গত ৩০ নভেম্বর দুটি বামপন্থী জোট — গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা ও সিপিবি-বাসদ এর ডাকে দেশব্যাপী হরতাল পালিত হলো। বিদ্যুতের বর্ধিত দাম প্রত্যাহার ও চালসহ নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবিতে ডাকা এ হরতালের প্রচারকালে কথায় কথায় একজন বলছিলেন, ‘সংবিধান মতে দেশের মালিক আমরা হলেও বাস্তবে আমরা হলাম ভাড়াটিয়ার মতো। অনেক বাড়িওয়ালা যেমন ইচ্ছামাফিক ভাড়া বাড়িয়ে চলে, মওকা খোঁজে ভাড়া বাড়ানোর, সরকারও তেমনটিই করছে।’ ভদ্রলোকের মিল খোঁজার ধরনটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সীমিত আয়ের জীবনযাপনে জেরবার মানুষের আর্তধ্বনিটি সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু এ সংবেদন বোঝার সাধ্য সরকারের নেই। জনগণের টুটি চেপে ধরে এভাবেই সরকারের ‘উন্নয়ন’ কর্মকা- চলছে।
দাম বাড়ার আসল কারণ
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে সরকার বলেছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নাকি ৫৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে! বর্তমানে প্রতি ইউনিট পাইকারি বিদ্যুতের গড় সরবরাহ ব্যয় ৫.৫৯ টাকা আর পিডিবি বিক্রি করে ৪.৮৭ টাকা। এ হিসেবে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয় ৭২ পয়সা। এ বিপুল আর্থিক ক্ষতি সমন্বয়ের জন্যই নাকি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এটি দাম বাড়ানোর আসল কারণ নয়। বিষয়টি বোঝার জন্য কিছু তথ্য জানা দরকার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে পিডিবি উৎপাদন করত ৭০ শতাংশ। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াট। পিডিবি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মিলে পাবলিক খাতে উৎপাদন হয় ৫৬ শতাংশ। অন্যদিকে ব্যক্তি খাতে (বেসরকারি) উৎপাদন হয় ৪৪ শতাংশ। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বিশেষত রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ সব খরচই বেড়েছে। দৈনিক পত্রিকা ‘বণিক বার্তা’র গত ৪ ডিসেম্বরের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে বর্তমানে পুঁজি লগ্নি করে সবচেয়ে বেশি মুনাফা আসে যে খাত থেকে, তা হলো বিদ্যুৎ। বাংলাদেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের মুনাফার হার ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তালিকাভুক্ত বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। লগ্নিকৃত মূলধন ও ব্যবহৃত সম্পদের বিপরীতে রিটার্নেও এগিয়ে আছে তারা। যেকোনো দেশে আপদকালীন সময়ে বা জরুরি প্রয়োজনে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হয়। কিন্তু এগুলো অর্থনীতিতে বড় ধরনের আর্থিক চাপ তৈরি করার কারণে দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী হয় না। অথচ আমাদের এখানে ব্যবসায়ীদের লুটপাটের জন্য ২০১৩ সালে বন্ধ করে দেয়ার কথা থাকলেও ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় বর্ধিত করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী তেলের দাম কমালে বিদ্যুতের দামও কমানো যেত
বর্তমানে চালু থাকা ১০৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে তেলভিত্তিক কেন্দ্র রয়েছে ৪৬টি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম প্রায় ৩ গুণ কমলেও দেশে সে অনুযায়ী কমানো হয়নি। যেন বিপিসি-র কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েল ৪২ টাকা দরে পিডিবি-র প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ে ১২ টাকা। অথচ ব্যক্তিখাতে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বা অন্য যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরকার বিদ্যুৎ কেনে, তাদের বাজারমূল্যে কেনার অনুমতি দেয়া হয়েছে। যে কারণে তারা প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েল ২২-২৪ টাকায় আমদানি করে। ফলে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ে ৬ টাকা প্রতি ইউনিট। এ বিদ্যুৎ তারা আবার বেশি দামে বিক্রি করে পিডিবি’র কাছে। এ কারণে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় যাচ্ছে বেড়ে। আর দাম সমন্বয়ের ফলে তাকে জনগণের ঘাড়ে তুলে দেয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজার দরের সাথে তেলের দাম সমন্বয় করলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বদলে কমানোই সম্ভব ছিল।
আবার পিডিবি তার উৎপাদিত বিদ্যুৎ কম দামে বিক্রি করে বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে। ফলে তার লস বেশি। এটাকে পূর্বে ভর্তুকি বলা হতো। সেটিকে এখন ঋণ হিসেবে ধরে নিয়ে সুদও চার্জ করা হচ্ছে। এরকম নানা মারপ্যাচে সরকার জনগণের পকেট কাটছে আর লুটপাটের সুযোগ করে দিচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল ইসলাম এক হিসেবে দেখিয়েছেন, সরকারি খাতে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন ক্ষমতার ৪৩% ব্যবহার হয়। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ২.০২ টাকা। অন্যদিকে রেন্টাল, কুইক রেন্টালে উৎপাদন ক্ষমতার ৭১ শতাংশের বেশি ব্যবহৃত হয়। তাদের ইউনিট প্রতি উৎপাদন ব্যয় হয় ৩.৩৭ টাকা। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যদি রেন্টালের মতো উৎপাদন ক্ষমতার ৭১ শতাংশ ব্যবহার করত, তাহলে প্রতি ইউনিটে তাদের ব্যয় হতো ১.৫৫ টাকা। অর্থাৎ ১.৫৫ টাকায় যে বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব, সরকার তা ৩.৩৭ টাকায় কিনছে। এতে বছরে ১৩০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়।
ডিজেলে আমদানি ব্যয় হ্রাস-সমন্বয় করা হলে প্রতি ইউনিট ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৬ টাকা উদ্বৃত্ত হবে এভাবে। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ থেকেই প্রায় ২১০০ কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব।
রেন্টাল-কুইক রেন্টাল প্রথম যে মেয়াদে এসেছিল, ধরা যাক তিন বছর, সেই তিন বছরে তার কাছ থেকে যে মূল্যহারে সরকার বিদ্যুৎ কিনেছে, তার মধ্যেই ওই কেন্দ্র স্থাপনের ব্যয় রয়েছে। এরপর মেয়াদ বাড়ানোর সময় তাদের আর জ্বালানি খরচের বাইরের অ-জ্বালানি ব্যয় আগের মতো থাকার কথা নয়। কিন্তু দেখা গেছে, দ্বিতীয় বা তৃতীয় মেয়াদের রেন্টাল-কুইক রেন্টালের অ-জ্বালানি ব্যয় সরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের অ-জ্বালানি ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ বেশি। যৌক্তিক হারে মূল্য নির্ধারিত হলে এখান থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব।
মেরিট অব অর্ডার অনুযায়ী কম দামের বিদ্যুৎ বেশি কিনে এবং বেশি দামের বিদ্যুৎ কম অংকের অর্থ সাশ্রয় করা যায়। যেমন- সরকারি খাতের উৎপাদন ক্ষমতার ১৪ শতাংশের বিপরীতে নজো পাডিকের উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ শতাংশ ব্যবহার করে বেশি ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেনায় প্রায় ১১০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এখানে কম উৎপাদন করা গেলে সাশ্রয় হতো। মেঘনাঘাটে ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করলে খরচ কম পড়ত। আবার ৪০ শতাংশ ক্ষমতা ব্যবহার করে ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখানে ফার্নেস অয়েল বা গ্যাসে উৎপাদন করা গেলে সাশ্রয় হতো। সব মিলিয়ে দেখা যায়, পাইকারি বিদ্যুতের বিদ্যমান মূল হারেই ভোক্তাদের কাছ থেকে প্রায় ৬৬০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত আদায় হচ্ছে।
বিদ্যুৎ চাই, কিন্তু বহুমুখী ক্ষতির বোঝা চাই না
যে উন্নয়ন দর্শন নিয়ে সরকার চলছে, তাতে সেবাখাতসমূহ ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। ব্যবসার সুযোগে মুনাফা লুটের উন্মত্ত প্রতিযোগিতার দাপটে অধিকার হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কখনো পরিবেশ-জীবন-জীবিকার ক্ষতির আশঙ্কা উপেক্ষা করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, কখনো বা ১ লক্ষ ১৪ হাজার কোটি টাকার বিপুল ব্যয়ের বোঝা নিয়ে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রচেষ্টা গায়ের জোরে অগ্রসর করছে সরকার। আখেরে যে বিদ্যুৎ মানুষ পাচ্ছে বা পাবে, চড়ামূল্যে সরকারি অপরিণামদর্শিতার পরিণাম ভোগ করছে সাধারণ মানুষ। এখনই সে লক্ষণ স্পষ্ট। যে দেশে ১০ বছরে ৬ লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়, খেলাপী ঋণ জমে সোয়া লক্ষ কোটি টাকা, সে দেশে দুর্নীতিবাজ লুটপাটকারীদের বহাল তবিয়তে রেখে জনগণের উপর মূল্যবৃদ্ধির বোঝা চাপানোর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ আজ সময়ের প্রয়োজন। সংগ্রামের পথ ধরেই কেবল সাধারণ মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে।