Tuesday, December 24, 2024
Homeফিচাররামপাল প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ক্ষমতার দম্ভ আছে — জনস্বার্থের বিবেচনা নেই

রামপাল প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ক্ষমতার দম্ভ আছে — জনস্বার্থের বিবেচনা নেই

KnfVYNOPRr7Xসুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রতিবাদে স্বাভাবিকভাবে সোচ্চার মানুষ। এই অবস্থায় গত ২৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিক সম্মেলন করে সকল বিরোধিতা সত্ত্বেও যেকোনো মূল্যে রামপাল প্রকল্প করার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের কারিগরি দিক নিয়ে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ইতোমধ্যে বিস্তারিত জবাব দিয়েছেন, অতীতেও বহু বিশেষজ্ঞ মত হাজির করা হয়েছে। সেদিকে না গিয়ে সংক্ষেপে কয়েকটি দিক আলোচনা করা যাক।

প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবন রক্ষায় আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন — উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ করেই ক্ষান্ত হননি, হলি আর্টিজানের খুনী জঙ্গীদের সাথে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যের মিল খুঁজে পেয়েছেন। এভাবে তিনি এই আন্দোলনের মধ্যে জনস্বার্থের প্রশ্নটিকে আড়াল করার অপপ্রয়াস করেছেন। প্রশ্ন হলো — যে বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের ক্ষতি করবে, তা কি উন্নয়ন কর্মকান্ড, না কি প্রকৃতি ধ্বংসের প্রকল্প? ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে শেখ হাসিনা যখন ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনবিরোধী আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছিলেন, তখন কি তিনি উন্নয়নের বিরোধিতা করেছিলেন? অথবা ১৯৮৮ সালে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ সরকার যখন হরিপুর তেলক্ষেত্র ভুয়া সিমিটার কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার চুক্তি করেছিল, তখন শেখ হাসিনাসহ এর বিরোধীরা কি তেল উত্তোলনের বিরোধিতা করেছিলেন, না কি উন্নয়নের নামে লুন্ঠনের প্রতিবাদ করেছিলেন?

শাসকরা জনস্বার্থহানিকর যা কিছু করে, জনগণের মঙ্গলের জন্য করছি এরকম বলে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও যা কিছুই করছেন, সবই তাঁর ভাষায় দেশ-জনগণের উন্নয়নের স্বার্থে! গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কয়েকগুণ কমার পরও দাম না কমানো, খরচের দিক থেকে উন্নত বিশ্বকে হার মানানো হাজার হাজার কোটি টাকার ফ্লাইওভার, বিকল্প উপায় থাকা সত্ত্বেও ব্যয়বহুল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ফুলবাড়ির কয়লাখনি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তোলনের জন্য লিজ দেয়া, গ্যাস চুক্তি এবং সর্বশেষ রামপাল চুক্তি — সবই তো জনগণের মঙ্গলার্থে! কিন্তু ভুক্তভোগী মানুষ কি এভাবে ভাবতে পারবেন?

প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিবেচনায় অন্যতম উন্নয়ন কর্মকান্ড কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ-এর সাফাই গেয়ে বললেন, এগুলো না হলে না কি হারিকেন জ্বালাতে হতো। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিরোধিতা কখনো কেউ করেনি। প্রশ্নটা ছিল সাশ্রয়ী বিকল্প যেমন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গ্যাসভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণ-সংস্কার-নবায়ন না করে বেসরকারি খাতের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার যৌক্তিকতা নিয়ে। যার জন্য বছরে অন্ততঃ ৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। আবার ভর্তুকির টাকা পূরণ করা হয়েছে বারবার গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে। দরিদ্র জনগণের স্বল্পমূল্যের ভাতের বদলে উচ্চমূল্যের পোলাও-বিরিয়ানি খেতে না চাওয়া নিশ্চয়ই অযৌক্তিক নয়।

সুন্দরবন থেকে রামপাল নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত বলে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন। তার তো এটা জানার কথা — ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি খোদ ভারতেই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারেনি — বনভূমি থেকে ২৫ কিমি এর কম দূরত্ব ছিল বলে। অথচ সে কোম্পানিকেই সুন্দরবনের ১৪ কিমি-এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন — বড় দেশ ভারতের মত বাংলাদেশে অত দূরত্ব বজায় রাখার দরকার নেই। কয়লাভিত্তিক বিদুৎকেন্দ্রের ক্ষতির মাত্রা কি দেশভেদে কম-বেশি হয়? বরং ছোট, ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে ক্ষতি তো আরো বেশি হবার কথা।

প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বনের কাছে ও শহরের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছবি দেখিয়ে দাবি করেছেন, সেখানে কোন ক্ষতি হচ্ছে না। তাঁর দেয়া উদাহরণের মধ্যে বেশ কয়েকটিতেই ক্ষতির তথ্য ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। যেমন — তাঁর উল্লেখ করা ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করে আমেরিকান ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি। ২০১৪ সালে পানি দূষণের দায়ে আদালতে অভিযুক্ত হয়ে এই কোম্পানি জরিমানা দেয় এবং একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ও দু’টিতে দূষণ কমানোর অঙ্গীকার করে। ভিয়েতনামের কুয়াঙ্গ নিন ও তাইওয়ানের তাইচুং কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুটির বিরুদ্ধেই মারাত্মক পরিবেশ দূষণের অভিযোগ আছে। বেইজিং শহরের বড় ৪টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৩টি ইতোমধ্যেই বন্ধ হযেছে, ৪র্থটি আগাম বছর বন্ধ হবে পরিবেশ দূষণ কমানোর প্রয়োজনেই।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “আট বছর ধরে বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলছে। কিন্তু ওই এলাকায় তো গাছপালা মরেনি,  পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়নি।” বড়পুকুরিয়া আর রামপাল একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলার সুযোগ নেই। রামপালের গুরুত্ব সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ঘিরে। অন্যদিকে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বড়পুকুরিয়ার চেয়ে কার্যত ১০ গুণ বড়, দৈনিক কয়লাও পুড়বে ১০ গুণ বেশি, গড়ে প্রতিদিন ১৩ হাজার টন কয়লা। আর বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা তুলে সেখানেই ব্যবহার হচ্ছে, এতে পরিবহনজনিত দূষণ এবং ক্ষতির পরিমাণ সঙ্গত কারণে কম। কিন্তু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আসবে সুন্দরবনের ভেতরের চ্যানেল দিয়ে। লাখ লাখ টন কয়লা সুন্দরবনের আকরাম পয়েন্টে বড় জাহাজ থেকে নামানোর পর ছোট জাহাজে তা নিয়ে যাওয়া হবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এতে দিন-রাতে কয়লা লোড-আনলোড আর পরিবহনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সুন্দরবনের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য খাল-নালার পানি। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে বড়পুকুরিয়ার পরিবেশের ক্ষতি হয়নি —এটা খালি চোখে দেখে সিদ্ধান্ত টানা যায় না। খালি চোখে বোঝার উপায় আছে কি ঢাকার বাতাস মারাত্মক মাত্রায় দূষিত? দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে জানতে হলে বড়পুকুরিয়ার পরিবেশ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। কিন্তু সেই কাজ না করেই ঢালাও সার্টিফিকেট দেয়া কতটা যৌক্তিক বা সমীচীন!

সবচেয়ে বড় কথা, যেকেনো বন আর সুন্দরবন এক নয়। সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। আমাদের দেশে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বুক আগলে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরবন পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের বনের সাথে তুলনীয় হতে পারে না। সবাই জানেন, জোয়ার-ভাটার লোনা ও মিঠা পানির ওপর নির্ভরশীল এ ম্যানগ্রোভ বন অত্যন্ত সংবেদনশীল। আর একথা বিজ্ঞানীমহলে স্বীকৃত — যত উন্নত প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হোক্ তা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে সৃষ্ট বায়ু, পানি ও মাটি দূষণকে পুরোপুরি রোধ করতে পারে না। এজন্যই আমেরিকার মত উন্নত প্রযুক্তির দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপরই বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে।

আন্দোলনকারীদের অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য সম্ভবতঃ তাঁর নিজের দল পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত। ন্যায়সঙ্গত লড়াইতে যখন মানুষ নামে, তখন টাকার লোভে সে চলে না, বিবেকের তাগদেই মানুষ আসে, দায়িত্ব নেয়। সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে সামষ্টিক কল্যাণ কামনা থেকে মানুষ কোনো কাজ করতে পারে, জনগণের অর্থসাহায্যে কোনো আন্দোলন পরিচালিত হতে পারে — এসব তাঁর ধারণার বাইরে।

প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে বিএনপি-র সমর্থনের উল্লেখ করে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িয়ে ন্যায্য এই আন্দোলনকে বিতর্কিত ও কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছেন। তিনি একথা ভালো করেই জানেন — সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে এতদিন খালেদা জিয়া ছিলেন না, ছিল জনগণ। আজ রামপাল প্রশ্নে বিএনপি যে অবস্থান নিয়েছে, তার সাথে জাতীয় কমিটির বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিক লড়াইয়ের চরিত্রগত পার্থক্য সচেতন মানুষ বোঝেন। অতীতে গ্যাস-কয়লা-বন্দর রক্ষার যে আন্দোলন হয়েছে, তা আওয়ামী লীগ-বিএনপির গৃহীত নীতির বিরুদ্ধেই হয়েছে। নিকট অতীতে বিএনপির দমন-পীড়ন মোকাবেলা করেই ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত কয়লাখনির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। সেই রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের সময়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্য জনসভায় বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে তাঁর দল আন্দোলনকারীদের সাথে চুক্তি বাস্তবায়ন করবে। তিনি অবশ্য তাঁর সে প্রতিশ্রুতি রাখেননি।

বামপন্থীদের অণু-পরমাণুতে বিভক্ত হওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কটাক্ষকে আপাত বাস্তব বলে মনে হতে পারে। কিন্তু, তাতে কি বামপন্থীদের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনের যৌক্তিকতা খারিজ হবে? বামপন্থীদের শক্তি সীমিত হতে পারে, কিন্তু তাদের গড়ে তোলা এ আন্দোলন যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রাণের দাবিকে প্রতিফলিত করছে — তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। না হলে প্রধানমন্ত্রীর এ সংবাদ সম্মেলন করার প্রয়োজন হতো না। ক্ষুদ্র শক্তি হলেও বামপন্থীদের অবস্থান জনস্বার্থের পক্ষে, আর বিরাট শক্তি ও ঐতিহ্য নিয়েও আওয়ামী লীগের অবস্থান আজ জনগণের আকাঙ্খার বিরুদ্ধে। ফলে, কেবল সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে ন্যায্যতা নির্ধারিত হয় না। পরিশেষে বিনীতভাবে আমরা বলতে চাই, বামপন্থীদের মধ্যে যারা আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রগতিশীলতা খোঁজেন, মৌলবাদ-জঙ্গীবাদসহ নানা প্রশ্নে তাদের ডাক এড়াতে পারেন না — তাঁরা যেন আওয়ামী লীগের চরিত্র ও তার চোখে নিজেদের অবস্থানটি বুঝার চেষ্টা করেন। এটি অনুধাবন করা গেলে পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে স্বাধীন অবস্থান নিয়ে গণআন্দোলনের পথে বামপন্থীদের ঐক্য স্থাপিত হবে এবং লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা কার্যকর রাজনৈতিক শক্তিকে তখন কেউ আর ‘অণু-পরমাণু’ বলে কটাক্ষ করতে পারবে না।

সাম্যবাদ সেপ্টেম্বর ২০১৬

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments