২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরপিওতে সংশোধনী এনে নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের বিধান করে। তবে সেসময় এ বিধান ছিল ঐচ্ছিক, দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক ছিল না। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ২৯ আগস্ট রাষ্ট্রপতির জারি করা এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরপিও সংশোধন করে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং নবম সংসদের প্রথম অধিবেশনে সামান্য সংশোধনীসহ এই অধ্যাদেশটি অনুমোদন করা হয়। তারপর সেটি The Representation of the People Order (Amendment Act 2009) নামে এটি আইন আকারে বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়।
কেন রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন করতে হবে
২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সুশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। এক্ষেত্রে ভোটার তালিকা ও রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আলোচনার শীর্ষে ছিল। জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে যে সকল যুক্তির অবতারণা করা হয় তা হলো:
১) এর মাধ্যমে নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ঠেকানো যাবে। ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এই আইন তৈরির সাথে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের বক্তব্য ছিল এরূপ যে, নিবন্ধন বাধ্যতামূলক না হওয়ায় নামসর্বস্ব বিপুলসংখ্যক দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এসব দলের এজেন্টরা ভোটের বুথে বড় দলগুলোর মাসলম্যান হিসেবে কাজ করেন। এটা ঠেকানোর জন্য নিবন্ধন প্রয়োজন।
২) এর মাধ্যমে নেতা বেচাকেনা ও ভাঙন ঠেকানো যাবে। ক্ষমতাসীন দল তার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে অর্থ ও সরকারি প্রভাব খাটিয়ে বিরোধী দলগুলোতে যে ভাঙন নিয়ে আসে, ইসিতে বাধ্যতামূলক নিবন্ধন এই ধরনের ভাঙনকে নিরুৎসাহিত করবে।
৩) এর মাধ্যমে যেহেতু একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে ইসি নির্ধারিত পদ্ধতিতে আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ করতে হবে ও তা ইসির কাছে জমা দিতে হবে, সেহেতু এতে দলগুলোর আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা আসবে।
২০০৮ সালে ৩৯টি রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেয়া হয়। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩৯টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে, যেহেতু নিবন্ধন আইনেই এটা উল্লেখ ছিল যে, নিবন্ধন ব্যতীত কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
নিবন্ধন সংক্রান্ত আইনের পরিণতি কী
বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৮টি। রাজনৈতিক দলের জন্য নিবন্ধন আইন কার্যকর করার পর এ পর্যন্ত অভিজ্ঞতা কী বলছে? প্রথমত, নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ঠেকানো যায়নি। এ আইন প্রণয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সাখাওয়াত হোসেন। ২০২২ সালে ১৬ নভেম্বরে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় লেখা একটি প্রবন্ধে তিনি নিজেও বলেছেন যে, নির্বাচন কমিশন দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে এরকম দলকে নিবন্ধন দেয়নি অথচ নামসর্বস্ব দলকে নিবন্ধন দিয়েছে।
সরকারি প্রভাব খাটিয়ে বিরোধী দল ভাঙা ও নেতা কেনাবেচাও ঠেকানো যায়নি। বিএনপির নেতাকর্মীদের একটা অংশকে বের করে ‘তৃণমূল বিএনপি’ গঠন ও তাদের দ্রুত নিবন্ধন দেয়ার উদ্যোগসহ এ ধরনের অনেকগুলো ঘটনা দেখানো যাবে। আর রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের হিসাবের কথা আমরা এখন বাদই দিলাম। এ ব্যাপারে সামান্য স্বচ্ছতাও আসেনি।
দেখা গেল, যে সকল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নিবন্ধনের বিধি প্রস্তুত করা হয়েছিল, তার একটাও বাস্তবায়িত হয়নি। বরং এটি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
এখানে একটা যুক্তি আসতে পারে যে, নিবন্ধনের আইন ও শর্তগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে হয়তো এ সমস্যা হতো না। ২০০৮ সালে নিবন্ধন পদ্ধতির প্রবর্তনের পর প্রথম যে নির্বাচন হয়, সেখানে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এরপর অনুষ্ঠিত সকল জাতীয় নির্বাচনই ছিল আওয়ামী লীগের পাতানো নাটক। নির্বাচন কমিশনের দলীয়করণের কারণে দল নিবন্ধন সংক্রান্ত আইনের অপব্যবহার হয়েছে। যদি নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতো তাহলে এ সমস্যা হতো না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইনটি কেমন
নিবন্ধন আইন বিশ্লেষণ করলে উপরোক্ত যুক্তির সত্যতা মেলে না। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইনের শর্তগুলোই এমন যে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করলেও এটি বিরোধী দলকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। এর কারণ হলো, বিদ্যমান আইন অনুসারে, নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতে হলে একটি দলকে তিনটি শর্তের যে কোন একটি পূরণ করতে হবে। সেগুলো হলো-
১) বিগত যে কোনো ২টি জাতীয় নির্বাচনে নিজস্ব দলীয় প্রতিক নিয়ে নির্বাচন করে অন্ততঃ ১টি আসনে বিজয়ী হওয়ার ফলাফল থাকতে হবে। অথবা,
২) বিগত যে কোনো ২টি জাতীয় নির্বাচনে নিজস্ব দলীয় প্রতিক নিয়ে নির্বাচন করে আসনগুলোর মধ্যে অন্ততঃ ৫% ভোট পাওয়ার ফলাফল থাকতে হবে। অথবা,
৩) দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও কার্যালয় থাকতে হবে। দেশের এক তৃতীয়াংশ জেলায় কার্যকর কমিটি থাকতে হবে এবং ১০০টি উপজেলা বা থানার প্রত্যেকটিতে অন্ততঃ ২০০ জন ভোটারের সমর্থনের প্রমাণ থাকতে হবে।
অনিবন্ধিত দলের পক্ষে পূর্বের কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণের উপায় না থাকায় প্রথম দুইটি শর্তই অবাস্তব এবং বর্তমানে অকার্যকর। প্রথমবার নিবন্ধনের সময় এর কার্যকরিতা ছিল এবং সেক্ষেত্রে আমাদের এটাও মেনে নিতে হবে যে, সেসময়ও যে সকল নামসর্বস্ব দলকে সংসদে একটি-দুটি আসন দিয়ে বড় দলগুলো সাথে রেখেছিল, তারা নিবন্ধন পেয়েছে। কিন্তু মাঠে যাদের অস্তিত্ব আছে, তারা নিবন্ধন পায়নি। বর্তমানে কার্যকর একমাত্র তৃতীয় শর্ত। এই শর্তে নিবন্ধন পেতে হলে একটি দলকে এক তৃতীয়াংশ জেলায় কার্যকর কমিটি ও কার্যালয় এবং ১০০টি উপজেলা বা থানার প্রত্যেকটিতে অন্ততঃ ২০০ জন ভোটারের সমর্থনের প্রমাণ দাখিল করার কথা আছে। এই শর্তও বৈষম্যমূলক। কারণ নতুন একটি দলের পক্ষে দেশের এক তৃতীয়াংশ জেলায় কার্যালয় দেখানো সম্ভব নয়। সম্ভব, যদি তার পেছনে বড় আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। একটা নতুন দলের পক্ষে ১০০টি উপজেলায় ২০০ জন করে ভোটার অর্থাৎ ২০ হাজার ভোটার দেখানোও কোন স্বাভাবিক শর্ত নয়। অর্থাৎ শর্তগুলোই এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন, কোন বড় আর্থিক গোষ্ঠি চাইলে রাতারাতি একটা দল গড়ে তুলে নিবন্ধন নিতে পারে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে মাঠের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা কোন সংগঠন নিবন্ধন পাবে না। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর বড় বড় আর্থিক গোষ্ঠির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথকেও সুগম করা হলো।
অন্যান্য দেশে দল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কী ধরণের শর্ত দেয়া হয়
সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হয় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নিয়ম তো অনেক দেশেই আছে, বাংলাদেশে কেন থাকবে না। আমরা এটার সাথে দ্বিমত করছি না। প্রশ্ন হলো, সেসকল দেশে আমাদের দেশের মতো শর্ত আছে কি? আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা- এদের দিকে তাকালে দেখব যে নিবন্ধন করতে হলে একটি নতুন দল সৃষ্টি হওয়ার পরপরই তাকে আবেদন করতে হয়। দলের গঠনতন্ত্র, কেন্দ্রীয় কমিটি, ব্যাংক একাউন্ট ইত্যাদি দেখাতে হয়। দল গঠনের লক্ষ্যে কী কী প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে-সেগুলো দেখাতে হয়। কিন্তু কোথাও বাংলাদেশের মতো কোন শর্ত দেয়া হয় না। কোথাও একটা দলকে ২০ হাজার সমর্থক, ২১টি জেলায় দলীয় কার্যালয় দেখাতে হয় না। অথচ নিবন্ধনের শর্তে দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পক্ষে কোন তথ্যপ্রমাণ চাওয়া হয়নি, যেটা ছিল সবচেয়ে জরুরি। এইসকল শর্তানুসারে একটা দল বিভিন্ন জেলায় নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করে, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থেকে, নিয়মিত দলীয় মুখপত্র প্রকাশ করে, আন্দোলন করে, জনগণের অধিকারের পক্ষে সরব থেকেও নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না। ছোট দল কিংবা নতুন দলের বিকশিত হওয়ার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এই নিবন্ধন আইনে। রাজনীতিকে কয়েকটি বড় দলের মধ্যে সীমিত করা হয়েছে।
ফলে নিবন্ধন আইন নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে বলে আমাদের মনে হয়। বিদ্যমান আইন বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংগঠন করার স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকারকে সংকুচিত করেছে। একটা বহুদলীয় দেশে নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা ততটুকুই যতটুকু রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি দলকে নথিবদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন হয়, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রয়োজনে আলোচনার জন্য। এর বাইরে এটাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হলে এটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতেই কাজ করবে।