বাংলা সাহিত্যের প্রধান দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। বাংলা সাহিত্যকে মধ্যযুগের সামাজিক মননকাঠামো থেকে মুক্ত করে ভারতীয় নবজাগরণকে বিরাট বিস্তৃতিতে ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর নজরুল সেই ধারারই এক বলিষ্ঠ প্রতিনিধি। দর্শনগত কিছুটা ভিন্নতা সত্ত্বেও এই দুই মানবতাবাদী লেখকের মধ্যে ছিল শ্রদ্ধার-স্নেহের এক মধুর সম্পর্ক, যার ভিত্তি ছিল পরস্পরের গুণের প্রতি স্বীকৃতি ও সমাদর। এ লেখায় ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে সে সম্পর্কের ইতিবৃত্তই তুলে ধরা হয়েছে।
তোমার আলোর রথ চালিয়ে ভাঙব ঘুমের দ্বার
রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের বয়সের পার্থক্য ৩৮ বছরের। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালে, নজরুলের ১৮৯৯ সালে। নজরুলের শৈশব-কৈশোর কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে লেটোগানের আসরে এবং রাণীগঞ্জ, মাথরুন ও দরিরামপুরে স্কুলের চৌহদ্দিতে। এ পর্বে তিনি আসানসোলে রুটির কারখানায় এবং ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের দারোগা বাড়িতে কাজ করেন। কাজেই কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু ইতিহাস থেকে জানা যায় – নজরুলের রবীন্দ্র-অনুরাগ তাঁর ছাত্রজীবন থেকেই।
১৯১৬ সালের ঘটনা। নজরুল তখন বর্ধমান জেলার (এখন পশ্চিম বর্ধমান) রাণীগঞ্জের নিকট সিয়ারসোল হাই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। ওই বয়সেই বাংলা সাহিত্যের অনেক দিকপাল লেখকদের লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর মনে অসীম ভক্তির জন্ম হয়। একবার খেলার মাঠে বন্ধুরা তাঁকে নিয়ে মজা করার জন্য রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে কিছু অপ্রিয় কথা বলায় নজরুল রেগে গিয়ে বাঁশের গোলপোস্ট উপড়ে বন্ধু জগৎ রায়ের মাথায় এমন আঘাত করেছিলেন যে, মাথা ফেটে রক্তপাত হয়েছিল। সে মামলা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
আকৈশোর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অদ্ভুত শ্রদ্ধা নজরুলের। নিজেই লিখেছিলেন, ‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা নয়, পূজা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্টদেবতাকে পূজা করে, ছেলেবেলা থেকে তাঁর ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধূপ-ফুল- চন্দন দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা বন্দনা করেছি। এ নিয়ে কত লোক কত ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছেন।’
সাহিত্যের ক্ষেত্রে ১৯২০-এর দিকে নজরুলের যখন আগমন, তখন রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন তাঁর গৌরবের পূর্ণতায়। তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁর প্রভাব প্রায় সবদিকেই। ওই সময় কোলকাতার ‘প্রবাসী’, ‘ভারতী’, ‘মোসলেম ভারত’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকাৎ, ‘নবযুগ’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় নজরুলে কবিতা ও অন্যান্য রচনা প্রকাশ হতে থাকে। বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায়ও নজরুল নিয়মিত যেতেন। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়তেন এবং নজরুল সম্পর্কে নিজের আগ্রহের কথা প্রকাশ করতেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এবং আরও অনেকের কাছে। কবিতাগুলি পড়ে নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন কবি। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর আত্মকথা ‘চলমান জীবন’-এ শুনিয়েছেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে নজরুলের প্রথম সাক্ষাতের কথা। সত্যেন দত্তকে নজরুল প্রণাম করতে যাওয়ামাত্র ‘সত্যেনদা জড়িয়ে ধরেন কাজিকে, বলেন, তুমি ভাই নতুন ঢেউ এনেছ। আমরা তো নগণ্য, গুরুদেবকে পর্যন্ত বিস্মিত করেছ তুমি।’ নজরুল বিস্মিত। সত্যেন্দ্রনাথ বলেন, ‘গুরুদেবই আমাকে একদিন নিজে থেকে প্রশ্ন করলেন, কাজি নজরুল ইসলামের কোনো কবিতা পড়েছি কি না। তাঁর মতে ভাবের সংস্কৃতি-সমন্বয়ের সাধনায় এই এক নতুন অবদান আনছ তুমি।’ অবশেষে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যান নজরুল। যদিও বিস্ময়ের ঘোরে নজরুল কোনো কথাই বলতে পারেননি সেদিন। এরপর থেকে তাদের উভয়ের চিঠি-পত্র আদান-প্রদান হতো নিয়মিত। চিঠি-পত্রে এবং ব্যক্তিগত সম্বোধনে নজরুল রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুজি’ বলতেন।
প্রথম দেখার দুই মাস পর ১৯২১ সালের অক্টোবরে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নজরুলের। নিশিকান্ত রায় এই সাক্ষাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘গুরুদেবের পাশে দু’জন আগন্তুক সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তাদের একজনকে অঙ্গুলি-নির্দেশে দেখিয়ে দিয়ে দাদা সুধাকান্ত আমাকে বললেন, ঐ দেখ কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এই কথা বলে দাদা গিয়ে নজরুলের সান্নিধ্যেই বসলেন। নজরুলের পাশেই ফেজ-পরা, কাঁচা-পাকা দাড়ি নিয়ে একজন বসে আছেন; তিনি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি কবিগুরুকে বলছিলেন, ট্রেনে আসতে আসতে কাজী সাহেব আপনার গীতাঞ্জলির সব ক’টা গান আমাকে গেয়ে শুনিয়েছেন। কবিগুরু বললেন, তাই নাকি? অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি তো! আমার গীতাঞ্জলির গান সবতো আমারই মনে থাকে না।”
‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে’
নজরুল ছেলেবেলা থেকেই রবি অনুরাগী ছিলেন। নানান জায়গায় তিনি রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে বেড়াতেন। করাচি সেনানিবাসে থাকার সময়েও নজরুল সদাসর্বদা রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্র-গানের ভাণ্ডারী। সে-কারণে তাঁকে পল্টনের সকলে ‘রবীন্দ্র-সংগীতের হাফিজ’ বলে ডাকতেন। যুদ্ধের সময় ট্রাংকে থাকতো রবীন্দ্রনাথের গানের বই। দেশে ফিরেই পরিচিত হয়েছিলেন সে সময়কার রবীন্দ্রসঙ্গীতের বড় গায়ক হরিদাস চট্টোপাধ্যায়ের সাথে। নজরুলের হৃদয়ের কতটা অংশ জুড়ে রবীন্দ্রনাথের গান ছিল তা তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ ও ‘রিক্তের বেদন’ এবং ‘বাঁধনহারা’ পত্রোপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচুর উদাহরণ দেখলে বোঝা যায়। আরেকবার কোনো এক পত্রিকার সম্পাদক নজরুলের কাছে এসেছিলেন কবিতা নেওয়ার জন্য। তিনি রবীন্দ্র সংগীতের চেয়ে নজরুলের গানের বেশি প্রশংসা করলেন। নজরুল তখন রেগে গেলেন, ধমক দিয়ে বললেন, “আমরা যদি কেউ না জন্মাতাম, তাতে কোনো ক্ষতি হতো না, রবীন্দ্রনাথের গান বেদমন্ত্র, তাঁর গান ও কবিতা আমাদের সাত রাজার ধন মানিক। লেখা নিতে এসেছেন, নিয়ে যান, লেখা নিতে এসে এ রকম আমড়াগাছি যেন আর না শুনি।” নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামও নজরুল রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে নিয়েছিলেন। ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে’চরণ থেকেই নজরুল ‘অগ্নিবীণা’ নিয়েছিলেন।
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত রবীন্দ্রনাথের ষাটতম জন্মদিন পালনের সভা হয় ১৯২১-এর ৪ সেপ্টেম্বর। নজরুল সভাকক্ষে ঢুকেই সোজা মঞ্চে উঠে বিশ্বকবিকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মাথায় আশীর্বাদ নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছিলেন। মঞ্চ থেকে নামার মুখেই রবীন্দ্রনাথ খপ করে নজরুলের হাত ধরে টানলেন। “না নজরুল, তুমি নিচে নয়, তুমি এই সভায় আমার পাশেই বসবে।” লক্ষণীয়, তখনও নজরুলের প্রথম কবিতার বইটিও বেরোয়নি।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুতে ১৯২২ সালের ২৫ জুন কলকাতায় রামমোহন লাইব্রেরি হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে স্মরণসভা হয়। সেখানেও নজরুলকে পাশে বসিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এদিন সভায় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ধূমকেতুর ম্যানেজার শান্তিপদ সিংহ লিখেছেন, ‘বিশ্বকবি মঞ্চে প্রবেশ করলেন এবং প্রায় পিছু পিছু কবি নজরুলও একেবারে মঞ্চের উপর। কবিগুরুর ইঙ্গিতে তাঁর পাশের আসনেই বসলেন। নিচে সেই গুনগুনানি। তাদের হিসাব মতে, কবিগুরুর পাশে বসবার যোগ্যতা নজরুলের নেই। অথচ ঘটনাচক্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের পাশে বসবার সুযোগ পাচ্ছেন বড় বড় সভায়। কি দুর্দৈব!’
চির উন্নত শির
জানুয়ারি, ১৯২২। সকাল বেলা ‘বিজলী’ পত্রিকার চারটি কপি হাতে করে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সামনে হাজির কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তখন তার বয়স মাত্র ২৩। ‘গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি, গুরুজি’ বলে চিৎকার করছেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথ উপর থেকে বললেন, ‘কী হয়েছে? ষাঁড়ের মতো চেচাচ্ছ কেন? এসো, উপরে এসে বসো?’ এবার ‘বিজলী’ হাতে উপরে উঠলেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথকে সামনে বসিয়ে বিদ্রোহী কবিতাটি আবৃত্তি করলেন। এটাই আগের দিন ছাপা হয়েছে ‘বিজলী’ পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে এতক্ষণ শুনছিলেন, স্তব্ধ হয়ে নজরুলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কবিতা পড়া শেষ হলে তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন এবং দু’হাত প্রসারিত করে তরুণ কবিকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ কাজী, তুমি আমাকে সত্যিই হত্যা করবে। আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার কবিতা শুনে। তুমি যে বিশ্ববিখ্যাত কবি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তোমার কবিতায় জগৎ আলোকিত হোক, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি।’
নজরুলের কবিতা সম্পর্কে কবিগুরু মূল্যায়ন করেছিলেন এভাবে, “অরুগ্ন-বলিষ্ঠ-হিংস্র-নগ্ন-বর্বরতা তার অনবদ্য ভাবমূর্তি রয়েছে কাজীর কবিতায় ও গানে। কৃত্রিমতার ছোঁয়াচ তাকে কোথাও ম্লান করেনি, জীবন ও যৌবনের সকল ধর্মকে কোথাও তা অস্বীকার করেনি। মনুষের স্বভাব ও সহজাত প্রকৃতির অকুণ্ঠ প্রকাশের ভিতর নজরুল ইসলামের কবিতা সকল দ্বিধা-গুণের ঊর্ধ্বে তা আসন-গ্রহণ করেছে।”
দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
এই সময় নজরুল ধূমকেতু নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। বন্ধু নৃপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে নজরুল বললেন, ‘ধূমকেতু’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করছি। আসুন, দেশের ঘুম ভাঙাই, ভয় ভাঙাই।’ নৃপেন উৎসাহে ফুটতে লাগলেন। নজরুল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে টেলিগ্রাম করে আশীর্বাদ চাইলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখে পাঠালেন, “কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু –
আয় চলে আয় রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ্ অগ্নিসেতু,
দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক্ না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক্ মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন।”
এখানে ধূমকেতু পত্রিকা আর নজরুল – দুজনের উদ্দ্যেশ্যেই যেন রবীন্দ্রনাথের এই আশিসবাণী বর্ষিত হয়েছিল। গুরুর কথার প্রতিফলন হিসেবে ‘ধূমকেতু’র সম্পাদকীয় ও অন্যান্য লেখায় নজরুলের গভীর ও তীব্র দেশপ্রেমিক সত্তা পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জ্বলন্ত দেশাত্মবোধ প্রকাশের হাতিয়ার হয়ে ওঠে এ পত্রিকাটি। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর ‘কল্লোল যুগ’-এ লেখেন, “সপ্তাহান্তে বিকেলবেলা আরও অনেকের সঙ্গে জগুবাবুর বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। হকার কতক্ষণে ধূমকেতুর বাণ্ডিল নিয়ে আসে। হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি পড়ে যায় কাগজের জন্য। কালির বদলে রক্তে ডুবিয়ে লেখা এই সব সম্পাদকীয়।”
সম্পাদকীয়ের পাশাপাশি মুদ্রিত হয় অগ্নিবর্ষী সব কবিতা, ‘আনন্দময়ীর আগমনে’, যাতে বলা হল,
“আর কতকাল থাকবি বেটী মাটীর ঢেলার মূর্তি-আড়াল,
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল !”
এই পত্রিকাতেই নজরুল ভারতের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিও প্রথম উচ্চারণ করলেন। ফলাফল হিসেবে ব্রিটিশ শাসক প্রত্যাঘাত করতে দেরি করল না। নজরুলের নামে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি হলো, জানুয়ারি ১৯২৩-এ কারারুদ্ধ হলেন নজরুল।
রুদ্র, তোমার দারুণ দীপ্তি এসেছে দুয়ার ভেদিয়া
কারারুদ্ধ নজরুলের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করলেন তাঁর নতুন গীতিনাট্য ‘বসন্ত’। জেলে নজরুলের উদ্দেশে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় মারফত বই পাঠিয়ে, রবীন্দ্রনাথ বলে পাঠিয়েছিলেন, ‘তাকে বোলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে আমার সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বোলো, কবিতা লেখা যেন কোনো কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই।’
রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন বাঙালির জীবন ও সাহিত্যে নজরুল বসন্তের অগ্রদূত। তাই নিজের লেখা ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি উৎসর্গ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রীতিভাজন পার্ষদদের অনেকেই এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। পরিবার-পরিজনের বাইরের কাউকে নোবেল বিজয়ী কবি তার বই উৎসর্গ করছেন। শুধু তাই নয়, যাকে উৎসর্গ করছেন সে সাহিত্য জগতে সদ্য এসেছে। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় এই বিরোধের কথা লেখা রয়েছে। পবিত্রবাবু লিখেছেন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “… নজরুলকে আমি ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গপত্রে তাকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছি। জানি, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস, তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করছে। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।” ‘মার-মার কাট-কাট ও অসির ঝনঝনার মধ্যে রূপ ও রসের প্রক্ষেপটুকু হারিয়ে গেছে’, উপস্থিত একজন মন্তব্য করলেন। “কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এও তোমাদের আবদার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যখন যে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন তাকে কাব্যে প্রকাশ করবে বৈ কি। আমি যদি আজ তরুণ হতাম, তাহলে আমার কলমেও ওই সুর বাজত। কিন্তু তার রূপ হত ভিন্ন।” উত্তর দিলেন কবি। আর একজনের মন্তব্য শোনা গেল – দুজনের প্রকাশ তো দু’রকম হবেই। “কিন্তু তা বলে আমারটা নজরুলের থেকে ভালো হত। এমন কথা বা জোর করে বলবে কী করে?”। ‘যাই বলুন, এ অসির ঝনঝনা জাতির মনের আবেগে ভাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নজরুলী কাব্যের জনপ্রিয়তা মিলিয়ে যাবে’, মন্তব্য এল ফরাস থেকে। “জনপ্রিয়তা কাব্যবিচারের স্থায়ী নিরিখ নয়, কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য”, বললেন রবীন্দ্রনাথ।
এই হলো জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রসভার বিবরণ। এর পরে সেই বুধবারে আলিপুর জেলে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎ। “জেলের ইন্টারভিউর নিয়মমাফিক গরাদের ব্যবধানে আমি প্যাকেট খুলে গুরুদেবের উৎসর্গ-পত্র দেখাতেই নজরুল লাফ দিয়ে পড়ল লোহার গরাদগুলির উপর। বন্দীর প্রবল উত্তেজনা লক্ষ্য করে ইউরোপীয় ওয়ার্ডার কারণ জানতে চাইল। আমি যখন বললাম Poet Tagore ওকে একখানা বই Dedicated করেছেন। সাহেব আমার ইংরেজির ভুল ধরে বলল, “You, mean, Presented।” আমি জোর দিয়ে বললাম, “No, dedicated”। সাহেবের মুখে বিস্ময়, “You mean this convicted is such an important person!” “Yes, our greatest poet next to Tagore.” এক সেকেন্ড কী ভেবে সাহেব দরজাটা খুলে আমাদের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ধরে নাচতে শুরু করল নজরুল। তার পর হঠাৎ খেয়াল হতে ছিটকে পড়া বইখানা তুলে নিয়ে (কপালে?) ঠেকিয়ে বুকে চেপে ধরল। … উত্তেজনা একটু প্রশমিত হতে নজরুল জিজ্ঞেস করল, ‘আর কী বলেছেন গুরুদেব?’ বলেছেন, তুই যেন কবিতা লেখা বন্ধ করিস না। ‘গুরুর আদেশ শিরোধার্য’, বলে সেদিন আমাকে বিদায় দিয়েছিল নজরুল।”
এই প্রসঙ্গে নজরুল নিজেই পরে লিখেছেন – “এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক আমায় উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ-মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা ক্লেশ ভুলে যাই।”
Our literature claims you
জেলখানায় থাকার এক পর্যায়ে নজরুলসহ অন্য বন্দিদের উপর অমানবিক আচরণ ও অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে ব্রিটিশরাজের পুলিশ। নজরুল এর প্রতিবাদে আমরণ অনশন শুরু করেন। কোনো দিক থেকেই কেউ নজরুলের অনশন ভাঙাতে সমর্থ হচ্ছিল না। এ প্রসঙ্গে ১৯২৩ সালের ১৭ মে শরৎচন্দ্র বাজে-শিবপুর হাবড়া থেকে লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে এক চিঠিতে লিখেছেন: “হুগলী জেলে আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম উপোস করিয়া মরমর হইয়াছে। বেলা ১টার গাড়ীতে যাইতেছি, দেখি যদি দেখা করিতে দেয় ও দিলে আমার অনুরোধে যদি সে আবার খাইতে রাজি হয়। না হইলে তার কোন আশা দেখি না। একজন সত্যিকার কবি। রবিবাবু ছাড়া আর বোধ হয় এমন কেহ আর এত বড় কবি নাই”। কিন্ত শরৎচন্দ্র দেখা করতে পারেননি।
রবীন্দ্রনাথ তখন শিলঙে। তাঁর কাছে নজরুলের বন্ধুরা চিঠি লেখেন, তিনি যেন নজরুলকে অনশন থেকে নিবৃত্ত হতে বলেন। রবীন্দ্রনাথ নাকি প্রথমে তাতে অসম্মত হন। কারণ যদি কোনো মানুষ সাধনার জন্য, আদর্শের জন্য কষ্ট স্বীকার করে, তবে তাকে বাধা দেওয়া তিনি উচিত বলে মনে করেন না। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে চিঠিতে তিনি লিখলেন, “আদর্শবাদীকে আদর্শ ত্যাগ করতে বলা তাকে হত্যা করারই সামিল। অনশনে যদি কাজীর মৃত্যুও হয় তাহলেও তার অন্তরের সত্য ও আদর্শ চিরদিন মহিমময় হয়ে থাকবে।” কিন্তু রবীন্দ্রনাথ স্নেহের নজরুলের দুর্দশায় কাতর হলেন। নিজের এই অবস্থান থেকে সরে এসে, এবং আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ঠিকানায় নজরুলকে উদ্দেশ্য করে টেলিগ্রাম পাঠালেন, “Give up hunger strike, our literature claims you.” কিন্তু সে টেলিগ্রাম কবির হাতে পৌঁছেনি। জেল কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠায়।
টেলিগ্রাম ফেরত পেয়েই রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন, এটি সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত ও হীনম্মন্যতা। তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখলেন: কল্যাণীয়েষু রথী, নজরুল ইসলামকে প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায় টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলাম … জেল থেকে memo এসেছে “Addressee not found.” অর্থাৎ ওরা আমার message দিতে চায় না, কেন না নজরুল প্রেসিডেন্সি জেলে না থাকলে ওরা নিশ্চয়ই জানতো যে কোথায় আছে। অর্থাৎ নজরুল ইসলামের আত্মহত্যায় ওরা বাধা দিতে চায় না।” পরে অবশ্য নজরুল তাঁর বন্ধু কুমিল্লার বীরেন্দ্রকুমারের মা বিরজা সুন্দরী দেবীর হাতে লেবুর সরবত পান করে অনশন ভঙ্গ করেন। জেলের মধ্যে কথা প্রসঙ্গে নজরুল নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষ কোনো দিনও কবির কাঙ্গাল নয়, ছিলেন বাল্মীকি, ব্যাস, কালিদাস – রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য কেউ নন।”
নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা!
দুই কবির ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের মাঝে শুধুই অন্ধত্ব নয়, পথ দেখানো, আরো বড় করে তোলার আগ্রহের দিকটিও ছিল। গুরুর শাসনে বা শিষ্যের সমালোচনায় রয়েছে তার প্রকাশ।
নজরুল নিজের কাব্যচর্চা থেকে অন্যত্র মনোনিবেশ করায় রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুলকে বলেছিলেন, ‘তুমি নাকি এখন তরোয়াল দিয়ে দাড়ি চাছো?’
অন্যদিকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গান্ধী, অরবিন্দ, চিত্ররঞ্জন, সুরেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, বারীণ ঘোষ প্রমুখের আপোসকামিতাকে সঠিক মনে করেননি নজরুল। সে কথা জানাতে দ্বিধা করেননি। রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন,
‘রবির শিখা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে আজ দিগন্তরে
সে কর শুধু পশলো না মা অন্ধ কারার বন্ধ ঘরে।’
ভাঙো সে দেয়াল, প্রদীপের আলো
যাহা আগুলিয়া রয়
কিন্তু রবীন্দ্র-নজরুল বিরোধীচক্র সদা তৎপর ছিল এই মহৎপ্রাণ দুই কবির সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ ঘনিয়ে তুলতে। এক পর্যায়ে তারা কিছুটা সফল হয়েছিল। একদিকে নজরুলের রক্ত অর্থে ‘খুন’ শব্দ ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা করেছেন – এ কথা রটিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথকেও নজরুল সম্পর্কে ভুল বোঝানোর চেষ্টা ছিল। তাই এমন একটি কথা শুনে নজরুল খুব ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি লিখলেন, ‘বড়র পিরিতি বালির বাঁধ’। যে রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কবিতায় আরবি-ফারসি ব্যবহারের প্রশংসা করেছিলেন, তিনি কী করে অমন কথা বলতে পারেন?
কিন্তু পরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তিনি নজরুলকে সে কথা বলেননি। তাঁর মন্তব্য ছিল কোনো উদীয়মান কবির জন্য, কোনো উদিত কবির জন্য নয়। রবীন্দ্রনাথও ব্যথিত হয়েছিলেন, নজরুল কেন রটনাটি বিশ্বাস করলেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের এই বিতর্ক থেকে ফায়দা তোলার জন্য ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকা উঠেপড়ে লাগল। শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধেয় প্রমথ চৌধুরী ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকায় ‘বঙ্গসাহিত্যে খুনের মামলা’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানটি ব্যাখ্যা করেন এবং অনভিপ্রেত এই বিতর্কের অবসান ঘটান। নজরুলও তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। ১৯২০-১৯৪১ পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্কে এই একটি ‘খুনের মামলা’ অভিমান পর্ব ছাড়া আর কোনো বিরোধের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না।
মাথার উপর জ্বলিছেন রবি
ঘটনার পরের বছরেই ১৯২৮-এ নজরুল তাঁর কাব্যসংকলন ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করলেন রবীন্দ্রনাথকে। নজরুলের রবীন্দ্র-ভক্তির প্রকাশ তাঁর জীবনব্যাপী অনবরত ও অব্যাহতভাবে ঘটেছে। আশ্বিন ১৩৩২-এর ‘বিজলী’তে প্রকাশিত হলো নজরুলের এক অসামান্য কবিতা “আমার কৈফিয়ৎ”। তাতেও তিনি “মাথার উপর জ্বলিছেন রবি” বলে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানালেন, যদিও নিজের স্বতন্ত্র বিদ্রোহের পথ থেকে তিনি এক তিল বিচ্যুত হওয়ার ইঙ্গিত দিলেন না।
ধূমকেতুর পর নজরুল প্রকাশিত আরেক পত্রিকা ‘লাঙল’-এও রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী ছাপানো হয়,
“জাগো জাগো বলরাম, আনো তব মরু-ভাঙা হল,
প্রাণ দাও, শক্তি দাও, স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল।”
১৯৩১-এ রবীন্দ্রনাথ তখন দার্জিলিংয়ে। কয়েকজন নবীন লেখক তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন বলে নজরুলের সঙ্গী করে হাজির হলেন। স্বপনবুড়ো সে দিনের স্মৃতিচারণায় জানিয়েছিলেন, ‘আমরা সবাই কাজিদাকে ধরলাম, তীর্থযাত্রার যেমন পাণ্ডার প্রয়োজন, তেমনি কবি সঙ্গমে আর এক কবির সঙ্গী হওয়াই সব চাইতে প্রশস্ত আর মঙ্গলজনক’। স্বপনবুড়োর স্মৃতিসাক্ষ্যে জানা যায়, কবি উপরের ঘরে কিছু লিখছিলেন। কিন্ত নজরুল এসেছেন খবর পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে আসেন।
১৯৩৫-এর আগস্টে ‘নাগরিক’ সাপ্তাহিকীর লেখা চেয়ে কবিকে চিঠি পাঠান নজরুল। লেখেন ‘আমার ওপর হয়ত কাব্যলক্ষ্মী হিজ্ মাস্টার্স ভয়েসের কুকুরের ভয়ে আমায় ত্যাগ করেছেন বহুদিন।’ পত্রোত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘অনেকদিন পরে তোমার সাড়া পেয়ে মন খুব খুশি হল। কিছু দাবি করেছ – তোমার দাবি অস্বীকার করা আমার পক্ষে কঠিন।’ লেখা পাঠাতে না পেরে চিঠির শেষে লিখলেন, ‘তুমি তরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছ থেকে আর কিছু না হোক করুণা দাবি করতে পারে।’ ওই ‘নাগরিক’-এরই শারদ সংখ্যায় নজরুল ‘তীর্থপথিক’ নামে কবিতায় রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে লিখলেন,
“হে কবি হে ঋষি অন্তর্যামী আমারে করিও ক্ষমা।
পর্বতসম শত দোষত্রুটি ও চরণে হল জমা।
জানি জানি তার ক্ষমা নাই, দেব, তবু কেন মনে জাগে
তুমি মহর্ষি করিয়াছ ক্ষমা আমি চাহিবার আগে। …
তুমি স্মরিয়াছ ভক্তেরে তব, এই গৌরবখানি
রাখিব কোথায় ভেবে নাহি পাই, আনন্দে মূক বাণী।
কাব্যলোকের বাণীবিতানের আমি কেহ নহি আর,
বিদায়ের পথে তুমি দিলে তবু কেন এ আশিস-হার ?
প্রার্থনা মোর, যদি আরবার জন্মি এ পৃথিবীতে
আসি যেন শুধু গাহন করিতে তোমার কাব্যগীতে।”
দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে
এ ঘটনার তিন বছর পরে এই দুই কবির পরস্পরের প্রতি গভীর ভালোবাসার ইতিহাস লেখা রয়েছে আরেক ঘটনায়। নরেশ মিত্র সিনেমা বানালেন ‘গোরা’। সঙ্গীত পরিচালক নজরুল। ৩০ জুলাই ১৯৩৮ ছবির মুক্তি। মুক্তির আগে ছবিতে রবীন্দ্র-গানের ব্যবহার নিয়ে বিশ্বভারতী সঙ্গীত-সমিতি আপত্তি তোলে। প্রযোজক আর সঙ্গীত পরিচালক ছবির প্রিন্ট আর প্রোজেকশন যন্ত্র নিয়ে হাজির শান্তিনিকেতনে। নজরুল-সহকারী নিতাই ঘটকের স্মৃতিচারণে শুনি, নজরুলকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন কবি। সমস্ত কথা শুনে নাকি তিনি বলেন, ‘কী কা- বলো তো! তুমি শিখিয়েছ আমার গান, ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরে? তোমার চেয়ে আমার গান কি ওরা বেশি বুঝবে? আমার গানের মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে?’ তবু নজরুল কবিকে ছবি দেখেই অনুমতি দিতে বলেন। শোনা যায়, কবি ছবিটি রেখে যেতে বললেও, ছবি দেখার আগেই অনুমতিপত্রে সই করে দেন। ছবি মুক্তি পায় নির্দিষ্ট দিনেই।
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে
১৯৪১ সালের মে মাসে কবিগুরুর ৮০তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে নজরুল লিখলেন কবিতা ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’।
কবিতাটিতে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, কবিকে আরেকবার শ্রদ্ধা জানাবার সুযোগ হয়তো আর পাবেন না। তাঁর সে আশঙ্কা সত্য হয়েছে। এ বছরই বাংলা ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ মারা গেলে শোকে বিহ্বল নজরুল সেই দিনই লিখলেন ‘রবিহারা’ কবিতা। তিনি আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবর্ণনা প্রচার করেন এবং আবৃত্তি করেন,
‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্তপথের কোলে
শ্রাবণের মেঘ ছুটে এল দলে দলে
উদাস গগনতলে
বিশ্বের রবি ভারতের কবি
শ্যাম-বাংলার হৃদয়ের ছবি
তুমি চলে যাবে বলে’।
বেতারে এই কবিতাটি আবৃত্তি করার সময়ে নজরুল হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবৃত্তি তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেননি, তাঁর জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে একটি গান রচনা করে সুর দিলেন – ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে, জাগায়ো না জাগায়ো না’এবং আরও একটি কবিতায় লিখলেন,
‘কাব্য-গীতির শ্রেষ্ঠ-স্রষ্টা, দ্রষ্টা, ঋষি ও ধ্যানী
মহাকবি রবি অস্ত গিয়াছে, বীণা, বেণুকা ও বাণী
নীরব হইল। ধুলির ধরণী জানি না সে কত দিন
রস-যমুনার পরশ পাবে না। প্রকৃতি বাণীহীন
মৌন বিষাদে কাঁদিবে ভুবনে, ভবনে ও বনে একা
রেখায় রেখায় রূপ দিবে আর কাহার ছন্দ-লেখা’?
(সালাম অস্ত রবি)
নজরুল যে নতুন যুগের প্রতিভাধর কবি, তা সে সময়ে যে কয়জন মানুষ বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাদের অন্যতম। আর নতুন যুগের কথা যারা বলে তাদের পুরনো যুগের সাথে সংঘর্ষ অনিবার্য। সেজন্য হয়তো নজরুলের জীবনের কোনো করুণ পরিণতির আশঙ্কা করেই রবীন্দ্রনাথ প্রিয় অনুজকে প্রায়ই বলতেন, ‘দ্যাখ্ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলির মতো কিট্সের মতো খুব বড়ো ট্র্যাজেডি আছে, তুই প্রস্তুত হ।’ আর রবীন্দ্রনাথের সে কথার যথার্থতা প্রমাণিত হয় তাঁর মৃত্যুর এক বছর পরই। নজরুল এ সময়ে অসুস্থ হয়ে চিরতরে নির্বাক ও স্মৃতিহীন হয়ে যান।
রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে, সমৃদ্ধ হয়ে, অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে সামনের দিকে ভিন্ন এক পথ ধরেই এগিয়েছেন নজরুল। তাই তো তিনি বলছেন,
“একা তুমি জানিতে হে কবি, মহাঋষি,
তোমারি বিচ্যুত-ছটা আমি ধূমকেতু।”
আর রবীন্দ্রনাথও বুঝেছিলেন নজরুলের আগমন কেবল যে একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা তা নয়, এ ছিল নতুন একটি যুগের আগমন বার্তা। স্বীকার করেছিলেন তাঁকে নতুন দিনের কবি বলে। ১৯২৯-এ নজরুলকে যে নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়, তাতে সভাপতিত্ব করেন বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের আওতায় নজরুল প্রতিভা পরিপুষ্ট হয়নি। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কবি বলে স্বীকার করেছেন।” বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের পাতায় দুই প্রধান কবি শ্রদ্ধা আর স্নেহের সম্পর্কের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা স্বমহিমায় উজ্জ্বল থাকবে চিরদিন।