[মাহমুদুর রহমান মান্না। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক। বাসদ (মার্কসবাদী)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এদেশের অনন্যসাধারণ কমিউনিস্ট বিপ্লবী কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী গত ৬ জুলাই ২০২১ তারিখে প্রয়াণের পর ১৪ জুলাই ২০২১ তারিখে দলীয় উদ্যোগে আয়োজিত অনলাইন স্মরণসভায় মাহমুদুর রহমান মান্না বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যটি পরবর্তীতে লিখিতরূপে `কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ‘-এ সংকলিত হয়। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরা হলো।]
জনাব সভাপতি, নেতৃবৃন্দ, সুধীমণ্ডলী এবং যারা শুনছেন … সবাইকে শুভ অপরাহ্ন। আমি আপনাদের কথা শুনতে শুনতে এতক্ষণ ভাবছিলাম যে, আমাকে এখানে কেন দাওয়াত করলেন। এই জন্য আমি আপনাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি, আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি। যখন রাত্রের বেলা আমি হায়দার ভাইয়ের মৃত্যুর খবরটা শুনলাম, তখনই মনের মধ্যে একটা আকুলি-বিকুলি করার মতো; আমি তার জন্য একটা লেখা শুরু করলাম ঐ রাতেই। আমি পরপর আরও দুটো দুঃসংবাদ পেয়েছিলাম, সে কারণে রাতে লিখতে পারিনি। পরের দিন লিখে এটা ফেইসবুকে পোস্ট করেছিলাম। আসলে ঐটাই আমার কথা। এর বাইরে খুব বেশি কথা নেই। বললে সেটা অনেক কথা হয়ে যাবে। এত কথা বলবার সময়ও হয়তো হবে না।
আপনাদেরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি এই কারণে যে, এই সুযোগটা পেয়ে আমার খুব ভালো লাগছে। আমি যাদের কথা শুনলাম, তাদের সঙ্গে আমার আন্তরিকতা, পরিচয়, ঘনিষ্টতা অনেক দিনের। হায়দার ভাইয়ের ব্যাপারটা হলো, যে আদর্শ নিয়ে এত কথাবার্তা বলা হচ্ছে, এটার যে ম্যাটেরিয়ালিস্টিক আউটলুক, আমরা বলি বস্তুবাদী দর্শন (দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ); এটার হাতেখড়ি হয়েছিল আমার তাঁর হাতে। সিরাজুল আলম খান আমাকে এবং মাহবুব ভাইকে (আ ফ ম মাহবুবুল হক তখন ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন) দুজনকে বলেছিলেন, ওঁনার সঙ্গে কথা বল। তখন হায়দার ভাই তো বেশ বিতর্কিত লোক, ওঁনাকে দলে চেনেই না কেউ ভালো করে। সিরাজ ভাইয়ের বা জাসদের নেতাদের এটা কোনো একটা অভ্যাসের মতো ছিল কি না জানি না, তবে তারা হায়দার ভাইকে কিন্তু কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের সামনে, দলের সামনে পরিচয় করিয়ে দেননি। এতগুলো বছর পরে মনে হয়, তাঁর প্রতি এটা একটা অবিচার করা হয়েছিল। কারণ এতখানি ডেডিকেশন নিয়ে যিনি এই রাজনীতিতে এলেন, নিবেদন করলেন, তাঁর সমস্ত মেধা-শ্রম-সময় ব্যয় করতে লাগলেন, তাঁকে তাঁর জায়গায় অন্তত অধিষ্ঠিত করার দরকার ছিল। অধিষ্ঠিত করা বলতে বলছি, পরিচয় করানো, সবাইকে জানানো। কেউ জানত, তা আমরাও বুঝতাম না।
আমি প্রথম স্বীকার করছি, মার্কসবাদী রাজনীতির দর্শনের ভিত্তি আমি মনে করি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এবং এটা নিয়ে উঁনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছিলেন, শেষ হয়নি। শেষ পর্যন্ত যাইওনি আমরা। তবে এটা অনেক লম্বা বিষয়। এটাই তো ম্যাটেরিয়ালিস্টিক আউটলুকের ফিলসফিক্যাল বেইজ। এবং এটা বোঝা যে খুব সহজ, এরকম মনে করি না। কিছু মনে করবেন না কেউ, এখানে যারা যারা যতখানি আলোচনা করেছেন, আমার কাছে সবচাইতে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, কঠিন বিষয়গুলো সহজ করে বলার একটা অদ্ভুত যোগ্যতা তাঁর ছিল। এবং আমাদের রাজনীতিতে, বিশেষ করে আমি দেখেছি বাম রাজনীতিতে, এটাই সবচাইতে বেশি সংকট (রবীন্দ্রনাথ যেরকম বলতেন–‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’)। কিন্তু হায়দার ভাই কঠিন কথাগুলো সহজ করে বলতেন। সে জন্যেই আমি আবার বলি, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের হাতেখড়ি আমার তাঁর কাছে।
অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হতে পারে, (কারণ অতঃপর আমরা রাজনীতিতে একত্রে ছিলাম না, আমি বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসও করি না) কিন্তু এটা সত্য আজ আমি রাজনীতির যেখানে পৌঁছেছি ঐ হাতেখড়ি না হলে অতদূর যেতেই পারতাম না। বেসিক্যালি মার্ক্সিজম, ডেমোক্রেসি হলো ফিলসফিক্যাল ব্যাপার। এটা ভালো করে বুঝতে পারা উচিত। এটার ইথিক্যাল দিক আছে, মোরাল দিক আছে, পলিটিক্যাল এবং প্রাকটিক্যাল-প্রাগমেটিক দিক আছে। কিন্তু এটা বোঝা না গেলে আপনি মূল কাজটা করতে পারবেন না। সেদিক থেকে হায়দার ভাই খুবই স্পষ্ট ছিলেন, পরিচ্ছন্ন ছিলেন।
আমি ক্যাপিটাল পড়েছি। তখন আমরা বেশ লেখাপড়া করতাম। এখন যদি জিজ্ঞেস করেন, ‘Das Capital‘-এর প্রোডাকশান-এর ডিপার্টমেন্ট ওয়ান, ডিপার্টমেন্ট টু ভালো করে বোঝাতে পারব না। তখন আমাদের থিওরেটিক্যাল বা ইকোনোমিক্স সাইডের গুরু ছিলেন ড. আখলাকুর রহমান। উনিও আমাকে এটা খুব ভালো করে বোঝাতে পারেননি। অ্যাট লিস্ট আমি বুঝিনি। পরবর্তীতে যখন ব্যবসা করতে আসলাম, তখন দেখলাম সারপ্লাস ভ্যালুর থিওরির মধ্যেও অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়। আমি একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি করি, আমি শার্ট বানাই। আমি শার্ট বানিয়ে যে ইনকাম করি বায়ার আমাকে দেয় ১০ ডলার। সেইম জিনিস প্রিপেয়ার করে আরেক জন ২০ ডলার পায়। এখন কোনটা সারপ্লাস হয়? ১০ থেকে ১০। দশ ডলার বেশি হলো। আমি তো দশ ডলারের মধ্যেই পেমেন্ট করেছি। অনেকে বিশ ডলারের মধ্যে করে। এরকম অনেক রকম প্রশ্ন আছে।
আমার কাছে সবচাইতে বেশি আকর্ষণ করেছে কোনটা? এখন আমাদের সোসাইটিতে মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয় চলছে। এখানে যারা আছেন, কমরেডবৃন্দ, সবাইকে বলি, আমার দোষ হলে অথবা আমি যদি আপনাদের আঘাত করে থাকি আামাকে ক্ষমা করে দেবেন। আপনারা নিশ্চয়ই চূড়ান্ত পরিশ্রম করছেন। আমি সব সময় বলি, আমি যখন বামপন্থীদের প্রকাশ্য সভার মধ্যে বক্তৃতা করার সুযোগ পেয়েছি, তখনও বলেছি, নিজেকে একজন প্রাক্তন বামপন্থী বলতে আমার কোনো লজ্জা নেই। এখনও আমি বামপন্থীদের বা সোশ্যালিজমের যে আইডিয়াগুলো আছে, সেগুলোকে রেসপেক্ট করি। কিন্তু সমস্ত রকম নিবেদন দিয়ে চেষ্টা করার পরেও সমাজের অবক্ষয়গুলো আমরা থামাতে পারছি না। এখন তো একটা নৈরাজ্য চলছে। মিথ্যার একটা রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে। প্রতারণা, ঠকবাজি, লুটপাট, দুঃশাসন, অপশাসনের রামরাজত্ব শুরু হয়েছে। কোনো প্রতিবাদ সেরকম নেই। ফ্যাসিস্ট শাসনের আমরা সূচনা দেখেছিলাম, শেখ মুজিবের সময়ে। এখন এটার পরাকাষ্ঠা দেখছি। এবং এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার নৈতিক-সাংস্কৃতিক একটা আধার এত দিনেও তৈরি হয়নি। যদি হতো তাহলে সম্ভবত ফ্যাসিবাদ এরকম করে এগুতে পারত না। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো যে, রাজনীতিবিদরাই বেশি করে বিপথগামী হয়েছেন। এবং তাদের মধ্যে নৈতিকতার ভিত্তিটাই গড়ে ওঠেনি। কারণ আপনি যে রাজনীতি করেন, ধরেন সেই সময়কার কংগ্রেসের কথা, তখন পর্যন্ত নেতারা টাকা কামাবার ধান্ধাতে ছিল না। একটা বিলাসবহুল জীবনযাপন করবার জন্য রাজনীতি করছি, এরকম রাজনীতিবিদরা মনে করতেন না। ডান বাম যাই হোক।
হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরবর্তী জীবনে যে সমস্ত কথাবার্তা হয়েছে, তাঁর চিন্তা, আপনারাও বললেন এবং আপনারা এই দল মানে বাসদ (মার্কসবাদী), (আমি অন্যদের কথা জানি না) আপনারা খুব সুস্পষ্ট ঘোষিতভাবে কমরেড শিবদাস ঘোষের আইডিয়ার ভিত্তিতে একটা পার্টি গড়তে চান; যেটা আমি তখন থেকে অপোজ করতাম। আমি রাজনীতি আরেকভাবে বিশ্বাস করি। কিন্তু এই জন্য তাঁর সাথে আমার একেবারে সরাসরি ডায়াগোনালি অপোজিট আইডিয়া থাকবার পরেও আমি মনে করি, যে বিশ্বাস থেকে হায়দার ভাই কাজটা করতেন, ঐ বিশ্বাসে কোনো খাদ ছিল না, ঐ চর্চায় কোনো ফাঁকি ছিল না। এবং আজীবন, ৮৭ বছর বয়স পর্যন্ত একটা মানুষ কোনো রকম ব্যক্তিগত লোভ-লালসার বাইরে থেকে করে যেতে পারেন, মে বি উঁনি বাংলাদেশের পলিটিক্সে lone soul। মে বি বলছি। বিকজ আমি হয়তো জানি না, কিন্তু আমার দেখার মধ্যে যত মানুষ আছে, তাদের মধ্যে এটা আমি বলব যে–ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তিগত লোভ, ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশ, নাম-ধাম এগুলোর বাহিরে থেকে উঁনি এটা করেছেন। আর ডেফিনিটলি কমিউনিস্ট মুভমেন্টের জন্য এটা তো লাগবে। কে না জানে যে, লেনিন যেরকম ছিলেন, সেরকম স্ট্যালিন ছিলেন না, সেরকম ট্রটস্কি ছিলেন না। এখন আমরা লেনিন, স্ট্যালিন ট্রটস্কিকে অনেক রকম পার্থক্য করব। মাও সে-তুঙ যেমন ছিলেন, তাঁর ওয়াইফ তেমন ছিলেন না, মাও সে-তুঙের পরের যে নেতারা ছিলেন … অত বিতর্কের মধ্যে আমি যাচ্ছি না। কিন্তু এই নেতাদের মধ্যেও যারা পরিচিত, যারা হয়তো তত বিখ্যাত হননি, সবাই বিপ্লবও করতে পারেননি, লেনিনের আগেও যারা ছিলেন; কার্ল লিবনেক্ট, রোজা লুক্সেমবার্গ–এদেরও যদি দেখি একটা comfortable লাইফ লিড করেছেন, তারপর স্ট্রাগল করেছেন। কিন্তু হায়দার ভাইয়ের comfort চিন্তাটাই মাথায় ছিল না। এটা কেমনে হয়, আমি খুব বিস্মিত এবং এজন্য এখনও উঁনি আমার কাছে একটা বিস্ময় বালকের মতো। বিস্ময় কমিউনিস্টের মতো।
এই নিবেদনটাই আসল কথা এবং শেষ দিন পর্যন্ত, মৃত্যু পর্যন্ত সেটাই করে গেলেন। এই যে মাও সে-তুঙ বলেছেন, ‘অল্প সময় বিপ্লবী থাকা সম্ভব, দীর্ঘদিন বা আজীবন বিপ্লবী থাকা অনেক কঠিন।’ কিন্তু হায়দার ভাই দেখিয়েছেন, আজীবন বিপ্লবী থাকা সম্ভব। এবং উঁনি খুব কঠিন জিনিসটাকে সম্ভব করে তুলেছেন। যখন আমাকে আপনারা ফোন করেছেন শুধু এইজন্যেই আমি খুব খুশি হয়েছি, আমি মনে করেছি যে, হায়দার ভাই সম্পর্কে অন্তত এই কথাগুলো আমি বলতে পারব, আমার এটা মন থেকে আসা কথা। আমি এটা সবার সামনে নিবেদন করতে পারব। এবং আমি মনে করি, এটা হায়দার ভাইয়ের জন্যে একটা আন্তরিক শ্রদ্ধার প্রকাশ। হায়দার ভাইয়ের মতো মানুষ ফিরে আসুক। আমাদের এই রাজনীতিতে ভবিষ্যতে ওঁনার মতো মানুষ আমরা মনেপ্রাণে খুঁজে পেতে চাইব।
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী লাল সালাম!