২০১৮-১৯ অর্থবছরে এডিপির সবচেয়ে বড় অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে বিতর্কিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যে। সার্বিক প্রকল্প ব্যয় ৩২,০০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে, ইতোমধ্যে লক্ষ-কোটির ঘর ছাড়িয়ে এটি এখন দেশের রেকর্ড ব্যয়ের প্রকল্প। অবশ্য শুধু দেশে কেন? সাম্প্রতিককালে প্রায় সব ‘মেগা’ প্রকল্পে ব্যয়ের হারের দিক থেকে বাংলাদেশ গোটা বিশ্বেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে, যদিও মানের প্রশ্ন তুললেই ‘উন্নয়নবিরোধী’ তকমা জোটে!
দেশের ভেতরে-বাইরে প্রচন্ড বিরোধিতা সত্ত্বেও এরই মাঝে প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের ঢালাই সম্পন্ন করা হয়েছে। অথচ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে প্রধান বিপদ, তার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সেই বিষয়টিরই কোনো সুরাহা করা হয়নি। সমালোচনার মুখে সরকারের তরফে জানানো হলো, আসছে জুনে রাশিয়ার সাথে চুক্তি হবে যাতে তারা ‘স্পেন্ট ফুয়েল’ ফেরত নিয়ে যায়। কিন্তু ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাস হওয়া রাশিয়ার আইনে স্পষ্ট বলা আছে অন্য দেশ থেকে পারমাণবিক বর্জ্য ‘রিসাইকেলের’ জন্যে আনা হলেও অন্য কোনো দেশের বর্জ্য সেখানে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা যাবে না।
উপরন্তু বিদ্যমান চুক্তিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার সম্পূর্ণ দায় বর্তাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকের উপর, যাতে চুক্তি মতো নাম আছে বাংলাদেশের। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কিন্তু চুক্তির শর্ত আলাদা। ২০১০ সালে ভারতে পাস হওয়া আইন অনুযায়ী দুর্ঘটনা যদি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কারণে হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়, তবে তার দায় তাকেও বইতে হবে। এবং সেখানে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে এর মধ্যেই চারটি নিম্ন মানসম্পন্ন পাইপ বদলে দিতে হয়েছে যা ভারতীয় বিজ্ঞানীরা সনাক্ত করেছিলেন।
ব্যয়ের হিসাব শিকেয় তুলে রাখলেও এমন ঘটনা আমাদের ক্ষেত্রে ঘটলে যে আমরা বুঝতে পারব — সেরকম নিশ্চয়তাই আমাদের নেই। পরমাণু কমিশনে কাজ করা সাবেক একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকতা কদিন আগেও দক্ষ জনবলের এই সংকটের কথা তুলে ধরেছেন। যদিও বুয়েট এবং ঢাবিতে এ সংক্রান্ত বিভাগ খোলা হয়েছে, কিন্তু তা এই বিশালায়তন প্রকল্পের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল, এমনটাই ‘দৈনিক প্রথম আলো’কে দেওয়া মতামতে তাঁরা জানিয়েছেন।
আরও ভয়ের ব্যাপার হলো এই প্রকল্পে ঠিকাদারী নিয়েছে রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান। যাবতীয় সমীক্ষাও করছে তারা। এবং সেইসব সমীক্ষার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বেও আছে রাশিয়া। ভবিষ্যতে যারা বাংলাদেশের হয়ে কাজগুলো দেখভাল করবেন বলে বলা হচ্ছে, তারাও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন সেই রাশিয়া থেকেই। এখানে তৃতীয় কোনো অভিজ্ঞ পক্ষ বা বিশেষজ্ঞ যাচাই কমিটির কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। দেশের মা-মাটি-মানুষের নিরাপত্তার কোনো তোয়াক্কা, এখন পর্যন্ত পরিবেশগত কোনো সমীক্ষা প্রকাশ না করে, সরকার কেবল একতরফাভাবে বিদ্যুৎ-সঙ্কটকে পুঁজি করে প্রকল্পের পক্ষে সাফাই গেয়ে যাচ্ছে।
এককালে আশা জাগানিয়া ‘গ্রীন এনার্জি’ খ্যাত এই নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ নিয়ে চেরনবিল-ফুকুশিমার পরে গোটা বিশ্বই আবার নতুন করে ভাবছে। যদিও এর মধ্যে প্রযুক্তির অনেক অগ্রগতি হয়েছে কিন্তু এমআইটি থেকে প্রকাশিত গবেষণা বলছে, ২০৫৫ সালের মধ্যে অন্তত আটটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপনা এতটাই জটিল যে, সবকিছু সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসহ ডিজাইন করলেও তাতে আর দুর্ঘটনা ঘটবে না বলে নিশ্চিত করে বলা যায় না।
প্রসঙ্গত জনবলহীন কাঠামো নিয়ে উচ্চ-প্রযুক্তির এমন দোহাই সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে নির্মাণাধীন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও দেওয়া হয়েছিল। অথচ সার-তেল-কয়লাবাহী জাহাজডুবির ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি নিয়মিত। ‘দক্ষিণবঙ্গে উন্নয়নের জোয়ার’ বইতে না বইতে সেখানে মাছ-মধু আহরণ বেঁচে থাকা জেলে-বাওয়ালদের জীবিকাই উল্টো এখন হুমকির মুখে। সেই অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশে ঠিক আমাদের প্রধান নদী পদ্মার পাশেই এই বিশাল আয়তন এবং অযৌক্তিক ব্যয়ের সম্পূর্ণ পরনির্ভর পারমাণবিক কেন্দ্রের স্থাপনা কোনো বিচারেই সমর্থনযোগ্য নয়। তাই দেশের সচেতন নাগরিকদের কাছে বাসদ (মার্কসবাদী)-র আহ্বান, মা-মাটি-মানুষের নিরাপত্তা রক্ষার লড়াইয়ে শামিল হোন, প্রাণ-প্রকৃতিবিধ্বংসী রামপাল ও রূপপুর প্রকল্প রুখে দাঁড়ান।