Monday, December 23, 2024
Homeসাম্যবাদশ্রম আইনের সংশোধন শ্রমিক নয়, মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করবে

শ্রম আইনের সংশোধন শ্রমিক নয়, মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করবে

তাজরীন ফ্যাশনে আগুনে পুড়ে কয়েক’শ শ্রমিকের করুণ মৃত্যুর ঠিক পাঁচ মাসের মধ্যে ঘটলো স্মরণকালের সবচেয়ে বড় শ্রমিক গণহত্যা। ফাটল ধরা সাভারের রানা প্লাজায় ১১৪১ জন শ্রমিকের মৃত্যু আর আড়াই হাজার শ্রমিক আহত হওয়ার ঘটনায় পুরো বিশ্ববাসী সত্মম্ভিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের তৈরি পোষাক কর্মীরা বিশ্বের সবচেয়ে কম মজুরি পায়, চরম নিরাপত্তাহীনতায় কাজ করে – এমন খবরে বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো সোচ্চার হয়ে ওঠে। দাবি ওঠে শ্রমদাসত্বের লজ্জা ও গ্লানি থেকে বের হয়ে আসার, শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।
এমনই পরিসি’তির মধ্যে সরকার বাংলাদেশ শ্রম আইন (২০০৬)-এর সংশোধন করেছে। ফলে ৪০ লাখ তৈরি পোষাক কর্মীসহ সকলেই প্রত্যাশা করেছিল সংশোধিত শ্রম আইনে কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হবে, যেসব মালিক এসব পরিপালন ঠিকভাবে করবে না তাদের বিরুদ্ধে শাসিত্মমূলক ব্যবস’া নেয়া হবে এবং সর্বোপরী শ্রমিকদের পরিবার পরিজন নিয়ে সুস’ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করার কথা বলা হবে। কিন’ মজুরি ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ তো দূরে থাক, প্রচলিত আইনে কাগজে-কলমে শ্রমিকরা যতটুকু অধিকার পেত, তাও কেড়ে নেয়ার ব্যবস’া করা হয়েছে। কথায় কথায় চাকুরিচ্যুত করার পাশাপাশি শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মালিকদের স্বার্থ রক্ষার চরম বৈষম্যমূলক প্রসত্মাব করা হয়েছে শ্রম আইনের সংশোধনীতে। সবার দাবি পায়ে দলে একদিকে মালিকদের সব রকম ছাড় দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে শ্রমিকের অধিকার। সংশোধিত শ্রম আইনটি পাশ হলে শ্রমিকদের স্বার্থ পুরোপুরি নির্ভর করবে মালিকদের চাওয়া-পাওয়ার উপরে। অথচ ‘শ্রম আইন’ প্রণয়নের উদ্দেশ্যই হল শ্রমিকদের সুরক্ষা দেয়া।
২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইনের এই অগণতান্ত্রিক সংশোধনী গত ২২ এপ্রিল অনুমোদন করেছে মন্ত্রীসভা। যা ইতিমধ্যে জাতীয় সংসদে উপস’াপন করা হয়েছে। এখানে শ্রম আইনের সংশোধনীর কয়েকটি ধারা তুলে ধরা হল।
মালিক তোষণের এই সংশোধিত শ্রম আইনের ২(৪৫) ধারায় মজুরি সংজ্ঞা থেকেও বাড়ি ভাড়া বাদ দেয়া হয়েছে। এতে শ্রমিকরা ছুটিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাড়ি ভাড়ার বাবদ যে আর্থিক সুবিধা পেতো, তা আর পাবেন না নতুন আইনে। এমনকী নতুন ন্যূনতম মজুরি প্রণয়ণের ক্ষেত্রেও বাড়ি ভাড়ার বিবেচনা নাও নিতে পারে মজুরী বোর্ড। এতে শ্রমিকদের হারাবে তার বাড়ি ভাড়া বাবদ ন্যায্য মজুরি। অথচ শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী সরকারি বেসরকারি সকল চাকুরির ক্ষেত্রে বেতনের সঙ্গে বাড়ি ভাড়া যুক্ত আছে।
এমন অগণতান্ত্রিক ও অন্যায় প্রসত্মাবের মতোই শ্রম আইনের ২৩(৩) ও ৪(ছ) ধারায় বলা হয়েছে, “প্রতিষ্ঠানের উশৃংখল বা দাঙ্গা হাঙ্গামামূলক আচরণ; অগ্নি সংযোগ, ভাংচুর, অন্যের কাজে বাধা প্রদান অথবা শৃংখলা হানিকর কোন কর্মজনিত অসদাচরণের কারণে শ্রমিক বরখাসত্ম হইলে কোন ক্ষতিপুরন পাইবে না।” আইনের এই সুযোগ নিয়ে যে কোন শ্রমিককে যে কোন সময় শৃংখলা ভংগের অভিযোগে চাকুররি চ্যুত করতে পারে মালিক পক্ষ। এমনকী উচ্চস্বরে কথা বলাসহ যে কাউকে অসদাচরনের দায়ে অভিযুক্ত করা সম্ভব। ফলে আইনের এই ধারাকে ব্যবহার করে চাকুরিচ্যুত করার অবাধ সুযোগ দেয়া হয়েছে মালিকদের। এভাবে কাউকে চাকুরিচ্যুত করলে একটি টাকাও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। এমনকী বহুবছর ধরে চাকুরি করলেও প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটিসহ কোনো আর্থিক সুবিধা পাবেন না সংশ্লিষ্ট শ্রমিক।
গামের্ন্টস কারখানাগুলোতে বেতন ভাতা বাড়ানোসহ কোন দাবিতে বিক্ষোভ করলেও তাকে অসাদচরনের অভিযোগে চাকুরিচ্যুত করার সুযোগ পাবেন গামেন্টর্স মালিকরা। ফলে কর্মক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকারতো দূরে থাক, মিছিল মিটিং করলেও শূন্যহাতে ফিরে যাওয়ার আশংকায় থাকতে হবে শ্রমিকদের।
সংশোধিত আইনের ২৭ এর(৩) খ ধারায় বলা হয়েছে, বিনা অনুমতিতে ১০ দিনের বেশি কর্মস’লে অনুপসি’ত থাকলে চিঠি দিয়ে চাকুরীচ্যুত করা হবে। এখানেও আগের মতো শ্রমিকদের কোনো আর্থিক সুবিধা দেয়া হবে না। এখন যদি কোনো শ্রমিক যদি ৮/৯ দিন পর কারখানায় যোগ দিতে আসে আর মালিক পক্ষের লোকজন যদি তাকে ঢুকতে না দেয় তাহলে ঐ শ্রমিকের কিছুই করার থাকবে না। তা সে যতদিনই কাজ করুক না কেন ঐ কারখানায়। ফলে বিনা বেতনে কাউকে বরখাসত্ম করার ক্ষেত্রেও এই অস্ত্রের প্রয়োগ হবে তা বলাই বাহুল্য।
১৯৬৮ সাল থেকে দেশের সকল কারখানার মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকদের কল্যাণে খরচের বিধান রয়েছে। কিন’ সংশোধিত শ্রম আইনে ২৩২(৩) এবং ২৩৩ ধারায় তৈরি পোষাক খাতকে বাদ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তৈরি পোষাক কারখানার মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকদের জন্য খরচ করতে হবে না! বাকী সব কারখানার জন্য তা বহাল থাকবে। রাষ্ট্র কতটা অগণতান্ত্রিক হলে এমন বৈষম্যমূলক আইন করতে পারে! কোমপানির মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকদের কল্যাণে খরচ থেকে এখাতকে ছাড় দেয়ায় শ্রমিকদের পিঠে নতুন করে ছুরি বসানো হয়েছে। আইন করে ছাড় দেয়ায় পোয়া বারো গামের্ন্টস ব্যবসায়ীদের। বিশ্ব দরবারের যখন তৈরি পোষাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোসহ শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার আওয়াজ উঠেছে; তখন সরকার বৈষম্যমূলকভাবে এক দেশে দুই আইন প্রণয়ন করে মালিকদের মুনাফা লুণ্ঠনকে পাকাপোক্ত করছে, খর্ব করছে শ্রমিক স্বার্থ।
৩৬ ধারায় গামের্ন্ট শ্রমিকদের বয়স সম্পর্কে সনদ হিসেবে জন্ম সনদপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এক্ষেত্রে জন্ম সনদ যোগাড়ে শ্রমিকদের গুণতে হবে শত শত টাকা। সঙ্গে স’ানীয় প্রশাসনের হয়রানি তো আছেই। তৈরি পোষাক কারখানায় শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় বেশিরভাগ শ্রমিকই ভোটার। তাই জাতীয় ভোটার পরিচয়পত্রের মাধ্যমেই বয়স প্রমাণ করা যথেষ্ট। কিন’ সংশোধিত আইনে শ্রমিকদের অধিকার বাড়ানোর আয়োজন না থাকলেও শ্রমিকদের ঘাড়ে বাড়তি ঝামেলা চাপানো হয়েছে।
২০৫ ধারায় পার্টিসিপেটরী কমিটি গঠনে শ্রমিকদের যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। কিন’ ট্রেডইউনিয়ন না থাকায় শ্রমিক প্রতিনিধি কে নির্ধারণ করবে? নিশ্চিতভাবেই মালিকদের অনুগতদের এই পার্টিসিপেটরি কমিটিতে অনত্মর্ভুক্ত করবেন মালিকরা।
আগের আইনে ১০০-র বেশি শ্রমিক থাকলে গ্রুপ বীমা করার কথা বলা উল্লেখ ছিল। অথচ এবারের সংশোধনে ২০০ শ্রমিক থাকলে গ্রুপ বীমা করার কথা বলা হয়েছে। তার মানে ২শ’ শ্রমিকের কম থাকলেও সেসব কারখানাগুলোকে গ্রুপবীমা থেকে ছাড় দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হলো। এমন আরও কিছু বির্তকিত সংশোধনী আনা হয়েছে শ্রম আইনে। যেগুলো বাসত্মবায়ন করা হলে শ্রমিকদের ঘাড়ে চেপে বসবে মালিকরা। এই আইনের মাধ্যমে আরো বেশি বৈধতা দেয়া হবে মালিকদের শোষণ-নিপীড়নসহ অন্যায় অত্যাচার। চরমভাবে লঙ্ঘিত হবে শ্রমিকদের অধিকার।
তৈরি পোষাক শিল্পের ৪০ লাখ শ্রমিকের ৮০ ভাগই নারী শ্রমিক। যাদের নিয়ে প্রতিমূহুর্তে গর্ব অনুভব করেন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই। অথচ সংশোধিত শ্রম আইনে মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাসের করার কথা থাকলেও তা করা হয় নি। সরকারিভাবে মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস করা হয়েছে। কিন’ যাদের রক্ত-শ্রম আর ঘামে প্রতিবছর প্রায় ১৮/২০ বিলিয়ন ডলার দেশে আনছে, সেই তৈরি পোষাকের নারী শ্রমিকরা পাবেন মাত্র এক/দু’মাস। এরচেয়ে বড় শঠতা আর কী হতে পারে?
মালিক পক্ষের অনুমোদন নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করার যে সুযোগ রাখা হয়েছে তা আদৌও কতটা কাজে লাগবে তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। কারণ কোন মালিকই চাইবে না তার কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন কার্যকর থাকুক। তাই কাগজেপত্রে এমন ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ রাখা আসলে আলংকারিক ছাড়া আর কিছু নয়। বরং তা প্রতারণা মাত্র।
শ্রমিকদের মামলা পরিচালনায় আগের মতো আইনজীবিদের পাশাপাশি ক্ষমতা প্রাপ্ত প্রতিনিধিদের রাখার সুযোগও খর্ব করা হয়েছে শ্রম আইনের সংশোধনীতে। এতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে শ্রমিক নেতাদের মামলা মোকাদ্দমা পরিচালনার সুযোগ থাকলো না। ফলে কম বেতনের এসব শ্রমজীবিরা আরও বেশি ক্ষতিগ্র হবেন।
সব মিলিয়ে শ্রম আইনের সংশোধনীর মাধ্যমে বঞ্চিত শ্রমিকদের আরও বেশিমাত্রায় বঞ্চিত করার আয়োজন আরও পাকাপোক্ত করা হবে। চলতি সংসদ অধিবেশনে আইনটি পাশের আগে অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক এসব ধারা বাতিল করে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা এখন সময়ের দাবি।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments