সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে আক্রান্ত এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন
সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর চরিত্র উদঘাটন, প্রশাসনের ভূমিকা পর্যালোচনা এবং হামলার সাথে যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের রাজনৈতিক চরিত্র উন্মোচন ও করণীয় নির্ধারণের জন্য গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক ও ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে বাম মোর্চার প্রতিনিধি দল যশোরের অভয়নগর চাঁপাতলা এবং দিনাজপুরের সদর উপজেলার করনাই অঞ্চল পরিদর্শন করেন। পরিদর্শক দলে আরও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বাসদ কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য ফিরোজ আহমেদ, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন নান্নু, অধ্যক্ষ আফসার আলী, সন্তোষ গুপ্ত প্রমুখ। এছাড়া যশোর ও দিনাজপুরের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এই সফরে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলকে সহযোগিতা প্রদান করেন।
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস উপদ্রুত যশোরের মালোপাড়া ও দিনাজপুরের করনাই গ্রাম পরিদর্শন শেষে গত ১৫ জানুয়ারি সকালে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার নেতৃবৃন্দ ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের অভিজ্ঞতা এবং দাবিনামা তুলে ধরেন। নেতৃবৃন্দ বলেন, অভয়নগরের মালোপাড়ায় নির্বাচনের দিন হামলা একবার না, তিন তিন দফায় ঘটে। প্রথম দু’বার তারা প্রতিহত করেছিলেন দুর্বৃত্তচক্রকে। একইসাথে বারংবার আবেদন জানিয়েছেন প্রশাসনের কাছে, তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য। কর্ণপাত করা হয়নি। এলাকাবাসী বরং অভিযোগ করেছেন ফায়ারব্রিগেড আর নিরাপত্তা বাহিনীর একাধিক গাড়ি তাদের গ্রামের কাছাকাছি এসেও থেমে গিয়েছে, ফিরে গিয়েছে। জামায়াত-শিবির ও বিএনপির ক্যাডাররা যে এই হামলায় প্রধান ভূমিকা রেখেছে, সেটা নিয়ে এলাকাবাসীর কোনো সংশয় নেই। কিন্তু তাদের প্রশ্ন, প্রশাসন কেন নীরব ছিল? কেন তারা আক্রান্ত মানুষজনকে সাহায্য করতে যায়নি? এলাকাবাসী কারও নাম প্রকাশে আগ্রহী নয়, যদিও অনেকেই তাদের ‘মুখচেনা’। এই আতঙ্কের কারণ সহজেই অনুমেয়। জামাত হোক, বিএনপি হোক, আওয়ামী লীগেরই কেউ হোক – মালোপাড়ার মানুষেরা তাদের হিংস্র প্রতিবেশীকে চটাতে চান না।
বাম মোর্চার নেতৃবৃন্দ ১৩ জানুয়ারি দিনাজপুরের সদর উপজেলার করনাই, তেলিপাড়া ও মধ্যপাড়ায় সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বসতিগুলোতে যান। সেখানকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নেতৃবৃন্দ বলেন, নির্বাচনের দিন সেখানে দিনব্যাপী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এরই পাশাপাশি এখানে চলে পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক হামলা। শুরুতে কয়েকবার গ্রামবাসী হামলা প্রতিরোধ করলেও নির্বাচন বিরোধী স্থানীয় জামায়াত-শিবির ও বিএনপির কর্মীরা মুসলমানদের ওপর হামলার গুজব রটিয়ে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষকে মোবাইলে ডেকে আনে এবং ওই তিনটি হিন্দু অধুষ্যিত গ্রামে হামলা চালায়। এখানেও আক্রান্ত মানুষেরা বারংবার প্রশাসনের সহায়তা চেয়ে পাননি। প্রশাসনের লোকজন ভোটকেন্দ্র ১টার মধ্যে বন্ধ করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।
দিনভর হামলার সময়ে প্রশাসন কোনো সহায়তা না করলেও রাতের বেলা স্থানীয় প্রশাসন নিকটবর্তী মহাদেবপুর গ্রামের মুসলমান অধ্যুষিত পাড়ায় হামলা চালায়। এলাকাবাসী অভিযোগ করেন দিনাজপুর শহরের যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল। সুনির্দিষ্ট অপরাধী ও সাম্প্রদায়িক হামলার উস্কানিদাতা ও মদদদাতাদের গ্রেফতার করার বদলে এই রকম নির্বিচার হামলা, ভীতিপ্রদর্শন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিভাজনকে আরও গভীরতরই করেছে। প্রশাসনের ভূমিকায় মনে হয়েছে তারা আতঙ্ক ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে স্থায়ী চেহারা দেয়ার নীতিই গ্রহণ করেছেন। বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত এলাকায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য এটা করা হলেও এর ফলে শেষপর্যন্ত হিন্দু জনগোষ্ঠীই বিদ্বেষের শিকার হবেন।
নেতৃবৃন্দ বলেন, সর্বশেষ নির্বাচনোত্তর সাম্প্রদায়িক হামলার সরকারী দল সমর্থকেরা তাদের পুরো আলোচনার কেন্দ্রে রাখছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বিএনপি-জামায়াতের হামলা, যদিও যশোরের অভয়নগরের বিজয়ী সরকার দলীয় সংসদ সদস্য প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন ওই হামলায় আওয়ামী লীগেরই পূর্বতন সংসদ সদস্য ও হুইপ ইন্ধন জুগিয়েছেন। রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় একই দৃশ্য আমরা দেখেছি, আমরা দেখেছি সাঁথিয়াতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীর পাশে হামলাকারীদের ভীড়। জামায়াত-শিবির হামলার প্রধান অভিযুক্ত হলেও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না এই হামলা ঠেকাবার দায়িত্ব কার ছিল, সেই প্রশ্নটি। কেন থানা থেকে অদূরেই শত শত ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়? টিভিতে তা প্রায় লাইভ দেখানো হয় অথচ পুলিশ খবর পায় না! স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল নাগরিকদের রক্ষা করা। সেটা করতে তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে, এটা আড়াল করার কোনো উপায় নেই।
বাম মোর্চার পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয় :
১. অবিলম্বে ইতিপূর্বে সংঘটিত সকল সাম্প্রদায়িক হামলার তদন্ত ও বিচার করে আক্রমণের সাথে যুক্ত এবং মদদদাতাদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার ও বিচার করতে হবে।
২. সাম্প্রদায়িক হামলাকে সাধারণ ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা চলবে না। সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য প্রণোদিত যে কোনো হামলা, উস্কানি, বক্তব্যকে চিহ্নিত করার জন্য পৃথক আইন প্রণয়ন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক হামলার বিচারের জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।
৩. সাম্প্রদায়িক আইন, বিধি এবং ঘটনাসমূহকে পর্যালোচনা করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য একটি সাংবিধানিক সংস্থা গঠন করতে হবে। শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে নিয়োগ পর্যন্ত সর্বত্র সাম্প্রদায়িক বৈষম্য ও বিভাজনের সংস্কৃতিকে চিহ্নিত ও সুনির্দিষ্ট করে সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৪. সাম্প্রদয়িক সহিংসতা মোকাবেলাকে অগ্রাধিকারমূলক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করতে হবে। সাম্প্রদায়িক যে কোনো হামলাকে আগাম অনুমান ও যথাসম্ভব দ্রুত মোকাবেলা করতে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার এবং শুধু প্রশাসনিক শাস্তি নয়, প্রয়োজনে কর্তব্যে অবহেলার দায়ে আদালতে হাজির করার বব্যস্থা করতে হবে।
৫. জামায়াত-শিবিরসহ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরোধিতাকারী ও যুদ্ধাপরাধের সাথে যুক্ত দলগুলোর রাজনীতি করার অধিকার নিষিদ্ধ করতে হবে। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সাথে যুক্ত সকলের দ্রুত বিচার সম্পন্ন কর।
৬. সংবিধান থেকে সকল সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক অনুচ্ছেদসমূহ বাতিল করতে হবে। অর্পিত সম্পত্তি আইনের জটিলতা দূর করে প্রকৃত মালিকদের তা বুঝিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে।