Saturday, November 23, 2024
Homeফিচারমানব পাচারের নামে দাস ব্যবসা পুঁজিবাদের নগ্ন চেহারাকেই উন্মোচিত করেছে

মানব পাচারের নামে দাস ব্যবসা পুঁজিবাদের নগ্ন চেহারাকেই উন্মোচিত করেছে

সম্প্রতি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উপকূল থেকে কয়েক হাজার বাংলাদেশি ও বর্মী রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়েছে, যারা অনাহার ও নির্যাতনে প্রায় অর্ধমৃত। থাইল্যান্ডের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে কয়েকশ জনকে। এই লেখাটি তৈরির সময় পর্যন্ত খবরে জানা যাচ্ছে, প্রায় আট হাজার মানুষ ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার উপকূলে খোলা সাগরে ভাসছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে পাচারকারীরা তাদের খোলা সমুদ্রে ফেলে গেছে, যাদের কোনো খাদ্য নেই, পানি নেই। কোনো দেশই তাদের আর আশ্রয় দিচ্ছে না। এদের বেশিরভাগই বাংলাদেশী ও বর্মী রোহিঙ্গা। আরো অগণিত মানুষ, তাদের প্রকৃত সংখ্যা কত কেউ জানে না — যাদের অনেকেই লাশ হয়ে সাগরে ভেসে গেছে, অনেকের ঠাঁই হয়েছে গণকবরে, অনেকে বন্দি হয়ে আছে বিভিন্ন দেশের কারাগারে। এদের কাউকে কাউকে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছে। নারীরা হয়েছে নির্যাতনের শিকার, অনেক নারীকে লাগানো হয়েছে দেহব্যবসায়। এ যেন ইতিহাসের ফেলে আসা সেই দাস ব্যবসার কাহিনী। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, প্রগতি, উন্নয়ন ইত্যাদি সমস্ত ছেঁদো কথাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মানবসভ্যতা যেন ইতিহাসের সেই কালোযুগেই আটকে আছে।

এসব খবরে সারাদেশের মানুষ শিউরে উঠেছে। পাচারের শিকার হতভাগ্যদের পরিবারেও চলছে আহাজারি। মানবপাচার বাংলাদেশে এমন ভয়াবহ রকমের শোচনীয় রূপ নিয়ে — দেশের মানুষ এ কথা ভাবতেই পারেনি। ভুক্তভোগীরা, তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা এসব কথা জানতেন, কিন্তু বিষয়টি কখনোই আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়নি। থাইল্যান্ডে অভিযান শুরু না হলে এ বিষয়টি দেশের বিবেকবান সচেতন মহল জানতেই পারত না। মানব পাচারের এই ভয়াবহ চিত্র দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন এমন ঘটছে? আমাদের রাষ্ট্র, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো কী করছে? যে-সব দেশে এই পাচারের ঘটনা ঘটছে তাদের ভূমিকাই বা কী?

মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্র
human traffi_BD 2জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ২৫ হাজারের মতো বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা পাচারের শিকার হয়েছে। এ সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ। ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে বঙ্গোপসাগর দিয়ে অবৈধভাবে গেছেন ৫৩ হাজার লোক। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৩ হাজার। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ এসব যাত্রায় ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে মারা গেছেন প্রায় হাজার খানেক মানুষ। তাদের অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর নির্যাতনে। অনেকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।

বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা থেকে মানব পাচারের ঘটনা ঘটলেও প্রধানত ৪১টি জেলা থেকে পাচারের মাত্রা বেশি। সীমান্তবর্তী সব জেলায়ই পাচারকারী চক্র সক্রিয়। শুধু সমুদ্রপথে নয়, স্থলপথে, বিমানপথেও পাচার হচ্ছে মানুষ। এমনকি হজ্বে পাঠানোর নাম করেও সৌদি আরবে মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে। কয়েক বছর আগেও ঢাকা বিমানবন্দর ছিল শিশু ও নারী পাচারের নিরাপদ রুট। আর স্থলপথে মানব পাচারের ঘটনা তো হরহামেশাই ঘটছে। কেবল পশ্চিমবঙ্গের কারাগারেই দেড় হাজারের বেশি বাংলাদেশি আটক আছেন। ভারত ও পাকিস্তানের কারাগারে আটক বাংলাদেশি এবং এ দু’দেশের পতিতালয়ে বাংলাদেশের মেয়েদের সংখ্যাও বিরাট। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দাবি, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ পাচার হয়ে যায়। ইউএনডিপি বলেছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৩ লাখ ও তিন দশকে ১০ লাখ।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, মানব পাচারের ক্ষেত্রে দেশে এবং দেশের বাইরে এক বিরাট সিন্ডিকেটে প্রায় ৪ শতাধিক পাচারকারী সক্রিয় রয়েছে। সমুদ্রপথে পাচারের ক্ষেত্রে তিন স্তরের চক্র কাজ করে প্রথম স্তরের চক্রটি বিদেশে অবৈধভাবে যেতে আগ্রহীদের সংগ্রহ করে; বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে পাচারের কাজটি করে দ্বিতীয় চক্র এবং তৃতীয় চক্রটি দেশের বাইরে তাদের গ্রহণ করে। স্বাভাবিক নিয়মে মালয়শিয়া যেতে খরচ হয় প্রায় ৪ লক্ষ টাকা অথচ বিকল্প রুটে খরচ বলা হয় মাত্র ১০ হাজার টাকা। মাত্র ১০ হাজার টাকা খরচের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ আদায় করা হয়। টাকা দিতে ব্যর্থদের এমনকি মেরেও ফেলা হয়।

পাচারের শিকার হওয়া মানুষগুলো কারা?
Thailand_BDযেদিন সরকার চলতি অর্থবছরে মানুষের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩১৪ ডলারে উন্নীত হওয়ার ঘোষণা দিল, সেদিনই মালয়েশিয়ার উপকূলে ভাসমান রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কয়েক শ বাংলাদেশি নারী, পুরুষ ও শিশুর আহাজারির সচিত্র খবর দেশবাসী দেখেছেন। রোহিঙ্গারা তাদের দেশে অবাঞ্ছিত, বিতাড়িত। তাদের দেশে সামরিক শাসন চলছে। সে কারণে তারা দেশে দেশে আশ্রয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকেরা এভাবে কেন পাচারের শিকার হচ্ছে? স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও কেন এ দেশ তাদের ন্যূনতম মানবিক ও নাগরিক সুবিধাটুকু দিতে পারল না? দেশে তো গত দুই যুগ ধরে কেবল উন্নয়নের জোয়ারই বয়ে চলছে! বিশেষত বর্তমান আওয়ামী মহাজোট তো ‘উন্নয়নে’র জন্য ‘গণতন্ত্র’কে খানিকটা সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত করার কথা বলছেন। সেই ‘উন্নয়নে’র ধাক্কাতেই কিনা গত দুই বছরে পাচারের সংখ্যা এভাবে বেড়ে গেল?

আসলে শাসকরা যত কথাই বলুক না কেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনে ‘উন্নয়ন’ কথাটা কোনো অর্থ বহন করে না। দেশে যে পুঁজিবাদী শোষণমূলক ব্যবস্থা চলছে তার ফলে একদিকে গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক জীবন থেকে প্রতিবছরই লক্ষ লক্ষ মানুষ উচ্ছেদ হচ্ছেন। এই মানুষগুলোর বড় অংশই মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ পায়নি। তাদের জন্য দেশের অভ্যন্তরে কোনো ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগও সরকার তৈরি করছে না। ফলে দেশের ভেতরে তাদের সামনে কোনো ভবিষ্যত নেই, সম্ভবানা নেই। এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি, এদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও রাষ্ট্র এবং শাসকরা করতে পারছে না। এ অবস্থায় তারা গিয়ে পড়ছে পাচারকারী চক্রের হাতে। এরা জীবন হারাচ্ছে, অর্থ হারাচ্ছে।

আসলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কর্মসংস্থান সৃষ্টির কাজটি স্বাধীনতার পর থেকে কখনোই করা হয়নি। ফলে উচ্চ শিক্ষিত দক্ষ শ্রমশক্তির পাশাপাশি স্বল্প শিক্ষিত অদক্ষ শ্রমশক্তি — সকলেই কর্মসংস্থানের খোঁজে দেশের বাইরে গিয়েছে। এদের মধ্যে সংখ্যায় গরিব মানুষের সন্তানেরাই বেশি। আর সম্প্রতি একদিকে দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান কমছে, অন্যদিকে প্রধান শ্রমনির্ভর বাজারগুলোতে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশীদের যাবার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পুঁজির পুঁঞ্জিভবন তীব্র হয়েছে, বড় পুঁজি ছোট পুঁজিকে গিলে খাচ্ছে এবং বাংলাদেশের বাজারে বহুজাতিক পুঁজির অনুপ্রবেশ বেড়েছে। এর ফলে ক্ষুদে মালিকানা থেকে, কৃষি থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। শিল্পায়ন বলতে বিশেষ কিছুই হচ্ছে না এবং শ্রমঘন শিল্পের পরিবর্তে প্রযুক্তি-নির্ভর শিল্পের প্রবণতা বেড়েছে। ফলে কর্মসংস্থানের হার কমেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী গত দশ বছরে দেশে বেকারত্ব বেড়েছে ১.৬ শতাংশ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার কমেছে ২ শতাংশ। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বলছে বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির বর্তমান হার ৩.৭ শতাংশ, যেখানে প্রতিবছর ২৭ লাখ মানুষ কর্মবাজারে প্রবেশ করলেও চাকরি পাচ্ছেন মাত্র ১ লাখ ৮৯ হাজার। এই ধারা বজায় থাকলে চলতি বছরেই দেশে মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ছয় কোটিতে। এদিকে বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, গত চার অর্থবছরের ব্যবধানে ব্যক্তিখাতে কর্মসংস্থান কমেছে ৩ লাখ ৭৬ হাজার। বিনিয়োগ বোর্ডের হিসাবমতে, ২০১০-’১১ অর্থবছরে ব্যক্তিখাতে ৫ লাখ ৩ হাজার নতুন কর্মসংস্থান হয়, যা ২০১১-’১২ অর্থবছরে নেমে আসে ৪ লাখ ৫১ হাজারে। ২০১২-’১৩ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৯ হাজারে। এভাবে প্রতিবছরই ব্যক্তিখাতে কর্মসংস্থান কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত শ্রমশক্তি জরিপের ফলে বলা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ৪ বছরে ৩৪ লাখ কর্মসংস্থান কমেছে। শিল্পখাতে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় বাড়ছে দক্ষ-আধাদক্ষ বেকারের সংখ্যা। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে বর্তমানে ৬৮ লাখ লোক কর্মরত। অথচ ২০০৫-’০৬ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২ লাখ। এটা সবারই জানা যে আদমজীসহ দেশের পাট, চিনি, কাগজ, বস্ত্র ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দেশের সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে হল কৃষি। কিন্তু সেই কৃষিতেও ভয়াবহ নৈরাজ্য বিরাজ করছে। ধান থেকে শুরু করে গম, সবজি কোনো ফসলেরই ন্যায্য মূল্য চাষীরা পায় না। বীজ-সার-ডিজেল-কীটনাশকের মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় ক্ষেত্র বিশেষে চাষীদের লোকসানের পরিমাণ তিনগুণ, চারগুণ পর্যন্ত হয়। এই লোকসানের ধাক্কায় প্রতিবছরই হাজার হাজার প্রান্তিক দরিদ্র চাষী সর্বস্বান্ত হচ্ছে, জমি হারাচ্ছে। মধ্য চাষী পরিণত হচ্ছে দরিদ্র চাষীতে।

এসব কিছুর সাথে রাষ্ট্র-প্রশাসনের সর্বস্তরে দলীয়করণ এবং দুর্বৃত্তায়ন এত ব্যাপক রূপ নিয়েছে যে আইনের শাসন বলে কিছুই টিকে নেই। একটা সামান্য পিয়ন-কেরানির চাকুরির জন্য ৩ থেকে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। বৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার পথে পথে বহু বাধা। উপায়হীন এ পরিস্থিতিতে গরিব মানুষ জীবিকার আশায় অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।

কথিত ‘উন্নত’ দেশের বর্বর চেহারা
একদিন দাস ব্যবসায়ীরা আফ্রিকা থেকে মানুষকে জোর করে ধরে নিয়ে যেত, তাদের নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হত ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে। এদের অনেকেই জাহাজে মারা যেত, তাদের লাশ পায়ে পাথর বেঁধে ছুঁড়ে দেয়া হত সমুদ্রে। নারীদের দিয়ে দেহব্যবসা করানো হত। বলা হচ্ছে সভ্যতা আগের চেয়ে অনেক এগিয়েছে, এখন গণতন্ত্রের জয়-জয়কার চলছে। কিন্তু পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী মুনাফানির্ভর ব্যবস্থায় দাস ব্যবস্থা নতুন চেহারা নিয়েছে।

সমগ্র ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতেই অভিবাসী শ্রমিকদের নামমাত্র মজুরিতে খাটানো হয়। তাদের কোনো ধরনের আইনি অধিকার বা সুরক্ষা দেওয়া হয় না। কৃষি শ্রমিকদের বড় অংশ, গৃহস্থালী শ্রমিকদের বিশাল অংশ এবং কোনো কোনো শিল্পেও অবৈধ শ্রমিকদের নিয়োগ করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও একই চিত্র। কেননা এর সুবিধা হলো, এই শ্রমিকরা কোনো আইনগত অধিকার পায় না, কম মজুরিতে এদের নিয়োগ করা যায়, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার না থাকায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবৈধ শ্রমিকদের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে চাপ কম হয়। যে কোনো সময়ে এদেরকে বহিস্কার ও শাস্তি দেয়া যায়, এদের ওপর আইনি নিপীড়ন চলে ব্যাপক। যে কোনো মুহূর্তে এদেরকে বেআইনি হিসেবে চিহ্নিত করে তার দায়দায়িত্বও অভিবাসীদের ওপরই চাপিয়ে দেয়া যায়। এতসব সুবিধার কারণেই এসব দেশ বৈধ পথে শ্রমিক আনার চেয়ে অবৈধ পথে তাদের আনায় উৎসাহ দেয়। সম্প্রতি এক তথ্যে দেখা গেছে, ইতালি পুলিশের ধারণা, ভূমধ্যসাগরে মানবপাচারের মাধ্যমে ৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার কামিয়েছেন পাচারকারীরা। সিরিয়ায় চলমান যুদ্ধের কারণে বিপুল সংখ্যক সিরিয় নাগরিক আশ্রয়ের জন্য ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে। গত বছরের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার শরণার্থী। আর সে সময় উদ্ধার করা হয়েছে আরো দুই লাখ শরণার্থীকে।

গণতন্ত্র আর মানবতার চ্যাম্পিয়ান খোদ আমেরিকার মাটিতেই অভিবাসীরা নিজেদের অধিকারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে চলছেন, কালোরা সেখানে এখনো কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের বেশি মর্যাদা পান না। একই অবস্থা সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, লিবিয়া ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্যের এবং এশিয়ার থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি উন্নত বলে খ্যাত দেশগুলিতেও। এই দেশগুলিকে আমাদের সামনে উন্নয়নের মডেল হিসাবে হাজির করা হয়। এখনও বাংলাদেশের দেয়ালে বিলবোর্ডে লেখা দেখা যায় — ‘শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মাহাথির’। অথচ আমেরিকান জরিপ সংস্থা ভেরিটে’র তথ্যমতে, মালয়েশিয়ায় ইলেকট্রনিকস শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের দাসের মতো খাটানো হয়। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের ২০১৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পৃথিবীর মাঝে সবচে খারাপ শ্রমপরিবেশের দেশগুলোর যে তালিকা প্রস্তুত করেছে, তার মাঝে মালয়েশিয়া অন্যতম। এই তালিকাতে এরচেয়ে নিকৃষ্টতর স্থান পেয়েছে কেবলমাত্র সামরিক শাসন বা যুদ্ধপরিস্থিতিতে থাকা দেশগুলো। মালয়েশিয়াসহ এই তালিকাভুক্ত দেশগুলোতে শ্রমপরিবেশের কোনো নিশ্চয়তা নেই কিংবা নামমাত্র আইনগত কিছু প্রতিশ্রুতি থাকলেও সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো ব্যবস্থা নেই। নব্য শিল্পায়িত এই দেশগুলোর মাঝে মালয়েশিয়াই সবচেয়ে বেশি অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়োগ করছে। শুধু তাই নয়, নানান প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া সরকার বৈধ শ্রমিকদের চেয়ে অবৈধ শ্রমিকদের নিয়োগে পরোক্ষভাবে উৎসাহ প্রদান করছে। ধারণা করা যায়, আজ মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে অভিবাসী শ্রমিকের প্রয়োজন কমে গেছে বলেই মানব পাচারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে।

আসলে পুঁজির চরিত্র তো সারা দুনিয়া জুড়েই এক — সে ইউরোপ হোক আর এশিয়া, মালয়েশিয়া হোক আর বাংলাদেশ। তার ধর্মই হল সস্তা শ্রম লুণ্ঠন, বাজার লুণ্ঠন এবং মুনাফা। প্রথমে সে নিজের দেশের শ্রমিকদের শোষণ করে, দেশের অভ্যন্তরের বাজার লুট করে। সেই বাজার যখন সংকুচিত হতে থাকে তখন সস্তা শ্রমের আশায় পুঁজি নিজের দেশ ছাড়িয়ে অনুন্নত দেশগুলিতে গিয়ে হানা দেয়। যেমন দিচ্ছে বাংলাদেশে।

গরিব মানুষের পাশে শাসকরা থাকে না
সম্প্রতি মানব পাচারের এই ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত হওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘আমরা শুধু বৈধ শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করি। অবৈধ শ্রমিকদের নিয়ে নয়।’ পাচার রোধ বা পাচার হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ব্যাপারে নাকি তার বা তার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেই, এটি দেখবে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হল, মানব পাচার নিয়ে স্বরাষ্ট্র কিংবা পররাষ্ট্র মন্ত্রীরও কোনো বিবৃতি বা ব্যাখ্যা দেশবাসীর চোখে পড়েনি। আসলে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী বা সরকার কি বৈধ শ্রমিকদের দায়ই নিয়েছে? তাই যদি নিত তাহলে প্রতি বছর শত শত শ্রমিকের লাশ দেশে আসার পর কি ব্যবস্থা তারা নিয়েছেন? দেশের ভেতরে শ্রমিক হত্যাকান্ডের বিচার তারা কতটুকু করেছেন? পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি-কোস্টগার্ড-নৌবাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে কেমন করে হাজার হাজার বাংলাদেশি পাচারা হয়ে গেল?

মানব পাচার নিয়ে যখন ব্যাপক হইচই চলছে তখন বেশ কয়েকজন মানব পাচারকারী গ্রেফতার এবং কয়েকজন ক্রসফায়ারে নিহতের খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে কতগুলো সাধারণ স্তরের ছিঁচকে পাচারকারী দিনের পর দিন প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে এই বিরাট অন্যায় চালিয়ে গেছে। এর পেছনে সরকার-প্রশাসনের উচ্চ স্তরের ব্যক্তিরা জড়িত বলেই জনমনে ধারণা। সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, একটা বিরাট সিন্ডিকেট এ মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত যারা শীর্ষে ক্ষমতাবানরা অবস্থান করে। এ ধারণা আরো জোরালো হয় যখন ক্রসফায়ারে পাচারকারী-চক্রের নিচের দিকের লোকদের হত্যা করা হয়। মানুষের মনে এই বিশ্বাসই দৃঢ় হয় যে রাঘব বোয়ালদের আড়াল করার উদ্দেশ্যেই চুঁনোপুটিদের খুন করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রার উৎস প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ। গত অর্থ বছরে (২০১৪-’১৫) এর পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ১০ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত দশ বছরে দেশে এসেছে প্রায় বিশ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের লাশ। এই লাশের দায় কেউ নেয়নি। একইভাবে দেশের অভ্যন্তরে যারা শ্রম দিয়ে প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আনার কাজটি করে সেই গার্মেন্ট শ্রমিকদের চিত্রও একই রকম ভয়াবহ। তাদের মজুরি নামমাত্র। তারা ভবন ধসে, আগুনে পুড়ে মরে। কিন্তু সেই হত্যাকা-ের বিচার হয় না, এমনকি তারা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণও পায় না। এই অবস্থা দেশের সমস্ত গরিব মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এ অবস্থায় একদিকে মানব পাচারের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচার এবং পাচারকারী সিন্ডিকেটের হোতাদের আটক করে দৃষান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলতে হবে। পাচারকারী চক্রের হাতে নিহতদের পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ক্ষতিপূরণ ও দ্রুত পুনর্বাসন, বিদেশে আটক এবং সমুদ্রে ভাসমান নারী-পুরুষ-শিশুদের ফিরিয়ে এনে দেশে কর্মসংস্থান করাসহ দেশের অভ্যন্তরে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের দাবিতে জোরদার গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য গরিব শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

সাম্যবাদ মে-জুন ২০১৫

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments