সাধনা মানুষকে নিয়ে যেতে পারে অনেক দূরে। জন্ম-মৃত্যুর আড়ালে যেমন প্রতিনিয়ত ঢাকা পরে মানুষের অস্তিত্ব, তেমনি কিছু একনিষ্ঠতা, কিছু সাধনা, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর তীব্র স্পৃহা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে তার মৃত্যুর পরেও। তেমনই এক সাধকের নাম, শিল্পপ্রেমিকের নাম জয়নুল আবেদিন।
জয়নুল আবেদিনের জন্ম ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহুকুমার কেন্দুয়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ সাব-ইন্সপেক্টর আর মা জয়নাবুন্নেছা ছিলেন সাধারণ গৃহিনী। তৎকালীন আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই জয়নুল আবেদিনের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় মায়ের কাছে।
স্কুলের নিয়মিত উপস্থিতি আর পরীক্ষার ফলাফলই যদি ভালো ছাত্র হবার মাপকাঠি হয়, তবে জয়নুল আবেদিন খুব ভালো ছাত্র ছিলেন না। স্কুলে যাওয়ার চেয়ে তার বেশি আগ্রহ ছিল আপন মনে ছবি আঁকাতে। স্কুলের সময় পেড়িয়ে যেত, আর জয়নুল তাঁর ঘরের বারান্দায় বসে আপন মনে এঁকে চলতেন ফুল, গাছ, পাখি, মানুষ, পশুপাখিসহ দৈনন্দিন পরিবেশের বিস্তর উপাদান। শৈশব থেকেই শিল্পের প্রতি ছিলো তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা। কিশোর জয়নুল একবার স্কুল পালিয়ে বন্ধুদের সাথে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতা শহরে, শুধুমাত্র ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস’র আয়োজন দেখার জন্য।
জয়নুল ভাবতেন, বন্ধুদের সাথে বলতেন, শুধুমাত্র স্কুল-কলেজ পাশ না করলেও বড় মানুষ হওয়া যায়। শিল্পের প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ অচিরেই তাঁকে টেনে আনে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার বলয় থেকে। মেট্রিক পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি তাঁর। পরিবারের সবার অমত সত্ত্বেও শুধুমাত্র নিজের শিল্পপ্রেমে আর মায়ের সহায়তায় চলে যান কলকাতায়। সেখানে ভর্তি হন আর্ট কলেজে।
জয়নুল আবেদিন ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতার আর্ট স্কুলে পড়ালেখা করেন এবং গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কলকাতার কলেজে পড়ার অর্থ যোগান দিতে জয়নুলের মায়ের সেদিন গলার হার পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছিল। তিনি সবসময় তাঁর ছেলের পাশে থেকেছেন।
জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম ছিল গণমুখী। মানুষের দৈনন্দিন জীবন, জীবনের লড়াই, প্রতি পদে বাধা, সেই বাধা উপেক্ষা করে আবার জীবনের জন্য ছুটে চলা ইত্যাদি ছিল তাঁর শিল্পকর্মের এক বিরাট অংশ জুড়ে। জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্মে স্থান পেয়েছে মানুষের শ্রম, শ্রমের বিনিময়ে গড়ে ওঠা সভ্যতার চিত্র। স্থান পেয়েছে মানব জীবনের উত্থান এবং পতনের গল্প।
খাদ্যাভাবে মানুষের মৃত্যু নিসর্গপ্রেমী এই শিল্পীর মনকে নাড়া দিয়েছিল বিপুলভাবে। যার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ পাওয়া দুর্ভিক্ষ চিত্রকর্মটিতে। তাছাড়া মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট, দারিদ্র্য উঠে এসেছে তাঁর শিল্পকর্মে। তিনি এঁকেছেন মুক্তিযুদ্ধের ছবি, অস্ত্রহাতে পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বিপ্লবী যোদ্ধার ছবি। একইভাবে লক্ষ-কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে চলার ছবিও জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর তুলিতে। তাঁর এ চিত্রকর্মটি ‘১৯৭১-এ বীর মুক্তিযোদ্ধা’ নামে প্রকাশিত। ‘নবান্ন’, ১৯৭৪-এ আঁকা ‘মনপুরা-৭০’, ১৯৫৭-এ ‘নৌকা’, ১৯৫৯-এ ‘সংগ্রাম’ তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্ম।
আমৃত্যু শিল্প সাধনায় নিমগ্ন এই শিল্পী শিল্পের বিকাশের জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার জনসন রোডে একটি কক্ষে ১৮ জন ছাত্র নিয়ে আর্ট কলেজ গড়ে ওঠে। যা পরবর্তীতে সেগুনবাগিচা এবং তারপরে শাহবাগে স্থানান্তরিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত একটি সরকারি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। জয়নুল আবেদিনের অনুপ্রেরণাতেই ১৯৭৫ সালে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প জাদুঘর ও ময়মনসিংহে জয়নুল সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠিত হয়।
শিল্পের জন্য শিল্প নয় বরং মানুষের জন্যই শিল্প – এমনই ছিল তাঁর শিল্প সংক্রান্ত দর্শন। যার ফলে তাঁর শিল্পে জীবনবোধ, জীবন সংগ্রামের ছবি ভেসে উঠেছে স্পষ্ট হয়ে। জয়নুল আবেদিনের শিল্প আপাদমস্তক মানুষের কথা বলে।
নিবিড় মনোযোগ, একান্ত সাধনা, একনিষ্ঠতা যে মানুষকে সাফল্যের সোপানে নিয়ে যায় – তার উদাহরণ জয়নুল আবেদিন। শিল্পী, তাঁর শিল্পকর্ম যে সমষ্টির কাছে, সমাজের কাছে দায়বদ্ধ – তারও যথার্থ এক উদাহরণ জয়নুল আবেদিন।
তিনি ১৯৭৬ সালের ২৮ মে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তিনি এখনো বেঁচে আছেন তার শিল্পে, বেঁচে আছেন শিল্পসাধনার উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে।