Monday, December 23, 2024
Homeফিচারমনীষার আলোকে সাম্প্রদায়িক সমস্যা

মনীষার আলোকে সাম্প্রদায়িক সমস্যা

কাজী নজরুল ইসলাম

“বাংলার মুসলমান ধনে কাঙ্গাল কিনা জানিনে, কিন্তু মনে যে কাঙ্গাল এবং অতিমাত্রা কাঙ্গাল তা আমি অনুভব করে আসছি বহুদিন হতে। আমায় মুসলমান সমাজ ‘কাফের’ খেতাবের যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি।…

হিন্দু লেখক-অলেখক মিলে যে স্নেহে যে নিবিড় ভালোবাসা প্রীতি দিয়ে আমায় এত বড়ো করে তুলেছেন, তাদের সে ঋণকে অস্বীকার যদি আজ করি, তাহলে আমার শরীরে মানুষের রক্ত আছে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। অবশ্য কয়েকজন নোংরা হিন্দু ও ব্রাহ্ম লেখক ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে আমায় কিছুদিন হতে ইতর ভাষায় গালাগালি করছেন এবং কয়েকজন গোঁড়া ‘হিন্দু-সভাওয়ালাআমার নামে মিথ্যা কুৎসা রটনাও করে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু এদের আঙ্গুল দিয়ে গোনা যায়। এঁদের আক্রোশ সম্পূর্ণ সম্প্রদায় বা ব্যক্তিগত।…

যারা দেশের সত্যিকার প্রাণ, সেই তরুণ বন্ধুরা আমায় যে ভালোবাসা, যে প্রীতি দিয়ে অভিনন্দিত করেছেন, তাতে নিন্দার কাঁটা বহু নিচে ঢাকা পড়ে গেছে। ইসলাম ধর্মের সত্য নিয়ে কাব্য রচনা চলতে পারে, কিন্তু তার শাস্ত্র নিয়ে চলবে না। ইসলাম কেন কোন ধর্মেরই শাস্ত্র নিয়ে কাব্য লেখা চলে বলে বিশ্বাস করি না।

হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে যে এ পোড়া দেশের কিছু হবে না, আমিও মানি। এবং আমিও জানি যে, একমাত্র সাহিত্যের ভিতর দিয়েই এ-অশ্রদ্ধা দূর করা যেতে পারে।…

আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের এ-সংস্কারে আঘাত হানার জন্য মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেবদেবীর নাম নিই। অবশ্য এর জন্য অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্যহানি হয়েছে। তবু আমি জেনে শুনেই তা করেছি।”

(হিন্দু-মুসলমান)

“এসো ভাই হিন্দু! এসো মুসলমান! এসো ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সব গণ্ডি কাটাইয়া সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।”

(যুগবাণী)

“মানুষ হয়ে মানুষকে কুকুর বেড়ালের মত এত ঘৃণা করা –মনুষ্যত্বের ও আত্মার অবমাননা করা নয় কি? … যদি সত্যিকারের মিলন আনিতে চাও ভাই, তবে ডাকো — ডাকো, এমনি করিয়া প্রাণের ডাক ডাকো। …

অন্তরের ডাক মহাডাক। … হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু একবার এই মহাগগনতলের সীমাহারা মুক্তির মাঠে দাঁড়াইয়া — মানব! — তোমার কণ্ঠে সেই সৃষ্টির আদিম বাণী ফুটাও দেখি! বলো দেখি, ‘আমার মানুষ ধর্ম!’ দেখিবে, দশদিকে সার্বভৌমিক সাড়ার আকুল স্পন্দন কাঁপিয়া উঠিতেছে। এই উপেক্ষিত জন-সংঘকে বুক দাও দেখি, দেখিবে এই স্নেহের ঈষৎ পরশ পাওয়ার গৌরবে তাহাদের মাঝে ত্যাগের একটা কী বিপুল আকাঙ্ক্ষা জাগে! এই অভিমানীদিগকে বুক দিয়া ভাই বলিয়া পাশে দাঁড় করাতে পারিলেই ভারতে মহাজাতির সৃষ্টি হইবে, নতুবা নয়। মানবতার এই মহা-যুগে একবার গণ্ডি কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বলো যে, তুমি ব্রাহ্মণ নও, শুদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমান নও, তুমি মানুষ — তুমি সত্য।”

(যুগবাণী)

এরা কি মানুষ? এরা আল্লাহর সৃষ্টি কী? হুশ নাই;

ডান হাত দিয়ে বাম হাত কাটে, ভাইকে মারিছে ভাই!

আত্মহত্যা করিছে; বীরের মৃত্যু মরিত যারা

মরণকালেও পাপ করে অভিশাপ নিয়ে যায় তারা।

কোন শয়তানটা টানিছে তাদের এ অভিশাপের পথে?

এরা কি দৈত্য রাক্ষস জ্বীন, এসেছে পাতাল হতে?

নিজ চোখে আজ দেখিতে পায় না আপন অকল্যাণ,

শান্তির নীড় অকারণে করে শ্মশান গোরস্তান!

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

“যে পুরাতন ধর্মতন্ত্র এবং পুরাতন রাষ্ট্রতন্ত্র বহু শতাব্দী ধরে এদের বুদ্ধিকে অভিভূত এবং প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ প্রায় করে দিয়েছে এই সোভিয়েক-বিপ্লবীরা তাদের দু’টোকে দিয়েছে নির্মূল করে। এতো বড় বন্ধনজর্জর জাতিকে অল্পকালে এত বড় মুক্তি দিয়েছে দেখে মন আনন্দিত হয়। কেননা যে ধর্ম মূঢ়তাকে বহন করে মানুষের চিত্তের স্বাধীনতা নষ্ট করে, কোন রাজাও তার চেয়ে আমাদের বড় শত্রু হতে পারে না — সে রাজা বাইরে থেকে প্রজাদের স্বাধীনতাকে যতই নিগড়বদ্ধ করুক না। এ পর্যন্ত দেখা গেছে, যে রাজা প্রজাকে দাস করে রাখতে চেয়েছে সে রাজার সর্বপ্রধান সহায় সে ধর্ম যা মানুষকে অন্ধ করে রাখে। যে ধর্ম বিষকন্যার মত; আলিঙ্গন করে সে মুগ্ধ, মুগ্ধ করে সে মারে। শক্তিশেলের চেয়ে ভক্তিশেল গভীরতর মর্মে গিয়ে প্রবেশ করে, কেননা তার মার আরামের মার।  সোভিয়েতরাও রুশ সম্রাটকৃত অপমান ও আত্মকৃত অপমানের হাত থেকে এই দেশকে বাঁচিয়েছে। অন্য দেশের ধার্মিকতা ওদের যতই নিন্দা করুক আমি তার নিন্দা করতে পারবো না। ধর্ম মোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো। রাশিয়ার বুকের ’পরে ধর্ম ও অত্যাচারী রাজার পাথর চাপা ছিল। দেশের উপর থেকে সেই পাথর নড়ে যাওয়ায় কি প্রকাণ্ড নিষ্কৃতি হয়েছে এখানে এলে সেটা স্বচক্ষে দেখতে পেতে।”

(রাশিয়ার চিঠি)

“আমাদের ভারতবর্ষীয় সঙ্গীত মুসলমানের বটে, হিন্দুরও বটে, তাহাতে উভয় জাতীয় গুণীরই হাত আছে। … চিত্র, স্থাপত্য, বস্ত্রবয়ন, সূচীশিল্প, ধাতুদ্রব্য নির্মাণ, দণ্ডকার্য, নৃত্য, গীত এবং রাজকার্য মুসলমানের আমলে ইহার কোনটাই একমাত্র মুসলমান বা হিন্দুর দ্বারা হয় নাই; উভয়ে পাশাপাশি বসিয়া হইয়াছে। তখন ভারতবর্ষের যে একটি বাহ্যাবরণ নির্মিত হইতেছিল; তাহাতেও হিন্দু ও মুসলমান ভারতবর্ষের ডানহাত ও বামহাত হইয়া টানা ও পোড়েন বুনিতেছিল।”

(‘কোট বা চাপখান’, ভারতী, আশ্বিন, ১৩০৫)

 

বেগম রোকেয়া

ধর্ম একটি ত্রিতল অট্টালিকার ন্যায়। নিচের তলে অনেক কামরা হিন্দু ব্রাহ্মণ শূদ্র ইত্যাদি বিভিন্ন শাখা; মুসলমান — শিয়া, সুন্নি, হানাফী, সাফী প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়, ঐরূপ খৃষ্টান — রোমান ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট ইত্যাদি। তাহার উপরে দ্বীতলে দেখ কেবল মুসলমান — সব মুসলমান হিন্দু — সবই হিন্দু ইত্যাদি। তাহার উপর ত্রিতলে উঠিয়া দেখ একটিমাত্র কক্ষ কামরা বিভাগ নাই অর্থাৎ মুসলমান হিন্দু কিছুই নাই সকলেই একপ্রকার মানুষ।

(পদ্মরাগ)

 

 

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়

মুসলমান ও হিন্দুরা শত শত বছর ধরে পরস্পর ভাই-এর মতো বাস করে আসছে। এদের জীবন চর্চা, স্বার্থ এবং আশা আকাক্সক্ষা পরস্পরের সঙ্গে শত বন্ধনে জড়িত। … এটাও ঘটনা নয় যে, মুসলমানরা এই দেশে বসতি স্থাপন করেছে মাত্র, এই দেশের জন্য কিছু করেনি। বরঞ্চ তার বিপরীত শিল্পে, স্থাপত্যে, সঙ্গীতে, সাহিত্যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় অসামান্য অবদান রেখেছে। বৈচিত্র্যময় ভারতীয় সংস্কৃতির ঠাস বুনোটকে ঐস্লামিক প্রতিভার স্পর্শ করে তুলেছে আরও বর্ণময়। মুসলমানদের পরানো এই উজ্জ্বল পোষাক ছাড়া না জানি সেই সংস্কৃতি কতো দীনহীন মনে হতো।

(আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণ, ১৯২৩)

 

শিবদাস ঘোষ

যতদিন পুঁজিবাদ টিকিয়া থাকিবে ততদিন পর্যন্ত সম্প্রদায়গত, জাতিগত ও বর্ণগত প্রভৃতি জনবিরোধী মনোভাবের উৎপত্তির মূল কারণগুলিও থাকিয়া যাইবে। যখন শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে জনসাধারণ ক্ষমতা করায়ত্ত করিয়া পুঁজিবাদের প্রভাবকে খতম করিবে এবং সমাজতন্ত্রকে সার্থকভাবে গড়িয়া তুলিবার জন্য গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচীগুলি সম্পূর্ণ সমাধা করিবে কেবলমাত্র তখনই জাতিগত, সম্প্রদায়গত এবং বর্ণগত সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হইবে। যাহারা যথার্থ সাম্প্রদায়িক সমস্যা ও তজ্জনিত দাঙ্গার চিরতরে সমাধান চান তাহারা ইতিহাসের এই শিক্ষাকে অবশ্যই স্মরণে রাখিবেন এবং পুঁজিবাদ উচ্ছেদ ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সামিল হইবেন।

(সাম্প্রদায়িক সমস্যা প্রসঙ্গে, শিবদাস ঘোষ, নির্বাচিত রচনাবলি, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ১৮৩)

 

[উৎস: সাম্যবাদ, ৮ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা, নভেম্বর ২০২১]

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments