Tuesday, November 19, 2024
Homeফিচারভারত-চীনের দ্বন্দ্ব ও বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব প্রসঙ্গে

ভারত-চীনের দ্বন্দ্ব ও বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব প্রসঙ্গে

গোটা বিশ্বে করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত। করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ এবং সংক্রমণ মোকাবেলার তৎপরতাকে কেন্দ্র করে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর দ্বন্দ্ব ও নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত প্রকাশিত হচ্ছে। এই ভাইরাস মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। এক দেশের সাথে আরেক দেশের স্থল-নৌ-আকাশ পথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের সাথেও প্রতিবেশী দেশসমূহের যোগাযোগ বন্ধ। অথচ এই পরিস্থিতির মধ্যেই গত ১৮ ও ১৯ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা দুই দিনের ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে আসেন। তার এই সফরকে কেন্দ্র করে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং বাংলাদেশে চীনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা আবারও তুঙ্গে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি এবং চীনের প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে নানান মহলে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির মধ্যেই লাদাখে চীন-ভারতের সংঘর্ষের পর থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে চীন-ভারতের টানাটানি বেড়েছে এবং দৃশ্যমান হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলেও তা মনোযোগের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশকে নিয়ে চীন-ভারতের টানাটানির প্রধান কারণ বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য বিস্তারের বাসনা। বাংলাদেশের অবস্থান বঙ্গোপসাগরের উপকূলে হওয়ায় ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

তাই এই অঞ্চলের রাজনীতিগত তাৎপর্য বুঝতে হলে বিশ্বরাজনীতির গতি-প্রকৃতি বোঝাটাও জরুরি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতির পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য ছিল। অর্থাৎ বিশ্বরাজনীতি এক মেরুকেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্তর্নিহিত সংকট ও বাজার দখলের প্রতিযোগিতা থেকে গত এক দশকে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে। স্পষ্টতই সাম্রাজ্যবাদী শিবিরে কয়েকটি ভাগ। আমেরিকার একক আধিপত্য এই সময়ে দুর্বল হয়েছে। পাশাপাশি চীনের অর্থনৈতিক উত্থান ঘটেছে। বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে আমেরিকার প্রধান বিরোধের জায়গাও এখন চীন। চীনকে মোকাবেলায় এই অঞ্চলে আমেরিকা ভারতের সাথে মৈত্রী গড়ে তুলেছে শুধু তাই নয়, আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে চীনকে শুধু আমেরিকা নয়, একই সাথে ভারতকেও মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

চীন তার সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষ চরিতার্থ করতে পুরনো সিল্ক রোডের পুনরুজ্জীবন অর্থাৎ ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় দেশে দেশে বিনিয়োগ ও সামরিক সহযোগিতা বাড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ এই প্রকল্পে যোগ দিয়েছে। এই প্রকল্পকে সফল করতে চীন গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী দেশগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান চীনের। শুধু বিনিয়োগই নয়, পদ্মাসেতু, মেট্রোরেলসহ অনেকগুলো মেগা প্রকল্পে চীন যুক্ত হয়েছে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ২৬টি সমঝোতা স্মারক চুক্তি করে দুই দেশ। এবং ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। বাংলাদেশের আমদানির প্রধান উৎসও এখন চীন। প্রতিবছর ১৬-১৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি হয় চীন থেকে। প্রযুক্তি পণ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালের জন্যও বাংলাদেশ চীনের উপর নির্ভরশীল। যদিও বিপরীত দিকে বাংলাদেশ চীনে মাত্র ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে পারে। আবার সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহেরও প্রধান উৎস চীন। বিগত বছর কয়েক আগেই বাংলাদেশ চীনের নিকট থেকে দুটি সাবমেরিন ক্রয় করেছে। ফলে বিনিয়োগ, অবকাঠামো নির্মাণ ও সামরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে চীন বাংলাদেশের অর্থনীতির সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এই গভীরতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বাংলাদেশের সাথে চীনের এই সংযোগের গভীরতা যত বাড়ছে, ভারতের  উদ্বিগ্নতাও তত বাড়ছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের পুঁজিপতিদেরও শোষণের ক্ষেত্র বাড়াতে, মুনাফা বাড়াতে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নী পুঁজির সহযোগিতা প্রয়োজন। তাদের কারিগরি দক্ষতা ও অতিকায় পুঁজির সক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিজেরাও মুনাফার একটা ভাগ ঘরে তুলতে চীনের উপর নির্ভরশীল হচ্ছে। গত এক দশক ধরে চীনের দিক থেকে এই প্রভাব ও বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা নীরবে বাড়তে থাকলেও করোনা মহামারি সময়ে চীন-ভারতের সংঘর্ষের পর থেকে তা আরও বেশি দৃশ্যমান হয়েছে কতিপয় ঘটনায়। লাদাখে চীন-ভারত সংঘর্ষের সময়েই চীনের তরফ থেকে বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের সেদেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশের ঘোষণা এসেছে। এসময় চীন করোনা মোকাবেলা বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও মেডিকেল টিম প্রেরণ করেছে। চীনা কোম্পানি উদ্ভাবিত টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল বাংলাদেশে হবে এই খবর এসেছে। বিশেষত তিস্তা প্রকল্পে চীনের ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের খবর আসার পর থেকে ভারত নড়েচড়ে বসেছে। তাই করোনা মহামারির মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব দ্রুত বাংলাদেশ সফর করে গেছেন।

তাহলে কি সত্যিই বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে? ভারতের সাথে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে? এরকম নানা জল্পনা বিভিন্ন মহলে চলছে। এটা সত্য অর্থনৈতিক কারণেই বাংলাদেশের উপর চীনের প্রভাব আগের যেকোনো সময়ের থেকে বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভারতের তুলনায় চীনের ভূমিকা বেশি। শুধু ২০১৯ সালেই বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ভারতের প্রায় ৫ গুণ। চীন বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য, যেখানে ভারত করে মাত্র ২৫ কোটি ডলার। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনই চীনের সাথে তার সম্পর্ক গাঢ় করছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ও প্রভাব বিদ্যমান। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার একতরফাভাবে ক্ষমতায় থাকার পেছনে ভারতের সমর্থনের বড় ভূমিকা আছে-জনমনে এমন ধারণা বিদ্যমান। অর্থনীতি পারস্পরিক সম্পর্কের মূল নিয়ামক হলেও এগুলোর প্রভাবও কম নয়। কখনো কখনো তা এমনকি অর্থনীতিকেও ছাপিয়ে যেতে পারে। কিন্তু শুধু অর্থনৈতিক কারণেই নয়, ভারতের সাথে অমীমাংসিত কিছু ইস্যুও দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি করেছে। বিশেষত নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি সরকারের হিন্দুত্ববাদী কার্যক্রম ও মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপ এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।

তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, বাণিজ্য অসমতা, সীমান্ত হত্যা, রোহিঙ্গা সমস্যায় ভারতের সমর্থন না পাওয়ায় সরকার চাপে পড়েছে। আবার গত বছর ভারতে যে এনআরসি ও সিএএ করা হয়েছে-যার মধ্য দিয়ে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাঙালি মুসলিমদের ভারত থেকে বিতাড়ন কর্মসূচি শুরু করেছে বিজেপি সরকার, তার ফলেও বাংলাদেশ সরকারের অসন্তুষ্টি রয়েছে। সেই সময় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন, সিএএ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও এটার প্রয়োজন ছিল না। ফলে বিগত কয়েক বছরে বিজেপি সরকারের ভূমিকায় কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এমন গুঞ্জনও আছে যে, এবিষয়ে বাংলাদেশ তার মনোভাব জানাতে একাধিক মন্ত্রী তাদের ভারত সফরও বাতিল করেছে। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৭ মার্চ মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে নরেন্দ্র মোদির পূর্বনির্ধারিত বাংলাদেশ সফর স্থগিত হয়েছে। করোনার অজুহাত দেখানো হলেও কূটনৈতিক মহলের ধারণা-নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী ও মুসলিম বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভের সম্ভাবনা আঁচ করে সফর পেছানো হয়েছে।

কিন্তু দৃশ্যত যা-ই মনে হোক, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে অর্থাৎ ভৌগোলিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণেই বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের প্রভাববলয় থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে যাবার উপায় নেই। ভারতও তার প্রয়োজনেই এটা কখনোই চাইবে না। চীনও এই অঞ্চলে ভারত-আমেরিকার মোকাবেলায় প্রভাববলয় বাড়াতে চাইবে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য বাড়াতে চাইবে দুই দেশই। ইতোমধ্যে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে দুদেশই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীন প্রায় সে কাজ পেয়েই গিয়েছিল। কিন্তু ভারতের চাপের কারণে নতি স্বীকার করে বাংলাদেশকে সোনাদিয়া বন্দর নির্মাণ থেকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে দুই সাম্রাজ্যবাদী দেশের স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে এই ভূখ- যুদ্ধেরও ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। ফলে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণিকে তার স্বার্থেই দু-কূল রক্ষা করে অর্থাৎ ভারত ও চীন উভয় দেশের মন যুগিয়ে চলতে হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে অর্থাৎ বাংলাদেশকে নিয়ে চীন-ভারতের এই দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে অনেকে মনে করছেন, এতে বাংলাদেশের দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়ছে। সঠিকভাবে এগোলে দু’দিক থেকেই সে লাভবান হবে। বিনিয়োগ বাড়বে, পণ্যের শুল্কমুক্ত ছাড় পাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে?

প্রথমত, চীন-ভারতের দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়ছে আপাত দৃষ্টিতে এটা সত্য মনে হলেও, এতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি। কখনো এক পক্ষের সাথে কোনো চুক্তি বা কিছু ক্রয় করলে আরেক পক্ষ নাখোশ হয়। তখন তাকে খুশি রাখতে আবার তার সাথেও নতুন কোনো চুক্তি বা কিছু ক্রয় করতে হয়। যেমন চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন কেনার পর ভারত নাখোশ হলে তার সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করে সরকার। যে চুক্তির ফলে ভারত বঙ্গোপসাগরের উপকূলে রাডার বসাবে। ফলে দেখা যায়, বড় দুটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে তাদের সাথে চুক্তিতে স্বাভাবিকভাবেই সমতা রক্ষিত হয় না। এতে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থেরই প্রাধান্য থাকে। ফলে এই টানাটানিতে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষার চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি। আবার যেটুকু হয়তো লাভের দিক আছে তাতেও কার স্বার্থ? এদেশের পুঁজিপতিশ্রেণির, নাকি জনগণের? পুঁজিপতিশ্রেণি নিজেদের স্বার্থে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন করে হলেও এই সব চুক্তি করছে। এখানে একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন-শ্রেণিবিভক্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শ্রমিকশ্রেণিসহ শোষিত জনগণ এবং পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ এক ও অভিন্ন নয়। ফলে এযুগে বুর্জোয়াদের দ্বারা জনগণের স্বার্থ রক্ষা করাও সম্ভব নয়।

দুর্বল পুঁজিবাদী দেশের উপর সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের আধিপত্য দেখে অনেকেই মনে করেন-দেশে বুঝি জাতীয় বুর্জোয়াই গড়ে উঠেনি। তাই এদেশের শাসকদের দালাল, মুৎসুদ্দি ইত্যদি নামে অভিহিত করেন। তাঁরা বুঝতে পারেন না, দুর্বল পুঁজিবাদী দেশের পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থেই সা¤্রাজ্যবাদের সহযোগী হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও চীনের সাথে বাংলাদেশের ঘটনাবলিও তাই প্রমাণ করে। ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতিও এদেশের বুর্জোয়াদের স্বাধীন চরিত্রের প্রমাণ বহন করে। কিন্তু তারা দুর্বল চরিত্রের হোক কি স্বাধীন চরিত্রের হোক-বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। দরকষাকষি করে যা কিছু আদায় হয়, তা-ও পুঁজিপতিদের স্বার্থই রক্ষা করছে। ফলে এর দ্বারা বাংলাদেশ লাভবান হচ্ছে-এটা বলা যায় না। কারণ দেশ মানে, পুঁজিপতিশ্রেণি নয়-দেশের জনগণ।

দ্বিতীয়ত, বলা হয় বিনিয়োগ বাড়বে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে সরকার ভারত ও চীনকে দেদারসে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এতে বিনিয়োগ কিছু বাড়ছে এটাও সত্য। কিন্তু সে বিনিয়োগের দ্বারা আমরা কি লাভবান হচ্ছি?  বিনিয়োগ মানে হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নী পুঁজি। সাম্রাজ্যবাদীরা নিজের দেশের পুঁজি অন্য দেশে বিনিয়োগ করে সেই দেশের কাঁচামাল, সস্তা শ্রমশক্তি ব্যবহার করে মুনাফা লুণ্ঠন করতে। তাই বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগে এদেশের অর্থনীতিতে সাময়িক গতি সঞ্চার হলেও এটা বুঝতে হবে, বিভিন্ন কায়দায় তারা মুনাফা তুলে নিচ্ছে। তাতে দেশের লাভ যতটুকু, তার চেয়ে অনেক বেশি চলে যাচ্ছে। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ মানে তাদের দেশের নির্মাণসামগ্রীর বাজার বৃদ্ধি, দক্ষ জনশক্তি সরবরাহ। এভাবে যে টাকা বিনিয়োগ করে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি তুলে নিয়ে যায়। ফলে বিনিয়োগের দ্বারা দেশের পুঁজিপতিরা কিছু লাভবান হলেও প্রকৃতপক্ষে জনগণের কোনো লাভ হয় না।  বরং জনগণের ওপর চেপে বসে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ।

ফলে সাম্রাজ্যবাদী দেশের টাকায় বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করে বাজার সংকটে ভুগতে থাকা দেশের পুঁজিপতিদের কিছুটা সাময়িক রিলিফ দিতে পারলেও অর্থনীতি সাম্রাজ্যবাদী দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতি তৈরি হয় না। বরং ঋণের সুদ উসুল করার জন্য জনগণের কাঁধে চাপে ট্যাক্সের বোঝা। আর ঋণ সহায়তা ও বিনিয়োগের নামে দেশের অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত ও চীনও ক্রমান্বয়ে ঋণ ও বিনিয়োগের নামে সেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথেই হাঁটছে। এক্ষেত্রে তুলনামূলক বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ হওয়ায় চীন তাতে কিছুটা বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে মাত্র।

চীন বা ভারত যে দেশই হোক উভয়েই নিজ স্বার্থেই এদেশে আসছে। বাংলাদেশের শাসকশ্রেণিও তাদের সাথে সমঝোতা করে চলছে নিজেদের স্বার্থেই। কিন্তু দুই দেশের সাথে শাসকশ্রেণির মৈত্রী বা বৈরিতা যাই হোক, সবই এদেশের পুঁজিপতিদের স্বার্থেই হচ্ছে। এতে দেশের জনগণের কোনো লাভ নেই। বরং চীন-ভারতের সাথে বাংলাদেশের শাসকদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়া মানে এদেশের জনগণের উপর সাম্রাজ্যবাদী শোষণের তীব্রতা বৃদ্ধি। তাই সাম্রাজ্যবাদী শোষণের হাত থেকে মুক্তি চাইলে প্রয়োজন এদেশের বুক থেকে পুঁজিপতিশ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী শাসক তথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের সংগ্রাম তীব্র করা।

সাম্যবাদ অক্টোবর ২০২০

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments