জাতীয় কমিটির মহাসমাবেশে জনতার ঢল
প্রতিদিন পত্রপত্রিকায়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখতে হয় গা শিউরে ওঠা নানা খবর। দেখতে দেখতে মানুষের অনুভূতিও কেমন যেন ভোঁতা হয়ে আসে। এত এত অমানবিক ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে, অথচ কোনটিরই কোন প্রতিকার-প্রতিবিধান নেই। আইন-বিচার কোন কিছুই আজ সাধারণ মানুষের পক্ষে নেই। “নাহ্। এদেশে কিছু হবেনা” – এমন ধারণা আজ কেবল বদ্ধমূলই নয়, সামাজিক স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট এমন যে কোন ক্রিয়াতে তৎপর হবার ক্ষেত্রে, সামাজিক প্রয়োজনে জেগে ওঠার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক। তাই মানুষের প্রতি সংবেদন যেখানে হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে জীববৈচিত্র্য বা সুন্দরবনের প্রতি কতটুকু সংবেদন আশা করা যায়?
২৬ নভেম্বর ২০১৬ জাতীয় কমিটির মহাসমাবেশ যারা দেখতে এসেছিলেন তারা নির্দ্বিধায় বুঝবেন, সংবেদশীলতা হারিয়ে যায়নি সমাজ থেকে। সবার চোখে-মুখে ছিলো এক প্রাণজাগানো আকুতি- ‘বাঁচাতে হবে সুন্দরবন।’ এরই প্রতিধ্বনি প্রকাশ পেলো আনু মুহাম্মদের কন্ঠে— “মানুষ না থাকলেও সুন্দরবন থাকবে, কিন্তু সুন্দরবন না থাকলে মানুষ থাকবেনা।”
শিশু, বৃদ্ধ, নারী, কৃষক, শ্রমিক— কে আসেনি সেদিন? উত্তরববঙ্গ থেকে কৃষকরা এসেছেন ফসল কাটার কাজ-মজুরি বাদ দিয়ে। সারাদিন হড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে না পাওয়া শ্রমিকরা এসেছেন। নবজাতক কোলে নিয়ে এসেছেন মায়েরা। বড় দলগুলোর সভায় টাকা দিয়ে য়ে লোক জড়ো করা হয়, তাদের চোখে দীপ্তি থাকেনা, তারা ভাড়ায় জমায়েত বাড়াতে আসে। কিন্তু সেদিন শহীদ মিনারের সভাস্থলে বসেছিলো কয়েক সহস্র দীপ্তিময় মুখ। মধ্যবিত্ত জীবনের নানা টানাপোড়েনের ঘটনা আমরা জানি। হিসেবে হিসেবে জীবন পার হয়ে যায়। সেই জীবন ভেঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে নাঈমউদ্দিন ছুটে এসেছিলেন মাতৃহারা দুই সন্তানকে নিয়ে, প্রাত্যহিক উদ্বিগ্নতাকে পাশ কাটিয়ে। সভা শেষ করে আবার ফিরে যান চট্টগ্রামে। পরদিন সকালে ছেলেমেয়েদের খাইয়ে আবার স্কুলে নিয়ে যেতে হবে! এভাবেই শহীদ মিনার যেন এক মোহনায় পরিণত হয়েছিল সেদিন, ঐদিন সারাদেশ থেকে আগত জনতার স্রোত মিলেছে এই এক মোহনায়।
সমাবেশের নির্ধারিত সময়ে পূর্বে সকাল থেকেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিবেশনায় সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনের নাটক-গান পরিবেশিত হতে থাকে। দুপুর ২টা থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠনের মিছিলগুলো একে একে আসতে থাকে। সমাবেশ শুরুর আগেই শহীদ মিনার জনসমুদ্রে পরিণত হয়। বেলা ৩টায় আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, বাসদ (মার্কসবাদী)র কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন নান্নু, বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, জাতীয় গণ ফ্রন্টের সভাপতি টিপু বিশ্বাস, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের আহ্বায়ক মাসুদ খান প্রমুখ।
সমাবেশে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সরকার রামপালের মতো সুন্দরবন বিনাশী প্রকল্প করছে আর বলছে এসব উন্নয়নের জন্য হচ্ছে। এই উন্নয়ন ৯৯জনকে বঞ্চিত করে একজনের উন্নয়ন। এই উন্নয়ন পুঁজিবাদী উন্নয়ন। যারা দেশে লুটপাট করে বিদেশে টাকা পাচার করছে, তারাই এসব উন্নয়নের কথা বলছে। এসব উন্নয়নের মানে হচ্ছে গাইবান্ধায় সাওতালদের, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দুদের, রামু থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদের উন্নয়ন।
শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলেন, জনগণের প্রয়োজন পূরণের নাম করে চলে জনগণের সম্পদ লুটপাট এবং জনগণের স্বার্থ হরণ। এবারও বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের কথা বলে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে। এর আগে বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে কথা বলে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। শুধু এক বিদ্যুৎ খাতেই কি ভয়াবহ লুটের শিকার হচ্ছে দেশবাসী! আসলে বিদ্যুৎ শুধু নয়, জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান-নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সমস্ত ক্ষেত্রেই দেশের সাধারণ মানুষ নির্মম শোষণের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে চলেছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বামপন্থীদের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের ধারায় জনগণের পক্ষের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি, সমাজ পরিবর্তনের শক্তি গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
সবার বক্তব্য শেষে আনু মুহাম্মদ নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করেন। তিনি ২৬ ডিসেম্বর দেশব্যাপী দাবি দিবস, ৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস, ১৪ জানুয়ারি জ্বালানি সংকট নিরসনে বিকল্প প্রস্তাবনা উপস্থাপন। এর মধ্যে দাবি মানা না হলে ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় অর্ধদিবস হরতাল পালনের ঘোষণা করেন। উপস্থিত জনতা মুহুর্মহু করতালির মধ্য দিয়ে এই কর্মসূচীকে স্বাগত জানায়। এবং সুন্দরবন রক্ষায় আরও কঠোর সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
সমাবেশ শেষে একটি দীর্ঘ মিছিল টিএসসি শাহবাগ, মৎস ভবন হয়ে প্রেসক্লাবের কদম ফোয়ারার সামনে এসে সমাপ্ত হয়।
সাম্যবাদ ডিসেম্বর ২০১৬