(দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার উপর হিটলারি নাৎসী বাহিনীর আক্রমণের পর বাংলার শিল্পী-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-বুদ্ধিজীবীরা জনগণের উদ্দেশ্যে এক আবেদনপত্র প্রচার করেন। নভেম্বর বিপ্লবের শতবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা তা এখানে প্রকাশ করছি।)
সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নাৎসী আক্রমণ পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করিয়াছে। বিশাল রণক্ষেত্র জুড়িয়া আজ যন্ত্র ও মানুষের তা- ব চলিতেছে; ব্যাপকতায় এ যুদ্ধ অভূতপূর্ব। এই সংকটকালে আমরা মনে করি, নৈতিক ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুল কীর্তির প্রতি সর্বসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করা একান্ত কর্তব্য। আমরা কেহ কেহ সোভিয়েত শাসনের কোনো কোনো বিষয়ের বিরুদ্ধে সমালোচনা করিয়া থাকি; কেহ কেহ মার্কসবাদ সমর্থনও করি না। কিন্তু জার আমলের কুশাসনের যে কুৎসিত উত্তরাধিকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে গ্রহণ করিতে হইয়াছিল, এবং তারপর সদ্যোজাত সোভিয়েতের বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত রাষ্ট্র যে মারত্মক আক্রমণ চালিয়েছিল তাহা যখন স্মরণ করা যায়, তখন সোভিয়েতের বর্তমান কীর্তিকে মুক্ত কণ্ঠে প্রশংসা না করিয়া থাকা যায় না। রবীন্দ্রনাথ উহার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছেন। আধুনিক জগতের দুজন প্রধান সমাজতত্ত্ববিদ সিডনি ও বীটরিস ওয়েব, তাঁদের “সোভিয়েত কমিউনিজম- এক নতুন সভ্যতা” (Soviet Communism,- A New Civilisation) নামক পুস্তক প্রকাশ করার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্বন্ধে প্রচুর নির্ভরযোগ্য তথ্য সকলের গোচরে আসিয়াছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নে সমস্ত কারখানা, খনি, রেলওয়ে, জাহাজ, জমি ও ব্যবসা-বাণিজ্য জনসাধারণের সম্পত্তি। দেশের অর্থনৈতিক বা সামাজিক জীবন সকলের মঙ্গলের জন্য পরিকল্পিত — কয়েকজন মানুষের মুনাফার জন্য নয়। যাহারা সমাজতান্ত্রিক মতবাদের সমর্থক নয়, সোভিয়েত পরিকল্পনা তাহাদিগকেও অনুরক্ত করে। সেখানে শিক্ষার সমান সুযোগ সার্বজনীন; প্রত্যেককে সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত স্কুলে পড়িতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ সরকারি ব্যয়ে অধ্যয়ন করেন। সকলের জন্য কাজের ব্যবস্থা আছে; সোভিয়েত ইউনিয়নে কেহ বেকার নাই। অন্য সমস্ত স্থানে বারবার যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়া থাকে, সেখানে তাহারা লুপ্ত হইয়াছে। সর্বাধিক খাটুনির সময় দিনে আট ঘন্টা; গড়ে তাহা দিনে সাত ঘন্টার কম। সকলের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। শ্রমিকরা পীড়িত অবস্থায় পুরা মজুরি পায়; এতদ্ব্যতীত তাহারা প্রতি বৎসর বেতনসহ ছুটি পায়। সোভিয়েত ইউনিয়নে নারী ও শিশুর যে রূপ যতড়ব লওয়া হয় জগতের আর কোথাও সেরূপ লওয়া হয় না। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকগণই এইসব কথা স্বীকার করিয়াছেন। সোভিয়েত পরিকল্পনাগুলি যে কার্য সাধনে প্রয়াসী, কোনো প্রাচীন বা আধুনিক রাষ্ট্র এ পর্যন্ত সে কাজে হাত দেয় নাই; এই পরিকল্পনাগুলি ব্যাপকতায় যেমন বিরাট, তেমনই বাস্তব প্রয়োগোপযোগী ও বিজ্ঞানসম্মত।
সিডনি ও বিটরিস ওয়েব বলিয়াছেন, “আমাদের মনে হয়, এমন দেশ নাই যেখানে সমভাবে থিয়োরী ও টেকনিকের ক্ষেত্রে সরকারি অর্থ ব্যয় এতবেশি ও এত বিচিত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণা চলিতেছে। মুনাফালোভী প্রবৃদ্ধির ফলে বিজ্ঞান যেভাবে ব্যর্থ হইতেছে, সে সম্বন্ধে, ব্রিটিশ ও আমেরিকান বৈজ্ঞানিকেরা এখন অনুযোগ করিতেছেন। এ কথা অন্তত নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এখানে (সোভিয়েত দেশে) সে ব্যর্থতার সুযোগ একরকম নাই।”
জার গভর্নমেন্ট অন্যান্য প্রধান রাষ্ট্রের সহযোগে এশিয়ার দেশসমূহে যেসকল অন্যায় সুবিধা ভোগ করিত, বিপ্লবের পর সোভিয়েত সেসব সুবিধা এক কথায় ছাড়িয়া দেয়, — আমরা ভারতবাসীরা ইহা ভুলিতে পারি না। বহু জাতিকে ও কোটি কোটি লোককে জার শাসন ইচ্ছাপূর্বক ‘অনুন্নত’ করিয়া রাখিয়াছিল, কিন্তু সোভিয়েতের জাতিগত ও ভাষাগত স্বাধীনতা প্রত্যেকের উৎকৃষ্ট সংস্কৃতিকে বিকশিত করিয়াছে। যেখানে একদিন কুসংস্কার ও ধর্মতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার রাজত্ব ছিল সেখানে আজ এক নতুন মানস-জীবনের সঞ্চার হইয়াছে। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৮৫টি জাতি ও ১৪৭টি ভাষার মধ্যের কোনো একটা বিশেষ জাতি বা ভাষার কৃত্রিম প্রাধান্য নাই। মুসলমান রাষ্ট্রের মধ্যে নারীমুক্তির প্রম আইন প্রবর্তিত হয় সোভিয়েত ‘আজেরবাইজানে’, কামালের তুরস্কে নয়। বুখারা রাজ্যের সহিত আধুনিক সোভিয়েত ‘উজবেকিস্তানের’ পার্থক্য ছিল বিপুল। বুখারায় ছিল আট হাজার ওঝা ও আমীর, তাহার হারেম ও তাহার দরবারের জন্য মাত্র একজন ডাক্তার। ওয়েব দম্পতি লিখিয়াছেন, “সোভিয়েত ইউনিয়ন অনগ্রসর জাতিগুলিকে শুধু যে সমান অধিকার দিয়াছে তাহা নহে। পরন্তু তাহাদের অনুন্নত অবস্থার জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যাপী দারিদ্র্য, অত্যাচার ও দাসত্ব দায়ী ইহা স্বীকার করিয়া তাহাদের শিক্ষা ও সামাজিক উনড়বতি, শ্রমশিল্পের উন্নতি ও কৃষি সংস্কার বাবদ উন্নত জাতিগুলি অপেক্ষা মাথা পিছু ব্যয় সরকারি তহবিল হইতে বরাদ্দ করিয়াছে।”
সোভিয়েত ইউনিয়নে পুস্তক প্রকাশের সংখ্যাও বিপুল। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা একত্রে ইংল্যান্ড, জার্মানি ও জাপান অপেক্ষা বেশি ছিল। নাৎসী নির্বাসিত আইনস্টাইনের পুস্তক সম্ভবত অন্য যেকোনো দেশ অপেক্ষা সোভিয়েত ইউনিয়নে বেশি বিক্রয় হয়; ১৯২৭ ও ১৯৩৬ সালের মধ্যে তাঁহার গ্রন্থ ৫৫,০০০ খ- সেখানে বিক্রয় হয়। শেক্সপীয়ারের ৩৭৫তম জন্মাবার্ষিকী তাঁহার স্বদেশে অলক্ষিত থাকলেও, সোভিয়েত ইউনিয়নে সর্বত্র শ্রমিক ও কৃষকগণ তাঁহার জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠিত করে। ১৯৩৯ সালের বসন্তকালে মস্কোতে প্রায় ২ লক্ষ লোক ‘কিং লীয়ার’ অভিনয় দেখে। ক্ষুদ্র আর্ম্মেনিয়া রাষ্ট্রে গত পাঁচ বৎসরের শেক্সপীয়ারের গ্রন্থ ৩২,০০০ খ- বিক্রয় হয়।
আমরা যে অর্থে বুঝি সে অর্থে সোভিয়েতের জনসাধারণের মধ্যে কোনো সংস্কৃতিবান শ্রেণি নাই; এবং তাহারা ইহা চাহেও না। তাহারা চাহে সমস্ত জাতিকে সংস্কৃতিবান করতে। তাহারা সকলকে অবকাশ, নির্বিঘ্নতা ও সুযোগ দিতে চায়।
কুড়ি বৎসরের প্রবল বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নের জনসাধারণ এক নতুন সভ্যতার সৃষ্টি করিয়াছে। সে সভ্যতা যখন বিপদাপন্ন , তখন আমরা বহু যুগব্যাপী অন্নাভাবে জীর্ণ, হীনতায় নিমজ্জিত ভারতবাসীরা নিরুদ্বিগ্ন থাকিতে পারি না। আমরা অসহায় ও পরাধীন; তথাপি সোভিয়েতে অন্তত আমাদের শুভ কামনা আমরা প্রেরণ করিতে পারি। সোভিয়েত ইউনিয়ন সেদিন তাহার বিরুদ্ধে শক্তিপুঞ্জকে পরাভূত করিয়া আপনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিবে, সেই দিনের জন্য আমরা অপেক্ষা করিয়া থাকিব।
স্বাক্ষর
আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রমথ চৌধুরী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, যামিনী রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, হিরণকুমার সান্ন্যাল, নীরেন্দ্র রায়, গোপাল হালদার, আবু সৈয়দ আয়ুব, আব্দুল কাদের, সমর সেন, বিনয় ঘোষ, অজিত চক্রবর্তী, বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য প্রমুখ।