ভারতের ‘অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার’ ( AIUTUC )-এর সাধারণ সম্পাদক শ্রমিকনেতা শংকর সাহা বলেন, “বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের দীর্ঘ লড়াই এবং জীবনদানের বিনিময়েই মালিকেরা স্বীকার করে নিয়েছিল শ্রমিকেরাও মানুষ; তারা যন্ত্র নয়, তাদেরও উন্নত জীবন-বিশ্রাম-বিনোদনের অধিকার আছে। বিশ্বব্যাপী জোরদার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপে বহুদেশে তা বাস্তবায়িতও হয়েছিল। আমাদের দেশেও শ্রমিকশ্রেণির সেসব অধিকার, অন্ততপক্ষে সংবিধানে ও কাগজে-কলমে স্বীকৃতি পেয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয় এবং শ্রমিক আন্দোলনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আজ দেশে দেশে মালিকশ্রেণি আবারও উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। লাগামহীন শোষণ ও লুটপাটের স্বার্থে অতীতে স্বীকৃত শ্রমিকশ্রেণির অধিকারগুলোকে মালিকরা আজ অস্বীকার করছে। তারা চায় ইচ্ছেমতো শ্রমিককে খাটাবার এবং ছাঁটাই করার অধিকার। স্থায়ী নিয়োগের পরিবর্তে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী নিয়োগই তাদের পছন্দ। অন্যদিকে, বিশ্বায়ন-উদারিকরণের নামে রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা ও ভর্তুকি প্রত্যাহারের ফলে দুর্দশা নেমে এসেছে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের জীবনে। উন্নত আদর্শ, জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী সমন্বিত ও জঙ্গী শ্রমিক আন্দোলন আজ জরুরি প্রয়োজন।”
লুটেরারা টাকার পাহাড় গড়ছে, আর শ্রমিক মানুষের মত বাঁচার অধিকার পাচ্ছে না
“বাংলাদেশে ‘অপ্রতিরোধ্য গতিতে উন্নয়ন’ হচ্ছে, অচিরেই ‘মধ্য আয়ের দেশ’-এ উন্নীত হতে যাচ্ছে বলে সরকার দাবি করছে। দেশে ভোটাধিকারসহ গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, নিরাপত্তাহীনতা-দুর্নীতি-লুটপাট-রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-বেকারত্ব-বৈষম্য ইত্যাদি সমস্যা সত্ত্বেও জাতীয় আয় সব সময়ই কিছু না কিছু বাড়ছে। কিন্তু দেশের সম্পদ বৃদ্ধিতে প্রধান অবদান যাদের, সেই শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষ এর সুফল পাচ্ছে না। একটি ক্ষুদ্র লুটেরা ধনিকগোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী-শিল্পপতি মালিকশ্রেণী টাকার পাহাড় গড়ছে। অন্যদিকে কর্মজীবী সাধারণ মানুষের বেশিরভাগ যে আয় করে, তা দিয়ে এই বাজারে মানসম্মত জীবনযাপন সম্ভব নয়। শ্রমিকদের উপর চলছে তীব্র শোষণ। তারা কোনোমতে খেয়ে-পরে বেঁচে আছে, উন্নত শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থান-বিনোদন-সঞ্চয় তাদের জন্য স্বপ্ন। গ্রাম-শহরের শ্রমজীবী পেশাজীবী নারী-পুরুষসহ আগের তুলনায় অনেক বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত ও দিশাহীন। এই পরিস্থিতির পরিবর্তনের লক্ষ্যে শ্রমিকদের সংগঠিত করতে হবে। যতদিন এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহাল আছে, ততদিন শ্রমিকশ্রেণিকে প্রতিদিনের ন্যায্য দাবিতে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম-আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি মালিকী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে উৎপাদনযন্ত্রের ওপর সামাজিক মালিকানা তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিপ্লবী শ্রমিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।” আজ বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাসদ(মার্কসবাদী) সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন ১৮ অক্টোবর শুক্রবার দিনব্যাপী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। শ্রমিকের অধিকার আদায় ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিপ্লবী ধারায় শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান নিয়ে অনুষ্ঠিত এই শ্রমিক সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন জেলা, শিল্পাঞ্চল ও নানা সেক্টরের সহস্রাধিক শ্রমিক কর্মচারী অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলন থেকে শ্রমিকের ন্যূনতম জাতীয় মজুরি ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠা, শ্রমিকস্বার্থে গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন, নিরাপদ-স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ, সরকার-মালিকের উদ্যোগে সকল শ্রমিকের জন্য রেশন-আবাসন-চিকিৎসা নিশ্চিত করা, পুনর্বাসন ছাড়া রিকশা-হকার-ইজিবাইক-বস্তি উচ্ছেদ না করার দাবি জানানো হয়।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে স্থাপিত মঞ্চে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, সিলেট ও হবিগঞ্জের চা-বাগান শ্রমিক এবং খুলনার পাটকল শ্রমিকরা। সকাল সাড়ে ১১টায় সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা শ্রমিকনেতা জহিরুল ইসলাম। উদ্বোধনী বক্তব্যের পর বেলা ১২টায় শ্রমিকদের দাবিসম্বলিত প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুনে সুসজ্জিত একটি লালপতাকা র্যালী পল্টন এলাকার রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। দুপুরে খাবার বিরতির পর বেলা ২.৩০টায় সম্মেলন মঞ্চে সফদার হাশমীর নাটক ‘হল্লাবোল’ পরিবেশন করেন গাজীপুরের গার্মেন্টস শ্রমিকরা। বেলা সাড়ে ৩টায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, ভারতের ‘অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার’ (AIUTUC )-এর সর্বভারতীয় সম্পাদক শ্রমিকনেতা শংকর সাহা, ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও স্কপ নেতা চৌধুরী আশিকুল আলম, শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল রায় ও কেন্দ্রীয় নেতা মানস নন্দী।
শ্রমিকনেতা জহিরুল ইসলাম সভাপতির বক্তব্যে বলেন, “পুনরায় ক্ষমতায় আসার এক সপ্তাহের মাথায়ই গুলি চালিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। পরবর্তীতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনে সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে, ১২ হাজারের মতো শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে, অসংখ্য মামলায় অজ্ঞাতনামা হাজার শ্রমিককে আসামি করে রাখা হয়েছে, আন্দোলনকারী শ্রমিকদের পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ তথ্যভা-ারে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে পোশাকশিল্প মালিকদের রপ্তানিতে উৎস কর ও কর্পোরেট ট্যাক্স কমানোসহ নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখছি কখনো শ্রমিকরা ফেটে পড়ছে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে, কখনো শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে কেবল দাবি-দাওয়াভিত্তিক লড়াইয়ে নামমাত্র কিছু দাবি আদায় হচ্ছে। অন্যদিকে শ্রমিকদরদি সেজে মালিকদের বিরুদ্ধে লড়ালড়ির অভিনয় করে দালাল নেতৃত্বের ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়, এনজিওদের সাথে যুক্ত হয়ে শ্রমিকদের সচেতন করার নামে শ্রমিক আন্দোলনকে ব্যক্তিগত আইনি লড়াইয়ে নিমজ্জিত করার প্রয়াস – এই হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের বর্তমান পরিস্থিতি। সঠিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং নীতি-আর্দশহীন সংগঠন ও সুবিধাবাদী-আপোসকামী নেতৃত্ব দিয়ে শ্রমিক আন্দোলন শক্তিশালী হবে না।”
আলোচনা সভা শেষে নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করেন সভার সভাপতি শ্রমিকনেতা জহিরুল ইসলাম। গত ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের সিদ্ধান্তক্রমে পুনরায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছেন যথাক্রমে জহিরুল ইসলাম ও উজ্জ্বল রায়। ২৬ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটির অন্যরা হলেন : সহসভাপতি – মানস নন্দী, সাংগঠনিক সম্পাদক – মাসুদ রেজা, আইন বিষয়ক সম্পাদক – শফিউদ্দিন কবির আবিদ, অর্থ সম্পাদক – রাজু আহমেদ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক – দোলন রায়, দপ্তর সম্পাদক – ভজন বিশ্বাস, সদস্য – ফখরুদ্দিন কবির আতিক, জসীমউদ্দিন, আব্দুল হাই, ডা. মুজিবুল হক আরজু, অপু দাশগুপ্ত, সুশান্ত সিন্হা, আলাল মিয়া, শেখর রায়, আজিজুর রহমান, হৃদেশ মুদি, মোখলেসুর রহমান, মশিউর রহমান খোকন, কিশোর অধিকারী, রিপন আহমেদ, শফিকুল ইসলাম, মামুন মিয়া, জাহেদ-উন-নবী কনক, মানিক হোসেন।