Tuesday, December 24, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - এপ্রিল ২০১৮মার্কস স্মরণে — পল লাফার্গ

মার্কস স্মরণে — পল লাফার্গ

59822-004-3BE11980[এ বছর সর্বহারা শ্রেণির মুক্তি সংগ্রামের পথপ্রদর্শক মহান কার্ল মার্কসের ২০০তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বছরব্যাপী মার্কসের জীবন সংগ্রাম ও তাঁর অবদান নিয়ে সাম্যবাদে ধারাবাহিক লেখা ছাপানোর অংশ হিসেবে এবারের সংখ্যায় পল লাফার্গের ভাষ্যে কার্ল মার্কসের জীবনযাপনের কিছু দিক তুলে ধরা হলো। ব্যক্তিজীবনে কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন, কী তিনি ভালোবাসতেন, প্রতিদিনের জীবনযাপনে কীভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন — তা-ই অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন লাফার্গ। পল লাফার্গ (১৮৪২-১৯১১) ছিলেন ফ্রান্সের এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা, ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, মার্কস ও এঙ্গেলসের বন্ধু ও প্রিয় শিষ্য এবং মার্কসের কন্যা লারা মার্কসের স্বামী। লেখাটির শেষ কিস্তি ছাপানো হলো]

কাজ করাটা ছিল মার্কসের নেশা। কাজে এমন ডুবে থাকতেন যে প্রায়ই খেতে পর্যন্ত ভুলে যেতেন। প্রায়ই বেশ কয়েক বার ডাকাডাকির পর তবে তিনি খাবার ঘরে নেমে আসতেন আর শেষ গ্রাস মুখে তোলা সাঙ্গ হতে না-হতেই ফের ফিরে যেতেন পড়ার ঘরে। মার্কস ছিলেন অত্যন্ত স্বল্পাহারী, এমন কি ক্ষুধামান্দ্যেও ভুগতেন। ক্ষুধামান্দ্য কাটানোর চেষ্টায় ধোঁয়ায়-জারানো মাছ, কেভিয়ার, আচার ইত্যাদি উগ্র গন্ধওয়ালা খাবার খেতেন। মস্তিষ্কের প্রবল সক্রিয়তার কারণে ভুগতে হোত তাঁর পাকস্থলীকে।

জীবনযাপনের এই অস্বাভাবিক ধরন এবং ক্লান্তিকর মননক্রিয়ার ধকল সামলাতে তাঁর শারীরিক গঠনকে রীতিমতো জোরদার হতে হয়েছিল। বস্তুত তাঁর শারীরিক গঠন ছিল শক্তিশালী। তিনি ছিলেন গড়পড়তা লোকের চেয়ে বেশি লম্বা, কাঁধ দুটো ছিল বেশ চওড়া, বুকটা সুগঠিত, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুসমঞ্জস্য-যদিও ইহুদিদের ক্ষেত্রে প্রায়ই যেমন দেখা যায় তেমনই পা দুটোর চেয়ে তুলনায় তাঁর মেরুদ- ছিল কিছুটা বেশি লম্বা। অল্পবয়সে যদি ব্যায়ামচর্চা অভ্যাস করতেন মার্কস তাহলে রীতিমতো শক্তিমান পুরুষ হয়ে উঠতে পারতেন। একমাত্র যে শারীরিক ব্যায়াম নিয়মিতভাবে সারা জীবন চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি তা হল পায়ে হাঁটা। অনবরত কথা বলতে বলতে আর চুরুট টানতে টানতে ঘন্টার-পর-ঘন্টা হাঁটতে কিংবা টিলার চড়াই ভাঙতে পারতেন তিনি, অথচ বিন্দুমাত্র ক্লান্ত হতেন না। বলা যেতে পারে, এমনকি ঘরের মধ্যেও হাঁটতে হাঁটতে কাজ করতেন মার্কস আর হাঁটার সময়ে যা ভাবতেন তা লিখে ফেলার জন্য মাঝে-মাঝে অল্প একটুক্ষণ বসতেন। কথা বলার সময়েও তিনি পায়চারি করতে ভালোবাসতেন, কেবল ব্যাখ্যাটা যখন বেশি প্রাণবন্ত কিংবা কথাবার্তা গুরুগম্ভীর হয়ে উঠত তখন থেকে-থেকে দাঁড়িয়ে পড়তেন।

বহু বছর ধরে হ্যাম্পস্টেড হীতে আমি ছিলুম তাঁর সান্ধ্য ভ্রমণের সঙ্গী। ওই সময়ে মাঠে মাঠে তাঁর পাশাপাশি পায়চারি করার ফাঁকে ফাঁকে অর্থশাস্ত্রে আমার হাতেখড়ি হয়। ‘পুঁজি’ বইটির প্রথম খ- লেখার সময়ে এইভাবে গোটা খ-টির যাবতীয় বিষয়বস্তু আমার কাছে ব্যাখ্যা করে বোঝান। তিনি যে লেখার পরিকল্পনা আগে থেকে ফাঁস করে দিচ্ছেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না তাঁর।

বাড়ি ফেরার পর সর্বদাই যা শুনেছি তা আমার সাধ্যমতো লিখে রাখতাম তখন। মার্কসের গভীর ও জটিল যুক্তিধারা অনুসরণ করা প্রথম প্রথম আমার পক্ষে কঠিন হোত। দুঃখের বিষয় ওই মূল্যবান লেখাগুলো পরে আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায়, কারণ প্যারিস কমিউনের পর প্যারিসে ও বোর্দোয় আমার যাবতীয় কাগজপত্র পুলিশ তছনছ করে দেয়।

ওই সময়ে এক সন্ধ্যায় মার্কস তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বহুবিধ প্রমাণ ও বহুমুখ বিবেচনার ফোয়ারা ছুটিয়ে মানব সমাজের ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত তাঁর চমৎকার তত্ত্বটির যে ব্যাখ্যা দেন, সে সম্পর্কিত আমার নেওয়া নোটগুলোও গেছে হারিয়ে। আজ এই আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ। সেদিন মনে হয়েছিল যেন আমার দিব্যচোখ খুলে গেল। বিশ্ব-ইতিহাসের বিকাশের অন্তর্নিহিত যুক্তিসঙ্গতি সে-ই প্রথম স্বচ্ছভাবে চোখে পড়ল আমার এবং সমাজ ও মতাদর্শের বিকাশের সঙ্গে তাদের বৈষয়িক উৎসের সম্পর্কের মতো অমন একটা আপাত-বিরোধী ব্যাপার ধরা পড়ল আমার কাছে। যেন একেবারে চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমার। এই অনুভূতি বহু বছর পর্যন্ত আমার মধ্যে জীবন্ত হয়ে ছিল।

…এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে ‘পুঁজি’ বইটি আমাদের কাছে এমন একটি মনের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করে দেয় যে-মন আশ্চর্য প্রাণশক্তি ও উন্নততর জ্ঞানের অধিকারী। কিন্তু আমার কাছে এবং মার্কসকে যাঁরা অন্তরঙ্গভাবে জানতেন তাঁরা সকলের কাছেই, কি ‘পুঁজি’ বইটি, কি অন্য কোনও রচনা কোথাও তাঁর প্রতিভার বিরাটত্ব কিংবা তাঁর জ্ঞানের বহুবিস্তৃত পরিধি পুরোপুরি প্রতিফলিত নয় বলেই মনে হয়। নিজের সৃষ্টির চেয়েও তিনি ছিলেন বহুগুণে উন্নততর, মহত্তর।

…নিজের সৃষ্টিকর্মের ব্যাপারে মার্কস ছিলেন সর্বদাই পরম বিবেকী; সব সেরা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা যা সমর্থিত ছিল না এমন একটিও তথ্য বা সংখ্যা তিনি কখনও সংকলিত করতেন না। হাত ফেরতা পরোক্ষ তথ্যে কখনও সন্তুষ্ট থাকতেন না তিনি, সর্বদাই তার উৎসের সন্ধান করতেন, তা সে-প্রক্রিয়া যতই ক্লান্তিকর হোক না কেন। গৌণ কোনও তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে সোজা ব্রিটিশ মিউজিয়মে চলে গিয়ে বই ঘাঁটতে পর্যন্ত কসুর করতেন না। ফলে তাঁর সমালোচকরাও কখনও প্রমাণ করতে পারেননি যে লেখার ব্যাপারে তাঁর যত্নের অভাব ছিল কিংবা এমন সব তথ্যের উপর ভিত্তি করে তিনি যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন কড়া পরীক্ষার সম্মুখীন হতে যা অপারগ।

সব সময়ে একেবারে উৎসে পৌঁছানো পর্যন্ত না-ছাড়ার অভ্যাসের ফলে তাঁকে যেমন সব লেখকের রচনা পড়তে হত যাঁরা ছিলেন নিতান্তই স্বল্পপরিচিত এবং তিনিই ছিলেন একমাত্র যিনি ওই সব লেখকদের রচনা উদ্ধৃতিযোগ্য মনে করেছিলেন। ‘পুঁজি’ বইটিতে স্বল্পপরিচিত লেখকদের রচনা থেকে এত বেশি সংখ্যায় উদ্ধৃতি লিপিবদ্ধ আছে যে মনে হতে পারে বইটিতে মার্কস বুঝি দেখাতে চেয়েছেন তাঁর পড়াশোনা কত বহুব্যাপক। আসলে তাঁর উদ্দেশ্য মোটেই তা ছিল না। মার্কস বলতেন, ‘ঐতিহাসিক দিক থেকে ন্যায়বিচার করতে চেয়েছি আমি। যার যা প্রাপ্য তা-ই তাঁকে দিয়েছি’। তিনি মনে করতেন, যে লেখক সর্বপ্রথম সবচেয়ে সঠিকভাবে কোনও একটি ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন কিংবা সূত্রবদ্ধ করতে পেরেছেন তাঁর কাছে ব্যক্তিগতভাবে তিনি দায়বদ্ধ, তা সে-লেখক যতই তুচ্ছ ও স্বল্পপরিচিত হোন না কেন তাতে কিছু যায়-আসে না।

সাহিত্যগত বা রচনা পদ্ধতির দিক থেকে যতখানি বিবেকবান ছিলেন মার্কস ঠিক ততখানিই ছিলেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিচারেও। সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত লেখার ক্ষেত্রে তিনি যে কোনও তথ্যের উপর নির্ভর করতেন না তা-ই শুধু নয়, আদ্যন্ত পড়াশুনো না করে কোনও বিষয় নিয়ে মৌখিক আলোচনা করতেও ছিলেন নারাজ। বারবার সংশোধন করতে করতে যতক্ষণ না তিনি লেখার সবচেয়ে উপযুক্ত ধরনটি পেয়ে গেছেন ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও একটি রচনাও প্রকাশ করেন নি। পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে প্রস্তুত না হয়ে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ তাঁর কাছে অসহনীয় ঠেকত। শেষবারের মতো কাটাকাটি করে লেখাটা মনোমতো না হওয়া পর্যন্ত পাণ্ডুলিপি কাউকে দেখানো তাঁর পক্ষে ছিল যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার। এ-ব্যাপারে তাঁর মনোভাব এত অনমনীয় ছিল যে কথায় কথায় একদিন আমাকে তিনি বলেছিলেন পাণ্ডুলিপিগগুলো বরং পুড়িয়ে ফেলবেন তা-ও ভালো, তবু তা অসম্পূর্ণ রেখে যাবেন না।

মার্কসের কাজ করার এই ধরন তাঁর উপর এমন গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করত যে পাঠক তার ব্যাপ্তি কল্পনা করতে পারবেন কিনা সন্দেহ। যেমন, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ’পুঁজি’-তে ইংলন্ডের ফ্যাক্টরি-আইন সম্বন্ধে পাতা বিশেকের মতো লেখার জন্যে তিনি ইংলন্ড ও স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন কমিশনের ও ফ্যাক্টরি-ইনস্পেক্টরদের লেখা কার্যবিবরণী সমন্বিত এক-লাইব্রেরি ব্লু বুকই পড়ে শেষ করেছিলেন। রিপোর্টগুলিতে মার্কসের দেওয়া পেন্সিলের দাগ দেখে বোঝা যায় সেগুলি আদ্যোপান্ত পড়েছিলেন তিনি। পুঁজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতির অনুুধাবনে ওই রিপোর্টগুলিকে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সুবিবেচনার প্রসূত দলিল হিসাবে গণ্য করেছিলেন।

আলোচ্য ‘ব্লু’ বুক’গুলো থেকে বাস্তব তথ্যভিত্তিক সংবাদের রীতিমতো এক সম্ভার আহরণ করেছেন মার্কস। ওই বইগুলো যাঁদের মধ্যে বিলি করা হয় পার্লামেন্টের সেই সদস্যদের অনেকেই ওগুলোকে একমাত্র চাঁদমারির নিশানা হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন, বইগুলিতে যে-কখানা পাতা ফুটো হয়, তাই দিয়ে পিস্তলের শক্তির বিচার করেন তাঁরা। অন্যের বইগুলো বিক্রি করে দেন ওজন দরে। ওগুলো নিয়ে অন্য কিছু করার চেয়ে এ কাজ অবশ্য খুবই যুক্তসঙ্গত, কারণ ওরই ফলে পুরনো কাগজ বিক্রি ওয়ালাদের কাছ থেকে সস্তা দরে বইগুলো কিনতে পেরেছিলেন মার্কস। পুরনো বই ও কাগজপত্র নেড়েচেড়ে দেখার জন্যে ওই কাগজ বিক্রি ওয়ালাদের দোকানে মার্কস প্রায়ই যেতেন। অধ্যাপক বীজলি বলেছেন, মার্কসই ছিলেন সেই লোক যিনি ইংল্যান্ডের সরকারি তদন্তের রিপোর্টগুলি সকলের চেয়ে বেশি করে কাজে লাগিয়েছিলেন এবং সেগুলো সেই প্রথম বিশ্বেও গোচরে এনেছিলেন। অধ্যাপক অবশ্য জানতেন না যে ১৮৪৫ সালের আগেই ইংলন্ডের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা সম্পর্কে বই লিখতে গিয়ে এঙ্গেলস ওই সব ’ব্লু’ বুক’ থেকে বহুবিধ দলিল সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

…পিতা হিসাবে মার্কস ছিলেন স্নেহপ্রবণ, মৃদুস্বভাব ও সন্তানদের প্রশ্রয়দাতা। তিনি বলতেন, ‘বাপ-মাকে শিক্ষা দেবে ছেলেপিলেরাই।’ মেয়েদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ক্ষেত্রে কতৃত্বপরায়ণ পিতৃত্ববোধের চিহ্নমাত্র ছিল না, তাঁর প্রতি মেয়েদের ভালোবাসাও ছিল অসামান্য। মেয়েদের কখনও হুকুম করতেন না তিনি, বরং যখন যা তাঁর দরকার হোত তখন তাঁদের কাছে এমনভাবে চাইতেন যে মনে হোত তিনি যেন তাঁদের আনুকূল্যের প্রার্থী; কিংবা মেয়েদের যে-কাজ তাঁর কাম্য ছিল না তাও এমনভাবে জানিয়ে দিতেন যে কাজটা করতে যে নিষেধ করা হচ্ছে সেটা মোটেই হাড়ে-হাড়ে টের পাইয়ে দিতেন না তাঁদের। অথচ তাঁর মেয়েদের মতো অত বশ্য বাধ্য সন্তান কোনও পিতার ছিল কিনা সন্দেহ। মেয়েরা তাঁকে গণ্য করতেন বন্ধু হিসেবে, আচরণ করতেন তাঁর সঙ্গে সমকক্ষ সঙ্গীর মতো। তাঁরা ওঁকে ‘বাবা’ বলে ডাকতেন না, রসিকতা করে বলতেন ‘মুর’ – গায়ের ময়লা রঙ ঘনকৃষ্ণ চুল আর দাড়ির জন্যে এই ডাকনাম পেয়েছিলেন তিনি। বাচ্চা মেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলোয় ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতেন মার্কস। মস্ত একটা জলের গামলায় নৌযুদ্ধ আর কাগজের নৌবহরে আগুন লাগানোর কথা এখনও মনে আছে ওঁদের। কাগজের জাহাজগুলো মেয়েদের জন্য বানাতেন মার্কস আর সেগুলোয় আগুন দিয়ে ওদের প্রচুর আনন্দ দিতেন।

রবিবারগুলোয় মেয়েরা মার্কসকে কাজ করতে দিতেন না, সারা দিনের মতো সেদিনটায় তিনি থাকতেন ওঁদের দখলে। আবহাওয়া যদি ভালো থাকত পুরো পরিবার ওইদিন শহরতলিতে হাঁটতে যেতেন। যেতে যেতে পথের ধারের ছোটখাট কোনও সরাইখানায় থামতেন তাঁরা রুটি, পনির আর খানিকটা জিঞ্জার বিয়ার খেয়ে নিতে। মেয়েরা যখন ছোট ছিল, লম্বা পথকে তাঁদের কাছে সংক্ষেপ করে তুলতেন তিনি অসংখ্য আজগুবি গল্প শুনিয়ে। গল্পগুলো পথে যেতে যেতেই বানাতেন তিনি, যতখানি পথ যেতে হবে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টেনে লম্বা করতেন সেগুলোকে আর গল্পের জটিলতাগুলো ভরিয়ে তুলতেন বেশি বেশি উত্তেজনা দিয়ে যাতে গল্প শোনার আগ্রহে বাচ্চারা পথচলার ক্লান্তি ভুলে থাকতে পারে।

তাঁর ছিল তুলনাহীন উর্বর কল্পনাশক্তি। কবিতা ছিল তাঁর প্রথম সাহিত্যপ্রচেষ্টা। স্বামীর তরুণ বয়সের লেখা কবিতাগুলি সযত্নে রক্ষা করতেন শ্রীমতি মার্কস, কিন্তু কখনও কাউকে তা দেখাতেন না। মার্কসের পরিবার স্বপ্ন দেখেছিলেন যে ভবিষ্যতে তিনি একজন সাহিত্যিক কিংবা অধ্যাপক হবেন, সমাজতান্ত্রিক প্রচার-আন্দোলন ও রাজনীতি সংক্রান্ত অর্থশাস্ত্রেও চর্চা করে তিনি নিজের অবমাননা করছেন এই ছিল তাঁদের ধারণা। এই শেষোক্ত বিষয়গুলির চর্চা তখন জার্মানিতে অশ্রদ্ধেয় বলে গণ্য হোত।

….মার্কসের স্ত্রী ছিলেন স্বামীর সারা জীবনের সহকর্মিণী। একেবারে শিশুকাল থেকে পরস্পরের পরিচিত ছিলেন তাঁরা, বড় হয়েও উঠেছিলেন একসঙ্গে। প্রাকবিবাহ বাগদানের সময় মার্কসের বয়স ছিল মাত্র সতেরো বছর। ১৮৪৩ সালে বিয়ে হবার আগে দীর্ঘ সাত বছর এই তরুণ দম্পতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বিয়ের পর অবশ্য আর কখনও তাঁরা পরস্পরের কাছছাড়া হননি। স্বামীর মৃত্যুর অল্প কিছু আগে শ্রীমতী মার্কসের মৃত্যু হয়। যদিও এক জার্মান অভিজাত পরিবারের জাত ও লালিত হয়েছিলেন তিনি, তবু সাম্যের বোধ তাঁর চেয়ে আর কারও মধ্যে বেশি ছিল না। কোনওরকম সামাজিক বৈষম্য বা শ্রেণিগত ছুৎমার্গের অস্তিত্ব ছিল না তাঁর কাছে। দৈনন্দিন কাজের পোশাক-পরা শ্রমজীবী মানুষজনকে তাঁর বাড়িতে ও তাঁর খাবার টেবিলে এমনভাবে অভ্যর্থনা ও যত্নআত্তি করতেন তিনি যে মনে হোত তাঁরা বুঝি ডিউক কিংবা রাজপরিবারের লোকই। সকল দেশের বহু শ্রমিকই শ্রীমতি মার্কসের আতিথেয়তায় ধন্য হয়েছেন এবং আমার দৃঢ়বিশ্বাস তাঁদের মধ্যে একজনও স্বপ্নে ভাবতে পারেননি যে অমন স্বচ্ছন্দ ও আন্তরিক সহৃদয়তা নিয়ে যে-মহিলাটি তাঁদের গ্রহণ করেছিলেন, মাতৃকূলের দিক থেকে তিনি ছিলেন আর্গাইলের ডিউকদের বংশোদ্ভূতা এবং তাঁর ভাই ছিলেন প্রাশিয়ার রাজার একজন মন্ত্রী। তার জন্যে শ্রীমতী মার্কসের অবশ্য ভ্রুক্ষেপ ছিল না। কার্লের সঙ্গে যাওয়ার জন্যে সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন তিনি এবং কখনও, এমনকী প্রচ- অভাবের সম্মুখীন হয়েও, এরজন্যে কোনওদিন অনুতাপ করেন নি।

…মার্কস পরিবারের অপর একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন হেলেন ডেমুথ। চাষির ঘরে জন্ম হয়েছিল তাঁর। শ্রীমতী মার্কসের বিয়ের বহু আগে, যখন তিনি শৈশব অতিক্রম করেছেন কিনা সন্দেহ তখন থেকেই ডেমুথ তাঁর পরিচর্যায় নিযুক্ত। তাঁর খুদে মনিবানী বড় হবার পর যখন তাঁর বিয়ে হল তখনও হেরেন তাঁর সঙ্গে রয়ে গেলেন এবং আত্মস্বার্থ সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে মার্কস পরিবারের সেবায় নিজেকে নিযুক্ত কররেন। তাঁর মনিবানী ও তাঁর স্বামী ইউরোপের যেখানে যেখানে গেছেন তিনিও তাঁদের সহযাত্রী হয়েছেন সেইখানেই আর অংশভাগ হয়েছেন তাঁদের নির্বাসিত জীবনের সকল দুঃখকষ্টের।

হেলেন ছিলেন সংসারটির ত্রাণকর্ত্রী, অত্যন্ত কঠিন অভাবের মধ্যেও উদ্ধারের একটা-না-একটা উপায় তিনি সব সময়েই খুঁজে পেতেন। একমাত্র তাঁর শৃঙখলাবোধ, মিতব্যয়িতা ও দক্ষতার কারণেই মার্কস-পরিবার কোনওদিন অন্ততপক্ষে একেবারে মোটাদাগের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব বোধ করেননি। হেলেন করতে পারতেন না হেন কাজ ছিল না। রান্নাবান্না, সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম, বাচ্চাদের পোষাক পড়ানো, তাদের জামা কাঁটছাঁট করা ও সেসব সেলাইফোঁড়াই – শ্রীমতী মার্কসের সঙ্গে তিনি ছিলেন গৃহস্থালির তত্ত্বাবধায়িকা ও সংসারের বাজার-সরকার। বস্তুত, গোটা সংসারটা পরিচালনা করতেন তিনিই।

বাচ্চারা তাঁকে মায়ের মতো ভালোবাসত আর তাদের প্রতি হেলেনের মাতৃত্বের ভাব তাঁকে সত্যিকারের মায়ের অধিকার দিয়েছিল। শ্রীমতী মার্কস তাঁকে প্রাণের বন্ধু হিসেবে গণ্য করতেন। মার্কসদের সঙ্গে যারই ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠত তাকেই তিনি নিজের মাতৃত্বসুলভ রক্ষণাবেক্ষণের অধীন করে নিতেন। এক কথায় তিনি যেন সকলের, গোটা পরিবারের মা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। মার্কস ও তার স্ত্রীর চেয়ে বেশিদিন বেঁচে ছিলেন হেলেন এবং স্থান পরিবর্তন করে এঙ্গেলসের সংসারে রক্ষণাবেক্ষণে অধিষ্ঠিত হন। বালিকা বয়স থেকেই এঙ্গেলসকে চিনতেন তিনি, তাই মার্কস পরিবারের প্রতি তাঁর অনুরাগ সম্প্রসারিত হয়ে অবশেষে এঙ্গেলসকে আশ্রয় করে।

বলতে গেলে এঙ্গেলস ছিলেন মার্কস পরিবারেরই একজন। মার্কসের মেয়েরা তাঁকে পিতৃসম জ্ঞান করতেন। তিনি ছিলেন মার্কসের ‘দ্বিতীয় সত্তা’। দীর্ঘদিন ধরে জার্মানিতে এই দুটি নাম কখনও পৃথকভঅবে উচ্চারিত হয়নি আর ইতিহাসে নাম দুটি চিরদিন সংযুক্ত থাকবে। প্রাচীন কালের কবিরা যে-সখ্যের আদর্শ চিত্রিত করে গেছেন আমাদের কালে মার্র্কস আর এঙ্গেলস ছিলেন সেই সখ্যের মূর্ত প্রতীক। তরুণ বয়স থেকে তাঁরা পরিণত হয়ে উঠেছিলেন একসঙ্গে এবং পরস্পরের সমান্তরালভাবে, মতাদর্শ ও মানস-অনুরাগের ঘনিষ্ঠ মেলবন্ধনে যাপন করেছিলেন জীবন এবং একই বৈপ্লবিক আন্দোলনের ছিলেন অংশ; যতদিন একসঙ্গে থাকতে পেয়েছিলেন, দু’জনে কাজ করেছিলেন যৌথভাবে। ঘটনাচক্রে প্রায় বিশ বছর যদি তাঁরা পরস্পরবিচ্ছিন্ন হয়ে না থাকতেন, তাহলে সম্ভবত সারা জীবনই একসঙ্গে কাজ করে যেতেন। কিন্তু ১৮৪৮ সালের বিপ্লব পরাস্ত হওয়ার পর এঙ্গেলসকে চলে যেতে হয় ম্যাঞ্চেস্টারে আর লন্ডনে থেকে যেতে বাধ্য হন মার্কস।

তবু তা সত্ত্বেও, যৌথ মানসজীবন যাপন করে চলেন দুজনে প্রায় প্রতিদিন পরস্পরকে চিঠি লেখার মধ্যে দিয়ে, রাজনৈতিক ও বিজ্ঞানক্ষেত্রের ঘটনাবলী এবং পরস্পরের রচনা সম্পর্কে মতবিনিময়ের সূত্রে। বাধ্যতামূলক কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই এঙ্গেলস ম্যাঞ্চেস্টার থেকে দৌড়ে চলে এলেন লন্ডনে, তাঁর প্রিয় মার্কসের বাসা থেকে মাত্র দশ মিনিটের পথের ব্যবধানে বাসা নিলেন। তারপর ১৮৭০ থেকে বন্ধুর মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত এমন একটি দিনও যায়নি যেদিন এই দুটি মানুষ কখনও এঁর কখনও-বা ওঁর বাড়িতে পরস্পর মিলিত হননি।

এঙ্গেলস যেদিন মার্কসদের জানালেন যে ম্যাঞ্চেস্টার থেকে পাঠ উঠিয়ে চলে আসছেন, সেটি ছিল মার্কস-পরিবারের উৎসবের দিন। তখনও পর্যন্ত অনিশ্চিত তাঁর আগমন নিয়ে পরিবারের মধ্যে কথাবার্তা চলছিল বহুদিন আগে থেকেই, আর যেদিন সত্যিসত্যিই আসার দিন এল মার্কস সেদিন এত অস্থির হয়ে রইলেন যে সারাদিন কাজই করতে পারলেন না। দুই বন্ধু সেদিন সারারাত্রি ধূমপান সহযোগে তাঁদের শেষ দেখাসাক্ষাতের পর যা-যা ঘটেছিল সে সমস্তের আলোচনা করে কাটালেন।

অন্য যেকোনও লোকের থেকে এঙ্গেলসের মতামতকে বেশি মূল্য দিতেন মার্কস, কারণ তিনি মনে করতেন এঙ্গেলসই হলেন সে-ই লোক যিনি তাঁর সহযোগী হবার যথার্থ উপযুক্ত। তাঁর কাছে এঙ্গেলস ছিলেন পুরো একটি সভার শ্রোতৃম-লীর সমতুল্য। যুক্তি-প্রমাণ প্রয়োগ করে এঙ্গেলসকে বুঝিয়ে স্বমতে আনার উদ্দেশ্যে কোনও প্রয়াসই মার্কসের কাছে অতিরিক্ত বেশি বলে গণ্য হোত না। যেমন, একটা উদাহরণ দিই। আলবিগোয়নের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় যুদ্ধ* সংক্রান্ত ব্যাপারে আলোচনার সময়ে আমার ঠিক মনে নেই কোনও একটা গৌণ বিষয়ে এঙ্গেলসের মতের পরিবর্তন ঘটানোর উদ্দেশ্যে তাঁর পক্ষে প্রয়োজনীয় একটা তথ্যের সন্ধানে মার্কসকে আমি কয়েকখানা গোটা বই বারেবারে ফিরে ফিরে পড়তে দেখেছি। মত পরিবর্তন করিয়ে এঙ্গেলসকে স্বমতে আনাটা মার্কসের পক্ষে মস্ত একটা কৃতার্থতার আনন্দের ব্যাপার ছিল।

…এঙ্গেলসের জ্ঞানের বহুমুখিতার প্রশংসা করতেন মার্কস, পাছে এঙ্গেলসের সামান্যতম কোনও বিপদ ঘটে এই ভয়ে সর্বদা তটস্থ থাকতেন। এ-প্রসঙ্গে একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘শিকারে গিয়ে কোনও বিপদ আপদ ঘটে এই ভয়ে সর্বদাই কাঁপি আমি। এত দুরন্ত স্বভাব ওর মাঠঘাটের ওপর দিয়ে রাশ আলগা করে সজোরে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে, কোনওরকম বাধার পরোয়া করে না’। যতখানি স্নেহপ্রবণ স্বামী ও পিতা ছিলেন মার্কস ঠিক ততখানিই ছিলেন শুভানুধ্যায়ী বন্ধু। তিনি যে-স্তরের মানুষ ছিলেন তার উপযুক্ত ভালোবাসার পাত্রপাত্রীও খুঁজে পেয়েছিলেন স্ত্রী ও মেয়েদের মধ্যে, হেলেন আর এঙ্গেলসের মধ্যে।

র‌্যাডিকাল বুর্জোয়ার নেতা হিসাবে সমাজ-জীবন শুরু করেছিলেন মার্কস। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা অত্যন্ত প্রবল হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল তিনি সকলের দ্বারা পরিত্যক্ত, আর যেই কমিউনিস্ট হয়ে দাঁড়ালেন অমনি আগের মিত্ররা সকলেই তাঁর শত্রু হয়ে উঠলেন। তুমুল নিন্দাবাদ ও মিথ্যা কুৎসা রটনার পর নির্যাতিন করে জার্মানি থেকে তাঁকে বহিষ্কার করে দেওয়া হল, তারপর তাঁর ও তাঁর সৃষ্টিকর্মের বিরুদ্ধে শুরু হল একেবারে চুপচাপ থাকার একটা ষড়যন্ত্র। মার্কস যে ১৮৪৮ সালের ২ ডিসেম্বরের ক্যুদেতার কারণ ও ফলাফলগুলির প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করেছিলেন ও তা উদ্ঘাটিত করে দিয়েছিলেন – এই সত্যটি যাতে প্রমাণিত হয়েছে সেই ’আঠারোই ব্রুমেয়ার’ বইটিকে চুপচাপ থেকে বেমালুম উপেক্ষা করা হল। সৃষ্টিকর্মটির জলজ্যান্ত অস্তিত্ব সত্ত্বেও একটিও বুর্জোয়া সংবাদপত্র তার উল্লেখ পর্যন্ত করল না।

অতঃপর মার্কসকে আর উপেক্ষা করা সম্ভব হল না। আন্তর্জাতিক ক্রমশ বড় হয়ে উঠতে লাগল আর তার কীর্তির গরিমায় পূর্ণ করে তুলল জগতকে। যদিও মার্কস নিজে নেপথ্যে থেকে সংগঠনে অন্যদের কাজ করতে দিতেন তবু পশ্চাদভূমির সেই আসল লোকটি যে কে তা শিগগিরিই ধরা পড়ে গেল।

জার্মানিতে সোস্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির প্রতিষ্ঠা হল এবং তা রীতিমতো এক শক্তিতে পরিণত হল, যাকে আক্রমণ করার আগে বিসমার্ক** তার প্রণয়প্রার্থনা করলেন পর্যন্ত। লাসালের*** জনৈক অনুরাগী শুভাইটসার ’পুঁজি’ বইটিকে শ্রমজীবী জনসাধারণের গোচর করার উদ্দেশ্যে পর্যায়ক্রমে কতগুলি প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন। অতঃপর, ইয়োহান ফিলিপ বেকারের উত্থাপিত প্রস্তাব অনুযায়ী আন্তর্জাতিকের কংগ্রেস থেকে গৃহীত এক নির্দেশনায় ‘শ্রমিক শ্রেণির বাইবেল’ এই আখ্যা দিয়ে ‘পুঁজি’ গ্রন্থটির প্রতি বিজ্ঞানসম্মত সমাজতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ তত্ত্ববিদ এবং প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন তিনি। ‘পুঁজি’ হয়ে দাঁড়াল সকল দেশের সমাজতন্ত্রীদের সার গ্রন্থ। সকল সমাজতন্ত্রী ও শ্রমিক শ্রেণির সংবাদপত্রে ওই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহ প্রচারিত হতে লাগল। ওই সময়ে নিউ ইয়র্কে একটা মস্ত বড় ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। সেই ধর্মঘটের সময় ‘পুঁজি’ বইটি থেকে নানা অংশবিশেষ শ্রমিকদের সহনশীলতা বাড়িয়ে তোলার ও তাঁদের দাবিদাওয়া যে কত ন্যায্য তা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে প্রচারপত্রের আকারে ছেপে প্রকাশ করা হয়।

প্রায় সব প্রধান-প্রধান ইউরোপীয় ভাষায় ‘পুঁজি’ বইটি অনূদিত হল। ইউরোপ ও আমেরিকার বিরুদ্ধবাদীরা যতবার চেষ্টা করেছে এ বইয়ের তত্ত্বসমূহ খন্ডন করতে ততবারই সঙ্গে সঙ্গে তার সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিসম্মত জবাব পেয়ে তাদের মুখ গেছে বন্ধ হয়ে। আন্তর্জাতিকের কংগ্রেস থেকে একদা যেমনটি বলা হয়েছিল ‘পুঁজি’ আজ সত্যিই তাই, অর্থাৎ ‘শ্রমিক শ্রেণির বাইবেল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

…যে অসুখে জেনি মার্কসের মৃত্যু ঘটে সেই অসুখ তাঁর স্বামীর জীবনেও ছেদ টানে। স্ত্রীর দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক রোগভোগের সময়ে রাত্রি জাগরণজনিত শ্রান্তিতে, ব্যায়াম ও মুক্ত বাতাসের অভাবে এবং মানসিক দিক থেকে জীর্ণ হয়ে গিয়ে মার্কসও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলেন। সেই অসুখই কাল হল তাঁর। ১৮৮১ সালে ২ ডিসেম্বর শ্রীমতী মার্কস প্রয়াত হলেন। যেমন সারা জীবন তেমনই মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত তিনি রয়ে গিয়েছিলেন কমিউনিস্ট ও বস্তুবাদী। মৃত্যুতে ভয় ছিল না তাঁর। যখন অনুভব করলেন যে তাঁর অন্তিম কাল উপস্থিত তখন শুধু বলেছিলেন, ‘কার্ল, আমার শক্তি ফুরিয়ে আসছে।’ এই কথাগুলিই ছিল তাঁর শেষ সুবোধ্য উক্তি। ৫ ডিসেম্বর তারিখে হাইগেট সমাধিক্ষেত্রের মন্ত্রপূত না-করা জায়গায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর ও মার্কসের জীবনযাপনের ধরনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শ্রীমতী মার্কসের অন্ত্যেষ্টির দিনটিকে সর্বসাধারণের গোচর করা হয়নি এবং কেবলমাত্র কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুই তাঁর এই শেষযাত্রায় শবানুগমন করেন। মার্কসের পুরনো বন্ধু এঙ্গেলস শ্রীমতী মার্কসের সমাধিপার্শ্বে অন্ত্যেষ্টিভাষণ দেন।…

স্ত্রীর মৃত্যুর পর মার্কসের জীবন হয়ে দাঁড়ায় একের-পর-এক শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণাভোগের এক অনুক্রম। সে-সবই বরণ করে নিচ্ছিলেন তিনি অপরিসীম বীরোচিত সহনশীলতার সঙ্গে। কিন্তু এর একবছর পর জেষ্ঠ্যা কন্যা শ্রীমতী লোঙ্গের আকস্মিক মৃত্যুতে যন্ত্রণার এই আগুন দ্বিগুণ প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল। এবার একেবারে ভেঙে পড়লেন তিনি, আর সামলে উঠতে পারলেন না।

১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ তারিখে কর্মরত অবস্থায় মহাপ্রয়াণ ঘটল মার্কসের।

*আলবিগোয়নের যুদ্ধ (১২০৯-১২২৯) – পোপের সঙ্গে মিলে উত্তর ফ্রান্সের সামন্তবর্গ দক্ষিণ ফ্রান্সের তথাকথিত ’বিধর্মী’-দের বিরুদ্ধে যে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই চালায়, দক্ষিণ ফ্রান্সের ’ আলবিগোয়নের যুদ্ধ’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে দক্ষিণ ফ্রান্সের আল্বিনগরের কারিগর ও ব্যাপারীদের স্বাধিকার বজায় রাখার সংগ্রাম প্রথাসিদ্ধ দক্ষিণ রোমান ক্যাথলিক সংস্কার বা যাজক পদসমূহের ক্রমিক শ্রেণীবিন্যাসের রীতির বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিরোধ ও সংঘর্ষের রূপ নিয়ে এই যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে প্রকট হয়।
**অটো বিসমার্ক (১৮২৫-১৮৬৪) প্রাশিয়ান রাষ্ট্রনায়ক; ১৮৭১ সাল থেকে জার্মান সাম্রাজ্যের চ্যান্সেলর।
***ফাডির্নানড লাসাল (১৮২৫-১৮৬৪) জার্মান পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী। ১৮৬৩ সালে ইনি নিখিল জার্মান শ্রমিক সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন। মার্কস ও এঙ্গেলস লাসালাবাদের সিদ্ধান্তসমূহ, কর্মনীতি ও সাংগঠনিক রীতিপদ্ধতিকে জার্মান শ্রমিক আন্দোলনে ও সোস্যাল ডেমোক্রেসির ক্ষেত্রে সুবিধাবাদ আখ্যা দিয়ে বারবার তার কড়া সমালোচনা করেন।

সাম্যবাদ এপ্রিল ২০১৮

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments