Wednesday, December 25, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - মার্চ ২০১৮মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস!

মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস!

cvUe9I_1504796722

ভূমিকম্প অনেকটা ঢেউয়ের মতো আঘাত করে। পানিতে যেমন বড় ঢেউ আসার আগে ছোট ছোট ঢেউ আসে, ভূমিকম্পেও তেমনি। প্রথমে কয়েকটি মৃদু ধাক্কা, তারপর বড় ঝাঁকুনি। বাংলাদেশেও মাঝে মাঝে ছোট-বড় ভূমিকম্প আঘাত হানে। অচিরেই এদেশে একটা বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছে। তবে সেটা ভূমিতে নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। এরই মধ্যে কয়েকটি ছোট ছোট ধাক্কা দিয়েছে ব্যাংকিং খাতে। আগামীতে বড় ঝাঁকুনির আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।

বাংলাদেশকে যখন কথিত ‘মধ্যম আয়ের’ দেশের কাতারে তোলার কৃতিত্ব প্রচার করছে বর্তমান আওয়ামী মহাজোট, ঠিক সে সময়েই এই আশঙ্কা। এবং এই সংকট কেন্দ্রীভূত হয়েছে ব্যাংকিং খাতকে ঘিরে। একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে দেউলিয়া অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বেসিক ব্যাংকের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঋণ কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংকের নজরকাড়া অনিয়ম, এনআরবিসি ব্যাংকের দৃশ্যমান অনিয়ম, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক-কান্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিসহ সব কেলেঙ্কারি ব্যাংকিং খাতকে অস্থির করে তুলেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক দখলের ঘটনা। সব মিলে ব্যাংকিং খাতে এত অস্থিরতা দৃশ্যমান হয়নি কখনও।

এক-চতুর্থাংশ ব্যাংক বেহাল দশায়
২০১৭ সাল ছিল ব্যাংক লুটের বছর, ব্যাংক দখলের বছর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-’১৮ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ যোগ করলে এটা ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

দেশে সরকারি-বেসরকারি-বিদেশি মিলে মোট ব্যাংক রয়েছে ৫৭টি। এর মধ্যে ঋণ কেলেঙ্কারিসহ অনিয়ম-দুর্নীতিতে ১৩টি ব্যাংকের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। যার মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ব্যাংকই আটটি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়ালে পরিস্থিতি কয়েক বছর ধরে খারাপ হচ্ছে। এ ছাড়া এক যুগ আগে বিলুপ্ত হওয়া ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের দুর্নীতির বোঝা এখনো টেনে চলেছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এমনকি দুই বছর ধরে এই ১৩ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। বাকি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগের অবস্থাও সন্তোষজনক নয়। ব্যাংকগুলো দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের রিজার্ভ থেকে পাচার হওয়া অর্থই উদ্ধার করতে পারেনি, উপরন্তু ব্যাংকগুলোর নজরদারিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংকের মালিকানা বদল নিয়ে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটলেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে সায় দিয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতের আমানতকারীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।

বেসিক থেকে শুরু
বেসিক শব্দের মানে হল ভিত্তি। সেই ভিত্তি থেকেই কম্পন শুরু হয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে। পরের ঝাঁকুনিটি টের পাওয়া গেল সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চোখের লাভজনক ব্যাংকটি প্রায় দেউলিয়া হতে বসেছে।

২০০৯ সালে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের সময় খেলাপী ঋণ ছিল মাত্র ৬ ভাগ। বাচ্চুর নেতৃত্বে ভূয়া গ্রাহকের নামে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট চলতে থাকে। ফলাফল ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪ শতাংশে, টাকার অংকে প্রায় ৭ হাজার ৪শ কোটি টাকা। ঋণ লুটপাটের ঘটনায় ৫৬টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর কোনোটিতেই আসামি করা হয়নি ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে। গণমাধ্যমের চাপে দায় এড়াতে সম্প্রতি বাচ্চুকে তলব করে দুদক।

এক গ্রাহকেই ডুবেছে জনতা ব্যাংক
সবধরনের নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে এনোনটেক্স নামে সাধারণ কোম্পানিকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী একজন গ্রাহককে ব্যাংকের মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ ঋণ দিতে পারে। সেই হিসেবে ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের নেতৃত্বে অখ্যাত এনোনটেক্স এর ২২ প্রতিষ্ঠানের নামে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয় জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। যা ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন কেলেঙ্কারি। পর্ষদের বেশ কয়েকজন সদস্য ছিলেন যারা সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। কিন্তু এখন পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের তখনকার চেয়ারম্যানসহ কোনো পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দুদক।

ইউনুস বাদলের কোম্পানির নামে বিতরণকৃত ঋণ দেয় জনতা ভবন করপোরেট শাখা। ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুছ সালাম আজাদ সে সময় ভবন শাখার মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন। পরিচালনা পর্ষদে ঋণের প্রস্তাব পাঠানোর কাজটি তিনিই করেছিলেন। ফলে ঋণ আবেদনকারীর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না দেখে অনুমোদনের জন্য পাঠানোয় দায় বর্তায় তার উপরেই। অথচ গুরুত্বর এই অভিযোগের কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বদলে পুরস্কার হিসেবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বানিয়েছে সরকার। ভবিষৎ দুর্নীতির পথ খোলা রাখতেই তাকে এমডি করার অভিযোগ আছে। নামে এনোনটেক্স থাকলেও ঋণ লোপাটের পেছনের সুবিধাভোগী সরকার দলীয় কেউ কেউ বলে কথা শোনা যায়।

সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কান্ড
দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির অভিনব সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বিষয়টি সবারই জানা। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর নাম জানিয়েছে। (প্রথম আলো, ৩১-০৮-২০১২) এছাড়া সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সুভাষ সিংহ রায়, স্বেচ্ছাসেবক লীগের আন্তর্জাতিক-বিষয়ক সম্পাদক সাইমুম সরওয়ার কামাল এবং মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক জান্নাত আরা হেনরি ছিলেন। এছাড়া পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন সাংবাদিক কাশেম হুমায়ুন ও আওয়ামী লীগ নেতা সত্যেন্দ্র চন্দ্র ভক্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ হলো — হলমার্ক গ্রুপের অখ্যাত অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ পাইয়ে দিতে এসব পরিচালক সহায়তা দিয়েছেন। একই সাথে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে ঋণ পেল তা দেখভাল করার ক্ষেত্রে পরিচালনা পরিষদ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নতুন প্রজন্মের ব্যাংক দুর্নীতির অভিনব নজির স্থাপন করেছে
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সরকারি হিসাব-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফারমার্স ব্যাংক। তারা দাবি করেছিলেন, এ হবে নতুন প্রজন্মের ব্যাংক। কিন্তু প্রতিষ্ঠার তিন বছর পার হতে না হতেই ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। আর ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদ ছাড়তে হয়েছে ম. খা. আলমগীরকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী প্রচলিত ধারার কোনো ব্যাংক তার আমানতের ৮৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারে না। তবে সেই নির্দেশনা উপো করে ফারমার্স ব্যাংক ৯৭ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে আমানতকারীদের দায় পরিশোধেরও ক্ষমতা হারিয়েছে ব্যাংকটি।

এখন ডুবন্ত ফারমার্সকে টাকার যোগান দিতে সরকার ও ব্যাংলাদেশ ব্যাংক মিলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে চাপ দিচ্ছে। ইতোমধ্যে, বেসরকারি ব্যাংকটিকে বাঁচাতে সরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়ে সভা করেছে খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আওয়ামী মহাজোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ৯টি ব্যাংকের একটি ফারমার্স ব্যাংক। একই দশা একইভাবে অনুমোদন পাওয়া এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেরও। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ফরাছত আলী।

দখল, অর্থ পাচার ও খেলাপি ঋণের ভার
এদেশের ব্যাংকিং খাতে নতুন উপসর্গ হলো ব্যাংক দখল। বিশেষ ব্যবস্থায় গত বছরের জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংক এবং অক্টোবরে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা দখলে নিয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক এস. আলম গ্রুপ। এর আগে ২০১৬ সালে বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব আবদুল মান্নানের শেয়ার কিনে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় গ্রুপটি। যদিও তাতে ব্যাংকটির উন্নতি হয়নি। বর্তমানে ব্যাংকটির মোট ঋণের ৩৪ শতাংশই খেলাপি। ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ এস. আলম গ্রুপের হাতে যাওয়ার পর ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। আর যে এস. আলম গ্রুপ একের পর এক ব্যাংক দখল করছে সেই গ্রুপটি নিজেরাই বিরাট অংকের খেলাপী ঋণের বোঝা বহন করছে।

ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত জুন (২০১৭) পর্যন্ত হয়েছে ২ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা, যা মোট দেওয়া ঋণের প্রায় ১১ শতাংশ। খেলাপি গ্রাহকদের থেকে ব্যাংক কোনো অর্থ আদায় করতে পারছে না, আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারছে না।

নিয়ন্ত্রণহীন খেলাপি ঋণ
২০১৭ সালের প্রথম দিকে ব্যাংকে ছিল উপচেপড়া তারল্য। ব্যাংকাররা এই অতিরিক্ত টাকা নিয়ে কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না। এক বছরের মাথায় নগদ টাকার সংকটে ব্যাংকিং খাতে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। কোথায় গেল এত টাকা? কাদেরকে দেওয়া হলো এত টাকা, যা আর ফেরত আসছে না? বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ঋণ অবলোপন (আদায়যোগ্য নয় বলে হিসেবে থেকে বাদ দেয়া) করা ৪৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, খেলাপি ঋণের এই নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি পুরো অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করতে পারে।

অনেকে মনে করছেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করছেন। ঋণের অর্থ পাচারও হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগির পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

গত জানুয়ারি মাসে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে প্রায় দুই হাজার ঋণখেলাপির যে তালিকা প্রকাশ করেছেন, তাতে দেখা যায়, ১০ কোটি টাকার উপর ব্যাংকঋণ নিয়ে আর ফেরত দেননি এমন প্রায় দুই হাজার গ্রাহকের মধ্যে ৬০০-এর মতো বস্ত্র ও পোশাক খাতের। বড় অংকের খেলাপি ঋণ রয়েছে, এমন শীর্ষ ১০০ গ্রাহকের মধ্যেও বস্ত্র ও পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদেরই আধিক্য। ঋণখেলাপি শীর্ষ ১০০ গ্রাহকের মধ্যে প্রায় ৪৪ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানই এ খাতের। আর প্রথম ৫০০ ঋণখেলাপি বিবেচনায় নিলে এর মধ্যে বস্ত্র ও পোশাক খাতের গ্রাহক সংখ্যা ১৫৭। (দৈনিক বণিকবার্তা, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮)

সংকটের আশঙ্কা : বাস্তব নাকি অমূলক?
এই যে বড় ধরনের আর্থিক সংকটের আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে — এটা কি বাস্তব নাকি অমূলক আশঙ্কা মাত্র? আমাদের এই আশঙ্কার সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে গত ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন থেকে। এতে বলা হয়েছে, “দেশের ব্যাংক খাতে হঠাৎ করেই ঋণ দেওয়ার মতো অর্থের টান পড়েছে। বেশ কিছু ব্যাংক নতুন করে ব্যবসায়ীদের ঋণ দিচ্ছে না। প্রায় সব ব্যাংকই বাড়িয়েছে সুদের হার। এমনকি কিছু ব্যাংকের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের দেওয়া ঋণের টাকা ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।” প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, “ব্যাংকাররা হঠাৎ এই সংকটের পেছনে কয়েকটি কারণ দেখছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণের সীমা কমিয়ে দেওয়া। এ ছাড়া সুদের হার কম হওয়ায় ব্যাংকে আমানত কমে যাওয়া, ডলার বিক্রি করে ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেওয়া এবং বেসরকারি একটি ব্যাংকের সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারিও পরোভাবে এ সংকটে ঘি ঢেলেছে।”

ব্যাংক লুটের রাজনীতি!
সোনালী ব্যাংকের অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর সে সময় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, বেসিক ব্যাংকে হয়েছে উচ্চপর্যায়ের মাধ্যমে দুর্নীতি। আর সোনালী ব্যাংকে হয়েছে বড় ধরনের ডাকাতি। (দৈনিক প্রথম আলো, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) কিন্তু সেই ডাকাতির বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, অর্থমন্ত্রী কথিত সেই ডাকাতের বিচারের আওতায় আনাও হয়নি। ফারমার্স ব্যাংকের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতারাই ব্যাংকটিকে লুটপাট করে শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠাতাদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? উত্তর হলো – না।

বণিক বার্তা ২০১৭ সালের ২ জুন এক হিসাব তুলে ধরে জানায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ২০০৯-১০ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে ১৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। এরপরও ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৪ হাজার ৭০১ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সাতটি ব্যাংক। এ কথা অত্যন্ত স্পষ্ট যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এই সংকটের কারণ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। এসব ব্যাংকেও বছরের পর বছর পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং তাঁরা ঋণও দিয়েছেন রাজনৈতিক তদবিরে ও প্রভাবে। এসব ব্যাংকের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে উদ্যোক্তা, চেয়ারম্যান, পরিচালনা পরিষদের সদস্য এবং সরকারের নেতা-নেত্রী বা ঘনিষ্ঠজনরা মিলে ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া বানিয়ে চলেছেন।

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এখন কারাবন্দি। এতিমখানার নামে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যক্তিগত একাউন্টে সরিয়ে নেয়ার অভিযোগে সাজা হয়েছে, আর্থিক জরিমানা হয়েছে খালেদা জিয়াসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে। দুর্নীতির বিরদ্ধে মুখে সোচ্চার বর্তমান সরকার অথচ সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম, দুর্নীতি এবং লুটপাটের খবর তুলে ধরছে সংবাদ মাধ্যম।। খুব সঙ্গত কারণেই মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, দুই কোটি টাকার অনিয়মের জন্য যদি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ৫ বছর জেল খাটতে হয় তাহলে হাজার কোটি টাকা অনিয়মের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্তদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না কেন? স্পষ্টতই বিষয়টি রাজনৈতিক, দলীয় স্বার্থ ও ভাগাভাগির বিষয়। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে, তাহলে ব্যাংকিং খাতকে রক্ষা করা তো যাবেই না বরং ব্যাংকিং খাতের আপাত মৃদু ভূমিকম্প ধীরে ধীরে গোটা অর্থনীতিকে আঘাত করবে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এটা অনিবার্য।

সাম্যবাদ মার্চ ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments