[dropcap]দৈ[/dropcap]নন্দিন জীবনের হাজারো চাপে এমনিতেই দিশেহারা এদেশের মানুষ। অভাব-দারিদ্রের বোঝা টানতে টানতে বেশিরভাগ মানুষ বুঝতেই পারে না জীবনের আয়ু কখন ফুরিয়ে এল। কোন রকমে দেহ ধারণ করা ছাড়া এখানে জীবনের অন্য কোন মানে নেই, মহত্তর কোনো তাৎপর্য নেই। দেহ-মনে বিকশিত হওয়ার কোনো আয়োজন নেই। মানুষের জীবনের এতবড় অপচয়, এত অমর্যাদা আর কি হতে পারে? অথচ তা বুঝবার ক্ষমতাটুকুও আজ মানুষের নেই। সে ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছে অচলায়তনে বন্দী এ সমাজ।
অসহায় মানুষের প্রাণের আকুতি, হৃদয়ের মর্মব্যথা নিজেরা প্রকাশ করবে সে ভাষাও তাদের নেই। বুকের অতলেই গুমরে গুমরে মরে সমস্ত কথা, স্বপ্ন-সম্ভাবনা। কুয়াশা ঢাকা অসীম সাগরে দিশাহীন নাবিকের মত তারা চেয়ে আছে বাতিঘরের দিকে। একবিন্দু আলোর রেখার দেখা যদি মেলে। কোন প্রাণেই কি পৌঁছবে এদের প্রাণের আর্তি? দেশের বিবেক বলে বিবেচিত শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমাজ সবাই তো নিশ্চুপ। অনুভূতিপ্রবণ একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব কি নীরব থাকা? শিল্পী-সাহিত্যিকের কারবারই তো অনুভূতি নিয়ে, আবেগ নিয়ে। যথার্থ আবেগ ভালবাসায় মানুষের যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করলে নিশ্চুপ থাকা যায় কি? জগতের সমস্ত বড় মানুষ – রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যেন বোস, রমাঁ রোল্যা এরা কেউই মানুষের প্রয়োজনে নিশ্চল থাকেন নি, থাকতে পারেন নি। পারেননি আরেক মহৎ প্রাণ শরৎচন্দ্রও। মানুষের দুঃখ বেদনা, মনুষ্যত্বের অমর্যাদা দেখে ব্যথিত-ক্ষুব্ধ চিত্তে নালিশ জানিয়েছেন মানুষের দরবারে। বলেছেন “সংসারে যারা শুধু দিলে পেলে না কিছু, যারা বঞ্চিত, যারা দুর্বল, উৎপীড়িত, মানুষ হয়েও মানুষে যাদের চোখের জলের হিসাব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনদিন ভেবেই পেলে না, সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই অধিকার নেই, – এদের কাছেও কি ঋণ আমার কম? এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই পাঠালে আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে”।
শুধু নালিশ জানিয়ে ক্ষান্ত হননি, মানুষের দুঃখময় জীবন তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। নিজেও দারিদ্রের দুর্ভোগ ভোগ করেছেন। কর্মহীন ভবঘুরে পিতার অভাবের সংসারে টানাপোড়েন সর্বক্ষণ লেগেই থাকত। নিজের পরিবারের আর্থিক দৈন্য শরৎকে কষ্ট দিত ঠিক কিন্তু এর মধ্যেই তিনি আচ্ছন্ন ছিলেন না। গ্রামের গরীব-দুঃখী মানুষের নিরন্ন মুখও তাঁকে ভাবাত। তাই অতটুকু শৈশবেই শরৎ বুঝেছিল ক্ষুধা-দারিদ্রের যন্ত্রণা কী? দু’মুঠো খাবার জোগাড়ের আশায় মানুষের সে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। তাও সবসময় মেলে না। শরতের নিজের জীবনেই বহুবার ঘটেছে এ ঘটনা। এমনও দিন গিয়েছে, শরৎচন্দ্রের নিজের ভাষায়, “বড় দরিদ্র ছিলাম, ২০ টাকার জন্যে একজামিন দিতে পাই নি। এমন দিন গেছে যখন ভগবানকে জানাতাম, হে ভগবান, আমার কিছুদিনের জন্যে জ্বর করে দাও, তাহলে দুবেলা খাবার ভাবনা ভাবতে হবে না, উপোস করেই দিন কাটবে”। কঠোর দারিদ্রের মধ্যেই কেটেছে শরতের শৈশব। কিন্তু বিরুদ্ধ পরিস্থিতি তাঁকে দমাতে পারে নি এতটুকু। বরং এর মধ্য দিয়ে তাঁর চরিত্রের একটি বড় দিক -দৃঢ়তার বুনিয়াদ রচিত হয়েছিল। এই দৃঢ়তা ও আত্মমর্যাদাবোধের সন্ধান পাওয়া যায় ওই সময়েরই আরেকটি ঘটনা থেকে। সেবার নিয়ম করা হল এফ এ ফাইনাল পরীক্ষার পূর্বে টেস্ট পরীক্ষা নেয়া হবে। শরতের নেতৃত্বে ছাত্ররা দাবি তুললো বাঁধাধরা এই নিয়ম তারা মানবে না। কিন্তু কর্তৃপক্ষের চাপের মুখে বন্ধুরা সব একে একে পরীক্ষার টেবিলে বসে পড়ল। দাবি থেকে সরে আসতে শরতের মর্যাদাবোধে লেগেছিল। তাই শরৎ তাঁর দাবিতে রইলেন অনড়। পরে মেধাবী ছাত্র হিসেবে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে পরীক্ষার অনুমতি দেয়। কিন্তু ফি জোগাড় করতে না পারায় এফ এ পরীক্ষা দিতে পারেননি। কলেজের পড়ায় ইতি টেনেছেন। পরবর্তী জীবনে এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, বিদ্যা ত শুধু বিদ্যাপীঠের বিষয় নয়। এমনও ত হতে পারে যে বিদ্যালয় ছাড়াই বিদ্যালাভের পথ। বাস্তবিক শরৎচন্দ্রের জীবনে এ কথাটি সত্যরূপ লাভ করেছিল। জ্ঞান মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি মানুুষের সঙ্গে থেকেই তাদের জীবনযাত্রা দেখেছেন, তাদের দুঃখকে অনুভব করেছেন। দুঃখের কারণ নির্ণয়ে সত্যসন্ধানী মন নিয়ে তাকিয়েছেন পৃথিবীর দিকে, সমাজের দিকে। দেখেছেন মানুষে মানুষে এই যে প্রভেদ, একই সমাজে বাস তবু হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-শূদ্রের কত তফাত, কত সামাজিক দূরত্ব, দারিদ্রের অভিশাপ কত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে, শুধু ঘরের প্রয়োজনেই ঘরে ঘরে কত নারীর জীবন তিলে তিলে নিঃশেষ হচ্ছে – একি শুধু দৈব দুর্বিপাকের খেলা? না। সামাজিক এই বৈষম্য সামাজিক ব্যবস্থারই ফল। মানুষের সৃষ্ট এ সমাজে মানুষই এই সংকট তৈরি করেছে। ধর্মের ছদ্মাবরণে ঢেকে রেখেছে এই নির্জলা নির্মম সত্য। শুধু সত্যকেই ঢেকে রাখেনি, চাপা দিয়ে মারছে সমস্ত ন্যায় নীতি ও মনুষ্যত্বকে। সমাজের নূতন প্রয়োজনে, মানুষের নবীন জীবনের প্রয়োজনে সেই আবরণ ভেদ করে মনুষ্যত্বের ঝাণ্ডাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন শরৎচন্দ্র।
বিশ্ব বরেণ্য মনীষী রঁমা রোল্যা শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত প্রথম খণ্ড পড়ে অভিভূত হয়ে শরৎচন্দ্র সম্পর্কে বলেছিলেন যুগের অন্যতম সেরা সাহিত্যিক, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার যোগ্য। রঁমা রোল্যার সাথে এক কথোপকথনে বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে ‘বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় জীবিত আর্টিস্ট’ বলে অভিহিত করেছেন। অন্যত্র শরৎচন্দ্রের সৃষ্টি সম্পর্কে বলেছেন-“শরৎচন্দ্রের দৃষ্টি ডুব দিয়েছে বাঙালীর হৃদয় রহস্যে। সুখে দুঃখে মিলনে বিচ্ছেদে সংঘটিত বিচিত্র সৃষ্টির তিনি এমন করে পরিচয় দিয়েছেন বাঙালী যাতে আপনাকে প্রত্যক্ষ জানতে পেরেছে। তার প্রমাণ পাই তার অফুরাণ আনন্দে। যেমন অন্তরের সঙ্গে তারা খুশি হয়েছে, এমন আর কারো লেখায় তারা হয়নি। অন্য লেখকরা অনেকে প্রশংসা পেয়েছে কিন্তু সর্বজনীন হৃদয়ের এমন আতিথ্য পায়নি।”
এমন সার্বজনীন হৃদয়ের আতিথ্য পেয়েছেন যে লেখক, সাহিত্য রথে আরোহণ করে দিগি¦দিক জয় করেছেন, জীবনের শুরুতে কিন্তু তাঁকে নিদারুণ প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়েছে। কৈশোরে মাতাপিতাকে হারিয়ে রূঢ় এক বাস্তবতার মুখোমুখি হন শরৎ। একদিক বোহেমিয়ান ঝীবরেন দিকে টান অন্যদিকে ছোট ছোট ভাই-বোনের প্রতি মায়া তাঁকে অস্থির করে তোলে। মাঝে কিছুদিন সন্ন্যাস বরণ করলেও কিছুদিনের মধ্যেই এই জীবন তাঁর কাছে বিষাদময় হয়ে উঠে। এই সময়ের একটি ঘটনা তাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। আশ্রমে তীর্থ যাত্রী এক পরিবার অসুস্থ হয়ে পড়লে সবাই তাদের ছেড়ে পালায়, কিন্তু শরতের মন তো সন্ন্যাসীর নয়, তাঁর অর্ন্তস্থলে সমাজ ও মানুষের প্রতি অসীম দরদ, মানুষের বিপদ দেখে সেকি পালাতে পারে? আশ্রমে গিয়ে মুক্তির সন্ধান শরৎ পাননি কিন্তু এ ঘটনা তাঁকে বৈরাগ্য জীবন থেকে মুক্তি দান করে। শরৎ ফিরে আসেন স্বগৃহে। স্বগৃহে ফিরেছেন ঠিকই কিন্তু স্বসমাজের আনুকূল্য লাভ করতে পারেনি। এবার তাই জীবিকার সন্ধানে বেড়িয়ে পড়লেন। উদ্দেশ্য সুদূর বর্মা মুল্লুক। জুটল একটা কেরানির চাকরি, কোনরকমে দিন চলে। নিজের জন্য কিছু রেখে মাস শেষে ভাই-বোনদের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে পারেন। ভাই-বোনদের মুখ চেয়ে কিছু টাকা রোজগারের প্রাণান্ত চেষ্টার শেষ নেই শরতের। এই যে দায়িত্ববোধ-এটা কোনদিন তাঁকে এক মুহূর্তেও কর্তব্যচ্যূত করতে পারেনি। শুধু ভাই-বোনদের প্রতিই নয়, যে কারও বিপদ-আপদে বুক বাড়িয়ে এগিয়ে আসতেন। যে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন, তারই নিচ তলায় থাকত একটি পরিবার। বাবা আর মেয়ে। মদ্যপ বাবা কিছু টাকার লোভে মেয়েকে আরেক মদ্যপ বৃদ্ধের হাতে সমর্পণের চেষ্টা করে। নারী জীবনের এ অমর্যাদা শরৎকে গভীরভাবে ব্যথিত করে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, সমস্ত কলঙ্কের দায় মাথায় নিয়ে অন্যের সম্মান রক্ষায় নিজের জীবন পণ করেছেন। শান্তি দেবীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে নিজের জীবনে গ্রহণ করেছেন। চাইলে তো অনায়েসে পাশ কাটিয়ে যেতে পারতেন। যান নি। ঝুঁকিমুক্ত স্বচ্ছন্দ জীবন যাপন করতে পারতেন, প্রথম জীবনে না হলেও পরবর্তীতে সে সুযোগ তাঁর এসেছিল, কিন্তু করেননি। বরং রেঙ্গুন শহরে প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে, সবাই যখন ভীত-সন্ত্রস্ত, আত্মীয়-পরিজনও আপনজনকে ত্যাগ করে নিরাপদে সরে যাচ্ছে, সেই রকম অনাত্মীয় পরিবেশে শরৎ ঝাঁপিয়ে পড়লেন মানুষের শুশ্রুষায়। অল্প বিস্তর হোমিওপ্যাথি জানতেন, এই নিয়ে। চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেই এক সময় আক্রান্ত হন। যাদের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজে অসুস্থ হন, তারাই তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। উপকারের এই পুরস্কার! এক বার দু বার নয়, জীবনে অনেক বারই ঘটেছে এরকম ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে অনেক অভিজ্ঞতাও আহরণ করেছেন। অভিজ্ঞতার নির্যাস অন্তর্ভেদী মন নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখেছেন মানুষ কত অসহায়। মানুষের এই যে হীনতা, ক্ষুদ্রতা তার জন্য তারা নিজেরা যতটা দায়ী, ততোধিক দায়ী এই সমাজব্যবস্থা। সামাজিক জীবনে দুঃখ-দারিদ্র, শিক্ষার অভাব-বৈষম্যই তাদের ঠেলে দিয়েছে প্রবৃত্তিসর্বস্ব জীবনের দিকে। এইসব মানুষের জীবনের মর্মব্যথা তুলে ধরে মানুষের হৃদয়ের দরজায় কড়ানাড়তে শরৎ কলম হাতে তুলে নেন। নিভৃতে সাহিত্যচর্চা করলেও তা প্রকাশিত হয়নি অনেক দিন। নিজের অগোচরে কোন এক বন্ধুর মারফত ‘যমুনা’ পত্রিকায় বেনামীতে একটি গল্প ছাপা হয়। গল্পটির নাম ‘বড়দিদি’। প্রকাশের পর অনেকেই ভুল করে এটি রবীন্দ্রনাথের গল্প মনে করেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও তখন মুখ খুলতে হয়। তিনি লিখেন, ‘সত্যি ভারি চমৎকার লেখা। এ আমি লিখিনি, অন্য কারুর লেখা। কিন্তু যিনি লিখেছেন তিনি অসাধারণ শক্তিশালী লেখক। তাঁর ঐ একটিমাত্র গল্প প্রকাশ করে নিঃশব্দে নেপথ্য বাস শুধু অনুচিত নয় – নিষ্ঠুর হবে।’
এর পর একে একে প্রকাশিত হয় রামের সুমতি, অনুপমার প্রেম, হরিচরণ, কাশীনাথ, আলো ও ছায়া, চন্দ্রনাথ ইত্যাদি গল্প। বাংলা সাহিত্যের পাঠক মুগ্ধ বিস্ময়ে আবিষ্কার করেন বাংলা সাহিত্যের ‘সবচেয়ে বড় আর্টিস্ট’কে। শুধু সাধারণ পাঠক নয়, তখনকার দিনে শিল্পী-সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্র বসু, জীবনানন্দ দাশ, চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ শরতের গুণমুগ্ধ পাঠক ছিলেন। সুভাষতো ছিলেন শরতের বন্ধু। চিত্তরঞ্জন শরতের বড়। কিন্তু শরতের মূল্য তিনি বুঝেছিলেন। চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পাদিত ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় স্বামী গল্পটি প্রকাশিত হয়। তিনি শরতকে লিখে পাঠান, ‘টাকা পয়সার হিসেব দিয়ে আপনার মত শিল্পীর মান নির্ণয় করা যায় না। আপনার পারিশ্রমিক হিসেবে এই সাদা চেক পাঠালাম। দয়া করে এটি গ্রহণ করবেন এবং ইচ্ছেমত টাকার অঙ্ক লিখে নেবেন। দ্বিধা করবেন না।’ একশ টাকা লিখে রাখলেন তিনি। এই হলো শরৎচন্দ্র। অর্থবিত্ত না থাকলেও চিত্তবৃত্তিতে অতুলনীয়। অর্থ-খ্যাতির এতটুকু লোভ কোনদিন তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। সবচেয়ে অভাবের দিনেও না। পরবর্তীতে যখন কিছুটা সচ্ছলতা এসেছে, তখনও না। দেশবন্ধু যখন সর্বস্ব উজাড় করে রাস্তায় নামলেন, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে শরৎচন্দ্রও ব্ল্যাঙ্ক চেক পাঠালেন। যা প্রয়োজন লিখে নিতে। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি কত বড় ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। শরৎ সাহিত্য বোঝার আগে শরতের এই মানবদরদী মনটিকে চিনে নেওয়া প্রয়োজন।
অথচ শরৎচন্দ্রের এই মানবতাবাদী চেতনার স্বরূপকে চিনতেই পারল না আমাদের দেশের অনেক সাহিত্যানুরাগী ও সাহিত্য সমালোচক। তারা একটা বিষয় ধরতেই পারল না যে, শুধু শরৎচন্দ্র নয়, যেকোন সাহিত্যিক বা মনীষীর চিন্তার বিচার করতে একটি বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা প্রয়োজন। যে কোন মানুষ একটি সমাজ পরিবেশের মধ্যে বসবাস করেন। স্থান ও সময়ের সীমা দ্বারা নির্ধারিত এই সমাজ পরিবেশ থেকেই মানুষ তার চিন্তার উপাদান আহরণ করে। সাহিত্যিকও এই সমাজেরই একজন প্রতিনিধিমাত্র বিধায় তার পক্ষেও এই প্রভাবের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। শ্রেণী বিভক্ত সমাজের যে দু’টো ধারা-প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার, একজন সাহিত্যিক ঐ নির্দিষ্ট সময়ে তার সাহিত্যচিন্তায় কোন ধারাকে প্রতিফলিত করছেন এই মাপকাঠিতেই তাঁর বিচার হওয়া উচিত।
এই মাপকাঠিতে বিচার করলে আমরা দেখতে পাবো শরৎচন্দ্রের সময়কালটা ছিল পরাধীন ভারতবর্ষ। শোষণের প্রয়োজনে ব্রিটিশ সাম্র্রাজ্যবাদের শাসনের প্রবল প্রকোপে এদেশের মানুষের জীবন ছিল জেরবার। দেশের ভেতরেও সামন্তীয় বিধি-নিষেধের নিগড়ে বন্দী মানুষের জীবন। অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রয়োজন থেকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটছে। স্বাধীন জীবন ও স্বাধীনতার প্রবল আকাক্সক্ষা মানুষের মনে তীব্র আলোড়ন তুলছে। তার ঢেউ আছড়ে পড়ছে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও। এই সময়েই সাহিত্যিক হিসেবে শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব। শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব সর্ম্পকে এযুগের অন্যতম মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ যথার্থ মূল্যায়ন উপস্থিত করেছেন। তিনি বলেন,“… দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ও স্বাধীনতা আন্দোলন যখন প্রবল আকার ধারণ করল, ঠিক সেই সময়েই বাংলার সাহিত্যিক সমাজে শরৎচন্দ্রের অভ্যূত্থান। ধর্মীয় সংস্কারের (রিফর্মেশন) পথে রেনেশাঁ আন্দোলনের মধ্যে বিদ্যাসাগর মশাই এর ভূমিকা যেমন মানবতাবাদী আন্দোলনকে তদানীন্তন সমাজ পরিবেশে যতদূর সম্ভব ধর্মীয় প্রভাব ও ধর্মীয় যুক্তি বিচার থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে একটা ছেদ (ব্রেক) তেমনি স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে হিন্দু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ (হিন্দু রিলিজিয়াস ওরিয়েন্টেড ন্যাশনালিজম) এবং ধর্মের সঙ্গে আপসমুখী জরাগ্রস্ত মানবতাবাদী চিন্তাভাবনা থেকে শরৎচন্দ্রও একটা ছেদ (ব্রেক)।” মানুষের প্রতি অসীম দরদবোধ, দুঃখীর প্রতি সত্যিকারের মর্মবেদনাই শরৎচন্দ্রকে মানবতাবাদী করে তুলেছে, আপসহীন যোদ্ধায় পরিণত করেছে। সমাজদেহের স্তরে স্তরে যে নোংরা পাক বিষিয়ে উঠে মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছিল, তাকেই সমূলে বিনাশ করতে চেয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। বিশেষত নারীর জীবনে অকাল বৈধব্যের পরিণতি কত মর্মান্তিক, সমাজের চোখে কতটা হেয় তাই দেখে শরৎ-এর সমস্ত অন্তরাত্মা কেঁদে উঠেছিল, বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল সেই সমাজের বিরুদ্ধে। তিনি এও লক্ষ্য করেছিলেন এই নারীদের চোখের জলের মূল্য পরিশোধ করতে চেয়েছিলেন বাংলার আরেক কীর্তিমান মনীষী বিদ্যাসাগর। সেই প্রচেষ্টা বিশেষ সাফল্য পায়নি। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আইন পাশ করে প্রয়োজনের স্বীকৃতি দেয়া যায় মাত্র, ভেতর থেকে অনুভব না করলে মর্যাদা দেয়া যায় না। তাই নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইতিহাস ও বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে তার যথার্থ অবস্থান তুলে ধরার জন্য লিখেছেন ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধ। আর সেই নারীদের গ্রহণ করবার উপযোগী সমাজ মানসিকতা তৈরির জন্য সৃষ্টি করেছেন শেষ প্রশ্নের ‘কমল’, চরিত্রহীনের ‘সাবিত্রী’ ‘কিরণময়ী’র মতো চরিত্র। সমাজের চোখে যারা ভ্রষ্টা, তথাকথিত চরিত্রহীন, তাদের অন্তরের সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করে মানুষের বিবেকের দরবারে তুলে ধরেছেন, দেখিয়েছেন মানবিক গুণাবলিতে কতটা উৎকর্ষের অধিকারী এইসব চরিত্র। তাই পাঠ শেষে দেখা যায়, যারা এদের চরিত্রহীন বলে অভিহিত করে, তাদেরই মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়ে পাঠকের কাছে। প্রশ্ন জাগে সাবিত্রী, কিরণময়ীকে চরিত্রহীন বলে রায় দেয় যে সমাজ, সে সমাজের চরিত্রটা কেমন?
শরৎচন্দ্র সৃষ্ট এইসব চরিত্র সম্পর্কে অনেকের অভিযোগ – এগুলো সবই কাল্পনিক, বাস্তবতার সংস্পর্শ রহিত। একথা ঠিক ‘কমলে’র মত জ্ঞানে বুদ্ধিতে, যুক্তি-তর্কে প্রখর নারী সেদিন হয়তো ছিল না কিন্তু সামন্তী সমাজের শৃঙ্খল মুক্ত হওয়ার আকাক্সক্ষা, গণতান্ত্রিক ভাবনা-চিন্তার উন্মেষ ঘটছিল, নারীর উপর পুরুষের জবরদস্তির অবসানে নারী স্বাধীনতার ধারণা এদেশে এসেছিল, তাকে ধারণ করেই কমল চরিত্র গড়ে উঠেছিল। নারী পুরুষের অধ্বস্তন, বিদ্যা-বুদ্ধিতে ছোট – পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এমনটাই ভাবতে অভ্যস্ত চিরকাল। তাই নারীর বিদ্যা-বুদ্ধি এ সমাজ কখনো উদার মনে গ্রহণ করতে পারে নি। কমলকেও গ্রহণ করতে পারে নি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি অক্ষয়ের বিদ্যাভিমানে প্রচণ্ড চপেটাঘাত হয়ে এসেছে কমলের যুক্তিধার। শুধু শরৎচন্দ্রর সময়ই বা কেন, আজকের সমাজও এমন নারীকে গ্রহণ করতে কতটা প্রস্তুত? নারীকে এইরূপে গ্রহণ করবার জন্য প্রয়োজন উন্নত মন। উন্নত সংস্কৃতি ও আদর্শ ছাড়া উন্নত মন তৈরি হয় না। ফলে তৎকালে মানুষের নতুন জীবনের প্রয়োজন থেকে যে আকাক্সক্ষা ও গণতান্ত্রিক চেতনা গড়ে উঠছিল, শরৎচন্দ্র তাকেই বাস্তবরূপ দান করেছিলেন। সত্য সম্পর্কে এইটাই যথার্থ ধারণা। একই কথা পথের দাবীর ‘সবসাচী’র ক্ষেত্রেও। ইংরেজের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রয়োজনে স্বাধীনতা সংগ্রামের আপসহীন ধারার চিত্র তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক আন্দোলনে গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংসার নামে কংগ্রেসের যে আপসকামী লাইন, শরৎচন্দ্র তাকে ঠিক মনে করতেন না। চরকার সুতা কেটে নয়, সৈনিকের সাহায্যেই স্বরাজ আসবে- এই ছিল শরৎ-এর বিশ্বাস। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ও ভারতবাসীর মুক্তির পথ কি- পথের দাবী উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ফলে এটা অলৌকিক নয়, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার বাস্তব রূপ হিসেবেই একে দেখতে হবে। মাস্টারদা সূর্যসেনকে উদ্দেশ্য করে একবার শরৎচন্দ্র বিপ্লবী কালিপদ ভট্টাচার্যকে বলেছিলেন, “পথের দাবীর বাস্তব রূপ দিয়েছে সূর্য। তার এই সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনে আমার সমর্থন জানিয়ে তাকে আমার আশীর্বাদ জানিও।”
সম্প্রদায়গত বিভাজন, ধর্মের সংকীর্ণ আচরণ মানুষের সাথে মানুষের সামাজিক সম্পর্কের প্রাচীর তৈরি করে। বহুদিন ধরে পাশাপাশি বসবাস করেও মানসিক মিলন তৈরি হয় না। কোন কারণে স্বার্থ ক্ষুণœ হলে বর্ণ বিদ্বেষ, জাতি বিদ্বেষ সংঘাতে পর্যবসিত হয়। এই সংঘাতে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ তো হয়ই, প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। এরকম ঘটনা অতীতের ভারতীয় উপমহাদেশ কিংবা আজকে আমাদের দেশে বিরল নয়। সাম্প্রদায়িক সংঘাতে কি কেবল মানুষেরই মৃত্যু হয়, মনুষ্যত্বেরও কি মৃত্যু হয় না? সাম্প্রদায়িক বিভাজনে ক্ষতবিক্ষত মানুষের কথা মনে হলে মনে পড়ে শ্রীকান্ত উপন্যাসের গহরের কথা। বৈষ্ণব আখড়ায় কীর্ত্তন চলে। ভক্ত গহর সারারাত বাইরে বসে শুনে অথচ ভেতরে ঢুকতে পারে না মুসলমান বলে। কীর্ত্তন শেষে শ্রীকান্ত যখন বের হয়ে দেখে এই দৃশ্য তার মনে প্রশ্ন জাগে এ কেমন ভগবৎ বিশ্বাস,কেমন আচার সর্বস্বতা যেখানে এক ভক্তকে দূরে ঠেলে রাখে। মুসলমান সমাজেও যে আচারসর্বস্বতা, অতীতের কোন এক কালে সমস্ত কিছুই নির্দিষ্ট হয়ে গেছে এই বিশ্বাস তাদেরও কত পশ্চাদপদ করে তুলছে তাও তুলে ধরেছেন শেষ প্রশ্ন উপন্যাসে। বলেছেন, “সত্যের সীমা যে কোন একটা অতীত দিনেই নির্দিষ্ট হয়ে যায় নি, এসত্য ওঁদেরও একদিন মানতে হবে।” ধর্মীয় গোড়ামী, আচারের উপর ভিত্তি করে যে সংস্কার গড়ে উঠে তাও মানুষের হৃদয়কে সংকীর্ণতার চোরাগলিতে নিক্ষিপ্ত করে। এই সংস্কার অস্থি-মজ্জায় এমনভাবে মিশে থাকে তাকে চেনা বড় দুঃসাধ্য। তিল তিল করে বহুদিন ধরে গড়ে উঠে যে ভালবাসার সম্পর্ক, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক, সংস্কারের বশে এক মূহুর্তেই তাকেও ছেড়ে যেতে দ্বিধা করে না। গৃহদাহ উপন্যাসে এরকমই একটি চিত্র অঙ্কন করেছেন শরৎচন্দ্র। রামচরণ বাবু নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ। কারো হাতের রান্না পর্যন্ত খেতেন না। কিন্তু ঘটনাক্রমে অচলাকে তিনি মেয়ের মত ভালবেসে ফেলেন। অচলার হাতের রান্না পর্যন্ত খেতে শুরু করেন। সুরেশ মারা যাওয়ার পর যখন জানতে পারেন অচলা সুরেশের স্ত্রী নয়, শ্মশানে অসহায় অচলাকে ফেলে চলে আসতে এক মূহুর্ত দ্বিধা করেন না। এতদিনের সম্পর্ক একমুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ঠিক এরকম না হলেও প্রাত্যহিক জীবনে হাজারো সংস্কার আমাদের আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। কতদিনের কত ধরণের অভ্যাস জীবনযাত্রায় মিশে আছে – যা হয়তো আরও উন্নত জীবনযাত্রা গড়ে তোলার পথে বাঁধা। উন্নত বোধের, উন্নত রুচির আধারেই কেবল এটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। শরৎচন্দ্র তাঁর সাহিত্যে মূল্যবোধের এই ধারণাটিই সযত্নে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। সত্যিকারের মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হলে, মানুষের মর্যাদায় জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এর কোন ব্যত্যয় নেই। তাঁর সাহিত্য সাধনার মূলে প্রোথিত ছিল এই প্রেরণা।
শরৎচন্দ্র বুঝতে পেরেছিলেন এরকম একটি সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাধা পরাধীনতা। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত না হলে মানুষের মনও স্বাধীন হতে পারবে না। রাজনৈতিক দাসত্ব মানসিক জীবনেও জড়তা তৈরি করেছে। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশের স্বাধীনতা। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাপ থেকে শরৎচন্দ্র দূরে থাকতে পারেন নি। তার রাজনীতিতে যোগ দেয়া নিয়ে অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করলে তিনি সমুচিত জবাব দিয়েছেন এই বলে, “রাজনীতির আলোচনায় প্রত্যেক দেশবাসীরই যোগ দেওয়া অবশ্যই কর্তব্য বলে আমি মনে করি। বিশেষত আমাদের দেশ হল পরাধীন দেশ, এদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন প্রধানতঃ স্বাধীনতার আন্দোলন। এই আন্দোলনে সাহিত্যসেবীদেরই তো সর্বাগ্রে এসে যোগ দেওয়া উচিত। কারণ জাতি গঠন ও লোকমত সৃষ্টির গুরুভার পৃথিবীর সর্বদেশে সাহিত্যিকদের উপরই ন্যস্ত। যুগে যুগে মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তোলেন তাঁরাই। তোমাদের নির্দেশমত সাহিত্যিকরা যদি বলেন, আমি সাহিত্যিক, সাহিত্য নিয়েই থাকব রাজনীতিতে যোগ দেব না -তাহলে উকিল ব্যারিস্টাররাও তো বলতে পারেন, আমরা আইন ব্যবসায়ী, মামলা-মোকদ্দমা নিয়েই থাকব রাজনীতিতে যোগ দেব না। ছেলেরা বলবে – আমরা ছাত্র, পড়াশোনা নিয়েই থাকব, রাজনীতির মধ্যে যাব না, তাহলে রাজনীতিটা করবে কারা শুনি?” আজকের যুগের শিল্পী- সাহিত্যিকদের সাথে শরৎচন্দ্রের বড় পার্থক্য এইখানেই। বর্তমানে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা রাজনীতি সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে চরম উন্নাসিক। তারা সাংস্কৃতিক আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলনকে দুই মেরুর বিষয় বলে ভাবেন। শরৎচন্দ্র এভাবে বিচার করেন নি। পরিপূরক ভাবতেন। এই বোধ থেকেই স্বয়ং যুক্ত হয়েছিলেন রাজনৈতিক আন্দোলনে। হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতির পদেও অভিষিক্ত হয়েছিলেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণ নেই দেখে দুঃখ পেয়ে বলেছিলেন, “যে চেষ্টায়, যে আয়োজনে দেশের মেয়েদের যোগ নেই, সহানুভূতি নেই, এই সত্য উপলব্ধি করবার কোন জ্ঞান, কোন শিক্ষা, কোন সাহস আজ পর্যন্ত যাদের দিইনি, তাদের কেবল গৃহের অবরোধে বসিয়ে, শুদ্ধমাত্র চরকা কাটতে বাধ্য করেই এত বড় বস্তু লাভ করা যাবে না। গেলেও সে থাকবে না।” এই দুঃখবোধ থেকেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকেও শরৎচন্দ্র উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে। পরে দেশবন্ধুর থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘নারী কর্ম মন্দির’। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তাকে শরৎচন্দ্র অনস্বীকার্য ভেবেছিলেন তেমনি দূরদৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন এর দুর্বলতাও। তাই সেদিন কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের পথে তিনি হাটতে চাননি। বিপ্লবী পন্থায় যারা সেদিন দেশের স্বাধীনতা আদায় করতে চেয়েছিল শরৎচন্দ্র তাদেও প্রতি অকুন্ঠচিত্তে সমর্থন দান করেছেন। গান্ধীকে শ্রদ্ধা করলেও স্বয়ং এই নিয়ে গান্ধীর সাথেও মতবিরোধ হয়েছিল। শুধু সমর্থন দানই নয়, জেল ফেরত বিপ্লবীদের সংবর্ধনা সভারও আয়োজন করেছেন। ঐ সভায় তিনি বলেছেন,“ দেশের জন্য যারা নিজেদের রিক্ত করেছে নিঃস্ব করেছে তারাই হবে দেশের লোকের ভয়ের পাত্র? দেশ ছাড়া যাদের আর কিছুই নেই; দেশ হবে তাদের প্রতি বিমুখ?” শরৎচন্দ্রের কর্মোদ্যোগের ফলে বিপ্লবীদের দিকে দেশের মানুষ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। কিন্তু যুগে যুগে যারাই সর্বস্ব উজাড় করে প্রগতির মশাল বহন করেছেন, অবক্ষয়িত রক্ষণশীল সমাজ আসন্ন মৃত্যুর ভয়ে প্রাণপণে পাল্টা আঘাত করেছে। শরৎচন্দ্রের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মহৎপ্রাণ মানুষের হৃদয় হয়তো এতে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে, তবু এই অপমানকে ব্যক্তিগত করে দেখেন নি। আর এটি সম্ভব কেবল মানুষের প্রতি ভালবাসার জোরে, সত্যের শক্তিকে ধারণ করতে পারলে। শরৎচন্দ্রের মহত্ত্ব এইখানেই তিনি মানুষকে ভালবাসতে পেরেছিলেন, শরৎচন্দ্রের কৃতিত্ব এইখানেই তিনি সত্যের শক্তিকে ধারণ করতে পেরেছিলেন। সত্যের শক্তিকে অসংখ্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্পৃহা জাগিয়ে তুলেছেন। তাই সুভাষচন্দ্র বসুর ভাষায়, “একাধারে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ লেখক, আদর্শ দেশপ্রেমিক ও সর্বোপরি আদর্শ মানব।”