গণতন্ত্র রক্ষার কথা বলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে নির্বাচন করেছিল। কিন্তু অগণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে কোন্ ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান তারা? শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আয়োজিত জনসভায় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সে খবরটি ফাঁস করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। বেশি গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না।’ অবশ্য ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ বা উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রিত করার কথা বেশ অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। কথায় কথায় যারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বুলি আওড়ান তাদের কাছে প্রশ্ন, এদেশের মানুষ জান বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতা ও শোষণহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য — নাকি এই ‘কম গণতন্ত্রের’ জন্য?
পরাধীন আমলে সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব সরকার ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ প্রবর্তন করেছিল। এই তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে জনগণের সর্বজনীন ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছিল। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ববাংলায় ঔপনিবেশিক কায়দায় যে শোষণ-লুণ্ঠন নিপীড়নের শাসন কায়েম করেছিল — এদেশের নিপীড়িত জনগোষ্ঠী যেন তাদের বিরুদ্ধে রায় দিতে না পারে সে জন্যই গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছিল। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সেদিন রুখে দাঁড়িয়েছিল বাংলার মানুষ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তারা অকাতরে জীবন দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের এই আকাঙ্খার সাথে, চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শাসকগোষ্ঠী দেশ পরিচালনা করে আসছে।
নব্বই পরবর্তী সময়ে ভোটের যে অধিকারটুকু ছিল, গত নির্বাচনে তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে। মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা নেই, গুম-খুন-ক্রসফায়ার লাগাতার বাড়ছে, মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে — অর্থাৎ রাষ্ট্র সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে ক্রমাগত আরও ফ্যাসিস্ট চেহারায় আত্মপ্রকাশ করছে। উন্নয়নের জিকির তুলে এভাবেই গণতান্ত্রিক অধিকারকে করা হচ্ছে সংকুচিত। উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একটিকে অপরটির বিপরীতে দাঁড় করিয়ে পুঁজিবাদী শোষণের চাপে পিষ্ট অসহায় জনগণকে মিথ্যে স্বপ্নের প্রলোভন দেখিয়ে জনসমর্থনের পাল্লা ভারী করতে চাইছে। একশ্রেণীর পোষা বুদ্ধিজীবীও ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’, ‘উন্নতি চাইলে গণতন্ত্রকে সীমিত করতে হবে’ — এই ধারণার পক্ষে তাত্ত্বিক ভিত্তি জোগাচ্ছেন, জোরালো মত প্রচার করছেন।
আর এক্ষেত্রে তারা মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশের উদাহরণ সামনে নিয়ে আসছেন। যে সব দেশ দীর্ঘদিন সামরিক সরকার বা একদলীয় সরকারের অধীন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যেও সেই অভিলাষ উচ্চারিত হয়েছে, ‘মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ যে পথে এগিয়ে গেছেন, বাংলাদেশেও শেখ হাসিনা সে পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই গণতন্ত্র আমরা মেনে চলব।’ পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে, মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ায় একটানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন এবং ১৩টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত যে ফ্রন্টকে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, এখনো সেই ফ্রন্টের শাসন অব্যাহত আছে। তথাকথিত উন্নয়নের মালয়েশিয়ান মডেল যদি এখানে প্রয়োগ করা হয় তার সহজ মানে দাঁড়াচ্ছে, ৫ জানুয়ারি এখানে গণতন্ত্রের অবশিষ্টাংশ তারও কবর খুঁড়ে যে একদলীয় শাসন কায়েম হয়েছে তা দীর্ঘতর হবে, সহজে এই ফ্যাসিবাদী সরকারের নাগপাশ থেকে জনগণের মুক্তি নেই। কেন এই পরিণতি?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের প্রথমে বোঝা দরকার, উন্নয়নের মালয়েশিয়ান মডেল কি, বাংলাদেশেই বা শাসকদের এর দরকার কেন? মালয়েশিয়ার অর্থমন্ত্রণালয়ের মহাসচিব মোহাম্মদ ইরওয়ান সেরিগার আবদুল্লাহর সাক্ষাতকারের একটি ছোট্ট কথায় মালয়েশিয়ান মডেলের মূল কথাটি ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন, ‘একটি বড় গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে দেশটির অর্থনীতিতে। মালয়েশিয়া একটি সরকারি ব্যবস্থাপনাভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বেসরকারি খাত নির্ভর বাজারে পরিণত হয়েছে। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন মডেলটির প্রধান আকর্ষণই এখানে।’ ১৯৭৮ সালে মাহাথির মোহাম্মদ শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনা ও বিনোয়োগকারীদের সর্বাধিক সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেন। ’৮১ সালে প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের পর সরকারি সংস্থাগুলোর দ্রুত বেসরকারিকরণ করেন। এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বেসরকারি বিনোয়োগকে উৎসাহিত করেন। প্রধানত সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক পুঁজির অবাধ শোষণ-লুণ্ঠন নিশ্চিত করার জন্যই এই নীতি গ্রহণ করা হয়। দেদারছে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ায় এসময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫ হাজারের মতো কোম্পানি তাদের প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র ও বিতরণকেন্দ্র মালয়েশিয়ায় স্থাপন করে। ফলে অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিখাত ও বৈদেশিক বিনোয়োগের মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়ায় একচেটিয়া পুঁজিপতিশ্রেণী শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সুরম্য অট্টালিকা, আলো ঝলমলে নগরীর যে চিত্র আমরা দেখি তা এই পুঁজির প্রয়োজনেই সৃষ্টি।
কিন্তু এই আলোর নিচেই আছে অন্ধকার। আমেরিকান জরিপ সংস্থা ভেরিটে’র তথ্যমতে, মালয়েশিয়ায় ইলেকট্রনিকস শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের দাসের মতো খাটানো হয়। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের ২০১৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পৃথিবীর মাঝে সবচে খারাপ শ্রমপরিবেশের দেশগুলোর যে তালিকা প্রস্তুত করেছে, তার মাঝে মালয়েশিয়া অন্যতম। মালয়েশিয়াই সবচেয়ে বেশি অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়োগ করছে। শুধু তাই নয়, নানান প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া সরকার বৈধ শ্রমিকদের চেয়ে অবৈধ শ্রমিকদের নিয়োগে পরোক্ষভাবে উৎসাহ প্রদান করছে। শ্রমিকদের অমানুষিক পরিশ্রমের ফল উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করেই তথাকথিত প্রবৃদ্ধি অর্জন। সেদেশের মাথাপিছু আয় ৬ হাজার ৭০০ ডলারে উন্নীত হয়। সুরম্য অট্টালিকা, আলোর রোশনাই, প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা প্রচারিত হলেও এর পেছনে লুকিয়ে থাকা শ্রমিকদের রক্ত ঘাম আর চোখের জলের ইতিহাস বিশ্বের কাছে থাকে গোপন। এই শোষিত শ্রমিকরা যেন অন্যায় অমানবিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে না পারে, সংঘবদ্ধ হতে না পারে, পুঁজিপতিদের অবাধ শোষণ যাতে বিঘ্নিত না হয় সে জন্যেই মিছিল, সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করা, গণতন্ত্রকে সীমিত করা হয়। ফলে এই যে আপাত স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা এর পেছনে আছে একচেটিয়া পুঁজির নির্মম শোষণের ইতিহাস।
এ-হেন প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি তথা উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে শুনিয়েই বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার এদেশে ফ্যাসিবাদী শাসনের ভিত পাকা করছে। যে উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র ছাড় দিতে বলা হচ্ছে কোথায় সেই উন্নয়ন? কিছু অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে। এগুলো দেখেই অনেকে ভাবছেন দেশ বুঝি উন্নয়নের জোয়ারে সত্যিই ভেসে গেল! কিন্তু আমরা কি জানি, যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে, তার কারণে প্রতিবছর জনগণের কাঁধেই শেষপর্যন্ত বাড়ছে করের বোঝা। রাষ্ট্রীয় খাতে সীমাহীন দুর্নীতির কথা নাই বা বলা হলো। বাজেটের আয়তন বাড়ছে কিন্তু জনগণের জীবনে তার সুফল কই? বেকারীর ভয়াবহতা এতদিন অন্ধকারে ছিল, আজ আমরা সবাই জানি কি বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পথে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কতজন সাগরে ডুবে মরেছে, কতজনের গণকবর হয়েছে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে। খাবার জোগাড় করতে না পারায় মা তার সন্তানকে বিক্রি করে দিচ্ছে, হাজার হাজার মানুষ ভিক্ষার জন্য হাত পাতছে, কত নারী অভাবের তাড়নায় দেহবিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে — এই তো আমাদের দেশ আর এই তো শাসকশ্রেণীর উন্নয়নের নমুনা।
এ যুগের অন্যতম মার্কসবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ আজকের দিনে পুঁজির চরিত্র ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, “পুঁজিবাদী অর্থনীতি, যা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মূল বনিয়াদ, তা পরিচালিত হয় সর্বোচ্চ মুনাফালাভের মৌলিক নিয়মের ভিত্তিতে। পুঁজিবাদী সমাজের উপরকাঠামোটির উদ্দেশ্য তাই সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের এই নিয়মকে সবচেয়ে কার্যকরীভাবে রূপায়িত করা। কিন্তু এই নীতিকে কার্যকরী করবার মতো পরিস্থিতি সবসময় একইরকম থাকে না, ফলে পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুঁজিপতিশ্রেণীকে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের নিয়মটি যাতে সবচেয়ে কার্যকরীভাবে রূপায়িত হয়, তা সুনিশ্চিত করার জন্য উপরকাঠামো, তার অর্থনৈতিক সংগঠনের রূপ ও রীতিনীতি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনযন্ত্র ইত্যাদিতে পরিবর্তন করতে হয়। … বুর্জোয়া অর্থনীতির বিকাশের জন্য সেই সময় প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন ছিল শান্তি ও অবাধ প্রতিযোগিতার অবস্থা বজায় রাখা। সেই সময় পার্লামেন্ট ছিল আদর্শ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যা বুর্জোয়াদের এইসব প্রয়োজন মেটাতে পারত। একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে অবাধ প্রতিযোগিতার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় একচেটিয়া পুঁজিবাদ এবং শান্তির জায়গায় সামরিকতন্ত্র। পার্লামেন্ট, যা অতীতের বুর্জোয়া অর্থে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অবাধ প্রতিযোগিতার ফোরাম, তা বর্তমান সময়ে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের কাছে, ধীরে ধীরে তার সময়োপযোগিতা হারাচ্ছে। ফলে বুর্জোয়াদের কাছে পার্লামেন্ট দ্রুত তার উপযোগিতা হারাচ্ছে এবং ফ্যাসিবাদ নানারূপে পুঁজিবাদী দেশগুলির রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রশাসনিক যন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ করছে।” মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশ — সর্বত্র এই জিনিসটিই আমরা দেখতে পাচ্ছি।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলতে হয়, উন্নয়ন কখনোই শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন হতে পারে না। অর্থনীতির সাথে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক উন্নতি মিলেই উন্নয়ন। ফলে রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করে, প্রতিদিন মানুষের রুচি-সংস্কৃতির মান নিচে নামিয়ে — একটা সমাজের উন্নয়ন বা অগ্রগতি ঘটে না, বরং তা এযাবৎ মানবসভ্যতার অর্জিত মূল্যবোধগুলোকেই পদদলিত করে। এই মূল্যবোধকে পদদলিত না করে আজকের দিনে শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা যায় না, লুটপাট করা যায় না। এই লুটপাট ও পুঁজিবাদী শোষণের মধ্য দিয়ে বিগত ৪৪ বছরে এদেশেও একটি একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। একচেটিয়া এই পুঁজির শোষণের পথকে নিষ্কণ্টক করতেই শাসকশ্রেণী ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়নে’র শ্লোগান তুলছে। তাই বিভ্রান্ত্রির চোরাবালিতে পথ না হারিয়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে একে বিচার করে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।