শিক্ষার্জনের মাধ্যমেই মানুষ আদিম পশুর স্তর থেকে মানবিক জীবনের অধিকারী হয়েছে। সকল মানুষের সংগ্রাম লব্ধ অর্জন বলে শিক্ষাকে সামাজিক সম্পদ বলা হয়। তাই কোনও একজন মানুষকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা মানে তাকে মানবিক জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, অসভ্য-বর্বর জীবনের দিকে ঠেলে দেয়া।
শুধু মানবিক জীবনই নয়, আমরা আজকে যে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বসবাস করি, তার সাফল্য-ব্যর্থতাও অনেকাংশে নির্ভর করে শিক্ষার বিস্তারের উপর। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল মর্মবাণীই হল সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা। যাতে রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়ম নীতি, সরকারের বিভিন্ন নীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা গড়ে না উঠলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের পক্ষে কার্যকর মতামত দেয়া সম্ভবপর হয় না। জনগণের মতামত ব্যতিরেকে স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় রাষ্ট্র পরিচালিত হতে থাকে। একের পর এক জনঅধিকার ক্ষণœœ হয়, জীবনের বিকাশও ব্যাহত হয়। শিক্ষিত ব্যক্তি শুধু যে কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রহরী তাই নয়, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি-অগ্রগতিরও অনেকখানি নির্ভর করে শিক্ষার উপর। যে দেশে শিক্ষার হার যত বেশি, সে দেশ তত বেশি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে মোট সম্পদের বিভিন্ন ধরনের পুঁজির মধ্যে মানব ও সামাজিক পুঁজির অবদানই ৬৪ শতাংশ। ফলে একদিকে মনুষ্যত্ব-মানবিকতার উদ্বোধনে মানবিক জীবনের পথ রচনা ও অন্যদিকে সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সার্বজনীন শিক্ষার বিস্তার প্রয়োজন।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে বুর্জোয়ারাই প্রথম এ দাবি তুলে ধরেছিল। মানবিক জীবনের আকাক্সক্ষাকে মূর্ত করে তুলেছিল। বুর্জোয়া সমাজের ঊষালগ্নে সামন্ত সমাজের শোষণ-নিপীড়ন-জবরদস্তির হাত থেকে মুক্তির জন্য। শিক্ষাকে সে দিন তারা প্রকৃতির অন্ধশক্তির হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন মানুষ গড়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল। পুঁজিবাদের অবাধ বিকাশের যুগে তারাই সে দিন সর্বজনীন শিক্ষার দাবিকে উচ্চকিত করেছিল। কিন্তু পুঁজিবাদ তার বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে অর্থাৎ একচেটিয়া স্তরে এসে নিজের মুনাফা সর্বোচ্চকরণের প্রয়োজনে একসময় যেটুকু অধিকার মানুষ পেয়েছিল, আজ তাও হরণ করছে,শিক্ষার অধিকারের ওপরও হস্তক্ষেপ করছে। রাষ্ট্রও ক্রমাগত তার দায়িত্ব সংকুচিত করে বেসরকারি পুঁজি বিনোয়োগের ক্ষেত্র প্রশস্ত করছে। গ্যাট্স চুক্তি অনুযায়ী যে ১৬১ টি পরিষেবা খাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে শিক্ষা তার মধ্যে অন্যতম। বিশ্বব্যাপী বাজারের চূড়ান্ত সংকটের মুখে পুঁজিপতিরা লাভজনক ব্যবসা হিসেবে শিক্ষাকে বেছে নিয়েছে। বিশ্বপুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অংশ হিসাবে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীও শিক্ষা সম্পর্কে মুক্তবাজারের দর্শন গ্রহণ করেছে। পুঁজিপতিদের বিনিয়োগের রাস্তা হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রকে উন্মূক্ত করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অব্যাহত ফি বৃদ্ধি, সরকারি দায়িত্বে নতুন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ না করে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে লাগামহীন। এভাবে শিক্ষা যখন বাণিজ্যের পণ্যে পরিণত হয় তখন শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে ন্যায়-নীতি মূল্যবোধ জাগ্রত করা, যথার্থ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীন মানুষ তৈরি আর থাকে না। ভাবগত তথা সংস্কৃতিগত উৎকর্ষের অধিকারী না হয়ে শুধু বস্তুগত উৎপাদন তথা কর্মদক্ষ খ-িত মানুষ গড়ে ওঠে। এটা শোষণমূলক পুঁজিবাদী সমাজে শাসকগোষ্ঠীর পরিকল্পনারই অংশ।
বাংলাদেশে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ধারা শুরু হয়েছে কয়েক দশক আগে প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারের দায়িত্ব অস্বীকারের মধ্য দিয়ে। প্রি-ক্যাডেট, কিন্ডারগার্টেন, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ফলে সাধারণ মানুষ আর্থিক অসঙ্গতির কারণে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। স্বাধীন দেশে এমনকি সকলের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাটুকুও নিশ্চিত করা যায় নি। এ জন্য ৮৮ হাজার গ্রামে অন্তত ৮৮ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখনও এর সংখ্যা ৬৩,৮৭২টি। (এর মধ্যে আবার রয়েছে গত ২০১৩ সালে আওয়ামী সরকারের পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের ঘোষণাকৃত ২৬,২০০টি বেসরকারি স্কুল) অর্থাৎ প্রায় ২৫ হাজার গ্রামে এখনও কোনো সরকারি বিদ্যালয় নেই। গত ১৬ বছরে (১৯৯৬ থেকে ২০১২ সাল) দেশে একটিও সরকারি স্কুল নির্মিত হয়নি। মাধ্যমিকের অবস্থা তো আরো ভয়াবহ। ১৮৭৯৫ টি মাধ্যমিক স্কুলের মধ্যে মাত্র ৩১৭ টি সরকারি! এর উপর এই সব স্কুলগুলোতে শিক্ষক সংকট, আয়োজনের অপ্রতুলতার কারণে এবং তথাকথিত সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির জন্য শিক্ষার্থীদের কোচিং ও গাইড বইয়ের উপর নির্ভর হতে হচ্ছে। ফলে প্রাথমিক স্তরেই প্রবল শিক্ষাব্যয় বাড়ছে। স্কুলের বাইরে নয়, সরকার কোচিং নীতিমালা করে স্কুলেই কোচিং-এর বৈধতা দিয়েছে। স্কুলে পড়াশুনা হয় না বলে অভিভাবকরাও বাধ্য হচ্ছেন সন্তানকে কোচিং করাতে। ভর্তির সময়ও নেয়া হয় অতিরিক্ত ফি। বিভিন্ন স্কুলে ভর্তির সময় ৫-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। বার্ষিক পরীক্ষায় পাস করার পর পুনঃভর্তির সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে টাকা নেয়া হয়। শিক্ষাবাণিজ্যের অন্যতম ক্ষেত্র উচ্চশিক্ষা। প্রতিবছর যে বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে উচ্চশিক্ষার দোরগোড়ার পৌঁছায়, পর্যাপ্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় তাদের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয়। তাই যেখানে ১৯৯২ সালের আগে ১টিও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না সেখানে এখন এর সংখ্যা ৭৯টি। গত ২০১২ সালে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুনাফা করেছে ১ হাজার ৮৫০ কোটি ৪২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। দেশে বর্তমানে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের সংখ্যা ৮০টি। এর মধ্যে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ৬২টি, যেখানে ভর্তি ফি গড়ে ১৮ লাখ টাকা। বিভিন্ন দৈনিকে এসেছে, গত বছর বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তিতে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। শিক্ষা সম্পর্কিত এই নীতির কারণে সরকার নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা তো করছেই না বরং ইউজিসি’র কৌশলপত্রের সুপারিশ অনুসারে ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ আয় বাড়িয়ে চলছে। অর্থাৎ ছাত্র বেতন-ফি বাড়ছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত ১০ বছরে ১০ গুণেরও বেশি ফি বেড়েছে। লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাণিজ্যিক নাইটকোর্স খুলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ভাড়া দিয়ে টাকা আয় করছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও মানোন্নয়ন ফি, ফরম পূরণ ফি, ভর্তি ফরমের মূল্যবৃদ্ধিসহ নামে বেনামে ফি আদায় চলছে। তীব্র সেশনজট একদিকে জীবনের মূল্যবান সময়ের অকারণ অপচয় ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে তীব্র শিক্ষক সংকট ও অবকাঠামোগত আয়োজনের দুর্বলতার কারণে সিলেবাস অসম্পূর্ণ রেখেই পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বাণিজ্যিকীকরণের যে ফলাফল তা ইতোমধ্যে আমরা পেতে শুরু করেছি। প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা ধরণের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীসহ শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কে পরিণত হয়েছে। সার্টিফিকেট বা কেবল ভালো পাশ করার লক্ষ্যে অর্জিত শিক্ষা মানবিক গুণাবলী বিকাশের পরিবর্তে আত্মকেন্দ্রিকতা ও মুনাফামুখী মানসিকতা বাড়িয়ে তুলছে। এ কারণেই সমাজে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়লেও, দুর্নীতি ও গণবিরোধী নানা কর্মকা- অনেকক্ষেত্রে শিক্ষিত (ডিগ্রিধারী) মানুষদের দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছে। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানেও উচ্চচেতনার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। তাই শিক্ষার বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণের নীতির বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই গড়ে তুলতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন গণতন্ত্রকামী সকল মানুষের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা আজ সময়ের দাবি। কেবল সাধারণ মানুষের শিক্ষার অধিকার রক্ষার জন্যই নয়, বরং মনুষ্যত্ব বিনাশের যে প্রক্রিয়াটি সমাজ জুড়ে চলছে, তাকে রোধ করতে গেলে এর কোনো বিকল্প নেই।
শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণ-সংকোচন নীতি বিরোধী শিক্ষা কনভেনশন, প্রথম অধিবেশন, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪, টিএসসি মিলনায়তন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট