Tuesday, April 16, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - আগষ্ট ২০১৯মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী 

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী 

(সৈয়দ আবুল মকসুদ রচিত ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’ গ্রন্থের উপসংহার অধ্যায়ের  ৬১৭-৬৪৫ পৃষ্ঠা এবং চতুর্থ অধ্যায়ের ১৭৮-১৯০ পৃষ্ঠা থেকে কিছুটা সংক্ষেপিত আকারে উদ্ধৃত। অনুচ্ছেদ ভাগ ও শিরোনাম আমাদের।)

শোষিত-নিপীড়িত মানুষের নেতা ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সে-জন্যেই তাঁর নামের সঙ্গে কে বা কারা কবে কখন জুড়ে দিয়েছিলো একটি অভিধা : ‘মজলুম জননেতা’। যথার্থ ছিলো এই অভিধা। … তিনি একজন ধর্মীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও সংস্কারমুক্ত মনেই নিজেকে নিবেদন করেন নিপীড়িত বঞ্চিত পদানত মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, সে-জন্যে কর্মক্ষেত্ররূপে বেছে নেন রাজনীতিকেই। … একালে প্রথাগতভাবে রাজনীতি করা হয় শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া অথবা ক্ষমতায় অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে, কিন্তু ভাসানীর রাজনীতি ছিলো শাসনক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কশূন্য। যদিও তাঁর দল একাধিকবার ক্ষমতাসীন হয়েছে। তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি একবাক্যে যা বলেছেন তার তাৎপর্য তাঁর নিজের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য: “রাজনীতি হইতেছে একটি মহৎ কর্মপ্রয়াস যার লক্ষ্য সমাজ হইতে অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতনের অবসান ঘটাইয়া জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমাজের সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ ও মঙ্গলের পথ প্রশস্ত করা: সমাজে ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা তথা সামগ্রিক গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা।”২

গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে তিনি সামন্তবাদী সমাজের সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে পরিচিত হন জীবনের শুরুতেই। তারপর শৈশবে পিতামাতা আত্মীয়পরিজন হারিয়ে পরিবারের ছায়া, পরিবারের স্নেহমমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে তিনি তাঁর অল্প বয়সে ছন্নছাড়া কৃষক, ক্ষেতমজুর, জেলে, তাঁতী, কামার-কুমার প্রভৃতি শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের সমস্যা ও তাদের মূল শত্রু জমিদার, মহাজন, আমলা মুৎসুদ্দিদের দৌরাত্ম্য সম্পর্কে অপার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সে অভিজ্ঞতা হয়তো এ দেশের কোটি কোটি মানুষেরই ছিলো, কিন্তু অনন্যসাধারণ বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী ভাসানী শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং সে-বিদ্রোহ অহিংস নয়। পরিণত বয়সে তাই তাঁর মুখে বারবার শোনা যায়: “তোমরা হিংসা করো। শোষক ও জালেমকে হিংসা করো। হিংসার আগুনে শোষকের সৌধ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দাও।” তিনি বলেছেন: “জমির পরিমাপে মানুষে মানুষে শ্রেণিভেদ করাটা আমি বরদাস্ত করিতে পারিতাম না। জমিদার মহাজনদের সুপরিকল্পিত শোষণের পরিচয় যেদিন পাইয়াছিলাম, সেইদিন মনে মনে চাহিয়াছিলাম, গোটা সমাজব্যবস্থাটাকে দুমড়াইয়া নতুন কিছুর পত্তন করি।”৩

এক অপ্রতিরোধ্য ক্রোধ আজীবন ভাসানীকে তাড়িত করেছে। সে-ক্রোধ অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার ও শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে। সেই পবিত্র ক্রোধের তাড়নায় তিনি ঝঞ্ঝার মতো নিরন্তর ছুটে বেড়িয়েছেন, যে কোনো ধরনের অন্যায়-অত্যাচারের মুখে তাঁর কোনো অবসর ছিলো না। ব্যক্তিগত অন্যায়, গোষ্ঠীগত অন্যায়, সম্প্রদায়গত অন্যায়, সরকারের অন্যায়-অবিচার, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের অন্যায়-অত্যাচার — এ সবকিছুই তাঁকে সমানভাবে উত্তেজিত করে তুলতো। মৃত্যুর মাত্র চার দিন আগে, ১৩ নভেম্বর ১৯৭৬, সন্তোষে খোদা-ই-খিদমতগার সম্মেলনে তাঁর জীবনের শেষ ভাষণে তিনি বলেন: “অন্যায়ের প্রতি অনীহা [হয়তো তিনি বলতে চেয়েছিলেন ঘৃণা] আমাকে সারাজীবন বিভিন্নমুখী কর্মতৎপরতার প্রেরণা জুগাইয়াছে। এই স্বভাবজাত প্রবণতার সহিত যোগ হইয়াছে আসামের জলেশ্বরের সুফী সাধক হযরত শাহ নাসিরুদ্দীন বোগদাদির আধ্যাত্মশিক্ষা। আরো যোগ হইয়াছে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধাপে ধাপে খেলাফত আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ আন্দোলন, কৃষক প্রজা আন্দোলন, পাকিস্তান যুগে ভাষা-আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন হইতে স্বাধিকার, স্বাধিকার হউতে স্বাধীনতা আন্দোলন — এই সবই আমি ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্রবিন্দু হইতে অবলোকন করিয়াছি।”৪

তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মওলানা তাঁর বেদনা ও হতাশার কথা অকপটে স্বীকার করেও শেষ পর্যন্ত আশাবাদই ব্যক্ত করলেন: “আমার বিগত ৭৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ক্ষমতার হাতবদল কখনো বা অতি নিকট হইতে কখনো বা কিঞ্চিৎ দূর হইতে অবলোকন করিয়াছি। এই পর্যায়ক্রমিক পটপরিবর্তনের ধারায় আমি নিজেও সাধ্যমতো সক্রিয়তা বজায় রাখিয়াছি। কিন্তু যে কৃষক-মজুর, কামার-কুমার, জেলে-তাঁতী ও মেথর প্রভৃতি মেহনতি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন আমি আবাল্য দেখিয়াছি এবং সে-জন্য সংগ্রাম করিয়াছি, তাহা আজও সুদূর পরাহত রহিয়া গিয়াছে। তাই আমার সংগ্রামের শেষ নাই। এই সংগ্রাম আজীবন চলিবে।”৫

যৌবনে ভাসানী সশস্ত্র বিপ্লবী অর্থাৎ ‘সন্ত্রাসবাদীদের’ সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তাঁর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা থেকে। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিপ্লবীদের আত্মদান তাদের প্রতি তাঁকে শ্রদ্ধাশীল করে তুলেছিলো। কিন্তু সেই বিপ্লবীদের – যাঁদের প্রায় সকলেই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের — সঙ্গে ধর্মীয় কারণে নয়, অন্য কারণে তাঁদের সংস্পর্শে বেশিদিন থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে তাঁদের প্রতি তিনি আমৃত্যু শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের নাম উচ্চারণ করতেন, অপরদিকে আপোসকামী বুর্জোয়া নেতাদের তিনি করতেন সমালোচনা।

এই শতকের দ্বিতীয় দশকটিতে ভাসানীর কর্মকান্ডের বিস্তারিত তথ্য জানার উপায় নেই। এই সময়, প্রথম মহাযুদ্ধের মধ্যে, তিনি ময়মনসিংহ-শেরপুর-নেত্রকোনা মহকুমার দুর্গাপুর, নালিতাবাড়ি, হালুয়াঘাট, ধুবাউড়া প্রভৃতি থানায় গারো, হাজং, কোচ প্রভৃতি উপজাতীয়দের জোর করে অথবা প্রলোভন দেখিয়ে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করার প্রতিবাদে মিশনারিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। তাছাড়া স্থানীয়ভাবে জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে উত্তরাঞ্চলের গরিব কৃষকদের সংগঠিত করেন।

মওলানা মোহাম্মদ আলী, চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দ্বিতীয় দশকের শেষ দিকে ভাসানী দলীয় রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ১৯১৯ সালে যোগদান করেন নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসে। চৌদ্দ বছর আগে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটি অতিরিক্ত সরকারঘেঁষা ও সাম্প্রদায়িক বলে তাতে যোগদান না দিয়ে তিনি অপেক্ষাকৃত অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসে যোগদান করাই সংগত মনে করেন। তিনি ছিলেন চিত্তরঞ্জনের ‘স্বরাজ্য দলের’ও একজন সক্রিয় কর্মী। ২০-এর দশকের প্রথম চার-পাঁচ বছর তিনি চিত্তরঞ্জনের একজন অনুগত কর্মী হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। তিনি ভারতবর্ষের নানা জায়গা ব্যাপক সফর করেন, সাক্ষাৎ করেন সেকালের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে বিপিনচন্দ্র পাল, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, স্যার আবদুর রহিম, হাকিম আজমল খান, মওলানা হাসরত মোহানী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মওলানা আজাদ সোবহানী, মওলানা মাহমুদ হাসান, হাসান ইমাম, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী, এ কে ফজলুল হক, মোহাম্মদ আকরম খাঁ, সুভাষচন্দ্র বসু, স্যার আবদুল হালিম গজনভী, সৈয়দ হুসেইন আহমদ মাদানী প্রমুখ প্রধান। সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণের সঙ্গে যোগ হয় বন্যা প্রভৃতি নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমাজসেবামূলক কাজ। ১৯২১ সালে তিনি গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন এবং কারাবাস করেন। 

আশৈশব সামন্তবাদ ও মহাজনী প্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন, মধ্য-২০ থেকে মধ্য-৩০ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ও আসামে কৃষকদের সংগঠিত করেন, তাদের উত্তেজিত করে তোলেন জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে। এই সময় তিনি বিরাট বিরাট কৃষক-সম্মেলনের আয়োজন করেন এবং অপরাজেয় কৃষকনেতা রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জে যে কৃষক-প্রজা সম্মেলন তিনি অনুষ্ঠিত করেন তাতে শুধু জমিদার-মহাজনদের নয়, টনক নড়িয়ে দেন ব্রিটিশ সরকারেরও। সরকার উপলব্ধি করতে পারে বাংলার গ্রামাঞ্চলে এমন একজন নেতার আবির্ভাব হয়েছে যাকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রশাসনের পক্ষে কঠিন। চারিত্রে তিনি অন্য বুর্জোয়া নেতাদের মতো নন, বাংলার রাজনীতিতে তিনি যোগ করেছেন এক নতুন মাত্রা। প্রজাসাধারণকে তিনি তুলেছেন ক্ষেপিয়ে যুগপৎ জমিদার-মহাজন ও সরকারের বিরুদ্ধে। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রক্ষিত এক গোপন নথি থেকে জানা যায়, তাঁকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার ব্যাপারে সুপারিশ করে বাংলা সরকারের চীফ সেক্রেটারি বড়লাটের কাছে তার পাক্ষিক প্রতিবেদনে জানুয়ারি ১৯৩৩ সালে জানান : ‘আবদুল হামিদ খান নামক জনৈক ব্যক্তি এক বিপজ্জনক সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারীরূপে পূর্ববঙ্গে আত্মপ্রকাশ করেছেন’। তিনি তাঁর আগে একবার টাঙ্গাইল মহকুমা থেকে বহিষ্কৃত হন। সিরাজগঞ্জের প্রজা সম্মেলনের পরে ভাসানীর পক্ষে আর বাংলাদেশে থাকা সম্ভবপর ছিলো না। পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের মানুষ তাঁকে হয়রানি করতো। তিনি আসাম চলে যান। সূচিত হয় তাঁর জীবনে সংগ্রামের আর এক অধ্যায়ের।

আসাম অধ্যায়

… জমিদার মহাজনদের নির্মম অত্যাচারে, নদীভাঙনে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতি নানা কারণে সর্বস্বান্ত কৃষকরা উনিশ শতকের শেষ বছরগুলো থেকেই পার্শ্ববর্তী প্রদেশ আসামে গিয়ে অনাবাদী জমি চাষ করে বসবাস শুরু করে। তাদের অশেষ পরিশ্রমে আসামে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়ে যায়, অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ আসাম ছিলো ব্রিটিশ ভারতের অনুন্নত এলাকাগুলোর অন্যতম। সেখানে বাংলাভাষীরাই ছিলো অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অগ্রসর। তা ছাড়া বাঙালিরাই ছিলো আসামের অনেকগুলো জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। … এই সংখ্যাগুরু বাঙালিদের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু অসমিয়া জনসাধারণ আন্দোলন শুরু করে। ভাসানী বাঙালিদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন।

বিশের দশক থেকেই আদিবাসীদের মধ্যে অভিবাসী বাঙালি কৃষকদের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। অসমিয়াদের চাপের মুখে অভিবাসীদের নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে এক পর্যায়ে সরকার প্রবর্তন করে কুখ্যাত লাইন-প্রথা। এই লাইন-প্রথা ছিলো একদিকে মানবতাবিরোধী, কারণ আইনগতভাবে ভারতের যে-কোনো এলাকার মানুষ যে-কোনো এলাকায় গিয়ে বসবাস করার অধিকারী ছিলো। লাইন-প্রথা প্রবর্তিত হওয়ার পর আসামের অভিবাসী বাঙালি কৃষকদের, যাদের অধিকাংশই ছিলো মুসলমান, তাদের জীবনে নেমে আসে এক চরম অনিশ্চয়তা: নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে তাদের বসবাসের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, এক পর্যায়ে আসাম থেকে তাদের বিতাড়িত করার আন্দোলনও শুরু হয় যা ‘বাঙাল-খেদা আন্দোলন’ নামে পরিচিত। এই সব সহায়সম্বলহীন নির্যাতিত নিপীড়িতদের পক্ষে কথা বলার কেউ ছিলো না, আর থাকলেও তাদের কণ্ঠস্বর ছিলো মৃদু ও দুর্বল। ভাসানী তাদের মুখপাত্রে পরিণত হন। প্রবল প্রতিপত্তিশালী ছিলো তাঁর প্রতিপক্ষ: আসামের বুর্জোয়া ও সামন্ত নেতা এবং ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু ভাসানী সর্বৈব অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন পরিচালনা করেন তার তুলনা এ শতকের পৃথিবীতে বিরল।

১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন, ১৯৪৬ পর্যন্ত পরিষদের সদস্য ছিলেন। এই সময় আইনপ্রণয়ন কক্ষের ভেতরে এবং রাজপথে সমান্তরালভাবে তিনি আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এরমধ্যে ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের ‘লাহোর প্রস্তাব’ গৃহীত হলে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। তাঁর চেষ্টায়ই সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।

দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, রক্তপাত, ধনসম্পত্তির অপরিমেয় ক্ষতি প্রভৃতি সর্বনাশা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান ও ভারত ১৯৪৭-এ আত্মপ্রকাশ করে। ওই সময় শুধু ভারতবর্ষ নয়, বঙ্গদেশও বিভক্ত হয়। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেয় মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ছিলেন নবাব, জমিদার ও ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের মানুষেরা। হিন্দু জমিদার মহাজন কর্তৃক পূর্ব বাংলার অধিকাংশ শোষিত-নিপীড়িত মুসলমান কৃষকপ্রজার জমিদারবিরোধী মনোভাবকে মুসলিম লীগের বুর্জোয়া নেতারা হিন্দুবিরোধী চেতনায় পরিণত করে। যদিও এই অঞ্চলের দরিদ্র হিন্দু প্রজারা হিন্দু জমিদার কর্তৃক এবং মুসলমান প্রজারা মুসলমান জমিদার কর্তৃক একইভাবে অত্যাচারিত হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান-আন্দোলন পরিচালিত হলো দ্বিজাতিতত্তে¡র সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই জানা গেলো মুসলমান শোষক আর হিন্দু শোষকের মধ্যে বিন্দুমাত্র ব্যবধান নেই। ভাসানী শোষকদের ‘শুয়োরের’ সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন: কালো ও সাদা শুয়োর দুই-ই যেমন হারাম, তেমনি শোষক সাদা হোক, কালো হোক, হিন্দু হোক, মুসলমান হোক উভয়েই সাধারণ মানুষের শত্রু, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই ন্যায়সঙ্গত। 

পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভাসানীর ভূমিকা : ৫০-এর দশক

পূর্ব পাকিস্তান কাগজপত্রে ছিলো স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অংশ, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে স্বাধীনতা অর্জনের পর দিনই এ দেশের বাঙালি উপলব্ধি করে জাতিগত শোষণ ও অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের এক সুচতুর ষড়যন্ত্র। বলা হলো: পাকিস্তান যেহেতু একটি মুসলিম রাষ্ট্র, সুতরাং এর একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। প্রকৃতপক্ষে উর্দুকে মুসলমানদের ভাষা আখ্যায়িত করলেও সেটি ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের প্রিয় ভাষা। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির উপর উর্দু চাপিয়ে দিয়ে তারা বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করেছিলো। পূর্ব বাংলার ছাত্রযুবসমাজ, বুদ্ধিজীবীসম্প্রদায় ও প্রগতিশীল রাজনীতিকদের একটি অংশ ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের গণবিরোধী এই ভূমিকার প্রতিবাদ করে এবং অবিলম্বে তাদের বাঙালিবিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে আন্দোলন শুরু হয়। শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮-৫২র ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেরই বীজ বপন করে। ভাষা আন্দোলনে ভাসানী ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন এবং কারারুদ্ধ হন। (তিনি ছিলেন ১৯৫২ সালে গঠিত ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ’-এর সভাপতি)

পাকিস্তান অর্জনের কিছুদিন পরে ভাসানী আসামের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পূর্ববঙ্গে আসেন। এসে টাঙ্গাইলের একটি শূন্য আসনের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থীরূপে পূর্ববঙ্গ প্রদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদে নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায়। তিনি পরিষদে আসনও গ্রহণ করেন, কিন্তু কক্ষে তাঁর উপস্থিতি মুসলিম লীগের গণবিরোধী শাসকদের উদ্বেগ ও অস্বস্তির কারণ ঘটায়। পরিষদের মাত্র একটি অধিবেশনে তিনি যোগ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং সেখানেই তিনি একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেন, উচ্চারিত হয় তাঁর কণ্ঠে: “আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম?” এই প্রশ্নে শাসকরা সচকিত হয় এবং ভাসানীকে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে। তিনি ছিলেন আসাম প্রদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি, পূর্ববঙ্গে এসে দেখলেন এখানকার লীগ নেতৃবৃন্দ তাঁকে উপেক্ষা করছেন। প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে আত্মসমর্পণ না করে তিনি পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি গণমুখী মুসলিম লীগ বা ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠন করেন ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। …

১৯৪৯-৫৩ সালের সাড়ে চার বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ই ভাসানীকে কারাগারের লোহার গরাদের অভ্যন্তরে অতিবাহিত করতে হয়; কিন্তু জেলের বাইরে যে-সময় তিনি থাকার সুযোগ পান সেই সময়ের তিনি সদ্ব্যবহার করেন বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তর ব্যাপক সফর করে। আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে সফর করে দলকে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যান। অনেকের মধ্যে তাঁর সঙ্গে থাকতেন তাঁর দুই তরুণ সহকর্মী দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক এবং সহ-সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান Ñ তাঁর দুই বলিষ্ঠ বাহু। তিনি হয়ে ওঠেন পূর্ববঙ্গের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিত মজলুম জনগণের কণ্ঠস্বর। ১৯৫৪-র নির্বাচনের আগে তাঁর জনপ্রিয়তার চিত্র পাওয়া যায় সেকালের একটি কবিতার কয়েকটি ছত্রে : “শহরে বন্দরে গ্রামে ঘরে/হৃদয়-নগরে/মুখের ভাষায় শুনি, বুকের সাড়ায় শুনি, চোখের তারায় দেখি নাম/মৌলানা ভাসানীর নাম।/পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণের কালাম Ñ /কণ্ঠে শুনি তাঁর। হতবাক বিস্ময়ে দেখি/জীবনে জীবনে এ কি/মিলিত প্রাণের গতি, কলকণ্ঠে আকাশ মুখর, /বজ্রে আর ঝড়ে যেন শুনি স্বচ্ছ স্বর/মুখের ভাষায় শুনি নাম।/মৌলানা ভাসানীর নাম।/এই নাম শুনে যেন আশা পাই বুকে/দুঃখ সুখে … … … তখন হৃদয়ে পাই ভাষা,/দেখি তিনি মানুষের সকলের এমন কি আমাদেরও আশা।/নক্ষত্রসঙ্গের মতো মানুষের জামাতে জামাতে/দেখি তিনি রাখী হাতে। [আমাদের মিলিত সংগ্রাম: মৌলানা ভাসানীর নাম, আবদুল গাফফার চৌধুরী]

[১৯৫৪ সালের] নির্বাচনের আগে এ কে ফজলুল হক, ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে একটি বহুদলীয় যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এই যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগের পতন ঘটায় শোচনীয়ভাবে। প্রদেশে ফজলুল হকের নেতৃত্বে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টের বিজয় মেনে নিতে পারেনি। ষড়যন্ত্র করে নির্বাচিত সরকার বাতিল করে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন জারি করে। অনেক নেতা কারারুদ্ধ হন। তার আগেই ভাসানী বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে ইউরোপ গিয়ে আটকে পড়েন। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে তার দেশে ফেরার পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়। ১৯৫৪-র আট মাস ইউরোপে এবং ’৫৫-র পাঁচ মাস কলকাতায় নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয় তাঁকে এবং এই সময় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার একের পর এক ষড়যন্ত্র করে পূর্ববাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক অধিকার হরণের আয়োজন সম্পন্ন করে। বাঙালি নেতাদের মধ্যেও ছিলো বিভেদ-বিভ্রান্তি, তাঁদের কাছে দেশের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তির স্বার্থ বড় হয়ে দেখা দেয়। অনেকে আত্মসমর্পণ অথবা সহযোগিতা করেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের কাছে। বারবার পূর্ব পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তিত হতে থাকে।

… এর মধ্যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে মহাচক্রান্তকারী প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার অধীনে সোহরাওয়ার্দী … প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১২ সেপ্টেম্বর ’৫৬ ক্ষমতাসীন হন সোহরাওয়ার্দী। ১১ অক্টোবর ’৫৭ পর্যন্ত এগার মাস সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। … প্রধানমন্ত্রী হয়েই সোহরাওয়ার্দী তাঁর দলের নীতি ও পূর্ববাংলার জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উপেক্ষা করেন এবং দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। যে জন্য অবিলম্বে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কের অবনতি ঘটে। প্রধানমন্ত্রীরূপে ঢাকার পল্টন ময়দানে প্রথম জনসভায় তিনি তাঁর পূর্ববর্তী পাকিস্তান সরকার প্রধানদের মতোই পশ্চিমপন্থী নীতির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ভাসানী তৎক্ষণাৎ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। নভেম্বর ’৫৬ সালে সুয়েজখালে ঈঙ্গ-ফরাসি ও ইসরাইলি অবরোধের প্রতিবাদে ভাসানী ঢাকায় এক বিক্ষোভ ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেন। ভাসানী কর্তৃক দাবি উত্থাপিত হয় পাকিস্তানকে কমনওয়েলথ এবং যুদ্ধজোট সিয়াটো ও বাগদাদ প্যাক্ট থেকে বেরিয়ে আসতে।৬ পাকিস্তানের সা¤্রাজ্যবাদঘেঁষা বৈদেশিক নীতির সমালোচনায় ভাসানী ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করেন। কিন্তু তাঁর নীতির বিরোধিতা আসে তাঁর দলেরই নেতাদের কাছ থেকেই। 

ভাসানীকে কেন্দ্র করে দক্ষিণপন্থী পেটিবুর্জোয়াদের থেকে শুরু করে বামপন্থী এমনকি কমিউনিস্টদের সমন্বয়ে একটি বড় মঞ্চ হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। ভাসানী হয়ে ওঠেন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রধান মুখপাত্র। মুদ্রা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি ছাড়া সকল বিষয় পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে তিনি ’৪৯ সাল থেকেই অব্যাহত চাপ দিতে থাকেন। ১৯৫৬ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের চারিত্র ছিলো সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী। ১৯৫৭ থেকে এই দলের নেতাদের একটি অংশ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পশ্চিমী সা¤্রাজ্যবাদের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তখন দল থেকে পদত্যাগ করে ভাসানী তাঁর বামপন্থী ও প্রগতিশীল সহকর্মীদের নিয়ে গঠন করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, সংক্ষেপে ন্যাপ। এ দলেরও তিনি প্রধান হন এবং তাঁর সঙ্গে থাকেন খান আবদুল গাফফার খান, জি.এস. সৈয়দ, মিয়া ইফতেখার উদ্দিন, আবদুস সামাদ আচকজাই, মাহমুদুল হক উসমানী, মাহমুদ আলী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, হাজি দানেশ প্রমুখ।

ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন  

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হলেও পাঞ্জাবিরা ও তাদের এদেশীয় সহযোগীদের ষড়যন্ত্র শেষ হলো না। তাঁরা শুরু করলো বাংলা ভাষাকে ‘মুসলমানি’ করার ষড়যন্ত্র, কখনো-বা আরবি হরফে বাংলা লেখার চক্রান্ত। সেটাও যখন সম্ভব হচ্ছিলো না তখন উপযুক্ত বাংলা শব্দের পরিবর্তে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করার চেষ্টা: যেমন রেডিও পাকিস্তানে ও পাকিস্তানপন্থী পত্র-পত্রিকায় ‘মন্ত্রী’, ‘মুখ্যমন্ত্রী’, ‘প্রধানমন্ত্রী’র পরিবর্তে ‘উজির’, ‘উজির আলা’, ‘উজিরে আজম’ লিখতো। শব্দগুলো শুধু যে বিজাতীয় তাই নয়, এতো সেকেলে যে মনে হয় রূপকথার দেশের ভাষা।

পাকিস্তানিদের মনোবৃত্তি অজ্ঞাত ছিলো না বাঙালি প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের। তাঁরাও নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষাকে স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামের অংশ রূপে গ্রহণ করেন। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি যতোই পাকিস্তানিদের সন্দেহ ও ষড়যন্ত্র তীব্র হচ্ছিলো ততোই এ দেশের প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক কর্মীগণ তাকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন। বাঙালি সংস্কৃতি-ভাষা-শিল্প-সাহিত্য নিয়ে ঔপনিবেশিক শাসক ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মী ও সংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে দ্ব›দ্ব স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত চলতে থাকে। পাকিস্তানিরা বাংলা সংস্কৃতি ও বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রতি এদেশের রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে বরং বেশিই ক্রুদ্ধ ছিলেন তার প্রমাণ মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংস্কৃতিসেবী ও বুদ্ধিজীবীদের তারা বাড়ি বাড়ি খুঁজে বের করে হত্যা করেছে, তুলনায় রাজনীতিকরা, সম্ভবত অতি সাবধানে থাকার কারণেই, নিহত হয়েছেন সামান্য।

মওলানা ভাসানীই ছিলেন পূর্ববাংলার একমাত্র নেতা যিনি সংস্কৃতিকে তাঁর রাজনীতি থেকে আলাদা করে দেখেননি। আমৃত্যু তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির জন্য ভেবেছেন এবং সাধ্যমতো কাজ করেছেন। সেই আসাম-যুগ থেকেই তিনি তাঁর রাজনৈতিক সভাসমাবেশ ও কৃষক-সম্মেলনগুলোর সঙ্গে অনিবার্যভাবে যুক্ত রাখতেন নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এমনকি তাঁর আয়োজিত ধর্মীয় সভাগুলোতেও অনেকসময় সঙ্গীতানুষ্ঠানের ব্যবস্থা রাখতেন। সারা জীবন তিনি তাঁর জনসভাগুলোয় ভাষণ দেবার জন্যে প্রায়ই আমন্ত্রণ জানাতেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো যেমন উচ্চশিক্ষিত নাগরিক সংস্কৃতিসেবী ও বুদ্ধিজীবীদের, তেমনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ শিল্পীদের।

দীর্ঘজীবনে ভাসানী অসংখ্য সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, কিন্তু তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি, এদেশের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, ১৯৫৭-র ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ‘পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন’ যা ‘কাগমারী সম্মেলন’ নামে পরিচিত। এটি পূর্ববাংলার সর্বকালের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই শুধু নয়, এদেশের জাতীয় রাজনীতিতে এর তাৎপর্য অনাগত কালের গবেষকদের কাছে স্বীকৃত হবে। আবু জাফর শামসুদ্দিন কাগমারী সম্মেলন সম্পর্কে এক বিশ্লেষণে লিখেছেন:

“… পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের সভাপতিরূপে মওলানা ভাসানী সাহেব সম্মেলন আহ্বান করেননি। মওলানা সাহেবের উদ্যোগ এবং নির্দেশেই সম্মেলন আহ্বান করা হয় বটে, কিন্তু তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানরূপে নয়। … মওলানা ভাসানীও সম্মেলনের সঙ্গে আওয়ামী লীগকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত করেননি। তথাপি সম্পূর্ণরূপে বেসরকারি উদ্যোগে আয়োজিত এবং অনুষ্ঠিত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক-কাম-রাজনৈতিক সম্মেলনের রূপ পরিগ্রহ করে। … কাগমারীতে প্যান্ডেল নির্মাণ, অস্থায়ী বাসস্থান এবং কর্মী ও মেহমানদের জন্য আহার্যের ব্যবস্থা প্রভৃতি কার্য মওলানা সাহেবের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে অসংখ্য কর্মীর দিবারাত্র পরিশ্রমে নিষ্পন্ন হয়েছিলো। টাঙ্গাইল শহর হতে কাগমারী পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মাইল দীর্ঘ রাস্তা অসংখ্য তোরণে সজ্জিত হয়েছিলো। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামকারী অবিভক্ত ভারতের প্রধার প্রধান সৈনিক ও নেতাদের নামে তোরণ উঠেছিলো। যতদূর মনে পড়ছে তার মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, মওলানা মোহাম্মদ আলী, সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল প্রমুখের নামবহনকারী তোরণও ছিলো। ১৯১৯-২১ এবং ১৯৩০-৩২ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাদের প্রতি মওলানা ভাসানী বিশেষ শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করতেন। …” (আবু জাফর শামসুদ্দিন, কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন ১৯৫৭। স্মৃতিচারণ, দৈনিক সংবাদ, ৭ ফেব্রæয়ারি, ১৯৮২; ভাসানী, পৃ. ১৭৫)

… কমিউনিস্ট নেতা নূরুল হক চৌধুরী (কমরেড মেহেদী) তাঁর এক স্মৃতিচারণে বলেছেন: “আমি ডেলিগেট হিসেবে সম্মেলনে যোগদান করেছিলাম। টাঙ্গাইলে ঢুকেই দেখি হজরত মোহাম্মদ তোরণ, তারপর তোরণ আর তোরণ। গান্ধী তোরণ, মওলানা মোহাম্মদ আলী তোরণ, নজরুল তোরণ, ইকবাল তোরণ, নেতাজী সুভাষ বসু তোরণ, হাজী শরিয়ত তোরণ, তিতুমীর তোরণ, নেহেরু তোরণ, হাজী মোহাম্মদ মোহসীন তোরণ, সি. আর. দাস তোরণ, লেনিন তোরণ, স্ট্যালিন তোরণ, মাও সে-তুঙ তোরণ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বায়রণ, শেলী, হালী, রুমি, ইমাম আবু হানিফা, গাজ্জালী তোরণ, টাঙ্গাইল থেকে সন্তোষ পর্যন্ত মোট ৫১টি তোরণ। সর্বশেষ আর সর্বপ্রথম তোরণ ছিল কায়েদ-ই আযম তোরণ। সন্তোষে পৌঁছে দেখি এলাহী কান্ড। … সন্তোষে কয়েক লক্ষ লোকের সমাগম হয়েছিলো এবং সম্মেলন চলছিল ৬ দিন[সাংস্কৃতিক ও আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনসহ]।”… (নূরুল হক চৌধুরী, শতাব্দীর উজ্জ্বল সূর্যের আকর্ষণে, প্রাচ্যবার্তা, মওলানা ভাসানী স্মরণিকা সংখ্যা ১৯৭৭; ভাসানী, পৃ. ১৭৫) 

… এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য বিদেশি অসরকারি প্রতিনিধিদের শুধু নয়, ভাসানী আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রনায়কদের। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের, চীনের একজন উপপ্রধানমন্ত্রী (নামটি জানা যায়নি), ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ সুকার্ণো অথবা তাঁর কোনো প্রতিনিধি, পশ্চিবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় এবং ব্রিটিশ বিরোধী দলের নেতা। নেহেরু, বিধান রায় ও নাসের চিঠি দিয়ে সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে মওলানাকে ব্যক্তিগত চিঠি দিয়েছিলেন, …। পূর্ব বাংলা, পশ্চিম পাকিস্তান এবং পশ্চিবঙ্গের বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী এই সাংস্কৃতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দেশ-বিদেশের সংখ্যাহীন ব্যক্তি। সময়ের স্বল্পতার কারণে অনেক দেশের আমন্ত্রিতরা এতে যোগদান করতে পারেননি। সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনের সরকারের সঙ্গে মওলানা ভাসানীর বিশেষ ভালো সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এই দুই দেশের কোনো কবি-সাহিত্যিক এই সম্মেলনে যোগদান করতে পারেননি। সে জন্য তাঁরা অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন এবং সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে পাঠিয়েছিলেন বাণী অথবা মওলানার কাছে ব্যক্তিগত পত্র।

… ৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল তিনটেয় সম্মেলনের মূল সভাপতি ড. কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান শুরু হয়। খোলা মাঠের মধ্যে অনুষ্ঠান। তিন দিকে লক্ষ লক্ষ শ্রোতা। … অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান মওলানা ভাসানী লক্ষ লক্ষ জনতার উদ্দেশে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। আবু জাফর শামসুদ্দিন লিখেছেন: “বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির উদ্দেশে তাঁর সুবিখ্যাত ‘সালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন। ঐ সালামু আলাইকুম তাৎপর্য উপস্থিত শ্রোতা এবং যাঁদের উদ্দেশে উচ্চারিত হয়েছিলো তাঁরা উভয় পক্ষই উপলব্ধি করেছিলেন। আমার ক্ষুদ্র মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম স্পষ্ট দাবি এবং তজ্জন্য প্রয়োজনীয় সংগ্রাম ও ত্যাগের সংকল্প ঐ ‘সালামু আলাইকুম’ ধ্বনিত হয়েছিলো।” [সূত্র: দৈনিক সংবাদ, ৭ ফেব্রæয়ারি ১৯৮২]

… সম্মেলনে স্বাগত ভাষণে ভাসানী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দু’ধরনের বক্তব্যই রাখেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে যে-সকল দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে সেগুলোতে জনসাধারণের দীর্ঘ ঔপনিবেশিকতাবিরোধী এতিহ্য রয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজ সকল উন্নয়নকামী দেশের উচিত পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা। এবং এই ঘনিষ্ঠতা অর্জনে সে-সব দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। … আজ পৃথিবীর নানা দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে যে ভুল বুঝাবুঝি বিরাজ করছে তা দূর করতে পারেন শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীগণ। তিনি উল্লেখ করেন বার্ট্রান্ড রাসেল, পাবলো নেরুদা, ম্যাক্সিম গোর্কীর মতো প্রগতিশীল, শান্তিবাদী ও মানুষের কল্যাণকামী লেখকদের কথা। উপমহাদেশের হিন্দুমুসলমান সাম্প্রদায়িক সমস্যার ওপর তিনি দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। … এই অঞ্চলের উন্নয়নের স্বার্থে তিনি ভারত-পাকিস্তান বন্ধুত্ব — দুই দেশের জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। 

….৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি তিনটি বড় অধিবেশন হয়। বিদেশীদের মধ্যে অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন মিশর থেকে ড. হাসান হাবাসী (অন ইবন হাজার আল আসকালানী), কানাডা থেকে ড. চার্লস্ ডে. এডামস (অন ইকবাল), ব্রিটেন থেকে ড. এফ. এইচ কওসন (অন দ্য কালচারাল লাইফ অফ গ্রেট ব্রিটেন), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিট গার্থ (অন দ্য কালচারাল লাইফ অব ইউ.এস.এ), জনৈক জাপানি প্রতিনিধি (অন দ্য কালচারাল লাইফ অব জাপান), হুমায়ুন কবীর (ভারতের সাংস্কৃতিক জীবন), এবং ভারত থেকে অন্যান্যের মধ্যে আলোচনা করেন কাজী আবদুল ওদুদ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, প্রবোধকুমার সান্যাল, রাধারাণী দেবী এবং মিসেস সোফিয়া ওয়াদিয়া।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যাঁরা প্রবন্ধ পড়েছিলেন অথবা বক্তৃতা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুস্ত একাডেমীর চেয়ারম্যান মওলানা আবদুল কাদের (অন পুস্ত লিটারেচার) এবং মাদাম আজুরী (অন আর্ট অব ডান্স)। অনুষ্ঠানে অংশ নেননি কিন্তু উপস্থিত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের আরো অনেকেই।

পূর্ববাংলার বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সকলেই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, যেমন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (পাকিস্তানের ভাষা), ড. কুদরাত-ই-খুদা (পূর্ব পাকিস্তানের রাসায়নিক শিল্পের ভবিষ্যৎ উন্নতি), ড. মুহাম্মদ এনামুল হক (বাংলা সাহিত্যে মুসলিম প্রভাব), ড. মাহমুদ হোসেন (অন দ্য কনসেপ্ট অব ইসলামিক কালচার), ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব (পূর্ব পাকিস্তানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব), ড. আখলাকুর রহমান (থটস্ অন দ্য ফাইনানশিয়াল অ্যাসপেকট অব দ্য ডেভেলাপমেন্ট অব এগ্রিকালচার ইন পাকিস্তান), শওকত ওসমান (আধুনিক বাংলা সাহিত্য), ড. মুহাম্মদ ওসমান গনি (বিকল্প খাদ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা ও পন্থা), জনশিক্ষা পরিচালক আবদুল হাকিম (পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা), অধ্যক্ষ ওসমান গনি (পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যমে), ড. নুরুল ইসলাম (পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন), বি. এম. আব্বাস (সেচ ব্যবস্থা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ), ড. শামসুদ্দিন আহমদ (অন হার্ট ডিজিজ), ডা. এম. এন. নন্দী (পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে মেডিকেল এসোসিয়েশনের ভূমিকা), মিসেস কুলসুম হুদা (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ) প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. এ. বি. হালিম এবং বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদও সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তা ছাড়া তৎকালীন বাংলাদেশের সকল বয়সের প্রায় সকল প্রগতিবাদী সাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ এবং সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। বহু বিদেশি সাংবাদিকও গিয়েছিলেন।[পৃষ্ঠা: ১৯০-৯১]”

একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায়: “প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন … রমেশ শীল, তসের আলী, মোসলেম, রাম সিং, মজিদ মিয়া, সুখেন্দু চক্রবর্তী, আব্বাস উদ্দিন, বেদারুদ্দিন, সোহরাব হোসেন প্রমুখ ছাড়াও ঢাকা রেডিওর শিল্পীবৃন্দ; চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকা, রংপুর, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলার নানা স্থান হতে আগত শিল্পীর দল; লালন শাহ দল, পশ্চিম পাকিস্তানি লোকনৃত্য দল, মাদাম আজুরী ও তাঁর দল, এবং বহু একক শিল্পী ও গায়ক-গায়িকা। তা ছাড়া নানারকম কুটিরশিল্পজাত পণ্যদ্রব্যের একটি সুন্দর প্রদর্শনীও খোলা হয়েছিলো।” (ভাসানী, পৃ. ১৭৯)

কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলো সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে এটি হয়ে থাকলো একটি মাইলফলক — বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় ঘটনা। 

৬০-এর দশকের রাজনীতিতে ভাসানী

রাজনৈতিক নেতাদের অনৈক্যের কারণে ধীরে ধীরে পাকিস্তানে সামরিক শাসনের পথ তৈরি হয়। ১৯৫৯-এর প্রথম দিকে দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ এক পাঁচ-দফা চুক্তির ভিত্তিতে পুনরায় মৈত্রী গড়ে তোলে। পাকিস্তানিদের ধারণা হয় – নির্বাচনের আগে যদি এই দুই জনপ্রিয় দল ঐক্যবদ্ধ থাকে তবে মুসলিম লীগের পরাজয় অনিবার্য এবং পাকিস্তানের নেতৃত্ব বাঙালিদের হাতে চলে আসবে। তাই অতি দ্রুত সামরিক শাসন জারির ষড়যন্ত্র করা হয়। ৭ অক্টোবর ’৫৮ দিনগত রাতে মির্জা-আইয়ুব দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। … ১২ অক্টোবর ’৫৮ ভাসানীকে গ্রেফতার করা হয়। আরো বহু নেতা কারারুদ্ধ হন। মির্জাও রেহাই পেলেন না। ২৭ অক্টোবর ’৫৮ তাঁকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে আইয়ুব পূর্ণ ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন, কারণ সেনাবাহিনী তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিলো। … 

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন দুটি সমান্তরাল ধারায় বিভক্ত ছিলো: একটি সাম্র জ্যবাদ-পুঁজিবাদবিরোধী স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যা সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করে তার নেতৃত্ব দেন মওলানা ভাসানী। অপরটি সাম্র জ্যবাদের আশীর্বাদ নিয়ে বিশেষ করে মার্কিন সাম্র জ্যবাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে পুঁজিবাদের স্বার্থ রক্ষাকারী স্বায়ত্তশাসনের ধারা। ’৬৬ সাল থেকে এই ধারাই বাঙালি উঠতি পুঁজিপতিদের সমর্থনে ব্যাপক আকার ধারণ করে। ছয়-দফাপন্থী আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তিশালী মুখপাত্রে পরিণত হয়। …

… কোনো জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের যে অধিকার তা অর্থনৈতিক শোষণমুক্তির সংগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র কিছু নয় — সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা না বলে শুধু জাতীয়তাবাদের শ্লোগানে জাতির ও জনগণের মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়, তা ভাসানী পঞ্চাশের দশক থেকেই অব্যাহত বলে এসেছেন। পরবর্তীতে তাঁর কথার যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে। …

আইয়ুব বছর চারেক সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী সামরিক আইনে দেশ শাসন করে ’৬০-এর দশকে যে পরোক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন, যার নাম দেন তিনি ‘মৌলিক গণতন্ত্র’, তা কোনো অর্থেই গণতন্ত্র ছিলো না। ক্ষমতায় আসার বছর তিনেকের মধ্যে তিনি তাঁর ক্ষমতার ভিত্তি শক্ত করে ফেলেন। এই সময় ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীসহ বহু রাজনৈতিক নেতা ছিলেন কারাগারে। তারপর ১৯৬২ থেকে ছাত্ররা আইয়ুবের শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র করে যে-সরকার বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেন তা পরবর্তী বছরগুলোয় ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-রাজনীতিকদের দ্বারা আরো গতিশীল হয়। অপর দিকে আইয়ুবশাহীও জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাতে থাকে নির্মমভাবে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারগুলো ভরে যায় প্রগতিশীল ছাত্র-শ্রমিক কৃষক ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা। … একমাত্র পাঞ্জাব ছাড়া তৎকালীন পাকিস্তানের সকল অঞ্চলের জনগণের পাঞ্জাবিদের প্রতি ঘৃণা ছিলো সীমাহীন। কিন্তু আইয়ুব ছিলেন পাঠান – একটি অনগ্রসর এলাকার অধিবাসী। তাই প্রথম দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের অনুন্নত অঞ্চলগুলোর মানুষ তাঁর সম্পর্কে কিছুটা শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করতো। নানা কৌশলে প্রথমদিকে পূর্ব পাকিস্তানেও তিনি কিছুটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এই জন্যে যে, জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করলেও, রাজনৈতিক নেতাদের অন্তরীণ করে রাখলেও, ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকনেতাদের হয়রানি করলেও, তাঁর সময়ই এক ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ হতে থাকে। বৈদেশিক ঋণের সাহায্য দ্বারা হলেও সমাজের উপরিকাঠামোর কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়, যে-ধরনের ‘উন্নয়ন’ স্বাধীনতাপরবর্তী একযুগে মানুষ লক্ষ্য করেনি। তাঁর সময় সামরিক খাতে ব্যাপক ব্যয় করা সত্তে¡ও অর্থনীতিতে কিছুটা চাঙ্গাভাব বিদ্যমান ছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন ছিলো একেবারেই দৃষ্টিগ্রাহ্য, পূর্ব বাংলায় ততোটা নয়, তবু নানা কারণে পাকিস্তানের দুই অংশের ভেতরকার বৈষম্য বাড়তে থাকে। সে-জন্য বাংলাদেশে অসন্তোষও বাড়তেই থাকে।

১৯৬৩-র মার্চে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন বসে তাতে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে অতি উত্তপ্ত আলোচনা হয়। বৈদেশিক সাহায্য, চাকরি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে শুধু পরিষদের মধ্যে নয়, বাইরেও ছাত্র-যুবক-জনতা প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। উদাহরণস্বরূপ : ১২ মার্চ জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যরা বলেন: সরকারি চাকরিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের হার যথাক্রমে ১২০ : ৬৭০।১০ ২১ মার্চ ’৬৩ পরিষদে বিরোধী দলের উপনেতা ন্যাপের মশিউর রহমান আইয়ুবকে ‘ডিক্টেটর’১১ বলে অভিহিত করে সমালোচনা করেন।

অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা এমন হলেও বৈদেশিক ক্ষেত্রে আইয়ুব সরকারের কিছু কিছু পদক্ষেপ ছিলো সে-সময়ে উল্লেখযোগ্য: সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন। ১৯৬৩-র মার্চে পাক-চীন সীমান্ত চুক্তিসহ দুই দেশের মধ্যে নানা অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিশ্বের দুই প্রধান সমাজতন্ত্রী দেশ রাশিয়া ও চীনের নেতা ও কর্মকর্তারা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন, আইয়ুবও এই দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেন। … এশিয়ায় আমেরিকার ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারের প্রেক্ষিতে ভাসানী চাইতেন পাকিস্তানের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও ভারতের এবং এই চার দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপিত হোক। পাক-চীন সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ ব্যাপারে তিনি আইয়ুব সরকার কর্তৃক ব্যবহৃতও হন। নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তিনি ব্যবহৃত হননি, দেশের স্বার্থেই তিনি যা ভালো মনে করেছেন তাই করেছেন।

১৯৬৪-৬৫ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আইয়ুবের সম্পর্কের সামান্য অবনতি ঘটে, পক্ষান্তরে পিকিং ও মস্কোর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো হয়। ’৬৫-র এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই পাকিস্তানে সরকারি সফরে আসেন। কয়েকদিন পরেই আইয়ুব যান মস্কো। পক্ষান্তরে আইয়ুবের পূর্ব নির্ধারিত যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করা হয়। কারণ আইয়ুব সরকার ভিয়েৎনামে মার্কিন হামলার নিন্দা করেন। আইয়ুবের এই মার্কিনবিরোধিতার মৃদু সাহসকে ভাসানী প্রশংসা করেন এবং বলেন : ‘ভিয়েৎনামের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন দেবে এমন যে-কোনো সরকারের বৈদেশিক-নীতির তিনি সমর্থন দেবেন। আইয়ুব যদি তাঁর এই নীতি অব্যাহত রাখেন তা হলে তাঁকেও সমর্থন দিতে তিনি প্রস্তুত।’১২ ভাসানীর মতো নেতার মুখ থেকে এ ধরনের কথা উচ্চারিত হওয়ায় আইয়ুবের উপকার হয়, পক্ষান্তরে ভাসানী হন দেশের মধ্যে তাঁর প্রতিপক্ষের দ্বারা কঠোর সমালোচিত।

এরমধ্যে আইয়ুব যখন সমাজতন্ত্রী শিবিরের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকেছিলেন তখন তাঁকে শাস্তি দেবার জন্য পাক-ভারত যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়া হয় সেপ্টেম্বর ’৬৫তে। এই যুদ্ধের জন্য ভাসানী যতো না ভারতকে নিন্দা করেছেন তার চেয়ে বেশি করেছেন মার্কিন সরকারকে। কারণ তাঁর এবং আরো অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, এই যুদ্ধের মূলে ছিলো মার্কিন সরকার। বার্ট্রান্ড রাসেলসহ পশ্চিমী বুদ্ধিজীবীরাও তাই মনে করতেন।

কিন্তু যুদ্ধের সংকট কাটিয়ে উঠতেই সমাজতন্ত্রী দেশগুলোর প্রতি আইয়ুবের ভালোবাসার ছদ্মবেশ খুলে যায় এবং তাঁর মার্কিনপন্থী চেহারা পুনরায় প্রকাশ্য আকার ধারণ করে। ডিসেম্বরে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। তখন আমেরিকান নেতারা তাঁর খুব প্রশংসা করেন। আইয়ুব যে বিশ্বাসঘাতক এবং মার্কিনের একান্ত দালাল তা অবগত হওয়া মাত্র ১৯৬৫-র ডিসেম্বর থেকে ভাসানী তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার উপায় খুঁজতে থাকেন।

ভাসানীর প্রতিপক্ষরা তাঁর সংগ্রামী চরিত্রকে হনন অথবা জখম করার জন্য যে অস্ত্রটি মধ্য ৬০ থেকে বহুদিন ব্যবহার করে এসেছেন এবং আজো করেন সেটি হলো : আইয়ুবের প্রতি তিনি নমনীয় ছিলেন, যখন তাঁর বিরুদ্ধে দেশে ছিলো গণ-অসন্তোষ। ভাসানী নাকি বলেছেন : উড়হ’ঃ ফরংঃঁৎন অুঁন। ভাসানী যে আইয়ুব সরকারের বৈদেশিক নীতির প্রতি কিছুকাল নমনীয় ছিলেন এতে কোনোই সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর অভ্যন্তরীণ অগণতান্ত্রিক নীতির তিনি ছিলেন কঠোর সমালোচক। উড়হ’ঃ ফরংঃঁৎন অুঁন কথাটি তিনি কখন কোথায় কার কাছে বলেছিলেন এবং তা কোন্ পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়েছিলো তা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবু তাঁকে ‘আইয়ুবের দালাল’ বলে গালিগালাজ করা হয়েছে। তিনি তাঁর সমালোচকদের কথায় কখনোই বিচলিত হতেন না। 

… ভাসানী আইয়ুবের পররাষ্ট্র নীতিকে কিছুদিন সমর্থন দিয়েছেন … তবে আইয়ুবের অভ্যন্তরীণ একনায়কত্ববাদী নীতির তিনি অনবরতই সমালোচনা ও নিন্দা করেছেন। আইয়ুবের আমলে ন্যাপের বিপুলসংখ্যক কর্মী ও নেতা কারা নির্যাতনও ভোগ করেন। (পৃ-২৬৪) … ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইয়ুবের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর সম্মিলিত মোর্চার প্রার্থী হন ফাতেমা জিন্নাহ … বিশেষ করে পূর্ব বাংলায় মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের তৎপরতা ছিল সবচেয়ে বেশি; সারাদেশে সংখ্যাহীন সভা-সমাবেশে তাঁরা ভাষণ দিতে থাকেন। (পৃ-২৭২)

১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান আক্রান্ত হলেও পূর্ব পাকিস্তানও তাতে মানসিকভাবে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। (পৃষ্ঠা-২৮১) … ১৯৬৬ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান প্রকাশ করেন ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬-দফা কর্মসূচি।’(পৃ-২৮৮) … কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এটি প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয় এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। … ‘ছয় দফায় পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা নাই এবং কৃষক-শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষের অধিকারের কোনো স্বীকৃতি নাই’ বলে ভাসানী ছয় দফা-কে সমালোচনা করেন। অবশ্য স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে ছয় দফা গতিবেগ সঞ্চার করায় তিনি আর পরে এটির সমালোচনা করেননি। … আড়াই মাসের মধ্যে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতার হন। তাদের মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগ ৭ জুন দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। ওইদিন পুলিশের গুলিতে ১৩জন নিহত হন। তাতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অসামান্য বেড়ে যায়।(পৃ-২৮৪)  … ভাসানী ৭ জুনের সরকারি বর্বরতায় নিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। (পৃ-২৯১) … ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে কারাবন্দী শেখ মুজিবসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ শুরু হলে ভাসানী … স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে একটি গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট গঠনের জন্য তিনি আহ্বান জানান। (পৃ-৩০৯) 

(চলবে – আগামী সংখ্যায় পরবর্তী অংশ প্রকাশিত হবে।)

সাম্যবাদ আগষ্ট ২০১৯

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments