Wednesday, April 24, 2024
Homeফিচারমার্কিন দস্যুতার টার্গেট এবার ভেনেজুয়েলা

মার্কিন দস্যুতার টার্গেট এবার ভেনেজুয়েলা

venezuela_0_0
ভেনেজুয়েলার নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নির্লজ্জ তৎপরতায় তার কুৎসিত স্বৈরাচারী চেহারাটা আবার বিশ্বের সামনে বেআব্রু হল। ভেনেজুয়েলার মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন ষড়যন্ত্র চলছিলই দীর্ঘদিন ধরে। সেই ষড়যন্ত্রেরই সর্বশেষ চাল হিসাবে জুয়ান গুয়াইদো, যিনি এক সময়ে স্যাভেজ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, হঠাৎই রাজধানী কারাকাসে এক বিক্ষোভ সভায় নিজেকে ভেনেজুয়েলার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করে দেন। দু’মিনিটের মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁকে ভেনেজুয়েলার বৈধ প্রেসিডেন্ট বলে তাঁর সমর্থন ঘোষণা করেন। এবং তার দু’ঘন্টার মধ্যেই কলম্বিয়া, ব্রাজিল, পেরু প্রভৃতি ল্যাটিন আমেরিকার মার্কিন প্রভাবাধীন সাতটি দেশ গুয়াইদোকে তাদের স্বীকৃতির কথা ঘোষণা করে দেয়। বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না — এই বিক্ষোভ, গুয়াইদোর নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা এবং প্রথমে মার্কিন সমর্থন, আর তারপরই অন্য দেশগুলির সমর্থন, সবটাই একই মার্কিন ষড়যন্ত্রের অঙ্গ।

প্রেসিডেন্ট হুগো সাভেজের সময় থেকেই ভেনেজুয়েলা ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে মার্কিন প্রভাবকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীন নীতি নিয়ে চলতে শুরু করে। এতেই সে চক্ষুশূল হয় সাম্রাজ্যবাদ শিরোমণি আমেরিকার। তেল–সম্পদে ভেনেজুয়েলা বিশ্বে চতুর্থ। তেলই তার জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস। এতদিন মার্কিন ধনকুবেরদের মালিকানাধীন তেল কোম্পানিগুলিই সেখানে ‘রাজত্ব’ করত। সাভেজ সেগুলির জাতীয়করণ করে তেল থেকে আয়ের অর্থ দেশের সাধারণ মানুষের কাজে লাগাতে থাকেন। জনকল্যাণে নতুন নতুন নীতি নেন। ধনীদের উপর আয়কর চাপান। ক্ষিপ্ত হয় দেশীয় এবং মার্কিন ধনকুবেররা। শুরু হয় সাভেজ বিরোধী ষড়যন্ত্র। কিন্তু প্রবল জনসমর্থনে সেই ষড়যন্ত্র বারেবারে ভেসে যায়। স্যাভেজের এই পদক্ষেপগুলি শুধু দেশের মধ্যে নয়, আশপাশের অন্যান্য দেশেও প্রভাব ফেলছিল। স্যাভেজের মৃত্যুর পর মার্কিন শাসকরা ভেবেছিল ভেনেজুয়েলাকে এবার কব্জা করা যাবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো দেশের ভিতরে ও বাইরে ষড়যন্ত্র, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকট সত্তেও দেশের অর্থনীতিকে স্যাভেজের ধারায় এগিয়ে নিয়ে যান। জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে চালিয়ে যেতে থাকেন। দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান যতদূর সম্ভব বিনামূল্যে প্রদান করার নীতি গ্রহণ করা হয়। সম্প্রতি ভেনেজুয়েলার সরকার তেইশ লক্ষের বেশি মানুষকে ঘর তৈরি করে দিয়েছে। আরও সাত লক্ষ বাড়ি তৈরি রয়েছে যা এ বছরই বন্টন করা হবে। নিকোলাস মাদুরো প্রথম জীবনে ছিলেন একজন বাস ড্রাইভার। পরে ট্রেড ইউনিয়নে নেতৃত্ব দেন। এ বছরই জানুয়ারির শুরুতে দ্বিতীয়বারের জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট হিসাবে কার্যভার নেন। গত বছর মে মাসে এই নির্বাচনে তাঁর জয় আটকানোর জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার দেশীয় দোসররা সব রকম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। বিপুল সমর্থনে তিনি নির্বাচিত হন। আন্তর্জাতিক পরিদর্শকরা নির্বাচনকে অবাধ এবং গণতান্ত্রিক বলে সার্টিফিকেট দেয়।

গত বেশ কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় ভেনেজুয়েলার জাতীয় আয় দারুণভাবে কমে যায়। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জনজীবনে কিছুটা হলেও তার প্রভাব পড়ে। সরকার জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে ধনীদের উপর আরও কর চাপায়। ক্ষুব্ধ হয় ধনীরা। সাম্রাজ্যবাদ দেশের এই বিক্ষুব্ধ ধনীদের মধ্যে তাদের দোসর খুঁজে পায়। মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদীরা মাদুরোকে ‘অগণতান্ত্রিক’, ‘স্বৈরাচারী’ প্রভৃতি আখ্যা দিয়ে প্রচার চালাতে থাকে। অর্থনীতির সংকটে জনজীবনে যে অসুবিধাগুলি নেমে আসে সেগুলিকে অজুহাত করে এই চক্র জনগণের একাংশকে উস্কানি দিয়ে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়। মাদুরোর দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর ষড়যন্ত্র চূড়ান্ত রূপ নেয়। দেশীয় ধনকুবের, প্রাক্তন আমলা, প্রাক্তন মিলিটারি অফিসারদের একটি অংশ মার্কিন মদতে জনগণের একাংশকে নিয়ে সরকার বিরোধী বিক্ষোভে নামে। তারা সশস্ত্র অবস্থায় দোকানপাট, বাজারে, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে প্রশাসনকে উস্কানি দিতে থাকে। তাদের লক্ষ্য বিশ্বের কাছে এটা তুলে ধরা– যেন ভয়ঙ্কর কষ্টে থাকা ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমেছে এবং সরকার সেই বিক্ষোভকে নির্মমভাবে দমন করছে। সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট সংবাদমাধ্যম সেগুলিকে সাতকাহন করে প্রচার করছে। এরপরই ‘বিশ্বস্ত সূত্রে’ পাওয়া খবর উদ্ধৃত করে তারা প্রচার করতে থাকবে কত মানুষ মারা গেছে, কত জন আহত হয়েছে, পুলিশ কত মানুষকে ঘরছাড়া করেছে।

এই সব দেখিয়েই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মাদুরো নেতৃত্বকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ভেনেজুয়েলার জনগণ সাহসিকতার সাথে মাদুরো এবং তাঁর রাজত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে এবং তারা স্বাধীনতা ও আইনের শাসন দাবি করছে। তিনি ভেনেজুয়েলার ‘জনগণের’ এই ‘স্বাধীনতার লড়াইয়ে’ সবরকম সহায়তার অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স প্রচারমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন, মাদুরো শাসনে ভেনেজুয়েলার জনগণ অবর্ণনীয় দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। অথচ ভেনেজুয়েলার জনগণের জীবনে সত্যিই যদি কোনও দুরবস্থা নেমে আসে তবে তার জন্য বিশেষভাবে দায়ী মার্কিন নীতি। গত দু’বছর ধরে আমেরিকা ভেনেজুয়েলায় মারাত্মক আর্থিক অবরোধ চালাচ্ছে। তেল বিক্রিতে বাধা দিচ্ছে, ওষুধ, খাদ্যদ্রব্য সহ নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানিতে বাধা দিয়ে চলেছে।

মাদুরো সরকার সাহসিকতার সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই নগ্ন ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে যাচ্ছে। জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মাদুরো সরকারের সমর্থনে রাস্তায় নেমেছে। ট্রাম্প গুয়াইদোকে সমর্থন জানানোর সাথে সাথেই মাদুরো আমেরিকার সাথে সমস্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং অফিসারদের দ্রুত দেশ ছেড়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছে। মার্কিন স্বরাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনীকে সেখানে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে’ সমর্থনের নামে বিদ্রোহের আহ্বান জানালেও সে দেশের সেনাবাহিনী মাদুরো সরকারের উপরই তাদের সমর্থনের কথা জোরের সাথে ঘোষণা করেছে। গণতান্ত্রিক একটি দেশের নির্বাচিত সরকারের উপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এমন ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের তীব্র নিন্দা করে তাকে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছে রাশিয়া। না হলে পরিণাম ভয়ঙ্কর হবে বলে ঘোষণা করেছে। চীনও একই ভাবে মার্কিন ষড়যন্ত্রের নিন্দা করেছে। নিন্দা করেছে তুরস্ক, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া। কিউবা এবং মেক্সিকো মাদুরো সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করেছে।

দেশে দেশে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে পুতুল সরকার বসিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করার এমন সব নজির আমেরিকার রয়েছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে ইরাক এবং লিবিয়া– দুটি দেশকেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে এই আমেরিকা। মারণাস্ত্র রয়েছে এই মিথ্যা অজুহাত তুলে ইরাকের তেলসম্পদ দখল করাই ছিল তার আসল লক্ষ্য। লিবিয়ায় প্রেসিডেন্ট গদ্দাফির মার্কিন বিরোধিতা গোটা অঞ্চল জুড়ে যে সমর্থন লাভ করছিল তাকে স্তব্ধ করতে এবং অন্যদের শিক্ষা দিতে লিবিয়াকে ধ্বংস করেছে এই আমেরিকা। স্বাধীন আফগানিস্তান মার্কিন লোভে আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত। ১৯৭০–এর দশকের শুরুতে চিলির নির্বাচিত সালভাদর গুয়েলারমো আলেন্দে সরকারের পতন ঘটাতে মিলিটারি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল আমেরিকা। কারণ আলেন্দে ক্ষমতায় এসেই মার্কিন তেল কোম্পানিগুলি এবং তামার খনিগুলির জাতীয়করণ শুরু করেছিলেন। খুন হতে হয়েছিল তাঁকে। একইভাবে ভেনেজুয়েলাতেও অভ্যুত্থান ঘটাতে চাইছে আমেরিকা। তাদের লক্ষ্য চরিতার্থ করতে এবার হয়ত সরাসরি সৈন্য নামাবে আমেরিকা। ইতিমধ্যেই নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া-চীন ছাড়া অন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিকেও সঙ্গে পেয়েছে সে।

চূড়ান্ত স্বৈরাচারী এই মার্কিন আক্রমণ ঠেকাতে আজ ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষকে এক মানুষের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাদুরো সরকারের পাশে দাঁড়াতে হবে। সাথে সাথে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রপ্রিয়, স্বৈরাচার বিরোধী প্রতিটি মানুষকে ভেনেজুয়েলার উপর এই নগ্ন মার্কিন হস্তক্ষেপের তীব্র নিন্দা করতে হবে। বিশ্বজুড়ে সমস্ত স্তরের সাধারণ মানুষকে আজ দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করতে হবে, ভেনেজুয়েলার ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে সেখানকার জনগণ, কোনও রকম বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ বরদাসত করা হবে না। অন্য কোনও দেশে ‘গণতন্ত্র ফেরানোর’ দায়িত্ব আমেরিকাকে কেউ দেয়নি। আমেরিকা তার তাঁবেদারি মানতে না চাওয়া কোনও দেশের উপর ইচ্ছামতো দস্যুবৃত্তি চালাবে আর গোটা বিশ্বের সাধারণ মানুষ তা চুপচাপ মেনে নেবে– না।
[ সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া (কমিউনিস্ট), সংক্ষেপে এসইউসিআই(সি) দলের বাংলা মুখপত্র সাপ্তাহিক গণদাবী, ৭১ বর্ষ ২৫ সংখ্যা থেকে লেখাটি নেয়া ]

selected 2 copy

সাম্যবাদ এপ্রিল ২০১৯

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments