সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট যে আন্দোলন করছে বাস্তবে তা সর্বজনীন, সেক্যুলার, একই পদ্ধতির, গণতান্ত্রিক শিক্ষার আন্দোলন। পাকিস্তান আমল থেকেই আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে বারবার দাবিগুলো তুলেছে। কখনো শাসক দলকে সাময়িকভাবে হলেও খানিকটা পিছু হটাতে পেরেছে, কিন্তু চূড়ান্তভাবে শাসকশ্রেণীর যে পরিকল্পনা, তাদের যে শ্রেণী উদ্দেশ্য সেখান থেকে তাদেরকে কখনো বিচ্যূত করা যায়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে এক অদ্ভুত অবস্থা দেশে শুরু হয়েছে। আমাদের দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ গ্রামে থাকে। তাদের জীবিকা নির্বাহের উপায় কৃষি । বছরে ৮ মাস গ্রামে কোনো কাজ থাকে না, তারপর তারা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, কোথায় কিভাবে শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা যায়। যে মজুরি পায় তা দিয়ে সত্যিকার অর্থে দুই মুঠো ভাত, একটু সবজি জোগাড় করাও কঠিন হয়ে পড়ে। সম্প্রতি জাতিসংঘের এক গবেষণা রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশের সাড়ে ৬ কোটি মানুষ প্রতিদিন পেট পুরে ভাত খেতে পারে না। সেই মানুষের ছেলে মেয়েরা কিন্ডার গার্ডেন স্কুলের বিভিন্ন ক্লাসে হাজার হাজার টাকা দিয়ে পড়বে কি করে? তার বাইরে গ্রামের মানুষদের আরও একটি অংশ যারা মধ্যবিত্ত বলে পরিচিত তাদের অবস্থা কি আপনারা সবাই জানেন। মধ্যবিত্তরা প্রতি বছর ধান, পাট, সবজি যা-ই আবাদ করছে, তাদের আবাদ করবার যে খরচ তার পরিমাণ আর ভরা মৌসুমে তারা যখন ফসল বিক্রি করে দুটোর মধ্যে এত পার্থক্য যে, তারা যে পুঁজিটা কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে সেই টাকাটাও তাদের ফিরে আসে না। কয়েক লক্ষ নি¤œবিত্ত চাষী জমি হারা হচ্ছে। সেই সাথে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে মহাজনী ঋণের ফাঁদ। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে এনজিওদের একটা মস্ত জাল ছড়িয়ে আছে। প্রায় দশ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে এই মহাজনী ঋণ অথবা এনজিও ঋণের ভিকটিম। এই মানুষদের ছেলেমেয়েদের পক্ষে কোনোমতেই বেশি পয়সা খরচ করে লেখাপড়া করা সম্ভব না। এই হিসাবগুলো শাসকরাও জানে। তাহলে তারা শিক্ষার খরচ প্রতি মুহূর্তে বাড়াচ্ছে কেন? আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত-নি¤œ মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র মানুষের ছেলে-মেয়েরা যাতে উচ্চশিক্ষার দ্বারে আসতে না পারে। উচ্চশিক্ষিত মানুষদের জন্য গত পয়তাল্লিশ বছরে বাংলাদেশের শাসকরা চাকুরির ব্যবস্থা করতে পারেনি। সরকারি হিসাব মতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে বাইশ লক্ষ ছেলে মেয়ে চাকুরির বাজারে আসে কিন্তু মাত্র আট থেকে দশ লক্ষ লোক চাকরি পায়। এই বেকার মানুষরা শাসকদের জন্য বিপজ্জনক। সেই জন্য চালানো হচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। ড্রাগের ব্যাপক চালান গোটা দেশ জুড়ে। আশিটি পর্নো ওয়েবসাইট চালু আছে। এর বিরুদ্ধে আমরা ধারাবাহিক আন্দোলন করছি। কিন্তু আন্দোলনে শাসকরা কর্ণপাত করছে না। কারণ কি? কারণ হচ্ছে শাসকরা জানে মানুষের কাজের প্রয়োজনকে তারা মেটাতে পারবে না। আর কাজ নেই মানে তার ক্ষুধা মেটানোর আয়োজনও নেই, ক্ষুধা মেটানোর আয়োজন নেই মানে সে বিদ্রোহ করবে, বিক্ষোভ করবে, বিপ্লব করবে। তাই শাসকরা মানুষকে অধঃপতিত করে, তাদেরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এই দুর্নীতিগ্রস্ত পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখতে চায়।
আমি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কর্মী-সমর্থক-বন্ধুদের বলবো যে, এই রাষ্ট্র শ্রেণী বিভক্ত রাষ্ট্র, ধনী-গরীবে বিভক্ত রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রে মানুষে মানুষে সম্পর্ক হচ্ছে শ্রম এবং পুঁজির সম্পর্ক, মালিক-মজুরের সম্পর্ক। এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে যারা শ্রম দিয়ে জীবন যাপন করে তারা হচ্ছে বিশাল জনগোষ্ঠী। তারা ক্ষুধায়-দারিদ্র্যে প্রতি মুহূর্তে জর্জরিত হচ্ছে। সেই মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আপনাদের শিক্ষার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমি বিশ্বাস করি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ সেই কাজটি যথার্থ গুরুত্ব দিয়ে করবেন। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।