৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার দুই বছর পূর্ণ করলো। এ উপলক্ষে তারা মহাসমারোহে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ উদযাপন করলেন। গত দুই বছরে কেমন ‘গণতন্ত্র’ তারা চালু করেছেন তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হলো গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচন। মানুষ ভোট কতটুকুু দিয়েছে বা কাকে দিয়েছে তা বড় কথা নয়, নৌকা প্রতীকের পক্ষে ভোটের বাক্স ভরে গেছে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী নাটকের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা একচেটিয়া বিজয় অর্জন করেছেন। সরকারি দল কর্তৃক প্রশাসনের সহযোগিতায় আগের রাতেই ব্যালটে সীল মেরে রাখা, কেন্দ্র দখল, বিরোধী পক্ষের পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে গণহারে সীল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা, বহিরাগতদের জড়ো করে ব্যাপক জালভোট প্রদান, বিরোধী নেতা-কর্মী ও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রের আশেপাশে ভিড়তে না দেয়া, নির্বাচনের আগে থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লোকজনকে পুলিশি হয়রানি করে এলাকাছাড়া করাসহ নানা কায়দায় পরিকল্পিত ও কৌশলী রিগিং করা হয়েছে। এই নির্বাচন ভিন্ন কৌশলে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন এবং বিগত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। প্রশাসনিক কারসাজি, বলপ্রয়োগ ও জালিয়াতিপূর্ণ এই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকারকে আরেকবার পদদলিত করা হলো। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ‘নিরংকুশ বিজয়ের’ মাধ্যমে অনির্বাচিত মহাজোট সরকার ‘সফলভাবে প্রমাণ’ করেছে যে, জনগণের বিপুল সমর্থন তাদের পেছনে আছে।
এই নির্বাচনে ৭৩.৯২ শতাংশ ভোট পড়েছে যা অস্বাভাবিক। প্রথম আলো পত্রিকার তথ্যমতে মেয়র পদে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৭৪টি পৌরসভায় এবং ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৬৩টি পৌরসভায়। তার মানে ২০৭টি পৌরসভার মেয়র পদের মধ্যে ১৩৭টিতে ৭৫ শতাংশের ওপরে ভোট পড়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি পৌরসভায় গড়ে ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে। নলডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট পড়েছে শতভাগ, যেমন ছিল যশোরের এমএম কলেজের কেন্দ্রটিতে। বেলা তিনটার সময় সেখানে ভোট গণনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল।
শাসক দল বুঝিয়ে দিচ্ছেন — ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি, ঢাকা-চট্টগ্রামে মেয়র নির্বাচন ও সম্প্রতি পৌরসভায় যেমন নির্বাচন হয়েছে অথবা যা হয়েছে, সেই ধারাই অব্যাহত থাকবে। কারণ, তাদের ভাষায়, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ রক্ষা করতে এবং ‘উন্নয়নের ধারা’ অব্যাহত রাখতে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে যে-কোনোভাবে ক্ষমতায় রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- ও সুশাসনে মানুষ খুবই খুশি, তারা এই সরকারকেই ক্ষমতায় দেখতে চায়। আর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং এর পরবর্তীতে যা চলছে তাতো ‘গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসন’ রক্ষার জন্যই। বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-গণতন্ত্র-উন্নয়ন-সুশাসন ইত্যাদি অর্জনগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে, দেশ আবার দুর্নীতি-জঙ্গীবাদের কবলে পড়বে। এইসব কথা বলে তারা নিজেদের অনির্বাচিত শাসনকে জায়েজ করছেন। দেখা যাক, প্রকৃত অবস্থা আসলে কেমন?
কী ধরনের গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে দেশে?
গত দুই বছরে গণতান্ত্রিক অধিকারকে ক্রমাগত সংকুচিত করে দেশে এক স্বৈরতান্ত্রিক নিপীড়নমূলক শাসন কায়েম করা হয়েছে যা সম্পূর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। মহাজোট সরকার জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। সমগ্র নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং এর ন্যূনতম বিশ্বাসযোগ্যতাকে তারা ধ্বংস করেছে। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও সভা-সমাবেশের গণতান্ত্রিক অধিকারকেও নানাভাবে হরণ করে চলেছে। দেশকে তারা এক ধরনের পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যকা–গুম-নির্যাতন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বিচার ব্যবস্থাসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের কর্তৃত্ব আরও জোরদার করা হয়েছে। গণমাধ্যমসহ সোশ্যাল মিডিয়াকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
প্রাইমারি থেকে এসএসসি, এইচএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াটা নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। কিন্তু সরকার প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দূরে থাক, স্বীকারই করেনি। সরকারের অনেক কাজের পক্ষে থাকা শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবালের মতো মানুষও বলতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘এই সরকারের সময় শিক্ষাব্যবস্থার যে ক্ষতি হলো, তা অতীতের কোনো সরকারের সময় হয়নি।’ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ শিক্ষকদের মর্যাদা প্রশাসনিকভাবে নামিয়ে দেয়ার মতো কাজও করেছে এই সরকার। নারী নির্যাতন-যৌন নির্যাতন বাধাহীনভাবে চলছে। পহেলা বৈশাখে নারী লাঞ্ছনার ঘটনারও কোনো বিচার হয়নি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অত্যন্ত নাজুক।
উন্নয়নের কথা বলে গণতন্ত্রকে বনবাসে পাঠানো হয়েছে। অথচ সীমাহীন দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার, দলীয়করণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি অতীতের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মতো বর্তমান সরকারেরও বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক লোপাটসহ অনেক ক্ষেত্রে তারা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম দুই-তৃতীয়াংশ কমার পরেও দেশে কমানো হয়নি, বরং বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপানো হচ্ছে। এখন আবার রেলের ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে। পুরো দেশের খাদ্যের যোগান দেওয়া কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে টাকা পাঠাচ্ছে, কিন্ত মানবপাচারকারী চক্রের প্রতারণা বা অন্যায় শ্রমশোষণের কবল থেকে তাদের রক্ষায় সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। শিক্ষা-চিকিৎসাসহ সেবাখাতের বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণ চলছে। উন্নয়নের নামে সমস্ত প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে মহাজোট সরকার প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ ও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের পাশে রামপালে বৃহদায়তন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো পরিবেশবিধ্বংসী প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ভারতের সাথে যৌথভাবে। রাশিয়ার ঋণ ও প্রযুক্তিতে বিপুল ব্যয়ে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে যা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে নিয়ে আসতে পারে। এর সাথে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় তো থাকছেই। ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ স্থাপন করতে হবিগঞ্জে চা-বাগানে বংশপরম্পরায় বসবাসরত হতদরিদ্র চা-শ্রমিকদের তাদের কৃষিজমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
সরকারি প্রশাসন-পুলিশ-সেনাবাহিনীকে হাতে রাখতে তাদের বেতন-বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে, কিন্তু সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী গার্মেন্টসকর্মীসহ শ্রমিকরা মানুষের মতো বাঁচার উপযোগী মজুরি পাচ্ছে না। এত শোষণের পরও চীনে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি যেখানে ৫০০ ডলার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামে যেখানে গড়ে ৩০০ ডলার — সেখানে বাংলাদেশে ৭০ ডলারেরও কম। বিদেশী ক্রেতারা তাদের বাজারে ৩৫ ডলারে যে পোশাক বিক্রি করে তা তারা এখানে তৈরি করিয়ে নিতে গড়ে ৫ ডলার খরচ করে, আর এদেশের মালিকরা সেই পোশাক প্রতি শ্রমিকদের ৩৫ সেন্ট করে মজুরি দেয়। ফলে বোঝা যাচ্ছে শোষণের চিত্র কতটা প্রকট।
বাংলাদেশ নিম্ন আয় থেকে মধ্য আয়ের দেশ হয়েছে — মহাজোট সরকারের বিরাট সাফল্য হিসেবে তা প্রচার করা হচ্ছে। তারা পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাচ্ছে — দেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অনেক দেশের তুলনায় বেশি। তথ্য কি সবসময় প্রকৃত চিত্রকে প্রতিফলিত করে? বিশ্বব্যাংকের মানদ- অনুযায়ী পর পর তিন বছর মাথাপিছু আয়ের গড় ১,০৪৫ ডলার হলেই বিশ্বব্যাংক তাকে মধ্যম আয়ের দেশ বলে গণ্য করবে। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু গড় আয় ১,৩১৪ ডলার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা (২০১৫) মতে, জিডিপির আকার ১৫ লাখ ১৩ হাজার ৬ শত কোটি টাকা। এই হিসাবে দেশের ১৬ কোটি লোকের প্রত্যেকের মাথাপিছু আয় হবে বার্ষিক ৯৫ হাজার টাকা, মাসিক প্রায় ৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ, বাংলাদেশে ৪ সদস্যের যে-কোনো পরিবারের মাসিক আয় প্রায় ৩২ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তব অবস্থা কি তাই? সুতরাং সরকার মাথাপিছু আয়ের যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে সেটি কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তার মধ্যে রয়েছে বিরাট শুভঙ্করের ফাঁকি।
তাই মধ্যম আয়ের দেশের গল্পে জনগণের কোনো লাভ নেই। পরিসংখ্যান, বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অথবা বিদেশী বিশ্লেষকদের প্রশংসাপত্র, কোনোটাই বাস্তব চিত্রকে উল্টে দিতে পারে না। যে নিদারুণ দারিদ্র্য ও বেকারত্ব লক্ষাধিক মানুষকে ভয়ংকর সমুদ্র পথে ঠেলে দিয়েছে, যে দুর্বিষহ জীবনযন্ত্রণা বারবার গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে — তাকে তো ছোট করে দেখানো যাবে না। বিশ্বব্যাংকের দেয়া মর্যাদা অথবা পরিসংখ্যানের অংকের চেয়ে খালি চোখে যা মানুষ দেখে, সেটাই সত্য, সেটাই বাস্তব। জনগণ সেটাই বিশ্বাস করবে।
মহাজোট সরকারের গণবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক শাসনের সুযোগে দেশে জঙ্গিবাদী-মৌলবাদী তৎপরতার জমিন বিস্তৃত হচ্ছে। শিয়া মুসলিম-খ্রীস্টান সম্প্রদায়-কাদিয়ানী-বাহাইসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আক্রমণের শিকার হচ্ছে, লেখক-প্রকাশক-বিদেশি নাগরিকদের ঘোষণা দিয়ে খুন করা হচ্ছে। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো যেমন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চক্রের সঙ্গে যুক্ত, আবার দেশের বুর্জোয়াশ্রেণীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতও এদের পেছনে আছে। কারণ এই সংগঠনসমূহ বুর্জোয়াদের পক্ষে পরিস্থিতি তৈরি করতে সহায়তা করে। এসব কারণে দেশে আজ নিরাপত্তাহীন ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
তথাকথিত উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে কারা? কাদের স্বার্থে দেশ পরিচালিত হচ্ছে?
উন্নয়নের তথ্য যা প্রচারিত হচ্ছে তাতে দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই কোনো সংযোগ নেই। উন্নতি হচ্ছে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিশ্রেণীর। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে শুধু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন হিসাবের সংখ্যা ৪৯ হাজার ৫৫৪। ২০১৩ সালের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৪৬ হাজার ১৩৫ জন। ৬ মাসের ব্যবধানে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৪১৯ জন। ২০০৯ সালে কোটিপতি ছিল ২৩ হাজার ১৩০ জন। পাঁচ বছরে কোটিপতি আমানতকারী বেড়েছে ২৬ হাজার ৪২৪ জন। দেশে ৭২ সালে ছিল মাত্র ৫ জন কোটিপতি — জোট-মহাজোট-সামরিক-বেসামরিক সবার শাসনে ও উন্নয়নে বর্তমানে কোটিপতির সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।
বাংলাদেশের দ্রুত বড় হওয়া অতি ধনী ও সুবিধাভোগীদের চিত্র ফুটে উঠেছে ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৩-এ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ন্যূনতম ৩ কোটি ডলার বা ২৫০ কোটি টাকা সম্পদধারীর সংখ্যা ৯০। তাদের কাছে গচ্ছিত মোট সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার বা ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ১২ শতাংশ। এক বছর আগে এমন ধনীর সংখ্যা ছিল ৮৫। তাদের কাছে গচ্ছিত সম্পদ ছিল ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার। এসব হিসাব থেকে দেখা গেছে, ন্যূনতম ৩ কোটি ডলার সম্পদ আছে এমন অতি ধনী ২০০৯ সালে ছিলেন সর্বোচ্চ ৫০ জন। ২০১৪ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমানো টাকার পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ৮০ লাখ ফ্রাঁ (চার হাজার ৪৫৪ কোটি টাকার সমান)। তার আগের বছর (অর্থাৎ ২০১৩ সালে) এটা ছিল তিন হাজার ২৩৬ কোটি টাকার সমান সুইস মুদ্রা। ২০১৪ সালের ‘বিআরটিএ’ প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী এক কোটি টাকার বেশি দামের গাড়ির সংখ্যা ৪৯ হাজার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ওয়েলফেয়ার মনিটরিং সার্ভে অনুযায়ী, মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশের হাতেই দেশের সম্পদের সবচেয়ে বড় অংশ, ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ।
দেশের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ সম্পদ দেশের মাত্র ৪ শতাংশ লোকের হাতে কিভাবে গেল? কাদের হাত থেকে সম্পত্তি এই স্বল্প-সংখ্যক লোকের হস্তগত হয়েছে? দেখা যাবে যে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা সম্পদ হারিয়ে রাস্তায় বসে যাচ্ছে। দরিদ্র চাষী জমি হারিয়ে ভূমিহীন হয়েছে, মাঝারী চাষী দরিদ্র চাষীতে পরিণত হয়েছে। কুমার, কামার, মুচি, তাঁতী, কারিগর ইত্যাদি ক্ষ্রদ্র ক্ষুদ্র পেশার লোক যারা দক্ষতা বিক্রি করে জীবনধারণ করতো তারা তাদের কাজের ক্ষেত্র থেকে উচ্ছেদ হয়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। আর তাদের শ্রমকে কীভাবে নিংড়ে নিয়ে মালিকশ্রেণী লাভ করছে তা গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
এই নির্মম শোষণের সাথে আছে রাষ্ট্রিয় সম্পদের যথেচ্ছা লুটপাট। যার ফলাফল হল জনগণের ওপর চেপে বসা অভাব ও দারিদ্র্য। দেশ থেকে এক বছরে পাচার হয়েছে কমপক্ষে ৭৬ হাজার কোটি টাকা। ১০ হাজার কোটি টাকার পদ্মাসেতু বারবার বাজেট বাড়িয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আগামীতে খরচ আরও বাড়ানো হবে। চার লেন সড়ক, ফ্লাইওভারগুলোর খরচ একেকবার কয়েকশ কোটি টাকা করে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। প্রায় ছয়শ কোটি টাকার হাতিরঝিল প্রকল্পে ইতিমধ্যে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। এই যে লুটপাট, অর্থ পাচার — এসব তো জনগণেরই অর্থ। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সাফল্যের আড়ালে ব্যাংক থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা লুটের বিষয় চাপা পড়ে গেছে। চাপা পড়ে গেছে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি। বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার চুক্তি, অস্ত্র কেনার চুক্তি করা হচ্ছে। এই ঋণের বোঝা টানতে হবে জনগণকেই। দুর্নীতির মাধ্যমে এসব খাত থেকে অর্জিত অর্থ চলে যাচ্ছে অল্প কিছুসংখ্যক মানুষের পকেটে।
যে দেশ থেকে এত হাজার কোটি টাকা লুট হয় সে দেশকে কে গরিব বলবে? যদিও সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’ই বলছে, জনসংখ্যার ২৫.৬ শতাংশ দরিদ্র। সরকারি পরিসংখ্যান একটু কমিয়েই বলে। তবু যা বলেছে, সেই সংখ্যাটাও বিরাট। প্রায় চার কোটি। পৃথিবীর বহু দেশের জনসংখ্যাও এর চেয়ে কম। এরা ঠিক মতো খেতে পায় না, শিক্ষা-চিকিৎসা-স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান-বিশুদ্ধ পানি এসব তো আরো দূরের ব্যাপার। অন্য আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, চলমান ‘উন্নয়নের’ ব্যবস্থায় ৭৫ শতাংশ মানুষই বড় ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কোনোভাবে আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলিয়ে দিন পার করছে ৫ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার মানুষ। আর দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী এমন মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিতের সংখ্যা দেড় কোটি মানুষ।
অন্যদিকে, ব্যাংকিং খাতে এখন অতিরিক্ত তারল্য আছে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। কয়েক বছর ধরে অলস টাকার এই পরিমাণ বেড়েই চলেছে। কিন্তু ঋণ নিচ্ছেন না শিল্পোদ্যোক্তারা, দেশে নতুন বিনিয়োগ তেমন হচ্ছে না। ‘তারল্য’, ‘অলস টাকা’ — এসব শব্দ শুনে আমরা অনেকেই বুঝতে পারব না এ শব্দগুলোর আড়ালে কি আছে। এগুলো বলছে, দেশে শিল্পায়ন তেমন হচ্ছে না। যার অর্থ দেশে সাধারণ মানুষের জন্য নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। বেকারত্ব বাড়ছে। অথচ আওয়ামী মহাজোট প্রত্যেক ঘরে ঘরে চাকুরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের ভোট নিয়েছিল।
৪ শতাংশ মানুষের স্বার্থে যে দেশ পরিচালিত হয়, সেটি গণতান্ত্রিক হতে পারে না
দেশের মানুষকে নির্মম শোষণ করে, দেশের সম্পদ লুট করে এই ৪ শতাংশ মানুষ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তারা বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা শ্রমের কেন্দ্র বানিয়েছে এই দেশকে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিসমূহকে আহবান করা হচ্ছে যাতে তারা দেশীয় বুর্জোয়াদের সাথে মিলে এখানে বিনিয়োগ করে। তাছাড়া এদেশের পুঁজিপতিরা বিদেশে পণ্য রপ্তানী করে বিরাট মুনাফা করছে এবং তা আরও বাড়াতে চায়। তৈরি পোশাক শিল্প সবচেয়ে বেশি রপ্তানীর ক্ষেত্র, সেখানকার শ্রমিকদের অবস্থা আমরা বলেছি। উল্লেখযোগ্য রপ্তানী ঘটছে ওষুধ শিল্পে, সিমেন্ট শিল্পে, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্পে, প্লাস্টিক শিল্পে। এসব আবার দেশের মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয় দেশের উন্নতি বলে। কিন্তু সত্য এই যে, যাদের শ্রমে এসকল দ্রব্য প্রস্তুত হয় তারা এর মালিক নয়। তাদের শ্রমের পুরোটাই আত্মসাৎ করা হয়। মজুরি যা দেয়া হয় তা শুধু কোনোরকমে জীবনধারণের জন্য, যাতে আরও অধিক মুনাফা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এদের শ্রমকে ব্যবহার করা যায়।
এই মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির স্বার্থরক্ষাকারী সরকার কখনও গণতান্ত্রিক হতে পারে না। আবার সারা দুনিয়ায় যে বুর্জোয়া গণতন্ত্র চলছে তাতে দেশের বেশিরভাগ সম্পদের নিয়ন্ত্রণকারী সেই স্বল্প সংখ্যক পুঁজিপতিশ্রেণীর স্বার্থরক্ষা ব্যতিরেকে কেউ এই প্রচলিত পার্লামেন্টারি পথে ক্ষমতায় আসতেও পারে না। দেশের ও দেশের মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী সরকার ক্ষমতায় আসতে হলে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় বিপ্লবের মাধ্যমে এই পুঁজিপতিশ্রেণীকে উচ্ছেদ করেই আসতে হবে।
বর্তমান সময়ে সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দল ঢাকাসহ সারাদেশে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে ৫ জানুয়ারির দুই বছর পূর্তি পালন করেছে। একদলের কাছে ৫ জানুয়ারি ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার দিবস, অন্যদলের কাছে গণতন্ত্র হত্যা দিবস। ৫ জানুয়ারিতে সরকার ও বিরোধী পক্ষের এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখে অনেকে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষণ থেকে এবং এদেশের বুর্জোয়া শাসকদের বর্তমান প্রবণতা থেকে আমরা বলতে পারি যে, শাসকদের এই শান্তি জনগণের জন্য ভয়াবহ বিপদ ও দুর্যোগ ডেকে নিয়ে আসছে। কেননা, কথায় বলে, গোরস্থানের মতো শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আর কোথাও নেই। শাসকশ্রেণী দেশের মাটিতে সেই গোরস্থানের শান্তিই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রতিবাদ নেই, বিক্ষোভ নেই — জনগণকে হীনবল ও হতাশ করে দিয়ে মুখ বুজে সমস্ত অন্যায় মেনে নেওয়ার পরিবেশ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আজকের দিনে বুর্জোয়াশ্রেণী ‘উন্নয়ন’ ও ‘গণতন্ত্র’ বলতে এই পরিবেশই বোঝে। এ পরিবেশকে ভেঙ্গে সম্পূর্ণ মুক্ত ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য তাই জনগণকে গণআন্দোলন গড়ে তোলার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।