সারা পৃথিবীর সামনে আমাদের গৌরব করবার মতো যে কয়টি বড় বিষয় আছে — তার একটি ভাষা আন্দোলন, অন্যটি মুক্তিযুদ্ধ। জাতীয় মুক্তির জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ লড়াই করেছে, আমরাও লড়েছি। কিন্তু, ভাষার লড়াই সারা পৃথিবীর মধ্যেই বিশেষ। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের বিকাশধারায় ভাষার আন্দোলন চেতনাগতভাবে এক বিরাট উল্লম্ফন ঘটিয়েছে। ’৪৭-এ ভারত বিভক্তির পর সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রভাব বিদ্যমান ছিল, ভাষা আন্দোলন তাকে পাল্টে দিয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে আরব-পারস্যের যে ঐতিহ্যবোধ কাজ করত, তার রূপান্তর ঘটিয়ে মুসলমানদের ‘বাঙালী’ পরিচয়কে মুখ্য করে তুলেছে, যে পরিচয়ের ভিত্তি ছিল ভাষা।
লড়তে লড়তেই মানুষের চেতনা পাল্টায়। ৫৬ ভাগ জনগোষ্ঠীর ভাষা অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা না হয়ে কেন উর্দু (যা পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলের ভাষা ছিল না) রাষ্ট্র ভাষা হবে — এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠেছিল। তুলেছিলেন শিক্ষিত সম্প্রদায় ও সচেতন বুদ্ধিজীবীসমাজ। পাকিস্তানি শাসকরা ধর্মের মোড়কে কার্যকর করতে চেয়েছিল তাদের অধীনতা আরোপের অভিসন্ধি। ভাষাতাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন, ইসলামের ভাষা বলে যে উর্দুকে হাজির করা হচ্ছে, তার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। ইসলাম-পূর্ব যুগে ‘আরবি’ পৌত্তলিকদের ভাষা ছিল।
পাকিস্তানের জনসংখ্যা গরিষ্ঠতার বিচারে (শতকরা ৫৬ ভাগ জনগোষ্ঠীর ভাষা) বাংলা ছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিদার। শাসকদের এ অগণতান্ত্রিক-স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভাষার লড়াই ছিল তাই গণতান্ত্রিক লড়াই। এ গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশধারায় ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও পরিণতি তৈরি হয়েছিল। পাকিস্তানিরা বুঝেছিল, যেমন সমস্ত কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকরা জানে, কেবল লাঠির জোরে জনগণকে অবদমিত করে রাখা যায় না — সেইজন্য সাংস্কৃতিকভাবে তাকে হীনম্মন্য প্রমাণ করতে হয়। ভাষা যেহেতু চিন্তার বাহন, তাই শাসকদের ভাষার কর্তৃত্ব তাদের রাজনৈতিক চিন্তার কর্তৃত্বও সৃষ্টি করবে স্বাভাবিকভাবেই। মুঘলযুগে যেভাবে ফারসি, ইংরেজ শাসনে এসে যেভাবে ইংরেজি চেপে ছিল, একইভাবে পাকিস্তানের কালে এসে উর্দু আরোপ করার চেষ্টা হয়েছিল।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোহভঙ্গ নাহলেও নতুন রাষ্ট্রের চরিত্র শুরু থেকেই মানুষ কিছু কিছু বুঝতে শুরু করেছিল। শ্রমিক-কৃষক-শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার হচ্ছিল। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা এমনই এক ঐক্যবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করেছিল, যা ছিল অভূতপূর্ব। শিক্ষিত মানুষের কাছে ভাষার উপর আক্রমণ এবং তার প্রভাব যতটা মূর্ত, সাধারণ মানুষের কাছে তা ছিল না স্বভাবতই। সাধারণ মানুষের যুক্ত হবার প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে রাষ্ট্রের অন্তর্গত বৈষম্য ও বঞ্চনা থেকে, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে। এভাবে গোটা জনপদ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। সে জন্যই কথা এসেছে — ‘একুশ মানে মাথা নত না করা।’
একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতেই গড়ে উঠেছিল শহীদ মিনার। কয়েকদিনের মধ্যেই সেই স্মৃতিস্থানটি গণমানুষের মিলনমোহনায় পরিণত হয়েছিল। পুরান ঢাকার বউঝি’রা (যারা রক্ষণশীলতার মধ্যে বাস করত) প্রবল আবেগে শহীদ মিনারে ফুল দিতে ছুটে এসেছিল ধর্মীয় কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতার শৃঙ্খল ভেঙে। এরপর থেকেই প্রতিবছর মেডিকেল কলেজের সামনে সে স্থানটিতে মানুষ একত্রিত হতো এবং পরবর্তীতে মওলানা ভাসানী একুশের ভোরে প্রভাতফেরী চালু করেছিলেন। পেছনের ইতিহাস ও স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি ভোর থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে খালিপায়ে প্রভাতফেরী করে স্কুলের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ শামিল হতো। বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী হলেও শহীদ মিনারকে কেউ ধর্মীয় স্থান হিসেবে দেখেনি, দেখেছে লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে। এ কারণেই যত দুর্যোগ আমাদের জাতীয় জীবনে এসেছে, মানুষ ছুঁটে গিয়েছে শহীদ মিনারে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রেরণা নিতে। শহীদ মিনার ও প্রভাতফেরী কেবল দুটি অনুষঙ্গ নয়, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় মানুষের ঐক্যবদ্ধতার বাস্তব রূপ। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াইয়ের পথ ধরে শাসকবর্গের সাম্প্রদায়িকতার সমস্ত চক্রান্তের জালছিন্ন হয় এ চেতনার উপর ভিত্তি করে (সমাজজুড়ে পরিপূর্ণভাবে প্রবিষ্ট না হলেও)। ভাষা আন্দোলনের চেতনা অন্য অর্থে তাই ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা।
ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস তৈরি হয়েছে। কথা ছিল বৈষম্য থাকবে না, শোষণ থাকবে না, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। সর্বস্তরে মাতৃভাষায় পাঠদান হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য বিলুপ্ত হয়ে একধারার শিক্ষা হবে। কিন্তু, শাসননীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পুঁজিবাদ। তাই ভূ-খন্ড ও শাসক বদল হলেও নীতি বদলায়নি। শিক্ষার সর্বস্তরে বিশেষত উচ্চশিক্ষার স্তরে মাতৃভাষায় পাঠ্যবই প্রণয়ন, বিভিন্ন ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় পুস্তক অনুবাদের জন্য বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এগুলো কোনো কঠিন কাজ ছিল না। যে মনোভাব নিয়ে মানুষ লড়েছিল, সে মনোভাব শাসকদের ছিল না বলেই তা হয়নি। তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা বহাল থেকেছে, যে কারণে সুস্পষ্ট শ্রেণিবিভাজন থেকে গেছে এবং দিন দিন তা আরো পুষ্ট হয়েছে। এখন ধনী পরিবারের সন্তানরা পড়ছে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজে, দরিদ্ররা পড়ছে মাদ্রাসায়, নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের সন্তানরা পড়ছে সাধারণ স্কুল-কলেজে। যেহেতু ধনীরাই দেশ চালায়, সেহেতু তাদের চিন্তাচেতনা ও দক্ষতা তৈরির উপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ইংরেজিমাধ্যম থেকেই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এভাবে এলিট একদল মানুষ তৈরি করা হচ্ছে, যাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকুতি বোঝার, তাদের স্বার্থানুগ হবার কোনো সাধ্যই থাকবে না। অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষার ধারা পুষ্ট হয়েছে, যা কার্যত আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যচেতনার সপক্ষে অবস্থান নিতে পারছে না। কার্যত ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধেই বিরাট মনস্তত্ত্ব তৈরি করেছে; যার ফলাফল আমরা দেখছি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার নানা ঘটনায়, সাম্প্রদায়িক নানা হামলায়। পাকিস্তানিদের যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল, ক্ষমতার প্রয়োজনে তাকেই পরিপুষ্ট করেছে বর্তমান ও অতীতের সরকারগুলো। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়াবলি পর্যন্ত পাল্টে দেওয়া হয়েছে গোঁড়া ধর্মীয়গোষ্ঠীর দাবির কাছে মাথা নুইয়ে। এদের কাছে একজন ‘রবীন্দ্রনাথ’ বা ‘সুকান্ত’ বড় সাহিত্যিক বা কবি নন, হিন্দু মাত্র। নতি স্বীকারের কারণ ও লক্ষ্য যে ভোটব্যাংক ও ক্ষমতা, তাতে এতটুকু সন্দেহ নেই। পাকিস্তান আমলে ধর্মের প্রবল ঘেরাটোপের মধ্যেও যে চেতনায় শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, প্রভাতফেরী চালু করা গিয়েছিল, আজ তার এই পরিণতি! অথচ এরাই আবার ফুল দেয়, শ্রদ্ধা জানায়, বইমেলার আয়োজন করে।
ভাষা আন্দোলন ছিল অন্য ভাষার প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সাংস্কৃতিকভাবে আজ ইংরেজির প্রভুত্ব তৈরি হয়েছে। ইংরেজি না জানলে জীবনটাই যেন বৃথা— এরকম মনোভাব সর্বত্র। কথায়, উচ্চারণে ইংরেজি ও বাংলা মিশিয়ে বলা, ভঙ্গি করা — সাহেবিয়ানার সংস্কৃতির প্রকাশ যেন! ভোগবাদের বিস্তার যুবক-তরুণদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার এক বিরাট বৃত্ত তৈরি করেছে। ভয়াবহভাবে বেড়েছে নারীনির্যাতন ও মাদকের বিস্তার। অর্থনৈতিক শোষণের তীব্রতা যত বাড়ছে, রাষ্ট্র হয়ে উঠছে তত কর্তৃত্বপরায়ণ। দুর্নীতি, লুটপাট, গুম, খুন, ধর্ষণ — কী নেই? ৪৭ বছরে গণতন্ত্রের কোনো বালাই-ই ছিল না। কখনো অনির্বাচিত, কখনো বা নির্বাচিত সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচারী ব্যবস্থা চেপেছে। শাসকদের আচরণে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি-মূল্যবোধ কোনোকিছুই যেন এখন আর অবশিষ্ট নেই। গায়ের জোরই যেন শেষ কথা। প্রতিবাদের সামান্য চেষ্টাও তীব্রভাবে দমন করা হচ্ছে। আজ দরিদ্র মানুষের কোনো ভাষা নেই, নীরব ক্রন্দন আর আর্তনাদ ছাড়া। আর নিরক্ষর যারা, তাদের তো ভাষাই নেই। রাষ্ট্রের ভাষা আজ আক্ষরিকভাবে বাংলা হলেও কার্যত বাংলা নেই। স্বৈরাচারের ভাষা জনগণের লড়াইয়ের বাংলা ভাষা নয়। কর্তৃত্বের ভাষা ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা’ হতে পারে না।
তাহলে ভাষা আন্দোলনের আজকের তাৎপর্য কী হবে? কী হবে তার চেতনা? প্রকৃতপক্ষে চেতনা কোনো স্থির ব্যাপার নয়, চেতনা প্রবহমান। পথ যেমন থেমে থাকে না, অগ্রসর হয়; ভাষার লড়াইয়ের চেতনাও তেমনি অগ্রসরমান। বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তা শোষণমুক্তিরই চেতনা। তাই বিদ্যমান পুঁজিবাদী কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া বাংলাভাষার মুক্তি আসবে না।
একুশের সংস্কৃতি — মাথা নত না করা। এই চেতনা আজ সমাজজীবনে স্বল্প পরিসরে দৃশ্যমান। আমরা কি তাহলে হতাশ হব? আত্মসমর্পণ করব? যা চলছে, তার সঙ্গে মানিয়ে চলব? ভাষা আন্দোলন বলছে — আত্মসমর্পণে মুক্তি নেই। যত কঠিনই হোক, ব্যবস্থা পাল্টানোর সংগ্রাম আমাদের এগিয়ে নিতেই হবে।