করোনা মহামারির পর থেকেই মানুষের আয় ও সঞ্চয় কমে গেছে, তা এখনও অনেকেই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দেশের ৩৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবারগুলো খাবারের ব্যয় কাঁটছাঁট করেছে ৪৩%। টিসিবির ট্রাকের সামনে বাড়ছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের ভীড়। কিন্তু ব্যয় কাঁটছাঁট করেও সামালানো যাচ্ছেনা প্রতিদিনের জীবন।
এরমধ্যেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। ‘ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)’-এর হিসাব বলছে, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ঢাকার বাজারে চিনির কেজিপ্রতি দর ছিল ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা। এখন তা ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। শুধু চিনি নয়; চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, মসলাজাতীয় পণ্য, দুধ, ডিম, মাংস, সাবান, টুথপেস্ট- প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি উঠেছে ১০ শতাংশের উপরে। সরকারের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির হিসাবে, বিগত ৫ বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৫৬ শতাংশ আর খোলা আটার দাম বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। ২০২০ সালের মার্চ মাসে এক কেজি মোটা চালের দাম ছিল গড়ে ৩১.৪৬ টাকা আর ২০২৪ সালের মার্চে সেই চালের দাম দাঁড়িয়েছে গড়ে ৫০-৬০ টাকা।
সরকারের দায়িত্ব অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা হামেশাই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে দু’চার সবক দেন। কখনো আশার কথা শোনান, কখনো অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। কোন মন্ত্রী মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সিণ্ডিকেটের হাত দেখেন, আর কেউ দেখেন বিএনপির দায়। সিন্ডিকেট আর ক্ষমতাবহির্ভূত বিএনপি যদি এতই শক্তিশালী হয়ে থাকে তাহলে সরকারে থেকে তাদের কাজ কী? আর সিণ্ডিকেটের কারণে দাম বাড়ছে কথা সত্য হলেও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারছে না কেন সরকার? নাকি সরকারই এ সিণ্ডিকেটের পৃষ্ঠপোষক?
সরকারের নীতি ও সিন্ডিকেট তোষণই মূল্যবৃৃদ্ধির জন্য দায়ী
সিণ্ডিকেটের ঘাড়ে সমস্ত দায় চাপিয়ে সরকার নিস্তার পেতে চাইলেও বাস্তবে খোদ সরকারই মূল্যবৃদ্ধির হোতা। গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানির মূল্য বাড়াচ্ছে কোন সিণ্ডিকেট? মূল্য সমন্বয়ের কথা বলে পূর্বে মাঝে মাঝে গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতো। গত মার্চে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় এখন থেকে বাজার দর অনুযায়ী এগুলোর দাম নির্ধারিত হবে এবং প্রতি মাসে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে তা সমন্বয় করা হবে। এই সমন্বয়ের অর্থ প্রতিমাসে মূল্যবৃদ্ধি হবে। ইতোমধ্যে তা ফলতে শুরু করেছে। ৩০ এপ্রিল ভোক্তা পর্যায়ে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে ডিজেল ও কেরোসিন লিটারপ্রতি ১০৬ টাকা থেকে ১ টাকা বৃদ্ধি করে ১০৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পেট্রলের বিদ্যমান মূল্য ১২২ টাকা থেকে ২ টাকা ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১২৪ টাকা ৫০ পয়সা এবং অকটেনের বিদ্যমান মূল্য ১২৬ টাকা থেকে আড়াই টাকা বাড়িয়ে ১২৮ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
একই দিন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিদ্যুতকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের নতুন দর ঘোষণা করে। সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প-কলকারখানায় ব্যবহৃত ক্যাপটিভ বিদ্যুতের (শিল্প-কারখানার গ্যাসভিত্তিক নিজস্ব বিদ্যুতকেন্দ্র) গ্যাসের দাম প্রতি ঘন মিটারে ৭৫ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ আরো বাড়বে। ব্যয় বাড়বে শিল্প-কারখানার পণ্য উৎপাদনেও। ফলে সিন্ডিকেট ছাড়াও বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানিখাতে ভর্তুকি থেকে সরে আসার সরকারি নীতির কারণে দাম বাড়ছে।
আমদানির খরচ বাড়ার কারণে নয়, সিণ্ডিকেটের কারণে মূল্য বাড়ছে
অনেকেই বলে থাকেন আমদানি খরচ বাড়ছে বলেই মূল্য বাড়ছে। একথাও সর্বাংশে সত্য নয়। বিশ্ববাজারের বাড়তি দামের অজুহাতে এখানে দাম বাড়ে কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম যখন কমে তখনও এদেশে দাম বাড়তে থাকেÑ এই সত্য কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না? যেমন- বাংলাদেশে আটার দাম এখনও বাড়ছে অথচ বিশ্ববাজারে ক্রমাগত কমছে। বিশ্ববাজারে গমের দাম ২০২৩ সালের মার্চের চেয়ে কম। বাংলাদেশে দুটো দেশ অর্থাৎ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করা হয়। ২০২০ সালের মার্চে রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত প্রতি টন গমের দাম ছিল ২১৪ ডলার। আর ২০২৪ সালের মার্চে প্রতি টন গমের দাম ২০৪ ডলার। (২২ এপ্রিল, ২০২৪, দৈনিক প্রথম আলো)
বাংলাদেশে সয়াবিন তেল আমাদানি করা হয় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ১ হাজার ৪১১ ডলার। অন্যান্য খরচ যুক্ত করেও সেই তেল প্রতি লিটার বর্তমানে বাজারে ১৫২ টাকায় বিক্রি সম্ভব। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ১৭৩ টাকায়। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। ৮-১০টি পরিশোধন কারখানা নিয়ন্ত্রণ করে চিনির বাজার। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড এ পাঁচটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে ভোজ্য তেলের বাজার। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণত কুষ্টিয়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের ১২-১৫ জন বড় চালকল মালিক। প্রশ্ন হলো, আওয়ামীলীগ সরকার এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে না কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বড় কঠিন নয়। সবাই জানে যে, বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় এই সরকার পর পর তিনবার বিনা ভোটে ক্ষমতার মসনদে আসীন। ফলে তারা নাখোশ হবে, এমন পদক্ষেপ গ্রহণের সামর্থ্য কি আওয়ামী লীগ সরকারের আছে? নাকি সেই নৈতিক জোর আছে? সরকার ও বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পরস্পর বন্ধু। যা কিছু হচ্ছে তা পরষ্পরের যোগসাজশেই হচ্ছে। তাই আমাদের দেশের জনসাধারণকে বুঝতে হবে, যে সমাজে উৎপাদনের লক্ষ্য সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন, সেখানে তীব্র গণআন্দোলন না থাকলে মূল্যবৃদ্ধি লাগামছাড়া হতে বাধ্য। এজন্যই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার যাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়, সেজন্য চাই ভুক্তভোগী জনগণের সংগঠিত গণআন্দোলন। মূল্যবৃদ্ধির লাগামহীন খড়গ থেকে নিজেদের বাঁচাতে হলে, না খেয়ে বা আধপেটা খেয়ে, কোনরকম সয়ে সয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলতে না চাইলে- সে আন্দোলনে আজ সবাইকে সামিল হতে হবে।