দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়
প্রায় বছরখানেক ধরে সবধরনের চালের দাম স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। মোটা চালের দাম ৫০ টাকার উপরে। এমনকি চালের ভাঙা অংশ, যা খুদ নামে পরিচিত, তারও কেজি ৫০ টাকা। মানুষের প্রধান খাদ্য চাল কিনতে নাভিশ্বাস উঠেছে নিম্ন আয়ের মানুষের। চালের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে বাড়তে দামের সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে পেঁয়াজ। খানিকটা কমলেও এখনও বাজারে ৭০/৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। ভরা মৌসুমে কোনো সবজিই মিলছে না ৫০ টাকার নীচে। এক কথায় প্রধান প্রধান খাদ্য পণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
ঢাকাসহ শহুরে মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে বছরের শুরুতে বাসা ভাড়ার লাগামহীন বৃদ্ধিতে। এমনকি মোটর সাইকেল ও গাড়ি রাখার গ্যারেজ ভাড়াও বাড়িয়েছে মালিকরা। জীবনযাত্রার ব্যয়ে ও পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণ গুমড়ে কাঁদলেও সরকারের মূল্যস্ফীতির খতিয়ানে সেই চিত্রের দেখা মিলছে না। বরং বাজারের ঠিক উল্টো চিত্র মূল্যস্ফীতির সূচকে। বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য উপাত্তের।
সাধারণভাবে মূল্যস্ফীতি দুইভাবে পরিমাপ করা হয়। একটা হচ্ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি — যেখানে চাল, তেল, আটা, পেঁয়াজ, মাছ-মাংসসহ ৪০টির বেশি খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির হিসাব করা হয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতির সব পণ্যের মধ্যে চালের অবদান বেশি, যা পরিসংখ্যানের ভাষায় ‘ওয়েট’ নামে পরিচিত। আরেকট হলো খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বা নন ফুড ইনফেশন। যেখানে বিবেচনায় নেয়া হয় পোশাক, বাড়ি ভাড়া, আসবাবপত্র, স্বাস্থ্য, বিনোদন ও পরিবহন খরচ। খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত দুটোর গড় করে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয়। গেল এক বছরে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লেও মূল্যস্ফীতি ঘুরে ফিরে ৫ দশমিক ৬ ভাগের মধ্যেই আটকে ছিল। কিন্তু, সব কিছুর মূল্যবৃদ্ধির পরও কেন মূল্যস্ফীতি সূচকে তেমন কোনো হেরফের হয়নি? এখানে ফাঁকিটা হলো বিবিএসের হিসেবে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি আগের তুলনায় অর্ধেকের কম দেখানো হয়েছে। একইভাবে পোশাক, স্বাস্থ্য ও বিনোদনের খরচ বৃদ্ধির হারও কমিয়ে দেখানো হয়েছে। আমাদের আলোচনায় দেখা যাবে কীভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতিতে সাধারণ মানুষকে দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্রের কাতারে নিয়ে যাচ্ছে।
মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ে পুরো অর্থনীতিতে, বাড়তি চাপ পড়ে সব শ্রেণির মানুষের উপর। মানুষের পণ্য সামগ্রী কেনার মতা কমে যায়। ধরা যাক, বর্তমান মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ, অর্থাৎ আগে যে পণ্যটির দাম ছিল ১০০ টাকা, সেই পণ্যটি এখন কিনতে হবে ১১০ টাকায়। একই পরিমাণ টাকা দিয়ে আগের চেয়ে কম জিনিস কিনতে হবে। বিপরীতে সবার আয় তো আর সমানভাবে বাড়ে না। কিন্তু, মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ে সমানভাবে। এতে করে, বেশি বিপাকে পড়তে হয় ধরাবাঁধা আয়ের মানুষকে। সংসার চালাতে সঞ্চয় করার মতা হারিয়ে ফেলে সাধারণ মানুষ। মূল্যস্ফীতির কারণে পরিবহনসহ সব ধরনের সেবা পেতেই গুণতে হয় বাড়তি টাকা। ফলে সঞ্চয় যখন থাকে না, তখন পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা বা শিার খরচ অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে আর কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। বাধ্য হয়ে তাদের ধার দেনা করে বাড়তি খরচ মেটাতে হয়। আর ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে স্থায়ী সম্পদ বিক্রি করার বিকল্প থাকে না। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে জায়গা-জমি বিক্রি করতে করতে ভূমিহীন হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে বেশির ভাগ সম্পদ ক্রমান্বয়ে চলে যাচ্ছে অল্প সংখ্যক ধনীদের কাছে। ফলে মূল্যস্ফীতির দীর্ঘমেয়াদী পরো প্রভাব আছে জাতীয় জীবনে।
বর্তমান সরকারের টানা দুই মেয়াদে উন্নয়নে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনার কথা হরদম বলছেন মন্ত্রী-এমপিরা। তারপরও দেশের মোট জনগোষ্ঠীর সাড়ে ১২ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। অর্থাৎ ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে আড়াই কোটি মানুষই অতি দরিদ্র, যাদের দৈনিক রোজগার গড়ে ১০০ টাকার কম। এই বছরে আরও বেশি মানুষ যোগ দেবে হতদরিদ্রের তালিকায়। এ বছরের ভয়াবহ বন্যায় চোখের নিমেষে সহায়-সম্বল সবকিছু হারিয়ে পথে বসেছেন সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজারসহ হাওর অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। একইভাবে দিনাজপুর, রংপুর, গাইবান্ধাসহ উত্তরের প্রায় ৮ জেলার মানুষও এ বন্যায় ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
বন্যার ধকল কাটতে না কাটতে মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে আঘাত হেনেছে প্রচন্ড ঠান্ডা। তাপমাত্রা নামতে নামতে ২.৬ পর্যন্ত নেমেছিল। হাড় কাঁপানো ঠান্ডার সাথে ঘন কুয়াশার কারণে দিনের পর দিন কাজ করতে পরেনি দিনমজুর, রিক্সা-ভ্যানচালক, কৃষি শ্রমিকসহ শ্রমজীবী মানুষ। শীত ও ঘন কুয়াশার প্রকোপে সবজি, বীজতলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোথাও কোথাও। পরপর কয়েকটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১০/১২টি জেলার কয়েক কোটি মানুষ দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রে। এ কারণেই বছর শেষে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা।
তবে সরকারের মন্ত্রী ও সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের মতো অনেকেই হয়তো ভাবছেন বন্যা-শীতসহ এসব প্রাকৃতিক বিষয়, যার উপরে মানুষের হাত নেই। সরকারই বা কী করবে? কথাটা যে সত্য নয়, তা গণমাধ্যমগুলো হাওর দুর্যোগের সময় বার বার তুলে ধরেছে। কীভাবে বছরের পর বছর হাওরে অঞ্চলে বন্যা ঠেকানোর বাঁধগুলো সংস্কার না করে বরাদ্দকৃত শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছে সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও তাদের মদদপুষ্ট ঠিকাদাররা। ত্রাণ বিতরণের নামে বিরামহীন লুটপাট ও অনিয়মের ভুরি ভুরি অভিযোগ ছিল সবখানেই। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে, অন্যদিকে এই দুর্যোগই সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করছে।
২০১০ সাল থেকেই টানা ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। তারা বলছে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি। কিন্তু, তার ফলাফল মানুষের জীবনে কোথায়? তাহলে এত এত উন্নয়নের সুফল যাচ্ছে কোথায়? স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, সরকারের এই উন্নয়ন দর্শন বেশিরভাগ মানুষকে ক্রমাগত নিঃস্বকরণের প্রক্রিয়ায় গুটিকয়েক মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড় সৃষ্টি করছে। এমন উন্নয়ননীতি দিয়ে আর যাই হোক টেকসই উন্নতি সম্ভব নয়, লুটপাট করার অবারিত সুযোগ তৈরি ছাড়া।