‘বিদ্যুৎ চাই’, ‘উন্নয়ন চাই’ — এমন কথা বাংলাদেশে খুব শোনা যাচ্ছে। বিশেষত বর্তমান আওয়ামী মহাজোট সরকারের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে যে, বিদ্যুৎ না হলে উন্নয়ন হবে না, আর তাই যেকোনো মূল্যে বিদ্যুৎ চাই। সরকারের এই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি সুন্দরবনের জন্য বিপজ্জনক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ও আলোচনায়। রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়টিও ছিল আমাদের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এবং এখানেও সরকারের মনোভাব পুনর্বার প্রকাশ পেল প্রধানমন্ত্রীর কথায়।
রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের সময় দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন : “আমরা সব ভেবেচিন্তেই করছি। এটা হবেই, সমালোচনা করে লাভ নেই।” আসলে শুধু রূপপুর নয়, রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ কিংবা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেয়া পরীক্ষা — কোনোটা নিয়েই সমালোচনা করে লাভ হচ্ছে না। কারণ সবই তারা ভেবেচিন্তে করছেন, আর এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার দ্বিতীয় কেউ দেশে নেই। দেশের জন্য যা ভাববার, যা করবার, সব তারাই করবেন। বাকিদের কাজ হলো দেখে যাওয়া আর বাহ্বা দেয়া।
পাবনার রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে গত ২৬ জুলাই ২০১৬ রাশিয়ার সাথে ঋণচুক্তি করেছে সরকার। সম্পূর্ণরূপে রাশিয়ার ঋণ, প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞ সহায়তার উপর নির্ভর করে বিপুল ব্যয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে সচেতন ও বিশেষজ্ঞ মহলে বহুদিন ধরেই উদ্বেগ বিরাজ করছে। মূলত ৪টি কারণে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আপত্তি উঠেছে। প্রথমত, এর বিপুল ব্যয় ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বারবার ব্যয়বৃদ্ধি। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ান কোম্পানির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা ও দেশে দক্ষ জনবলের ঘাটতি। তৃতীয়ত, তেজস্ক্রিয় দূষণ ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি। চতুর্থত, বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপন্ন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সংকট। এছাড়াও এখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের উচ্চ দামও একটা আপত্তির বিষয়। এসব আপত্তি উপেক্ষা করেই গত ৩০ নভেম্বর ’১৭ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কংক্রিট ঢালাই উদ্বোধন করলেন।
এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে আমরা শুরুর একটা কথা সামান্য আলোচনা করে নিতে চাই। বিদ্যুৎ হলে সাধারণ মানুষের সুবিধা হয়, এটা সত্য। কিন্তু বিদ্যুৎ, আমাদের মতো দেশগুলিতে, আরো বড় সুবিধা নিয়ে আসে ব্যবসায়ী মহলের জন্য। বিদ্যুৎ বিরাট বাজার খুলে দেয়। বিদ্যুৎ হলে লাইট, ফ্যান, টিভি, ফ্রিজ বিক্রি হয়; এমনকি যেসব এলাকায় দিনে ৪/৫ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকে না সেখানেও। এছাড়া বাংলাদেশে এখন গার্মেন্ট, ঔষধ, সিরামিক, চামড়া, খাদ্যদ্রবসহ বিভিন্ন রপ্তানিমুখী শিল্পের বাড়বাড়ন্ত। এসব শিল্পের নতুন নতুন কারখানা করার জন্য বিদ্যুৎ চাই। আর সে কারণেই এ কথা বললে ভুল হবে না যে ব্যবসায়ী শিল্পপতি মহলের বিদ্যুতের চাহিদাকে জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে ‘উন্নয়ন’ বলে চালানো হচ্ছে।
পরমাণু বিদ্যুৎ : সারা বিশ্বের অভিজ্ঞতা কী বলে?
জাপান প্রযুক্তিতে অত্যন্ত অগ্রসর একটি দেশ। বাংলাদেশের তুলনায় তো বটেই, সারা বিশ্বের প্রেক্ষাপটেও। ২০১১ সালে ভূমিকম্প ও সুনামির সময় জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তেজস্ক্রিয় দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষণীয় হলো, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে আমাদের চেয়ে বহুগুণ উন্নত হয়েও জাপান নতুন কোনো পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেয়নি। বরং জাপানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী নাওতা কান মন্তব্য করেন যে জাপানের পরমাণুকেন্দ্রগুলো ধ্বংস করে ফেলা উচিত।
জাপানের ঘটনার পর পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় দেশ জার্মানি ও ফ্রান্সে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় ঘটে গেছে। জার্মানি তাৎক্ষণিকভাবে দেশের ৭টি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করে। পরমাণু জ্বালানি ইস্যুকে ঘিরেই ২০১২ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৫৮ বছর ধরে ক্ষমতাসীন সিডিইউ সরকারের পতন ঘটে। সেখানে পরমাণু জ্বালানির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে গ্রিন পার্টি বিজয়ী হয়। এমন পরিস্থিতির মধ্যে জার্মানি ঘোষণা করে যে ২০২২ সালের মধ্যে সমস্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ধাপে ধাপে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কতটুকু নিরাপদ?
পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রসঙ্গে প্রথমেই যে কথাটি চলে আসে তা হল এর নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির বিষয়টি। বিজ্ঞানের যেকোনো আবিষ্কারই এক ধাক্কায় সফলতার মুখ দেখে না, এবং সে কারণেই প্রতিটি প্রযুক্তিই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিখুঁত ও নিরাপদ হতে থাকে। প্রযুক্তি এবং আর্থিক সামর্থ্যে অগ্রসর দেশগুলো পরমাণু প্রযুক্তি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো দেশই পরমাণু জ্বালানির নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেনি।
বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে তা রাশিয়ার উপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি করে দেবে। কেননা শুধু রাশিয়ার প্রযুক্তি সহায়তাই নয়, বরং বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য যে কাঁচামাল দরকার হবে (ইউরেনিয়াম), তার সরবরাহ নিশ্চিত করার এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য নেয়ার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সব সময় আমাদের সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে। এমনকি আমাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন করে হলেও। এ প্রকল্প যতদিন চলবে ততদিন দুইটি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারে?
তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে পারে পানিতে যা মুহূর্তে গোটা দেশকে গ্রাস করবে
এই বর্জ্য নিষ্কাশনের সমস্যা ছাড়াও আর অনেক সমস্যা আছে। পারমাণবিক চুল্লিকে ঠান্ডা রাখার জন্য তাকে ঘিরে ঠান্ডা পানির প্রবাহ চালানো হয় (জাপানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল ওই পানি দিয়ে ঠান্ডা করার প্রযুক্তি বা কুলিং সিস্টেম অচল হয়ে পড়ায়)। জাপানের ফুকুশিমা ও আমেরিকার থ্রি মাইল আইল্যান্ডের ঘটনায় আমরা জানি তেজস্ক্রিয়তাযুক্ত পানি আশপাশের নদী-সাগরের পানির প্রবাহের সাথে মিশে বিস্তীর্ণ এলাকার, এমনকি প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারের জনগণকেও বিরাট স্বাস্থ্যঝুঁকির মাঝে ফেলেছে। আমাদের এই নদীবহুল-পানিবহুল দেশে একটি ছোট ঘটনাই কি যথেষ্ট নয় সারাদেশের মানুষকে ক্যান্সারের ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিতে?
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্যপদার্থ থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে পরিবেশ দূষণের মাত্রাও খুব ভয়াবহ। বাংলাদেশে আমরা এই পারমাণবিক বর্জ্য পুঁতে রাখব কোথায়? ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে এমন কোনো পরিত্যক্ত অঞ্চল নেই যেখানে আমরা পারমাণবিক বর্জ্য সরিয়ে রাখতে পারি। মাটির গভীরে পুঁতে রাখলে ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে যা আমাদের দেশে বিরাট বিপর্যয় নামিয়ে আনবে। ফলে পারমাণবিক বর্জ্য আমাদের ঘাড়ে এক বিরাট সমস্যা হিসাবে আবির্ভূত হবে। বলা হচ্ছে, রাশিয়া এই বর্জ্য বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাবে। কিন্তু এ ধরনের কোনো সুনির্দিষ্ট চুক্তি এখনও স্বাক্ষর হয়নি।
সরকার কী বলছে?
এসব বিপদের কোনো কিছুকেই বিবেচনায় না নিয়ে সরকারের তরফ থেকে যে কথাটি বলা হচ্ছে তা হলো, রূপপুরে আনা হবে তৃতীয় প্রজন্মের রিঅ্যাক্টর, যা অত্যন্ত নিরাপদ। তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় দ্বিতীয় প্রজন্মের তুলনায় এতে দুটি বৈশিষ্ট্য উন্নত — এতে তেজস্ক্রিয়-দূষিত পানি বাইরে আসবে না, আর এর নিরাপত্তা বেষ্টনী অধিক পুরু স্টিলের তৈরি। এর ফলে খরচও বেড়ে যায় প্রায় চার গুণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতসব জানার পরও জার্মানি, ফ্রান্স ও আমেরিকার মতো প্রযুক্তিতে উন্নত দেশ কেন নতুন পারমাণবিক চুল্লির বিষয়ে অনাগ্রহী?
ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানীরা চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তির দিকে ধাবিত হচ্ছেন, এবং সেটা নিরাপত্তার কথা ভেবেই। যদি তৃতীয় প্রজন্মের প্ল্যান্ট যথেষ্ট নিরাপদ হতো তাহলে এতো দ্রুত কি বিজ্ঞানীরা তা পরিবর্তনের কথা ভাবতেন? বলা দরকার যে অতি উন্নতমানের ইউরেনিয়াম ব্যবহার না করলে তৃতীয় প্রজন্মের প্লান্টের কর্মদক্ষতা ব্যাপক পরিমাণে হ্রাস পায়। এ কারণেই, রাশিয়া আমাদের কী মানের ইউরোনিয়াম দেবে তা খুবই সংশয়ের ব্যাপার। পণ্য বিক্রেতা সবসময়ই বিজ্ঞাপনে তার পণ্যের গুণাগুণ বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে, এমনকি যা নেই তাও প্রচার করে। কিন্তু ক্রেতাও যখন বিক্রেতার ভাষায়, বিজ্ঞাপনের ভাষায় কথা বলে তখন সত্য-মিথ্যা যাচাই করা সত্যিই দুরূহ হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকা। কিন্তু সে ঝুঁকিকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন সরকারের কর্তারা। তারা বলছেন যে, বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকলেও রূপপুর পরমাণু বিদ্যুকেন্দ্র রিখটার স্কেলে ১০ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করার মতো করে তৈরি করা হবে। কিন্তু সমস্যাটা তো শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভূমিকম্প সহনক্ষমতার বিষয় নয়। বড় ধরনের ভূমিকম্পে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরে প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন উৎপন্ন তাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। সেই পানির যোগান তখন কীভাবে মেটনো হবে? আর শুধু চুল্লি নয়, ভূমিকম্পের ফলে পরমাণু বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বড় দুর্যোগের জন্য আমরা সাধ্যমতো প্রস্তুতি নেব, কিন্তু যে প্রযুক্তি দুর্যোগের ফলে, যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনার ফলে বোমায় রূপান্তরিত হবার একাধিক নজির আছে, সেই প্রযুক্তি ঘরে তুলে আনার অর্থ কী?
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কি সস্তা?
এক সময় অনেকেই ভেবেছিল, পারমাণবিক শক্তির সাহায্যে স্বল্প খরচে অফুরন্ত শক্তি উৎপাদনের চাবিকাঠিটা মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও সেদিন এ আবিষ্কারকে ‘প্রাগৈতিহাসিক মানুষের প্রথম আগুন আবিষ্কারের পর সবচেয়ে বড় বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। চল্লিশের দশক থেকেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়। পরে এ তালিকায় যুক্ত হয় কানাডা, চীন, ভারত, পাকিস্তানসহ আরও অনেক দেশের নাম।
কিন্তু কিছুদিন পরেই এ উৎসাহে ভাটার টান লাগে। দেখা গেল, পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে তা ব্যবহারের মাত্রাও কমতে থাকে। হিসেব করে দেখা যাচ্ছে, একই ক্ষমতার একটা তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে প্রয়োজনীয় পুঁজির চেয়ে একটা পারমাণবিক বিদ্যুকেন্দ্র স্থাপনে প্রয়োজনীয় পুঁজির পরিমাণ আড়াই থেকে তিন গুণ বেশি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণ খরচও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। আবার একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যত খরচ হয়, তার আয়ু শেষ হওয়ার পর তা নিরাপদে ভেঙে ফেলতে খরচ পড়ে নতুন চুল্লি বসানোর খরচের প্রায় সমান। অর্থাৎ খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। এখন কেউ যদি নিরাপত্তা ও ভাঙার খরচ বাদ দিয়ে শুধু নির্মাণ ব্যয়টাকেই দেখায় তাহলে সেটা হবে একটা নির্জলা মিথ্যাচার ও প্রতারণা।
এমনিতেই উচ্চমূল্যের এ পরমাণু বিদ্যুৎ আমাদের মতো দুর্নীতি-লুটপাটে আক্রান্ত দেশে আরও দামী হয়ে ওঠে। যেমনটা রূপপুরের ক্ষেত্রেও হয়েছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা)। এরপর শোনা গেল এতে ব্যয় হবে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলার বা ২৪ হাজার থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা। আর নির্মাণ শুরু হওয়ার আগেই কয়েক ধাপে ব্যয় বাড়িয়ে এখন পর্যন্ত ব্যয় এসে ঠেকেছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১ লাখ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায়। এই ব্যয় কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কে বলতে পারে?
পরমাণুর রাজনীতি : লুণ্ঠিত গ্যাস-কয়লা
বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস-কয়লা-পানি-বায়ু প্রভৃতি বিপুল প্রাকৃতিক উৎস আমাদের দেশে আছে। এসব নিরাপদ পথ থাকতেও অনিরাপদ এবং ভয়ঙ্কর পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন কেন? তাও আবার পরের কাছ থেকে ধার করে? এর পেছনে একদিকে আছে শাসকদলের বাহবা নেয়ার প্রচেষ্টা। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন তাদের কাছে নাকি প্রেস্টিজিয়াস ইস্যু! কিন্তু বিষয়টি আসলে প্রেস্টিজের নয়, ক্ষমতার। আওয়ামী লীগ দেশের জনগণের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় নেই। তার প্রধান সহযোগী হলো দেশের বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি শ্রেণি, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র আর সাম্রাজ্যবাদী ভারত। আওয়ামী লীগের নানা সিদ্ধান্তে সা¤্রাজ্যবাদী বিশ্বের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ। তাকে মোকাবেলা করতে আওয়ামী মহাজোট বিশ্বের অপরাপর পরাশক্তি যথা রাশিয়া ও চীনকে হাতে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, প্রধানত রাশিয়াকে সন্তুষ্ট রাখতেই রূপপুর প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জামও কেনা হয়েছে। একইভাবে চীনকে হাতে রাখার জন্যও নানা প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিষয়ে রাশিয়াও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ইত্যাদি প্রকল্পে আগ্রহী হয়ে উঠেছে চীন।
এটাও সবার জানা পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্য শুধু চুল্লি নয়, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম, এমনকি প্রকৌশলী-মিস্ত্রি সবকিছুই আমাদের আমদানি করতে হবে। ফলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বাবদ মন্ত্রী-আমলাসহ দেশের কর্তাদের পকেটে একটা মোটা অংকের কমিশন জমা হবে। এ কাজের কন্ট্রাকটের (ঠিকাদারি) সাথে যুক্ত থেকে বড় ব্যবসায়ীদেরও বেশ ভাল লাভই হবে।
শাঁখের করাতের নিচ থেকে বেরিয়ে আসুন
বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠী শাঁখের করাতের মতো জনগণকে কাটছে। একবার দেশের গ্যাস-কয়লা সা¤্রাজ্যবাদীদের হাতে তুলে দিয়ে, আরেকবার বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটের কথা বলে সুন্দরবন বিনাশী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কিংবা দেশকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে।
আমরা বিজ্ঞানের অন্য যেকোনো আবিষ্কারের মতো পরমাণু শক্তির ব্যবহারের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু এর জটিল প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান, দক্ষতা-অভিজ্ঞতা ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আয়ত্ত করা ছাড়া ব্যবহারের যে ঝুঁকি রয়েছে তা এড়ানোর পক্ষে। সাথে সাথে পরমাণু শক্তির ব্যবহার নিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর যে আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা আছে তার কবল থেকে মুক্ত থাকার পক্ষে।
রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের সময় থেকে বাংলাদেশে একটা স্লোগান আমরা শুনলাম — ‘পারমাণবিক যুগে বাংলাদেশ’। এই স্লোগান লেখা বিলবোর্ডে গোটা ঢাকা শহর ছেয়ে গেল। পাবনা শহরসহ রূপপুরকেও সাজানো হয়েছিল। কিন্তু এই সাজ সাজ রব আর স্লোগান আমাদের কী দেবে? বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে বলেও তো অনেক ঢাক-ঢোল পেটানো হয়েছে। কিন্তু সেই ঢাকের শব্দ কি দেশের গরিব শ্রমিক কৃষক সীমিত আয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে কোনো প্রভাব ফেলেছে? বরং প্রতিদিন চালের দাম, পেঁয়াজের দাম, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে মানুষের আহাজারি কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। মালিকগোষ্ঠীর খাই মেটাতে আর শাসকদের ‘প্রেস্টিজ’ উঁচু করতে যে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের উপর চাপানো হলো, তার দায় কারা বহন করবে?