প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আমি আমার জীবন শুরু করি প্যারিসে, একজন আলোকচিত্র শিল্পীর পরিমার্জনাকারী এবং ‘চাইনিজ অ্যান্টিকুইটিজ’-এর (ফ্রান্সে তৈরি!) চিত্রকর হিসেবে। আমি তখন প্রচারপত্র বিলি করতাম, যাতে ভিয়েতনামে ফ্রেঞ্চ ঔপনিবেশিকদের কৃত অপরাধের সমালোচনা লেখা থাকত।
সেসময় আমি অক্টোবর বিপ্লবকে সমর্থন করেছিলাম প্রবৃত্তিগতভাবে; তখনো তার সব ঐতিহাসিক গুরুত্ব আমার বুঝে ওঠা হয়নি। আমি লেনিনকে ভালবেসেছিলাম ও তাঁর প্রশংসা করেছিলাম কারণ তিনি ছিলেন একজন মহান দেশপ্রেমিক, যিনি তাঁর দেশবাসীকে স্বাধীন করেছিলেন। তখনো আমি তাঁর লেখা কোনো বই পড়িনি।
ফরাসি সমাজতান্ত্রিক পার্টিতে আমার যোগ দেওয়ার ফলে, আমার কমরেড, সেই ‘ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোকেরা’Ñ আমার প্রতি ও নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। কিন্তু আমি বুঝতামই না সংগঠন কী, শ্রমিক ইউনিয়ন কী, সমাজতন্ত্র কী বা সাম্যবাদই বা কী!
সমাজতান্ত্রিক পার্টির সব শাখায় তখন উত্তপ্ত একটি আলোচনা চলছিল এই প্রশ্নে যে, সমাজতান্ত্রিক পার্টির কি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকেই থাকা উচিত নাকি একটি ‘আড়াই আন্তর্জাতিক’ তৈরি করা দরকার, নাকি লেনিনের তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সাথে যুক্ত হওয়া উচিত? আমি প্রত্যেকটা সভায় গিয়েছি, সপ্তাহে দু’বার অথবা তিনবার এবং মনোযোগী হয়ে শুনেছি সব আলোচনা। প্রথমে আমি ধারাবাহিকভাবে বুঝিনি। কেন ওই আলোচনাগুলো এত উত্তপ্ত হয়ে উঠত? দ্বিতীয় হোক, আড়াই হোক বা তিন, যে আন্তর্জাতিকই হোক না কেন, বিপ্লব তো হবেই। তাহলে এত কথা কাটাকাটি কেন? প্রথম আন্তর্জাতিকের থেকে কী পাওয়া গিয়েছিল?
আমি এসব বিতর্ক চাইতাম না, আমি শুধু জানতে চাইতাম কোন্ আন্তর্জাতিক উপনিবেশিক দেশগুলির মানুষের পাশে রয়েছে?
আমার মতে এ প্রশ্ন ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাই একদিন এক সভায় আমি এই প্রশ্নটা করেছিলাম। কয়েকজন কমরেড বললেন, “দ্বিতীয় নয়, তৃতীয় আন্তর্জাতিক।” আরেকজন কমরেড আমায় লেনিনের লেখা ‘Thesis on the national and colonial questions’ বইটি দিলেন পড়ার জন্য।
ওই থিসিসের মধ্যে কিছু রাজনৈতিক পরিভাষা ছিল যা আমার পক্ষে বোঝা বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু বারবার পড়তে পড়তে আমি একদিন ওই লেখার সারাংশ ও ভাবনা আত্মস্থ করে ফেলতে পেরেছিলাম। কী আবেগ, উৎসাহ, অন্তর্দৃষ্টি এবং আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার করেছিল আমার মধ্যে! আনন্দে অভিভূত হয়ে জল এসে গিয়েছিল চোখে। নিজের ঘরে একা একা বসে আমি চিৎকার করতাম যেন আমি কথা বলছি ভীড় করে আসা জনতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে- “প্রিয় স্বদেশবাসী! এটাই সেই, যা আমাদের প্রয়োজন, এই আমাদের মুক্তির রাস্তা!” এরপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস জন্মেছিল লেনিন ও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতি।
আগে পার্টির সভাগুলিতে আমি শুধু চুপ করে বসে আলোচনা শুনতাম, আমার একটা ভুল বিশ্বাস ছিল যে ওরা সবাই যুক্তিযুক্ত কথা বলে, আমি পার্থক্য করতে পারতাম না কারা সঠিক বলছে আর কারা বলছে ভুল। কিন্তু তারপর থেকে, আমিও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম তর্কে, আর আলোচনা করতে শুরু করেছিলাম প্রবল উৎসাহে। যদিও সমস্ত ভাব প্রকাশ করার মতো প্রয়োজনীয় ফরাসি শব্দ আমার জানা ছিল না। লেনিন ও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ আমি গুঁড়িয়ে দিতাম তখন। আমার একমাত্র যুক্তি ছিল- “যদি উপনিবেশিকতাবাদকে দোষারোপ না করো, যদি তুমি উপনিবেশের অত্যাচারিত মানুষের পাশে না দাঁড়াও, তবে কী ধরনের বিপ্লব তুমি করতে চাইছ?”
আমি শুধু আমার নিজের দলের শাখার সভাতে নয়, অন্য শাখার সভাতেও যেতাম বক্তব্য রাখতে। এবার আমার আবার বলা উচিত যে, কমরেড মার্সেল ক্যাসিন, ভেইলা কুটোরিয়ার, মনমৌসি এবং আরো অনেকেই আমায় সাহায্য করেছেন আমার জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে। শেষ পর্যন্ত, ত্যুর কংগ্রেসে, আমিও ওদের সাথে ভোট দিলাম তৃতীয় আন্তর্জাতিকে যোগ দেওয়ার জন্য।
প্রথমে দেশপ্রেম, প্রথমেই সাম্যবাদ নয়, এই কথা লেনিন ও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতি আমায় আরো আত্মবিশ্বাসী করলো। ধাপে ধাপে, সংগ্রামের সাথে, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের চর্চা ও দৈনন্দিন নানা কাজেকর্মে যোগ দিতে দিতে আমি যে বিষয়টা বুঝেছিলাম, তা হল সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদই একমাত্র পারে নিপীড়িত জাতিগুলির এবং সারা পৃথিবীর শ্রমিকদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে।
আমাদের দেশে এবং চীনে একটি কিংবদন্তী আছে, ‘Book of the Wise’ নামক একটি বিস্ময়কর বইকে ঘিরে। যখনই কারো জীবনে খুব বড়ো সমস্যা আসে, তখন এই বই খুলে তার সমাধান পাওয়া যায়। লেনিনবাদ শুধুমাত্র সেই বিস্ময়কর ‘Book of the Wise’ নয়, আমাদের ভিয়েতনামি বিপ্লবী আর মানুষের কাছে এ হল কম্পাসের মতো: এ আসলে এক উদ্ভাসিত সূর্য, আমাদের আলোর পথের দিশারী, যা আমাদের পৌঁছে দেবে অন্তিম জয়ের কাছে, যা আমাদের পৌঁছে দেবে সমাজতন্ত্রে ও সাম্যবাদে।
অনুবাদ : নীলাঞ্জন মিশ্র
উৎস: সিলেক্টেড ওয়ার্কস অফ হো চি মিন; ভলিউম ৪; ফরেইন ল্যাঙ্গুয়েজেস পাবলিশিং হাউস। (কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সংবর্তক’ সাহিত্য ও সমাজ বিষয়ক পত্রিকার লেনিন সংখ্যা হতে সংগৃহিত)