলে, ব্যক্তির মত ও আদর্শ পোষণ ও তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার, নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে নির্বাচন বা সমাজের মানুষের স্বাধীন ও অবাধ অভিমতের ভিত্তিতে প্রশাসন ক্ষমতা পরিচালনের নিরঙ্কুশ অধিকার। বুর্জোয়া সাংবিধানিক প্রতিনিধিত্বমুলক গণতন্ত্রের এই ছিল ভিত্তিমূল। …
… ইতিহাসের ধারা বেয়ে, অবাধ প্রতিযোগিতার স্তর অতিক্রম করে পুঁজিবাদ, বিকাশের এক বিশেষ স্তরে একচেটিয়া পুঁজি ও লগ্নীপুঁজির জন্ম দিল, যার অপর নাম সাম্রাজ্যবাদ। পুঁজিবাদ পরিবর্তিত হয়ে গেল একচেটিয়া পুঁজিবাদ, যৌবন হল জরা। … বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বর্তমান সর্বাত্মক সংকটের পরিস্থিতিতে, উন্নত-অনুন্নত সকল পুঁজিবাদী দেশেই ব্যক্তিগত একচেটিয়া পুঁজির সাথে রাষ্ট্রীয় পুঁজির মিলন ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজির সৃষ্টি হয়েছে। বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা, একচেটিয়া পুঁজির সেবাদাসে পর্যবসিত হয়েছে। আর এই যে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজির সৃষ্টি হয়েছে, এটাই হচ্ছে ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিমূল।
সুতরাং একচেটিয়া পুঁজির আবির্ভাবের আগে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতার বনিয়াদের উপরিকাঠামো হিসাবে যে বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামো গড়ে উঠেছিল – তার রূপ ও চরিত্র, নূতন পরিস্থিতিতে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রয়োজন ও চাহিদাকে যে মেটাতে আর পারে না, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, এটাই স্বাভাবিক। কাজেই একদিন এই বুর্জোয়া প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ঘিরে যে ঐতিহ্য ও গৌরবচ্ছটা গড়ে উঠেছিল, একচেটিয়া পুঁজির এই স্তরে, সেই বুর্জোয়াশ্রেণীর হাতেই তার অবলুপ্তি ঘটতে থাকল …। তাই, হয় বুর্জোয়া পার্লামেন্ট ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ সরিয়ে দিয়ে সোজাসুজি ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা হল, না হয় দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে ঠাঁট বজায় রেখে, সেই একই ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম হল।
আজকের বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে সমগ্র বুর্জোয়া দুনিয়ার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে হাজির হয়েছে ফ্যাসিবাদ। … বিশ^জোড়া সংকটের ধাক্কায় নেহাৎ অস্তিত্ব বজায় রাখার তাগিদেই, কি আপেক্ষিক অর্থে উন্নত বা অনুন্নত, সব পুঁজিবাদী দেশের রাজনীতিতেই ফ্যাসিবাদের প্রবণতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বর্তমান একচেটিয়া পুঁজির স্তরে, সংকটে জর্জরিত পুঁজিপতিশ্রেণী, অতীত দিনের অবাধ প্রতিযোগিতার স্তরে, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার আইনের শাসনকে কার্যকরী করতে যে আগ্রহ-উৎসাহ দেখাত আজ আর তা দেখায় না। প্রাক্ একচেটিয়া পুঁজির যুগে, বুর্জোয়া রাষ্ট্রনীতিবিদরা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতার অধিকারের সুরে সুর মিলিয়ে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, বিচার ব্যবস্থার অপক্ষপাত, আপেক্ষিক স্বাধীনতার দাবী যেমন তুলে ধরতেন, সেই সঙ্গে ঐগুলির মধ্য দিয়ে সমগ্র দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতার যাতে প্রসার ঘটে, তার জন্য লড়তেন। কিন্তু পুঁজিবাদ যখন থেকে একচেটিয়া পুঁজিবাদের রূপ পরিগ্রহ করল, তখন থেকেই প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার নীতিকে বিসর্জন দিয়ে প্রশাসনব্যবস্থাকে করা হয়েছে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের নিরঙ্কুশ স্বার্থরক্ষার একটি যন্ত্র বিশেষ। বুর্জোয়া রাষ্ট্রকাঠামোর অন্যান্য বিভাগ সম্পর্কেও একথা একইভাবে সত্য। এরই ফলে সমাজের সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতা ক্রমশঃই বেশী বেশী করে খর্ব হচ্ছে।
যে বুর্জোয়ারা একদিন ছিল ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকারের অনুরক্ত, তারাই আজ হয়েছে বিভিন্ন বুর্জোয়া দেশে দেশে আমলাতান্ত্রিক কঠোরতা আর জঙ্গীবাদের ভক্ত। … এ যুগের অগ্রণী মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ভাষায় — “কি উন্নত, কি অনুন্নত, সকল পুঁজিবাদী দেশেই, বিশেষতঃ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ও রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে ফ্যাসীবাদ নানারুপে, নানা প্রকারে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।” শুধু তাই নয় — “এমনকি যেসব বুর্জোয়া দেশে পার্লামেন্টের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, সেখানেও বুর্জোয়া সংসদীয় গণতান্ত্রিক অধিকার, সুযোগ সুবিধাগুলিও ক্রমাগত খর্ব করা হচ্ছে। বুর্জোয়াশ্রেণীর কাছেও বুর্জোয়া পার্লামেন্টের প্রয়োজনীয়তা দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।” … …
… অথচ এমনই মজা, বিভিন্ন বুর্জোয়া দেশগুলিতে আজও দেখা যাবে বুর্জোয়া দলগুলি … একে অপরের দোষারোপ করছে তারস্বরে। একে অপরকে বলছে অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিষ্ট। কোথাও আবার বুর্জোয়াদের যে অংশ … বিরোধী দল হিসাবে কাজ করছে, তারা গদীয়ান অংশকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জনগণের নাম নিয়েই, তাদের স্বার্থের ধ্বজা তুলেই, আন্দোলন-লড়ালড়ির ভাব দেখাচ্ছে। … একবার গদীতে বসলে এরা সবাই এক সেই একই বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা — জনতার স্বার্থের জলাঞ্জলি। সেই একই শোষণ-দারিদ্র-অনাহারের চাবুক থেকে গরীবের রক্ত ঝরবে। শুধু তাই নয়, গদীয়ান দলের ক্ষমতার ব্যভিচার সম্পর্কে এত যে অভিযোগ, গদীতে বসলে এঁরা কিন্তু সেটা ছাড়তে চাইবেন না। বিপক্ষ দল যা রেখে গেল, ক্ষমতার ব্যভিচারের জের সমানেই এঁদের হাত দিয়েও বইতে থাকবে। … …
… এই ফ্যাসিষ্টরা ক্ষমতা করায়ত্ত করে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেও সাধারণ মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি খর্ব করে। কেননা, এর দ্বারাই তারা সংকটে জর্জর পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের অর্থনৈতিক অধিকারটি জনগণের উপর বলপূর্বক চাপিয়ে রাখতে চায়। …
… … বিংশ শতাব্দীতে, ইতালী ও জার্মানীতে সামরিকভাবে পর্যুদস্ত হওয়া সত্তে¡ও ফ্যাসীবাদ আজকের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ায় এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। … রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একদিকে গণতন্ত্রের অস্বীকৃতি, জনতার গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারগুলি খর্ব করা এবং অপরদিকে শাসনযন্ত্রের প্রধান হিসাবে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর হাতে রাজনৈতিক শক্তিকে ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত করার মধ্য দিয়ে এই ফ্যাসীবাদী লক্ষণগুলি প্রকাশিত হচ্ছে। সাথে সাথে এই সমস্ত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলিতে বিচারবিভাগের অধিকারকেও খর্ব করা হচ্ছে এবং সংসদীয় বুর্জোয়া গণতন্ত্রে একজন ব্যক্তি বা দেশ শাসনের দায়িত্বে ন্যস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের কোন অঙ্গ কতৃক ‘আইনী শাসন’ লঙ্ঘন করার সম্ভাব্য কোন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে … বিচারবিভাগ এতদিন পর্যন্ত যে অধিকার ভোগ করে এসেছে — তার সেই ঐতিহ্যগত অধিকারকেও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এবং এইভাবে বিচারবিভাগকে কার্যতঃ সরকারী প্রশাসনের অধীনস্ত একটি ক্ষমতাহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হচ্ছে। …
পূর্ব অভিজ্ঞতা ও অধুনা যে সকল প্রচেষ্টা বিভিন্ন বুর্জোয়া রাষ্ট্রে দেখা যাচ্ছে, তা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের এই প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি হল, সর্বপ্রধান প্রশাসক তা তিনি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি যিনিই হোন না কেন, তার হাতে সকল ক্ষমতা অর্পণ করা। … প্রধান প্রশাসক সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত, নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতার অধিকারী হবার ফলে, স্বাভাবিক কারণেই ফ্যাসিষ্ট রাষ্ট্রে বুর্জোয়া সংবিধানের বিভিন্ন যন্ত্রের পারস্পরিক ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটে। প্রশাসন যন্ত্রই সাংবিধানিক সকল ক্ষমতার অধিকারী হয়। নতুন ব্যবস্থায়, মন্ত্রীসভাসহ প্রশাসন, আইন সংসদ বা পার্লামেন্টের পরিবর্তে, প্রধান প্রশাসকের কাছে দায়ী থাকে এবং তারই ইচ্ছানুযায়ী প্রশাসন কার্য্য নির্বাহ করে থাকে।
এ থেকে কেউ হয়ত মনে করতে পারেন যে ফ্যাসিবাদে বুর্জোয়ারা … এখন আইনী শাসনের স্থলে ব্যক্তি শাসনের প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু কেউ যেন মূহুর্ত মাত্রের জন্য এ ভুল না করেন যে ফ্যাসিবাদের এই প্রধান প্রশাসক ব্যক্তিটি কিন্তু অতীতের সামন্ততন্ত্রের কোন রাজা বা সম্রাট নন। তিনি হচ্ছেন একজন ফ্যাসিষ্ট একনায়ক — বুর্জোয়া শ্রেণীর সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নেতা — যার একমাত্র উদ্দেশ্য হল বুর্জোয়া সংবিধান ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সমস্ত যন্ত্রের সাহায্যে সঙ্কটজর্জরিত বুর্জোয়া অর্থনীতি ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে রক্ষা করা। …
আজকের যুগের বুর্জোয়ারা আরও চতুর। ‘গণতন্ত্রের সাইনবোর্ড’কে উজ্জ্বল রেখে গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন জনগণকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে তারা পার্লামেন্টকে চালু রাখে ; অবশ্য তার পূর্বের ক্ষমতা ও মর্যাদা কেড়ে নিয়ে — এবং তাকে প্রধান প্রশাসকের কর্তৃত্বাধীন প্রশাসনযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের আওতার মধ্যে এক ক্ষমতাবিহীন ‘আলাপ-আলোচনা করার সংস্থা’ মাত্রে পরিণত করে। …
… … মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের কাছে বিষয়টি খুবই পরিষ্কার। তাঁরা যেমন বুর্জোয়া সংবিধান ও রাষ্ট্রকাঠামোর সীমাবদ্ধতার বিষয়ে জনগণকে যথার্থ রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেন, তেমনি এই বুর্জোয়া ব্যবস্থার শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যেখানে যতটুকু আপেক্ষিক নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার ধারণাটুকু কাজ করছে, তাকে আরও সংকুচিত করার অপচেষ্টাকে তাঁরা কোনমতেই সমর্থন জানাতে পারেন না। এবং তাকে রক্ষা ও সম্প্রসারণের জন্য তারা লড়েন। তাঁরা জানেন, এই বুর্জোয়া ব্যবস্থার খন্ডিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতা নিঃশেষিত হবার পথ বেয়েই এর সঙ্গে ছেদ টেনে স্বাধীনতা ও অধিকারের পূর্ণতা অর্জনের সংগ্রাম উন্নততর সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটাবে। তাই দেশের অভ্যন্তরে যাঁরাই ফ্যাসিবাদকে শিকড় চালাতে বাধা দিতে এগিয়ে আসবেন, তাঁরাই দেখবেন যে প্রকৃত সাম্যবাদীরা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ছেন। …
[ভারতের ‘সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া (কমিউনিস্ট)’ বা এসইউসিআই(সি) পার্টি কর্তৃক প্রকাশিত ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রসঙ্গে’ পুস্তিকা থেকে সংগৃহীত ও সংক্ষেপিত।]