Wednesday, December 25, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জানুয়ারি ২০১৫শান্তির জন্য জনগণের প্রতিরোধের শক্তি গড়তে হবে

শান্তির জন্য জনগণের প্রতিরোধের শক্তি গড়তে হবে

একজন প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক হামলা

[গত ১০ ও ১১ জানুয়ারি রাঙ্গামাটি শহরে সংঘটিত পাহাড়ী-বাঙালি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনার ওপর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সমন্বয়ক কমরেড বোধিসত্ত্ব চাকমার পাঠানো প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরা হলো]

10505312_764372080304000_6242417515233312336_n১০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে রাঙ্গামাটিতে সরকারি প্রশ্রয়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটে গেল। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ এই উদ্বোধনের বিরোধিতা করে। তাদের দাবি ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আগে মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করা। কিন্তু সরকার পাহাড়ীদের এই আপত্তি গুরুত্ব দেয়নি। তাই উদ্বোধনের দিন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ সকাল-সন্ধ্যা সড়ক ও নৌপথ অবরোধের ডাক দেয়। অন্যদিকে ছাত্রলীগ এই অবরোধ কর্মসূচি প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়।

উদ্বোধনের দিন ভোরে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কর্মীরা কালিন্দীপুরের নিউমার্কেটে পিকেটিং করে। আর ছাত্রলীগ হ্যাপী মোড়ে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে পিকেটিং-এর মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা মেডিকেল কলেজ উদ্বোধনস্থলে যেতে চাইলে জজ কোর্ট এলাকায় সকাল সাড়ে ৯টায় দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষের সময় উভয় সংগঠনের কর্মীরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট ভাংচুর করে। এক পর্যায়ে সকাল ১১টার দিকে কিছু বাঙালি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সংগঠিত হয়ে প্রশাসনের নাকের ডগায় বনরূপাস্থ দেওয়ানপাড়া-কাটাপাহাড় এবং ট্রাইবেল আদামে পাহাড়ী গ্রামে দফায় দফায় সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। ফলে সংঘাতটি একসময় পাহাড়ী-বাঙালি সাম্প্রদায়িক সংঘাতের রূপ নেয়। পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকায় দাড়িয়েছিল। এক পর্যায়ে সাড়ে ১১টার দিকে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন তা কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করেই প্রায় দুই ঘন্টা ধরে হামলা চলতে থাকে। সাম্প্রদায়িক হামলাকারীরা পুলিশের সামনে মূল রাস্তা ধরে লাঠিসোঠা নিয়ে পাহাড়ী গ্রামে হামলা চালায়। প্রায় আড়াই-তিন ঘণ্টা ধরে এই হামলা চলে। বেলা ১২টায় তারা তবলছড়ির আনন্দ বিহার এলাকায় পাহাড়ীদের ওপর হামলা চালায়। এই সময় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কর্মীরা আনন্দ বিহার নামক বৌদ্ধ মন্দিরে আশ্রয় নিলে হামলাকারীরা চারদিক থেকে ঘিরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পরে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ এসে ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রথম হতে প্রশাসন সক্রিয় হলে এই সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হতে পারতো না। ১৪৪ ধারা জারির পরও যেভাবে হামলা সংঘটিত হয়েছে তাতে প্রশাসনের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হয়। ফলে প্রশাসনের দায়িত্বজ্ঞান ও নিরপেক্ষতা নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

১১ জানুয়ারি সবকিছু শান্ত হয়ে এসেছিল। মানুষ স্বাভাবিক কাজকর্ম সারছিল। তবে আতংক ও অবিশ্বাস মানুষের মনে তখনও ছিল। এমন সময় বিকাল ৪টার সময় বনরূপা বাজারে পাহাড়ী বাঙালি দু’জন ব্যবসায়ীর ঝগড়া-বিবাদকে কেন্দ্র করে আবারও ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৪৪ ধারা তখনও বলবৎ ছিল। এর মধ্যেই কিছু সাম্প্রদায়িক বাঙালি গোষ্ঠী বনরূপাস্থ কাটাপাহাড় ও দেওয়ানপাড়ায় আবার হামলা চালায়। পরে সেনাবাহিনী বনরূপায় এসে দ্রুত এ ঘটনার নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু বনরূপা হতে বিতাড়িত হয়ে হামলাকারীরা অন্যান্য এলাকায় হামলা চালায়। পুলিশের সামনে লাঠিসোঠা নিয়ে পাহাড়ী গ্রামে আক্রমণ করা হয়। জেলা প্রশাসক সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে সান্ধ্য আইন জারি করেন। এরপরও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী পাথরঘাটা, মাস্টার কলোনী, ভেদভেদীতে সাম্প্রদায়িক হামলা চালাতে থাকে।

এবারের সাম্প্রদায়িক হামলা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারতো। পাহাড়ী-বাঙালি সম্মিলিত প্রতিরোধে তা বেশি দূর গড়ায়নি। বিভিন্ন স্থানে বাঙালিরা সংখ্যালঘু পাহাড়ীদের রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছে। রিজার্ভবাজারের পাথরঘাটায় শত শত বাঙালি পরিবারের মাঝে মাত্র ৩০/৩৫টি জুম্ম পরিবার বাস করে। ১১ জানুয়ারী সন্ধ্যায় সাম্প্রদায়িক হামলাকারীরা ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোঠা নিয়ে যখন এই গ্রামে হামলা করতে গিয়েছিল তখন পুলিশ ইন্দ্রপুরী সিনেমা হলের সামনে নীরব দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে দেখছিল। এই হামলা ওই গ্রামের জুম্মদের পক্ষে প্রতিহত করা ছিল অসম্ভব, তারা অসহায়ভাবে নিয়তির জন্যই অপেক্ষা করছিল। সেখানে স্থানীয় বাঙালিরাই এই হামলাকে প্রতিরোধ করেছে। জানা যায়, সেদিন স্থানীয় বাঙালিরাই ঘর হতে বের হয়ে গ্রামের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়েছিল। তাদের সেই বাধা উপেক্ষা করে হামলাকারীরা আক্রমণ করতে চেয়েছিল। দীর্ঘক্ষণ হামলাকারীদের সাথে তাদের ধস্তাধস্তিও হয়। এই সময় হামলাকারীরা তাদের উপরও চড়াও হয়েছিল, চাকমাদের দালাল বলে গালিগালাজ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্থানীয় বাঙালিদের প্রতিরোধে জুম্মরা রক্ষা পায়। তবলছড়ির মাস্টার কলোনিতে হাজার হাজার বাঙালির মাঝে মাত্র ৯/১০টি জুম্ম পরিবার বাস করে। সে সব জুম্ম পরিবারের ঘরবাড়ি তছনছ করে দেয়া হয়। গ্রামটির সামনেই কোতোয়ালী থানা। সেখান থেকে কোন বাধা দেয়া হয়নি। যখন এই অত্যাচার চলছিল এবং জুম্মরা অসহায়ভাবে মার খাচ্ছিল তখন সেখানকার স্কুল শিক্ষক ও স্থানীয় বাঙালিরাই ঘর হতে বের হয়ে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিল। তারা হামলাকারীদের বুঝানোর চেষ্টা করে যে নিরীহ মানুষদের উপর কেন হামলা করা হচ্ছে। তখন উগ্র সাম্প্রদায়িক বাঙালিরা তাদের উপরও চড়াও হয়, অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। কিন্তু প্রবল বাধার মুখে সেদিন তারা চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সেদিন রাত্রে বাঙালিরাই পাহারা দিয়ে পাহাড়ীদের নিরাপত্তা বিধান করে। ঘটনার এক ঘন্টা পর পুলিশ যায়। বনরূপায় জুম্ম গ্রামে হামলার সময়ও স্থানীয় বাঙালিরাই রাস্তার প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে হামলাকারীদের বাধা দিয়েছিল। একইভাবে ট্রাইবেল আদামের নিরিবিলি আদাম ও রসুলপুরের গ্রামবাসী পাহাড়ী-বাঙালি মিলে গ্রাম পাহারা দিয়েছিল। পাবলিক হেলথ এলাকায় একইভাবে বাঙালিরা পাহাড়ীদের সাথে মিলে সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবিলা করেছে।

ঘটনার পরপরই প্রশাসন শান্তি মিছিলের আয়োজন করে। প্রকৃতপক্ষে এই শান্তি মিছিল ছিল দায় এড়ানোর মিছিল। প্রশাসনকে প্রথমে জবাবদিহি করতে হবে, কেন ১৪৪ ধারা এবং কার্ফ্যু জারি করার পরও সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হলো? সংঘটিত ঘটনাই বলে দেয় প্রশাসন শান্তি দিতে পারেনি, সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবিলা করতে পারেনি। যেমন – ১১ জানুয়ারি ভেদভেদীতে সেনাবাহিনীর রাঙ্গামাটি জোন কমান্ডার রাত ৮টার দিকে বিবদমান উভয় পক্ষকে কারফিউ জারি হয়েছে জানিয়ে যার যার বাড়ি চলে যাবার জন্য নির্দেশ দেন। সেনাবাহিনী কর্তৃক রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা নিরাপত্তা বিধান করার প্রতিশ্রুতিও তিনি দেন। কিন্তু তার এই ঘোষণার মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে সেনাবাহিনীর সামনে ভেদভেদী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী শ্যামল কান্তি চাকমার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ফলে, শান্তির জন্য প্রশাসনের উপর নির্ভর করা যায় না। সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবিলা করতে হলে এভাবে পাড়ায় পাড়ায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন বাঙালি-পাহাড়ীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়তে হবে, শান্তির জন্য লড়তে হবে।

পাহাড়ী-বাঙালি বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান আনতে পারবে না। তা শাসকগোষ্ঠীর শোষণের হাতকে শক্তিশালী করবে। এদেশের বুর্জোয়া শাসকরাই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে তৈরি করেছে ও তা জিইয়ে রেখেছে। আজ গরিব পাহাড়ীর সাথে গরিব বাঙালির মধ্যে যে বিরোধ তাও এই শাসকদেরই তৈরি। শাসকগোষ্ঠীই পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িকতাকে লালন-পালন করে। তাদের প্রয়োজন হলে তারা তা ব্যবহার করে, নিজেদের প্রয়োজনে আবার তা নিয়ন্ত্রণও করে। এতে সাধারণ গরিব বাঙালি ও গরীব পাহাড়ী কারও স্বার্থ নেই। বরং, পাহাড়ী-বাঙালি গরিব মানুষকে আজ এই সমস্যা সমাধানের জন্য শাসকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। একমাত্র এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামের গরিব মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হবে। তাই সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গণআন্দোলন গড়ে তোলার প্রতি জোর দিতে হবে।

সাম্যবাদ জানুয়ারি ২০১৫

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments