শিক্ষা মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্রীয় উদাসীনতায় শিক্ষার সর্বস্তরে ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষাকে বেসরকারিকরণসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণের যে চক্রান্ত চলছে তার বিরুদ্ধে তীব্র ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।”- সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ৩৩ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ২১ জানুয়ারি ২০১৭ সকাল ১১ টায় চট্টগ্রাম শহীদ মিনারে আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে নেতৃবৃন্দ এ কথা বলেন। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন নগর সহ-সভাপতি মুক্তা ভট্টাচার্য । সমাবেশ পরিচালনা করেন নগর সাংগঠনিক সম্পাদক দীপা মজুমদার। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সাধারন সম্পাদক আরিফ মঈনুদ্দিন, স্কুল সম্পাদক জয়তু সুশীল প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, ” স্বৈরাচারী শাসকের অগ্নিগর্ভে ১৯৮৪ সালের ২১ জানুয়ারি একটি সর্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, সেক্যুলার, একই পদ্ধতির, গণতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম। পাকিস্তান সরকার আমাদের শিক্ষা দিতে চায় নি। মানুষের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিতে তারা তৈরি করেছিল শরীফ কমিশন শিক্ষানীতি। এই শিক্ষানীতি বাতিলের জন্য ১৯৬২ সালে ছাত্ররা লড়াই করেছিল। শরীফ কমিশন শিক্ষানীতিতে পরিষ্কার হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে কুদরত এ খুদা শিক্ষা কমিশন যে শিক্ষানীতি গঠন করে তাতেও শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতিরই পুনরাবৃত্তি ঘটে। ১৯৮৩ সালের মজিদ খান শিক্ষানীতিতেও বলা হয়, শিক্ষা সবার জন্য নয়। এর বিরুদ্ধেও সেদিন ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষানীতি-২০১০ পর্যন্ত আজ অবধি যেসব শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে সকল শিক্ষানীতিরই মূল কথা একই। অর্থাৎ পাকিস্তান সরকার যে দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মানুষকে শিক্ষা দিতে চায় নি, আমাদের দেশের বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠীও একই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সকলের শিক্ষা নিশ্চিত করতে চায় না।”
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, ” স্বাধীনতার পর থেকে চট্টগ্রামে কোন সরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হয় নি। কিন্তু ব্যঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেহেতু সকলের পড়ার সুযোগ নেই তাই শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই পড়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু সেখানেও ক্রমাগত ফি বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষাকে মুষ্টিমেয় মানুষের সুযোগে পরিণত করা হচ্ছে। গতবছরের মত এবছরও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে বেতন ও ভর্তি ফি শতভাগ বাড়িয়েছে। বোর্ড নীতিমালা না মেনেই নগরীর অনেকগুলো স্কুলে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অবৈধভাবে আদায় করা হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে প্রাইমাররি থেকে ঝড়ে পড়ার হার শতকরা ৫৫ ভাগ। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর পরও ৩২ ভাগ শিশু নিরক্ষর থেকে যাচ্ছে। নামমাত্র পড়াশুনায় শিক্ষার মান ধ্বংসের মুখে। ভুলে ভরা পরীক্ষার খাতায় চোখ বুজে নম্বর দিয়ে শতভাগ পাশের হার ও লক্ষ লক্ষ জিপিএ-৫ দেখিয়ে শিক্ষাবিপ্লব ঘটাচ্ছে সরকার। সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা জেনেছি, বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণ পাওয়ার জন্য সরকার এভাবে পাশের বন্যা তৈরী করছে। একদিকে শিক্ষার এই পরিস্থিতি, আর অন্য দিকে সরকার মহা ধুমধাম করে বই উৎসব করছে। অজ¯্র ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তকগুলোতে বিকৃতি, লৈঙ্গিক বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। বই হয়ে পড়ছে সাম্প্রদায়িকতা ও দলীয় প্রচারণার মাধ্যম। সরকারের এই অগণতান্ত্রিক অমানবিক কার্যক্রম রাষ্ট্রের বাণিজ্যিকীকরণ-সাম্প্রদায়িককিরণ ও শিক্ষা সংকোচন নীতিরই প্রতিফলন।”
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, ” বর্তমান সরকারের ফ্যাসীবাদী দুঃশাসনে সাধারণ মানুষের জীবন দূর্বিষহ হয়ে পড়েছে। ক্রমাগত বাড়ীভাড়া, গাড়িভাড়া, গ্যাম-বিদ্যুতের দাম, দ্রব্যমূল্য যে হারে বাড়ছে সে হারে বাড়ছে না সাধারন মানুষের আয়। সম্প্রতি মিথ্যা অজুহাতে বিদ্যুতের দাম আবারো বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়েছে। চট্টগামে পানির বিল ১৮% বাড়ানো হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন বাড়ি ভাড়ার উপর ১৭% হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করেছে। মাদক-জুয়া-পর্ণোগ্রাফির দৌরাত্মে যুবসমাজের নৈতিক চরিত্র, মূল্যবোধ ক্রমান্বয়ে ধ্বসে পড়ছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করে শাসকগোষ্ঠীর লোভ ও রাবের শিকার হয়ে ধ্বংস হতে চলেছে প্রাণ-প্রকৃতির লীলাভূমি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। এক চরম ফ্যাসিবাদী কায়দায় পরিচালিত হচ্ছে দেশ। সারাদেশের এমন অন্ধকার হতাশাময় পরিস্থিতিতে সাধারন জনগণের সামনে আলোর দিশারী হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট।”
নেতৃবৃন্দ বলেন, “শিক্ষা সংস্কৃতি মনুষ্যত্ব রক্ষার যে অঙ্গীকার নিয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। আমরা এমন একটি শিক্ষা আন্দোলন গড়ে তুলতে চাই যে শিক্ষা মানুষকে ভালোবাসতে শিখাবে, ন্যায় অন্যায় বুঝতে শিখাবে, যুক্তি ও বিজ্ঞানের ভিত্তিতে জীবনকে পরিচালনা করতে শিখাবে। সমাজের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক-পেশাজীবী সকলকে এই আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই।”