‘শিক্ষার সকল স্তরে ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলুন’ – এই স্লোগানকে সামনে রেখে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট মহান শিক্ষা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও প্রধান জেলা শহরগুলোতে আঞ্চলিক ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রংপুর, ময়মনসিংহ, স্কুলে কোচিং-গাইডবই-প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ, স্কুলকে শিক্ষার মূল কেন্দ্রে পরিণত করা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র পরীক্ষাহল নির্মাণ, ২১০ দিন ক্লাস নিশ্চিত করা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাইটকোর্স বন্ধ করার দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলনের প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়।
ঢাকা : শিক্ষাদিবস উপলক্ষে ১৭ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)-র কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। সমাবেশে ঢাকা নগর শাখার সভাপতি নাঈমা খালেদ মনিকার সভাপতিত্বে আরো বক্তব্য রাখেন বাসদ (মার্কসবাদী) নেতা ফখরুদ্দিন কবির আতিক, সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী রিন্টু, শরীফুল চৌধুরী, রাশেদ শাহরিয়ার, মাসুদ রানা। সমাবেশ শেষে দাবিনামা সম্বলিত প্লাকার্ড-ফেস্টুনসমেত একটি সুসজ্জিত মিছিল প্রেসক্লাব-হাইকোর্ট, পল্টন, দৈনিক বাংলা-বঙ্গভবন-গুলিস্তান প্রদক্ষিণ করে সংগঠন কার্যালয়ে এসে শেষ হয়।
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী তাঁর আলোচনায় বলেন, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন করতে গিয়ে সে সময় এ দেশের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। সেদিন শিক্ষা হরণের বিপরীতে ছাত্ররা সর্বজনীন শিক্ষার দাবিতে লড়াই করেছিল। ৫৩ বছর পর আজ স্বাধীন দেশের সরকার শিক্ষায় ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ছাত্ররা তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করল। দেশ স্বাধীন হলেও ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গিতেই স্বাধীন দেশের সরকারগুলোও শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করছে। পুঁজিবাদী সমাজে শিক্ষাকে মুনাফার পণ্যে রূপান্তর করেছে। ছাত্ররাই পারে আদর্শের উপরে দাঁড়িয়ে ন্যায্য অধিকার আদায় করতে। তিনি আরো বলেন, নানা ভোগবাদী অপসংস্কৃতির দ্বারা ছাত্রসমাজের চরিত্রও হরণ করা হচ্ছে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা এবং বড় মানুষদের চরিত্রের শিক্ষা নিয়ে পুঁজিবাদী সমাজ ভাঙার পরিপূরক শিক্ষা আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে।
রংপুর : সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট রংপুর বিভাগীয় সমাবেশ ১৭সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় রংপুরের টাউন হল মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুজ্জামান সাকন, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিলুফার ইয়াসমিন শিল্পী, এসএম মনিরুজ্জামান প্রমুখ। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আহসানুল আরেফিন তিতু। সমাবেশ শেষে প্রায় ২ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর একটি সুসজ্জিত মিছিল শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্দশা দেশের সমস্ত ক্ষেত্রের অরাজক পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। একদিকে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি দরিদ্র মানুষকে আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করছে। উপর্যুপরি বন্যায় উত্তরবঙ্গের জনপদ এখন বিপর্যস্ত। খুন-ধর্ষণ লাগামহীন ভাবে চলছে, বিচার নেই। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুম-ক্রস ফায়ার জনজীবনকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মত মৌলিক অধিকারকে পুঁজিপতিদের অবাধ মুনাফার ক্ষেত্রে পরিণত করে দিয়েছে সরকার। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র লাগামহীন ব্যয়বৃদ্ধি দরিদ্র মানুষের শিক্ষা নেবার রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে। শিক্ষাসহ জনঅধিকারের উপর এই আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়বে যে ছাত্রসমাজ তাদেরকে বিপথগামী করা হচ্ছে। একদিকে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-সন্ত্রাসে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে, অন্যদিকে আত্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতি ও ভোগবাদী মানসিকতা ছড়িয়ে দিয়ে সমাজবিমুখ ও স্বার্থপর করে তোলা হচ্ছে। এ দুঃসহ পরিস্থিতিতে আলো জ্বালবে কারা? বড় মানুষের জীবনের শিক্ষাকে ধারণ করে কেবল শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নয়, মনুষ্যত্ববিনাশী যে প্রক্রিয়াটি সমাজে চালু আছে তাকে প্রতিরোধ করতে হলে, ছাত্র-যুবকদেরই আজ জাগতে হবে। সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধের শক্তি গড়ে তুলতে হবে।
সাইফুজ্জামান সাকন বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই প্রধান ধারা হয়ে উঠেছে। শিক্ষার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অস্বীকার করে সরকার ’৬২এর সেই স্বৈরতান্ত্রিক পাকিস্তানিদের নীতিকেই অনুসরণ করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অবকাঠামোসহ চরম শিক্ষক সংকটে জর্জরিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত কলেজগুলোতে বছরে ২ মাসও ক্লাস হয় না। সরকারি কলেজগুলোতেই বিভাগ প্রতি গড়ে ৪/৫ জনের বেশি শিক্ষক নেই। সিলেবাস-প্রশ্ন পদ্ধতির পরিবর্তন ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার মতো। শিক্ষক নিয়োগ, উপযুক্ত প্রশিক্ষণসহ যথাযথ আয়োজনের অভাবে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি, গাইড-কোচিং নির্ভরতা কমানোর পরিবর্তে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কোমলমতি শিশুদের জন্য অযৌক্তিক পাবলিক পরীক্ষা চালুর ফলে স্কুলেই এখন কোচিং বিস্তৃত হয়েছে। পাসের হার বাড়িয়ে কৃতিত্ব জাহিরের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ফাঁস, নম্বর বাড়িয়ে দেয়া সহ নানা দুর্নীতিই উৎসাহিত হয়েছে। গোটা শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার ধরণ ও লক্ষ্য যখন সার্টিফিকেট অর্জন হয়ে দাঁড়ায়, তখন শিক্ষিত মানুষরা সমাজে আলো ছড়ানোর পরিবর্তে দুর্নীতি ও স্বার্থপরতার পঙ্কে নিমজ্জিত হয়। এভাবে দেশের ভবিষ্যত বিপন্ন হবে, আর ছাত্রসমাজ চেয়ে চেয়ে দেখবে – এ হতে পারে না।
নোয়াখালি : ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় নোয়াখালী মুক্ত স্কয়ারে আঞ্চলিক ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছাত্রনেতা মাসুদ রেজা-এর সভাপতিত্বে এবং নোয়াখালী জেলা শাখার আহবায়ক বিটুল তালুকদারের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটির সদস্য কমরেড মানস নন্দী, পার্টি নোয়াখালী জেলা শাখার আহবায়ক কমরেড দলিলের রহমান দুলাল, ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী রিন্টু, সাংগঠনিক সম্পাদক সত্যজিৎ বিশ্বাস, নোয়াখালী জেলার মোবারক করিম, চাঁদপুরের সাদ্দাম হোসেন, ফেনীর নয়ন পাশা, লক্ষ্মীপুর জেলার নুরুল আলম, কুমিল্লা জেলা আবু সুফিয়ান, নোবিপ্রবি শিক্ষার্থী অনিক দাস, ফেনী ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী জামাল আহমেদ রনি প্রমুখ। সমাবেশ শুরুর আগে ব্যানার ফেস্টুন সম্বলিত বিক্ষোভ মিছিল শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
সিলেট : ১৭ সেপ্টেম্বর বিকাল ৩টায় সিলেট কোর্ট পয়েন্টে বিভাগীয় ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগঠন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শফিকুল ইসলাম এবং পরিচালনা করেন সিলেট নগর শাখার সভাপতি রেজাউর রহমান রানা। বক্তব্য রাখেন, বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটির সদস্য কমরেড মানস নন্দী, সংগঠন কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সত্যজিৎ বিশ্বাস, সিলেট নগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রুবাইয়াৎ আহমেদ, শাবিপ্রবি শাখার কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক অপু কুমার দাস, হবিগঞ্জ জেলার সংগঠক এনামুল হক, মৌলভীবাজার জেলার সংগঠক রানা বাউড়ি প্রমুখ। সমাবেশ শেষে শত শত শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সুশৃঙ্খল এবং সুসজ্জিত মিছিল নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়।
চট্টগ্রাম : ১৬ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩টায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আঞ্চলিক ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ সভাপতিত্ব করেন জোন ইনচার্জ সত্যজিৎ বিশ্বাস ও পরিচালনা করেন নগর শাখার সভাপতি তাজ নাহার রিপন। বক্তব্য রাখেন বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটির সদস্য কমেেরড উজ্জ্বল রায়, কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রী চক্রবর্তী রিন্টু, রাঙামাটি জেলা আহবায়ক কলিন চাকমা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আহবায়ক ফজলে রাব্বী, খাগড়াছড়ি জেলার কবির হোসেন, চট্টগ্রাম নগর শাখার সাধারণ সম্পাদক আরিফ মাঈন উদ্দিন ও নগর সহ-সভাপতি মুক্তা ভট্টাচার্য।
এছাড়া ১৫ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহে এবং ১৯ সেপ্টেম্বর খুলনায় আঞ্চলিক অনুষ্ঠিত হয়। আগামী ১৩ অক্টোবর রাজশাহীতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।