বছরের শুরুতেই রক্তে রঞ্জিত হলো রাজপথ। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ‘সকালের সূর্য দেখেই নাকি বলা যায় সারাদিন কেমন যাবে।’ তেমনি আওয়ামী লীগ সরকার আবার ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’ বা ভোট ডাকাতির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর আগামী দিনগুলো এদেশের মানুষের কেমন যাবে তারই পূর্বাভাস হলো এই ঘটনা। নতুন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পরপরই একদিকে গার্মেন্টস মালিকদের রপ্তানিতে উৎসে কর দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করা হলো। অন্যদিকে ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকের উপর গুলিতে শ্রমিক হত্যা হলো। এই দুই ঘটনা এই বার্তাই দিয়ে গেলো, সরকার কার পক্ষে — মালিক না শ্রমিকের?
গত ৮ জানুয়ারি সাভারে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে সুমন মিয়া নামে এক গার্মেন্টস শ্রমিক নিহত হয়েছে। শুধু সাভার আশুলিয়া নয়, এই বিক্ষোভ ছড়িয়েছে গাজীপুর, উত্তরা, মিরপুর ও নারায়ণগঞ্জের প্রায় সমস্ত কারখানাতেই। সরকার শ্রমিকের দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে পুলিশ-বিজিবি লেলিয়ে দিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করছে। শত শত শ্রমিক ইতোমধ্যে আহত হয়েছে। আর মালিক পক্ষ বরাবরের মতোই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ নিয়ে ব্যস্ত। আর ষড়যন্ত্র যদি হয়ই তা করছেন মালিকরাই। ন্যায্য আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার ষড়যন্ত্র করছেন। হামলা-মামলা, দমন-পীড়ন, জীবনের নিরাপত্তাহীনতায়ও পুলিশের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কেন আজ শ্রমিকরা রাস্তায়?
ঘটনার সূত্রপাত নতুন মজুরি কাঠামোর পর থেকে। গত ২৫ নভেম্বর পোশাকশিল্পের জন্য নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করে শ্রম মন্ত্রণালয়। তাতে সর্বনিম্ন সপ্তম গ্রেডে নতুন শ্রমিক বা হেলপারের মোট মজুরি ২ হাজার ৭০০ টাকা বাড়লেও দক্ষ শ্রমিক বা অপারেটরদের বেতন বাড়েনি। বা দু’একটি গ্রেডে যৎসামান্য বাড়লেও ক্ষেত্রবিশেষে মূল মজুরি কমেছেও। ২০১৩ সালের মজুরিকাঠামোতে তিন নম্বর গ্রেড বা সিনিয়র অপারেটর পদের মূল মজুরি ছিল ৪ হাজার ৭৫ টাকা। প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট হওয়ায় গ্রেডটিতে কর্মরত পুরোনো শ্রমিকের মূল মজুরি বেড়ে চলতি বছর ৫ হাজার ২০৪ টাকা হতো। অথচ নতুন কাঠামোতে এই গ্রেডের মূল মজুরি করা হয়েছে ৫ হাজার ১৬০ টাকা। অর্থাৎ নতুন কাঠামোতে মজুরি কমে গেছে ৪৪ টাকা। একইভাবে চার নম্বর গ্রেড বা অপারেটর পদের মূল মজুরি বেড়েছে মাত্র ৭৯ টাকা ও পাঁচ নম্বর গ্রেডের বেড়েছে মাত্র ১৬৪ টাকা।
দীর্ঘ পাঁচবছর পর নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষিত হলেও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত না হওয়াতেই শ্রমিকদের ক্ষোভের স্ফূরণ ঘটেছে। আন্দোলনের চাপে ১৩ জানুয়ারি পর্যালোচনা কমিটি সমন্বিত মজুরি কাঠামো ঘোষণা করে। ঘোষিত কাঠামোতে দেখা যায়, সংশোধনে যে তিনটি গ্রেড নিয়ে শ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল — সেই ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেডে ডিসেম্বরের গেজেটের তুলনায় বেতন বেড়েছে যথাক্রমে ২০, ১০২ ও ২৫৫ টাকা। এছাড়া ষষ্ঠ গ্রেডে ডিসেম্বরের গেজেটের তুলনায় ১৫ টাকা মাত্র বেতন বেড়েছে। এই বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা শ্রমিকদের সাথে প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়!
শ্রমিকদের মজুরি না বাড়লেও, বাড়ছে মালিকদের রপ্তানি আয়
মজুরি বৃদ্ধির দাবি উঠলেই গার্মেন্টস মালিকরা লোকসানের গল্প ফেঁদে বসেন। প্রকৃত সত্য তার উল্টো। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-র তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) প্রথম চার মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। এই সময়ে আয় হয়েছে প্রায় ১হাজার ৩৬৫ কোটি ডলার। আর সর্বশেষ অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয় প্রায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত বছরের প্রথম ৯ মাসে রপ্তানি বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে ৫.৮৪ শতাংশ। এই রপ্তানি আয় ক্রমবর্ধমান। মালিকদের আয় ক্রমবর্ধমান হলেও শ্রমিকদের জীবনের অবস্থা কী?
কেমন করে বেঁচে আছে শ্রমিকরা
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির উদ্যোগে ‘কী করে বাঁচে শ্রমিক’ নামক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: “৬১ শতাংশ শ্রমিক মনে করেন, তাঁর আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি।…অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা সামাল দেওয়ার জন্য শ্রমিকেরা নিয়মিত ঋণ নেন এবং খাদ্য ও বাসাভাড়া বাবদ ব্যয় কমিয়ে দেন। গড়ে একজন পোশাকশ্রমিক দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের পাশাপাশি মাসে গড়ে ৬০ ঘণ্টা পর্যন্ত ওভারটাইম করেন। ফলে শ্রমিকেরা প্রয়োজনীয় ঘুম ও বিশ্রাম থেকে বঞ্চিত হন…”। এই ঢাকা শহরে জীবনযাপনের খরচ ক্রমাগত বাড়ছে। সাধারণ একটি বাসা ভাড়া নিতে গেলেও গুণতে হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এলাকাভেদে যা আরো বেশিও হয়। যেখানে একজন শ্রমিকের মাসিক আয়ই ৭-৮ হাজার টাকা। ফলে বাধ্য হয়েই শ্রমিকরা ঠাঁই নেয় শহরের বস্তিগুলোতে। অন্ধকার ঘর। দরজা দিয়ে কোনোরকমে প্রবেশ করলেও জানালা নেই — আলো-বাতাসহীন, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, ময়লা- নোংরা আবর্জনা আর দুর্গন্ধময় বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়াই ভার — এই রকম পরিবেশে একজন শ্রমিকের দিন কাটে। দিনের আলো ভালো করে ফোটার আগেই ছুটতে হয় কারখানায়, সন্ধ্যে হলেও ছুটি মেলে না। অন্ধকার ঘনিয়ে আসলে — অন্ধকারে বাড়ি ফেরে ওরা। কখনো জোর করে রাত ১০টা-১২টা পর্যন্ত খাটিয়ে নেয়। কাজের রেট বাড়িয়ে দিয়ে বাড়তি কাজ আদায় করে। অকথ্য গালাগাল-নির্যাতন তো বোনাস। শত অপমান সয়েও শুধু বাঁচার তাগিদে, দু’মুঠো ভাতে জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে তিলে তিলে নিঃশেষ হয় শ্রমিকদের জীবন। বেঁচেবর্তে থাকার এই সরু গলিপথটাও যখন অবরুদ্ধ তখনই শ্রমিকরা জীবনের তাগিদে নেমে এসেছে রাস্তায়। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সম্মিলিতভাবে বাঁচার মতো মজুরি, মনুষ্যোচিত জীবনের জন্য ন্যায্য মজুরির দাবি তুলেছে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই নির্মিত হবে আগামীর পথ।