Tuesday, December 24, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ সেপ্টেম্বর ২০১৯মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী

(সৈয়দ আবুল মকসুদ রচিত ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’ গ্রন্থের উপসংহার অধ্যায়ের ৬১৭-৬৪৫ পৃষ্ঠা এবং চতুর্থ অধ্যায়ের ১৭৮-১৯০ পৃষ্ঠা থেকে কিছুটা সংক্ষেপিত আকারে উদ্ধৃত। অনুচ্ছেদ ভাগ ও শিরোনাম আমাদের।)

(পূর্ব প্রকাশের পর)
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে ভাসানীর ভূমিকা
… আসামে লাইনপ্রথা বিরোধী আন্দোলন এবং চুয়ান্নর মুসলিম লীগ বিরোধী আন্দোলনের পর ১৯৬৮-র নভেম্বরে মওলানা ভাসানী আর একবার জাতীয় রাজনীতির কাÐারীরুপে আবির্ভূত হন। ’৬৮-৬৯ সালের সেই আন্দোলনেই ‘ লৌহ মানব’ আইয়ুব খনকে বিদায় নিতে হয়। ইনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় শুধু দেশবাসীর কাছে নয়, বিশ^বাসীর কাছে ভাসানী পরিণত হলেন এক দুর্বিনীত ব্যক্তিত্বে।

… ৬৮-র শেষ দিকে আইয়ুবের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা হয় গোটা পশ্চিম পাকিস্তানে। … ৬৮-র ৬ ডিসেম্বর পল্টনের এক বিরাট জনসভায় মওলানা ভাসানী বলেন, … স্বায়ত্তশাসন, সার্বজনীন ভোটাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা … এসব দাবি মানা না হলে পূর্ব পাকিস্তান ‘স্বাধীনতা’ ঘোষণা করে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেই। … তিনি … ইঙ্গিত দেন বর্তমান অবস্থায় ন্যাপ আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ নাও করতে পারে। সভার শেষে ভাসানীর নেতৃত্বে একটি শোভাযাত্রা গভর্নর হাউসের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সেকানে পুলিশের সঙ্গে জনতার খণ্ডযুদ্ধ হয়। … ভাসানী পরদিন ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানান। … ৭ ডিসেম্বর এক অভূতপূর্ব হরতাল পালিত হয়। … পুলিশের গুলিতে দু’জন নিহত হবার খবরে বিরোধী ও স্বতন্ত্র সদস্যরা জাতীয় পরিষদ থেকে ওয়াকআউট করেন। … ভাসানী সরকারি নির্যাতনের নিন্দা করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোরনের জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানান … ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয় এবং ১৪৪ ধারার মধ্যেই বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সকল বিরোধীদলীয় নেতা ও কর্মীদেরসহ লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে আগের দিনের নিহতদের গায়েবানা জানাজার ইমামতি করেন মওলানা ভাসানী। ঢাকায় … চট্টগ্রাম, পাবনা, বগুড়া প্রভৃতি শহরেও পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ হয়। … ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ সরকারবিরোদী আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে যায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং ভাসানী মফস্বলের বিভিন্ন জায়গা সফর করে জনগণকে বিশেষ করে কৃষক ও পল্লীর শ্রমজীবী মানুষদের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করেন।

… ২৮ ডিসেম্বর ভাসানী ঘেরাও আন্দোলনের সূচনা করেন। ওই দিন পাবনায় এক বিশাল জনসভা … শেষে ভাসানীর নেতৃত্বে এক মিছিল পাবনা জেলা প্রশাসকের বাংলো ঘেরাও করে। … এই আন্দোলনের প্রাক্কালে ভাসানী শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে গ্রামের জনসাধারণের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। … আইয়ুবের দুর্নীতিপরায়ণ মৌলিক গণতন্ত্রী ও গ্রামের মোড়ল মহাজনদের নির্মূল করার লক্ষ্যেই জননেতা উদ্ভাবন করেন নতুন রাজনৈতিক কৌশল : ঘেরাও আন্দোলন। … ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা জেলার অন্তর্গত মনোহরদীতে বিক্ষোভকারী জনতার ওপর পুলিশ গুলি চালায়। সেখানে তিনজন নিহত হবার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে ঘেরাও আন্দোলন এক মারাত্মক আকার ধারণ করে।

… ৫ জানুয়ারি বৃহত্তর আন্দোলনের লক্ষ্যে ১০ সদস্যবিশিষ্ট ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় (ডাকসু, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ভাসানীপন্থী ও মস্কোপন্থী দুই অংশের সমন্বয়ে)। ১৪ জানুয়ারী তাঁরা ঘোষণা করেন তাঁদের ১১ দফা কর্মসূচি, যা তৎক্ষণাৎ ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পায়। … ১৭, ১৮, ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয় এবং ২০ জানুয়ারি … পুলিশ … গুলিতে ভাসানীপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আসাদুজ্জামানকে হত্যা করে, … ছাত্র আন্দোলন ও ভাসানীর জ্বালাও-পোড়াও-ঘেরাও আন্দোলন এক হয়ে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয় গণঅভ্যুত্থানে। … ভাসানী ছাত্রদের এগার দফায় সমর্থন জানিয়েছিলেন।

… ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী অবস্থায় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়। … পরদিন, ১৬ ফেব্রুয়ারি, পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দানকালে জননেতা বলেন, “প্রয়োজন হলে ফরাসি বিপ্লবের মতো জেলখানা ভেঙ্গে মুজিবকে নিয়ে আসবো। দুই মাসের মধ্যে ১১ দফা কায়েম এবং রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া না হলে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হবে।” … ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা সেনাবাহিনীর লোকদের হাতে নিহত হন, … ১৮ তারিখ ঢাকাতেই সরকারি হিসেবে চারজন নিহত … সরকারি ও মুসলিম লীগ নেতাদের বাড়িঘর আক্রমণ করছিলো বিক্ষুব্ধ জনতা।

… উত্তাল আন্দোলনের মুখে সরকার কথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার করে এবং বিনাশর্তে শেখ মুজিবসহ অভিযুক্তদের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দেয়। … মুক্তি পেয়ে ওইদিনই রাতে শেখ মুজিব ভাসানীর সাথে দেখা করেন … ভাসানী মুজিবকে (আইয়ুবের ডাকা) গোলটেবিলে যেতে বারণ করেন। … যাইহোক, শেখ মুজিব, … আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের জন্য ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে লাহোর যান। … ১১ দফার ভিত্তিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য ন্যাপ … আবেদন জানান। … গোলটেবিল বৈঠকের পরও মওলানা ভাসানীর জ্বালাও, পোড়াও, ঘেরাও আন্দোলন অব্যাহতভাবেই চলতে থাকে। … কোনক্রমেই আর আইয়ুবের পক্ষে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয় ভেবে তিনি ২৪ মার্চ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে এক দীর্ঘ চিঠি দিয়ে তাকে ক্ষমতা গ্রহণের আহ্বান জানান। … ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারি করা হয়।

… আইয়ুবের পতনে ভাসানী যে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন তার জন্য সমগ্র বিশ্বে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। সাপ্তাহিক ‘টাইম’ তাকে ‘Prophet of violence’ অভিধায় ভূষিত করে। ‘টাইম’ সাময়িকী লেখে : “… একজন, শুধু একজন মানুষই, গত মাসে (মার্চ ১৯৬৯) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং ‘ ‘লৌহমানব’ নামে খ্যাত আইয়ুব খানকে গদিচ্যুত করতে বাধ্য করেছেন। … তিনিই এখন সেই সামরিক আইনের একমাত্র-একক আতংকস্বরূপ। ভাসানীর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নরমপন্থী শেখ মুজিবুর রহমানসহ পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা একটি ভীতির কারণে নিশ্চুপ। কিন্তু ভাসানী অকুতোভয়। … ” [ পৃষ্ঠা ৩১৩-৩৩১]

কৃষক ও শ্রমিক সংগঠন গড়ায় ভাসানী
কৃষকনেতা হিসেবে ভাসানী নিজেই এই দেশে এক অপ্রতিদ্ব›দ্বী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন ৩০-এর দশক থেকে। উপমহাদেশের অন্য কৃষকনেতার চেয়ে স্বভাবে ও চারিত্রে তিনি ছিলেন ভিন্ন ও ব্যতিক্রমী। কৃষকদের নিয়ে সংগঠন করেন তিনি অনেক পরে, ১৯৫৭ অব্দে, যখন গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি’। এই সমিতি দেশে কৃষক আন্দোলনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। অনেক সংসদীয় গণতন্ত্রী নেতাদের মতো ভাসানী চাতুর্য করে কৃষকদের ভোটের সময় দলে টানবার নীতিকে ঘৃণা করতেন। তিনি চাইতেন কৃষকদের আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তুলতে যাতে সংগ্রামের মাধ্যমেই তাদের নিজেদের দাবি তারা নিজেরাই আদায় করতে পারেন।

বহুকাল যাবৎ কৃষকসমাজের ‘রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার’ কথা সমাজবিজ্ঞানীদের লেখায় আলোচিত হয়েছে। কৃষকনেতা থেকে যখন রাজনীতিবিদে উত্তরণ ঘটে ভাসানীর তখনো তাঁর ক্ষমতার মূল উৎস ছিলো কৃষকসমাজ। … … বিকশিত আধুনিক নাগরিক জীবনের জৌলুস থেকে দূরে বিভিন্ন লোকালয়ে ও জনপদে বিচ্ছিন্ন কৃষকদের কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে একত্রিত করা সহজসাধ্য নয়। … … মার্কস-এঙ্গেলস ছোটো কৃষকদের কিভাবে বিপ্লবে ও আন্দোলনে আনা যায় সে বিষয়ে ভেবেছেন, কিন্তু ভাসানী কোনো সমাজবিজ্ঞানের বইপত্র ও অর্থনীতি না পড়ে তাদের সংগঠিত করেছেন শুধু তাঁর উপলব্ধি থেকে। তিনি ছোটো কৃষক ও খেতমজুরদের দ্বারা সংগঠিত ও পরিচালিত আন্দোলনে গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ ভাসানী জমিদার ব্যবস্থায় মধ্য কৃষক ও প্রান্তিক চাষী ও ভূমিদাসদের দুঃসহ অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি দেখেছেন জমিদারদের ও জোতদারদের তারা দাসবিশেষ। তিনি যে-সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন তাকে সফল করার লক্ষ্যে … তিনি কৃষকদের বিপ্লবের জন্য সংগঠিত করতে চেয়েছেন, তাদের চেতনার মান বাড়াতে চেয়েছেন, বরং নির্বাচনে কৃষকদের ব্যবহৃত হতে দেখে তিনি ব্যথিত হয়েছেন। জীবনের শেষ পঞ্চাশ বছর তিনি আসামের বরপেটায়, ময়মনসিংহে, টাঙ্গাইলে, সিরাজগঞ্জে, পাবনায়, পাকসিতে, নওগাঁতে, মহিপুরে, ঢাকায়, শিবপুরে, ভুরুঙ্গামারিতে প্রভৃতি স্থানে বিশাল বিশাল কৃষক সম্মেলন করেছেন।

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সামগ্রিকভাবে কৃষক ও শ্রমিককে সংগ্রামে সম্পৃক্ত করার বিরল কৃতিত্ব তাঁর। তা ছাড়া কৃষকদের মধ্যে পৃথিবীর সর্বাধিক পাট উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পাটচাষীদের সংকট, সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ ছিলো সবচেয়ে বেশি। ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত এবং সমস্যায় জর্জরিত পাটচাষীদের দুর্দশাকে আলাদাভাবে সমাধানের জন্য তিনি গড়ে তোলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান পাটচাষী সমিতি’: পাটচাষীদের প্রথম সংগঠন। ৫০ ও ৬০-এর দশকে এই সংগঠনের উদ্যোগে বড় বড় পাটচাষী সম্মেলন করেন।

মৎস্যজীবীদের নিয়ে কে ভেবেছেন এ দেশে তাঁর আগে? তিনি ১৯৫৮-তে গড়ে তোলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান মৎস্যজীবী সমিতি’। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম এই মৎস্যজীবী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী স্বয়ং এবং এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নারায়ণ চন্দ্র মজুমদার। জেলেদের স্বার্থরক্ষার জন্যে এই সমিতি একটি ১২-দফা দাবিনামা নিয়ে আন্দোলন শুরু করে, কিন্তু অল্প কিছুকাল পরেই দেশে সামরিক শাসন জারি হয়।

ঢাকাসহ বড় বড় শহরের রিকশাচালকগণ কোনো কারখানার শ্রমিক না হওয়ায় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে অংশ নিতে পারছিলেন না তারা। ৫০-এর মাঝামাঝি ভাসানী ঢাকায় রিকশাচালকদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান রিকশাচালক সমিতি’। … ১৯৫৮-তে দেশে সামরিক শাসন জারি না হলে ’৫৯ নাগাদ ভাসানী তাঁর নেতৃত্বে তাঁতী সমিতি, কুম্ভকার সমিতি, কর্মকার সমিতি প্রভৃতি গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন। শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসে তাতে যোগ হতো নতুন মাত্রা।

বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনে ভাসানীর অবদান বর্ণনার জন্য বিরাট জায়গার প্রয়োজন। ১৯৫০ পর্যন্ত এ দেশের শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রধানত কমিউনিস্টরাই জড়িত ছিলেন। ১৯৪৭ থেকে ’৫৭ পর্যন্ত বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত কোনো শ্রমিক সংগঠন প্রকাশ্যে ছিলো না। আত্মগোপনকারী কমিউনিস্টরাই কলকারখানা, শিল্প এলাকা ও শ্রমিক-বেল্টগুলোয় শ্রমিকদের দাবি আদায়ের জন্য তাদের সংগঠিত করতেন ও সংগ্রাম করতেন। ’৫০ নাগাদ হিন্দু কমিউনিস্টদের অনেকেই দেশত্যাগ করায় শ্রমিক আন্দোলনে শক্তি কমে আসে।’ … ১৯৫৭-তে ‘পূর্ব পাকিস্তান মজদুর ফেডারেশন’ জন্ম নেয় বামপন্থীদের দ্বারা। ভাসানী ছিলেন এর মুখ্য উপদেষ্টা। এটির সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বরিশালের স্টিমার শ্রমিক-নেতা কাজী মহিউদ্দিন। অসংখ্য বামপন্থী শ্রমিক নেতা এই সংগঠনে ছিলেন। ’৫৮-তে সামরিক আইন জারি হলে ফেডারেশনের অফিসে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। … ১৯৬৬-তে গঠিত হয় ভাসানীর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন’। এর নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, সিরাজুল হোসেন খান, মনীন্দ্র মহাজন, অমল সেন, জ্ঞান চক্রবর্তী, কালী চক্রবর্তী, বারীন দত্ত, আবদুস সাত্তার, দেবেন শিকদার, মণিকৃষ্ণ সেন, রওশন আলী, অমূল্য লাহিড়ী, খোকা রায়, কাজী জাফর আহমদ, কাজী মহিউদ্দিন প্রমুখ। ’৬৮-তে এই সংগঠন ভাগ হয়ে যায়: এক দলের নেতৃত্বে থাকেন আবুল বাশার, সিরাজুল হোসেন খান প্রমুখ। অন্য দলের নেতৃত্ব দেন কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকবর খান রনো প্রমুখ। এই সকল শ্রমিক সংগঠনের লিখিত বা অলিখিত প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন মওলানা ভাসানী। তাছাড়া ’৫০-এর দশকে ভাসানী ‘আদমজী জুট মিলস মজদুর ইউনিয়নে’র সভাপতি ছিলেন। মোহাম্মদ তোয়াহা ছিলেন সহ-সভাপতি। ‘ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়েজ এমপ্লয়িজ লীগ’-এরও মওলানা ছিলেন সভাপতি। দেশের সকল বামপন্থী শ্রমিক-সংগঠনগুলোর তিনি ছিলেন প্রধান অভিভাবক।

গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী ভাসানী
এ দেশের গ্রামের মানুষকে স্পর্শ করে এমন প্রত্যেকটি ব্যাপারে ভাসানী ছিলেন অসামান্য সচেতন। তাদের সুখ-দুঃখের জায়গা তিনি শনাক্ত করতেন পারতেন অতি সহজে। যখন যেখানে কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, কলেরা-বসন্তের প্রাদুর্ভাব হতো, তিনি অবিলম্বে সেখানে যেতেন ছুটে, বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বা অন্যভাবে প্রশাসনকে ব্যস্ত করে তুলতেন। শুধু মানুষের রোগশোকে নয়, গবাদিপশুর নানা অসুখেও তাঁর তৎপরতা লক্ষ করা যেতো। নদনদীবিধৌত এই দেশের নদীভাঙন সাংবাৎসরিক সমস্যা। … নদীর দু’তীরের অথবা বালুচরের শ্রমজীবী মানুষগুলোর সঙ্গে ছিলো তাঁর গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক। … বহু সভা-সমাবেশ তিনি দেশের মানুষের যে সমস্যাসমূহ বারংবার তুলে ধরতেন তার মধ্যে থাকতো নদীসিকস্তি সর্বস্বান্ত মানুষের হাহাকারের কথা, তাঁর ভাষায় : বান তুফান হইলে ঘরবাড়ি জিনিসপত্র কিছু পাওয়া যায়। নদীর ভাঙনে কিছুই থাকে না — ভিটিসহ নদী সব কিছু ভাসাইয়া নিয়া যায়।
এ দেশ যেমন নদনদীর তেমনি বন্যারও। … এ শতকের ২০, ৩০ ও ৪০-এর দশকে দেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। বন্যাউপদ্রæত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন ভাসানী। বড় বড় জোতদারের বাড়ি থেকে ধান-চাল-ডাল সংগ্রহ করে তিনি বড় নৌকা নিয়ে যেতেন উপদ্রুত এলাকায়। ১৯৪৭ পরবর্তীকালে ১৯৫০, ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৬২, ৬৪, ৬৫, ৬৮, ৭০ সালে বাংলাদেশে প্রবল বন্যা হয়। প্রত্যেকটি বন্যার সময় তাঁর তৎপরতা ছিলো যে-কোনো রাজনীতিকের চেয়ে বেশি। ১৯৬২-র বন্যার সময় তিনি ছিলেন অন্তরীণ, বন্যার্তদের পর্যাপ্ত সাহায্যের দাবিতে তিনি অনির্দিষ্টকাল অনশন ঘটলে তাঁকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। পরে দেশের রাজনীতিবিদদের চাপে আইয়ুবের সামরিক সরকার তাঁকে চার বছর বন্দী রাখার পর মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তি পেয়েই তিনি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ছুটে যান। দুর্গত মানুষের সেবা ছিলো তাঁর রাজনীতিরই অংশ। …

… পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আসাম থেকে এখানে প্রত্যাবর্তন করেই তিনি বন্যাসমস্যা সমাধানের কথা বলতে থাকেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে চুয়ান্নর নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত অনবরত তিনি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য অধিক পরিমাণ অর্থ বরাদ্দের জন্য কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারকে চাপ দিয়েছেন। যুক্তফ্রন্টের বিখ্যাত ২১ দফায় বন্যার প্রসঙ্গ ছিলো। ১৯৫৬ সালে তিনি বন্যা পরবর্তীকালের খাদ্যসংকট সমাধানের জন্য অনশন ধর্মঘট করেন। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের প্রত্যেকটি কাউন্সিল ও বিশেষ অধিবেশনে তিনি বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য সংকটের কথা বারবার উত্থাপন করেছেন। উত্তরবঙ্গে বন্যার সময় জরুরি খাদ্য সরবরাহের জন্য ‘উত্তরবঙ্গের কেন্দ্রস্থল শান্তাহারে একটি বিমানঘাঁটি’ (বিমানবন্দর) নির্মাণের প্রস্তাব করেন তিনি মধ্য-৫০-এ।
জীবনে কোনো ব্যাপারেই তিনি শাসকদের সঙ্গে আপোস করেননি তা নয়, পরিস্থিতির কারণে অনেক শাসককে তিনি কোনো ব্যাপারে ছাড় দিয়েছেন, কিন্তু ক্ষুধার্র্ত মানুষের খাদ্যসমস্যার ব্যাপারে তিনি ছিলেন চরম কঠোর। মধ্য ৫০-এ শুধু স্বায়ত্তশাসন ও বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে নয়, পূর্ব বাংলার খাদ্যসমস্যা সমাধানের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর গাফিলতির জন্যেও তাঁর সঙ্গে ভাসানীর সম্পর্কের অবনতি ঘটে, পল্টন ময়দানে জনসভায় ভাসানী সোহরাওয়ার্দীর উপস্থিতিতেই তাঁকে অসৌজন্যমূলক ভাষায় সমালোচনা করেন। প্রাজ্ঞ রাজনীতিক সোহরাওয়ার্দী ভাসানীর ভর্ৎসনায় লজ্জিত বিব্রত হয়েছেন, কিন্তু প্রকাশ্যে ক্রুদ্ধ হননি। দুর্র্ভিক্ষপীড়িত মানুষের খাদ্যের দাবিতেই ভাসানী বারবার অনশন করেছেন। ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের আগে ’৭৩-এ অনশন করে তিনি সরকারকে সতর্ক করে দেন, কিন্তু সরকার তাঁর হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করে। (চলমান)

সাম্যবাদ সেপ্টেম্বর ২০১৯

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments